ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ২৪+২৫

0
443

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|চব্বিশ তম পর্ব +পঁচিশ তম পর্ব |

মাথার উপর সূর্য মনে হচ্ছে নাছোড়বান্দার মতো স্থির হয়ে আছে। যাবির ভাইয়া অফিস থেকে এক দিনের ছুটি নিয়েছেন। আজ এমনিতেও বন্ধ ছিল। বাবা, বড়ো মাকে দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। ভর দুপুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। এখন বাজে বেলা এগারোটা। যাবির ভাইয়া আমাকে রেখে আবারো গিয়েছেন বাজারে। কি যেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসবেন বলে। যাওয়ার আগে আমাকে বলেছে, একটা ব্যাগে দুই সেট জামা এবং দুইটা পাঞ্জাবি ভরতে। প্রায় বিশ মিনিট পর যাবির ভাইয়া আসেন। হাতে কিছু ফল মিষ্টি এবং একটা ব্যাগে কি কি যেনো নিয়ে আসেন।
–” তুমি তৈরি তো, বউ?”

কোমল স্বর কর্ণধারে আসতেই সম্মুখে ফিরে তাকালাম। এতক্ষণ আমি এতটাই আনন্দিত ছিলাম যে উনার উপস্থিতিও টের পাইনি।
উনার কথার প্রত্যুওরে বললাম, –” হ্যাঁ আমি তৈরি। কখন যাবো। চলুন এখনই যাই।”

–” এই নাও বোরকা। এটা পরিধান করে নাও। আমি চাইনা, আমার জন্য তোমার সম্মানে একটা আচর পর্যন্ত লাগুক। সেখানে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে আমাদের অজানা।”

উনার কথা মতো তাই করলাম। বোরকা পরে মুখ বেঁধে তৈরি হয়ে নিলাম। উনি কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললেন, –” যদি তোমাকে বলা হয়, স্বামী এবং পরিবার এই দুইটার মধ্যে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে। তাহলে তুমি কাকে বেছে নিবে?”

হাসিমাখা মুখখানা চুপসে গেল। আমি তো এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। আমি তো উভয়দেরই খুব ভালোবাসি। যাবির ভাইয়াকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা অসম্ভব আর পরিবারকে ছাড়া আমি অসুখী।

অসহায় দৃষ্টিতে উনার পানে তাকালাম। উনি মলিন হেসে বলল আমার হাত ধরে বললেন, –” চলো, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আমাদের ভাড়া বাসাটা একটু গ্রামের দিকে পড়েছে। এখানে এখানে ফল, সবজির সাথে আখ চাষ হয়। আখের বাগান করা হয় এবং সে বাগানে পাশেই আখের রস দিয়ে রশি বানানো হয়। যাবির ভাইয়া আমার হাত ধরে আকস্মাত বললেন, –” তুমি তো চলে যাবে, চলো তোমাকে একটা মজার খাবার খাওয়াই।”
–” এভাবে বলছেন কেনো? আমি আপনার পাশেই সর্বদা থাকব।”
–” চলো।”

উনার সাথে থাকা প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা ঘন্টা আমার জন্য স্পেশাল। আমি খুব করে উপভোগ করি। আমার মুখে হাসি ফুটাতে উনি সদা সক্ষম হয়। অন্তরে কোনো দুঃখ আসতে দেন না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। রিক্সাওয়ালা মামার ভাড়া পরিশোধ করে রিক্সা থেকে নেমে গেলাম।

রাস্তার দুই পাশে আখের চাষ করা হয়েছে। আখকে অনেকেই গেন্ডারি বলে থাকে। আমরা মূলত আখ বলি। আখের চাষ এবার মনে হয় খুব ভালো হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, যে বাড়ি থেকে খুব মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম আখের রস জ্বা’ল দেওয়া হচ্ছে এবং সেটা দিয়ে রসি বানানো হবে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকে হাসলেন। আমাকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে পাশের কাঁঠাল গাছ থেকে দুইটা কাঁঠাল পাতা পেড়ে নিলেন। পাঞ্জাবির মধ্যে কাঁঠালের পাতা ঘষে পরিষ্কার করে নিলেন। উনার কাণ্ডে আমি মুখে হাত দিয়ে রেখেছি। আস্ত একটা খচ্চর আমার স্বামী।
এভাবে পাতার ময়লা মানুষ নিজের পাঞ্জাবিতে মুছে নেয়? একটা খচ্চর যাবির ভাইয়া, খচ্চর আমার স্বামী। খচ্চর আমার মানুষটা। আমি নাক উঁচু করে রেখেছি। উনি মাথা হেলিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললেন, –” আদরের মেয়েদের নিয়ে এই একটাই সমস্যা। আদরে আদরে তারা একদম ঘরের কোনায় চেপে থাকে। প্রকৃতির উপভোগ করতে জানে না। এই যে আমি যে কাজটা করলাম এভাবে নাক উঁচু করে রেখেছো কেনো? তুমি জানো! পাতা দিয়ে আখের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”

কাঁঠাল পাতা প্রথমে মাঝ বরাবর এক ভাঁজ করলেন। তারপর উপরে ঠিক মাঝ বরাবর থেকে আড়াআড়ি ভাবে আবারও দুটি ভাঁজ করে নিলেন এরপর নিচের অংশ একটু ছিড়ে কিছুটা গুটিয়ে নিলেন। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি কিন্তু শেষে যখন আমার সামনে পাতাটা ধরলেন তখন সেটা মনে হল আস্ত একটা পাত্র। যেটাতে পানি পান করা যাবে। এভাবে পাতা দিয়ে দুইটা পাত্র বানিয়ে নিলেন।
আখ ক্ষেতের এক পাশে আমাদের ব্যাগগুলো রেখে আমার হাত ধরে এগিয়ে গেলেন সে বাড়ির দিকে।

দুজন লোক দাঁড়িয়ে লম্বা একটি হাতলের সাহায্যে রসি নাড়াচাড়া করছিলেন আর দুইজন লোক দুই পাশে নিচে বসে সে পাত্রের নিচে লাকড়ি দিচ্ছিলেন আর আখের শুকনো খড়কুটা দিচ্ছিলেন। আ’গু’ন জ্বা’লা’নো’র জন্য। উনাদের পিছনে আরেকটি রসির পাত্র নামিয়ে রেখেছেন ঠান্ডা হওয়ার জন্য। এরপর হয়তো সেটা সংরক্ষণ করবেন তার সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। আমরা নিচে নামানোর যে পাত্রটা ছিল সেখানে এগিয়ে গেলাম। যাবির ভাইয়া প্রথমে উনার হাতে থাকা পাতাটা ডুবিয়ে দিলেন রসির পাত্রের মধ্যে এরপর আমি উনার দেখাদেখি তাই করলাম।

পাতা ভর্তি রসি আর আমার মুখে মিষ্টি হাসি। উনি একমনে আমার সে হাসি দেখছেন হঠাৎ উনি সিনেমার মত কান্ড করেলেন। দিন দুপুরে আমার কপালে অধর ছুঁয়ে দিলেন। মুহূর্তে আমার হাসি উবে গেল। উনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের দুজনের বৃষ্টি মিলিত হয় আমরা যেন অজানায় চলে গেছি।
ইতিমধ্যে একজন লোকের কথা আমাদের কর্ণধারে পৌঁছায়। লোকটি লাঠি হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছেন আমাদের দিকে। জোরে হাঁক ছাড়ছেন, ‘চোর, চোর’ বলে। জাবের ভাইয়া জিহ্বা কে’টে আমার হাত ধরলেন শক্ত করে। এরপর দৌঁড় দিয়ে বের হয়ে গেলেন সে বাড়ি থেকে। আমরা আখের ক্ষেতের পাশে চলে আসলাম যেখানে ব্যাগ রাখা আছে। সেখানে চুপটি করে বসে রইলাম। লোকটি সামনে চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাবির ভাইয়ার দিকে তাকাতে দেখতে পারলাম উনি হাসছেন মন খুলে। যে হাসিটা দেখে আমি বারবার ঘায়েল হয়ে যাই। হাসি থামিয়ে হাঁটা ধরলেন। দুই পাশে আখের ক্ষেত মাঝখানে আমরা সুখী দম্পতি
———–

আমাদের বাস পেতে অনেক কষ্ট হয়েছে। পূর্বেই বলেছিলাম আমাদের এদিকে মাত্র তিন থেকে চার বার বাস থামে। বাসে উঠতে উঠতে প্রায় তিনটা বেজে যায়। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় তিনটা বাজে বাস পেয়েছি।
বাড়িতে পৌঁছাতে বিকেল পাঁচটা বেজে যায়। বাস থেকে নেমে লম্বা নিঃশ্বাস গ্রহণ করি। আমার মাতৃভূমি, আমার জন্মভূমি, এখানেই আমার বেড়ে উঠা এখানেই রয়েছে আমার শত হাজারো স্মৃতি। আমি আর উনি হেঁটে যাচ্ছি। আর কিছুটা পথ পেরোলেই আমাদের বাড়ির রাস্তা। মাঝপথে শুভ্রপুষ্পের পথ পরে। উনার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, –” সেখানে যাবেন কি?”

–” সময় নিয়ে সেখানে যাবো। অনেক স্মৃতি রয়েছে সেখানে।”

আমি হাসলাম। উনার কথা শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে গেলাম।

–” মায়াবিনী, তোমার হাসিতেই আমি খুশি।”

বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির সামনে আসতেই অন্তর কেঁপে উঠলো। কি অবস্থা কে জানে! আমাদেরকে একসাথে দেখলে তাদের অনুভূতি কেমন হবে? দরজায় করাঘাত করলাম। ভেতর থেকে শুনতে পেলাম মালা মেহেদী পালাক্রমে চিৎকার করে আসছি বলছে। এই কাজটা ওরা সব সময় করতো। দুইজন একসাথে দৌড়ে কে কার আগে দরজা খুলতে পারবে তার প্রতিযোগিতা করতো। দরজা খুলতেই সক্ষম হয় মেহেদী। আমাদের দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। এদিকে মালা মেহেদীকে বকছে, –” দাঁড়িয়ে আছো কেনো? সড়ে দাঁড়াও, কে এসেছে দেখবো।”

মালা এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। আমাদের দেখে বড়ো মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
আমি মালা মেহেদীকে দেখে হাসছি। দুই হাত বাড়িয়ে দেই আমার কাছে আসার জন্য। ওরা দুজন আমার কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মালা কান্না করে বলে, –” কোথায় চলে গিয়েছিলে আপু? তোমাকে অনেক মনে করেছি। বাবা বড়ো মা তো খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিল তোমার জন্য। মা বড়ো মাকে অনেক বকেছে এখন বড়মা আলাদা থাকে। ঐ যে বাড়ির কোণে যে টিনের ঘরটা আছে, সে ঘরে থাকে।
মা তো বড়ো মাকে বাড়িতেও জায়গা দেয় না। বড়ো মা আলাদা রান্না করে খায়।”

বড়ো মার করুন অবস্থা শুনে চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বাড়িতে প্রবেশ করব তখনই কর্ণধারের বাবার স্বর ভেসে আসে। বাবা চিৎকার করে বলে, –” যেখান থেকে এসেছ সেখানেই ফিরে যাও। ভুলেও এই বাড়িতে প্রবেশ করার চিন্তাভাবনা করবে না। এবারের দরজা কোন অপরিচিতদের জন্য নয়। তুমি আমার কাছে আজ থেকে অপরিচিত। আজ থেকে না যেদিন আমাদের ছেড়ে অন্যের হাত ধরে চলে গিয়েছো সেদিন থেকেই তুমি অপরিচিত। আর আসবে না। আমার জীবন চলে যাবে কিন্তু তোমাকে ক্ষমা করব না, কোনদিনও না।”

বাবার চিৎকার শুনে মা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। আমাকে দেখে রক্তিম চোখে তাকিয়ে তেড়ে আসেন
আমার গালে জোরে চড় বসিয়ে দেন। এদিকে যাবির ভাইয়া মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। আমার হাত ধরে উনার পিছনে নিয়ে আসেন। শক্ত স্বরে বলেন, –” আমার স্ত্রী গায়ে হাত উঠাবেন না।এতদিন সে আপনার মেয়ে ছিল। এখন আমার স্ত্রী।”

–” ফিল্মি ডায়লগ দেওয়া বন্ধ করো। আমার মেয়ের বয়স এখন আঠারো হয়নি। তোমাকে ধরে একদম জে’লে পাঠিয়ে দিব।”

উনি চুপসে গেলেন। অসহায় চোখে আমার দিকে তাকালেন। উনার চোখের ভাষা আমি পড়তে পাচ্ছি। যেন অমাকে বলছেন, –” তুমি আমাকে ফেলে চলে যেও না মায়া, আমি একা হয়ে যাব।”

আমি সম্মুখে বাবার দেখে এগিয়ে গেলাম। বাবার পায়ের কাছে বসে নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলাম। বাবা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। হেঁটে চলে গেলেন ঘরে। এদিকে মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, –” বের হয়ে যা এই বাড়ি থেকে। তোদের যেনো আর আমাদের আশপাশে না দেখি। আজ থেকে তুই আমাদের জন্য মৃত। আমার দুইটা ছেলে মেয়ে যাদেরকে আমি নিজের মত বড়ো করব। তোকে তো বড়ো করেছে এক আটখোঁড়া। নিজে যেমন আটখোঁড়া, অভিশপ্ত। তোকেও বানিয়েছে তেমন। দেখিস তুই যেন আবার তোর বড়ো মায়ের মত আটখোঁড়া না হোস।”

একজন মা যে কিনা সন্তানের জন্য নিজের জীবনও বিপদে ঠেলতে পারে। নিজের মা যদি সন্তানকে অভিশাপ দেয় অথবা কটু কথা বলে তাহলে সেটা সন্তানের জন্য লানত হিসেবে কাজ করে। মায়ের কথায় ছল ছল চোখে উনার দিকে তাকালাম। আমি হয়তো সারা জীবন মাকে একটু কম ভালোবেসে ভালোই করেছিলাম। নয়তো আজ দেখতে পারতাম না আপন মা হয়েও নিজের সন্তানের সাথে এমন আচরণ করে। মাও চলে গেলেন বাবার পিছু পিছু। মালা, মেহেদী আমার কাছে এসে কান্না করতে করতে বলল, –” আপু উঠো, কান্না কইরো না। বাবা কষ্ট পেয়েছে। বাবার রাগ কমে গেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ছোট মানুষের কথা অনেক সময় বিশ্বাস করি তো অনেক সময় আমরা হেসে উড়িয়ে দেই। বর্তমানে আমার মালা মেহেদীর কথাও কানে ঢুকছে না। হঠাৎ বড়মার কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেলাম, –” তোকে পেটে না ধরতে পারি কিন্তু তোকে আমি বড়ো করেছি। আদর, ভালোবাসা, শাসন সবকিছু করেছি। কিন্তু তুই আমাকে বিনিময়ে কি দিলি, মা? শেষ বয়সে এমন একটা কষ্ট দিলি? তোর বাবা তোর মাকে বিয়ে করার পর আমি যতটুকু না কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বড়ো কষ্ট পেয়েছি তুই যেদিন আমার বিশ্বাস ভেঙে অন্যের হাত ধরে চলে গিয়েছিলি। কেনো এসেছিস মায়া? দেখতে এসেছিস আমি কেমন আছি? এই দেখ, আমি খুব ভাল আছি, সুখে আছি। তোর বাবা আমাকে এত জীবনে যতটুক না সুখ দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি অসুখী করে দিচ্ছেন বর্তমানে।”

বড়ো মা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। চোখের পানি মুছে বড়মার দিকে তাকালাম। উনার চোখের নিচে কালো পড়ে আছে। শরীর স্বাস্থ্য আগে থেকে কমে গেছে। কেমন যেন রোগী রোগী মনে হচ্ছে বড়ো মাকে।

আমি কান্না করে অস্পষ্ট স্বরে “বড়ো মা” বলে ডাক দিলাম। আমার এখন ইচ্ছে করছে বড়ো মাকে জাপটে ধরে কিছুক্ষণ থাকতে। এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বড়ো মা হাত দিয়ে ইশারায় কাছে যেতে না করলেন, বললেন, –“একদম আগাবি না মায়া। আমি তোকে কখনো ক্ষমা করব না। তোর জন্য আজকে আমার এই অবস্থা। ক্ষণিকের সুখ পেয়েও অসুখী হয়ে পড়লাম। চলে যা মায়া, আর কখনো আসবি না।”

বড়ো মা নিজের টিনের ঘরে চলে গেলেন। আমি ধপ করে বসে পড়লাম। যাবির ভাইয়া পিছন থেকে আমাকে ধরে নিজেও বসে পড়লেন। আমার হাত উনার হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন,
–” অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে তাই না! আমাকে ক্ষমা করে দাও, বউ! আমি যেই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম তা আমার কারণে ভঙ্গ হয়ে গেল। আমি প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম তোমার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝড়তে দিব না। কিন্তু দেখো আমার জন্য আজকে তোমার চোখ বেয়ে হাজারো অশ্রু ঝড়ে যাচ্ছে।”

চোখের পানি মুছে নিলাম উনার হাত শক্ত করে ধরে বললাম, –” চলুন আমরা বাসায় যাব।”

———

সন্ধ্যা লগ্নে শুভ্রপুষ্পে বসে আছি। আমরা দুজন একে অপরের হাতে হাত রেখে দূর আকাশে তাকিয়ে রয়েছি। আমার মাথা উনার কাঁধে, উনিও মাথাটা একটু হেলে রেখেছেন আমার মাথার উপর। সূর্য ডুবছে। এই সময়টা মূলত দম্পতিরা ভালোভাবে উপভোগ করে। কিন্তু আমাদের দুজনের মনই বিষন্নতায় ঘেরা। যাবির ভাইয়া হয়তো আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এখানে আসলে এমন কিছুরই সম্মুখীন হতে হবে কিন্তু আমার অবুঝ মন সেটা মানে নি। আমি ভেবেছিলাম আদরের দুলালীকে তারা কখনো উপেক্ষা করতে পারবে না। অবশ্যই গ্রহণ করে নিবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল।
আমি নিঃশব্দে কান্না করছি। কিছুক্ষণ পর আমার মাথায় উনার হাতের স্পর্শ পাই। উনি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গালে হাত রেখে বললেন, –” আগামীকালের সূর্য উদিত হওয়া থেকে শুরু হবে আমাদের নতুন জীবনের নতুন পথচলা। কথা দিচ্ছি তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে দেব না। সব সময় আগলে রাখবো।”

ছলছল চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি জানি উনি খুব ভালো মানুষ। আমাকে সুখে রাখবেন, কষ্ট পেতে দিবেন না কিন্তু মনের কোণে একটা কষ্ট রয়ে গেল। এই জীবনে আমার জন্য বড়ো মাকে কষ্ট পেতে হলো।
————-

সময় থেমে থাকে না। নদীর স্রোতের মতো সময় ও তাড়াতাড়ি বয়ে যায়। আজকাল আমার সময় খুব ব্যস্ততায় কা’ট’ছে এই তো কিছুদিন আগে এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করলাম। উনি আমার সকল কিছু পাশের স্কুলে ট্রান্সফার করে নিয়ে আসেন। পরীক্ষা মোটামুটি ভালই দিয়েছি। যেহেতু মাস্টারের সাথে বিয়ে হয়েছে পড়তে বসতে না চাইলেও জোর করে পড়িয়েছেন। উনার অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আপনারা ভাবছেন কলেজে ভর্তি হলে আবার কিসের প্রস্তুতি নিতে হয় আগেই বলেছিলাম আমি পড়াশোনায় খুবই কাঁচা। পড়াশোনা না করতে করতে যদি আবার মাথায় জং ধরে যায় এজন্য উনি আমাকে প্রতিদিনই পড়ায়। পড়ার ফাঁকে আমাদের দুষ্টু মিষ্টি আলাপচারিতা হয়।

রান্নার বিষয়ে প্রায় অনেক কিছুই শিখেছি। যেমন: ডিম ভাজা, ভাত রান্না করা, আলু ভর্তা করা, ডাল রান্না করা; এগুলো সব উনার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শিখেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে উনি এই কয়েকটা খাবার ছাড়া আর কিছুই রান্না করতে পারেন না। আমিও কিছুই রান্না করতে পারি না বিধায় এগুলোই খেতে হয়।

এইতো কিছুদিন আগের কথা, আমার তখন বাংলা পরীক্ষা চলছিল। বাংলা মানেই আমার কাছে সহজ বিষয়। ঘরে বসে পড়ছিলাম, এমন সময় উনি বাজার করে নিয়ে আসেন। অভ্যাস মোতাবেক পাঞ্জাবি হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেন।
–” পড়ছো বউ! আচ্ছা পড়ো, পড়ো। আলু ভর্তা ডাল খেতে খেতে আমি মোটা টমেটো হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি আজকে নতুন স্পেশাল কিছু রান্না করব।”

খাবারের ক্ষেত্রে আমি খুব এগিয়ে। বিশেষ করে এই কয়েকমাসে না খেয়ে খাবারের প্রতি লোভ জেগে গেছে। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা যখন অনেক দিন ইচ্ছামত খাবার খেতে পারি না তখন কিছু খাবার পেয়ে গেলে গাপুস গুপুস করে খেয়ে ফেলি। আমার অবস্থাও তেমন। নতুন রেসিপির কথা শুনে খুশি হয়ে গেলাম। বই বন্ধ করে উনার কাছে দাঁড়িয়ে বললাম, –” কি রান্না করবেন, শুনি?”

–” শুঁটকি রান্না করব।”

শুঁটকি আমার খুবই প্রিয়। শুনে খুশি হয়ে গেলাম। বড়ো মার হাতের শুঁটকি ভুনাটা সেই লাগতো। আঙুল চেটেপুটে খেয়ে ফেলতাম। আজ অনেকদিন পর সেই স্বাদ গ্রহণ করব, ভাবতে আনন্দ লাগছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে উনার কাছে আবদার করে বসলাম,

–” আগামীকাল তো বাংলা পরীক্ষা। আমি আপনার পাশে দাঁড়িয়ে রান্নাটা দেখব তারপর আমি শিখে নিব। এরপর মজার মজার রান্না করে আপনাকে খাওয়াব। প্লিজ প্লিজ না করবেন না।”

আমার বাচ্চামো অবস্থা দেখে উনি হেসে উঠলেন। আমার কপালে শক্ত করে চুমু খেয়ে বললেন, –” আচ্ছা ঠিক আছে চল।”

উনি বাজার করে নিয়ে এসেছেন। বাঁধাকপি, ফুলকপি, শুঁটকি আর কিছু শাক। আমি ভাবছি উনি শুঁটকি কী দিয়ে রান্না করবেন? রান্না বান্না না পারলেও কা’টা’কু’টি তো করতে পারি। আমি অনেকগুলো পেঁয়াজ এবং রসুন কে’টে ফেললাম। উনি ততক্ষণে পাঞ্জাবি ছেড়ে একটি টি শার্ট পড়ে নিলেন। আমার কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, –” কি বউ সব রেডি তো?

–” রেডি, আপনি শুধু এখন রান্না করবেন।”

উনি পাত্রের মধ্যে শুধু পেঁয়াজ আর রসুন কুঁচি দেখে প্রশ্ন করলেন, –” শুধু পেঁয়াজ রসুন কে’ টে’ছো যে, আর কিছু কা’টো’নি?”

–” আর কি কা’ট’বো?”
–” আরে আমি যে বাঁধাকপি আর ফুলকপি নিয়ে আসলাম!”

ওনার কথা শুনে মাথা চুলকাচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে উনি হেসে বললেন, –” দাও আমি কা’টি।”

আমি শুধু দাঁড়িয়ে উনার কাণ্ডকারখানা দেখছি। ফুলকপি বড় বড় করে কে’টে নিলেন। বাঁধাকপি কোনো রকম কুঁচি কুঁচি করে নিলেন। আমি উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছি। উনার কাজ মাথায় ঢুকিয়ে রাখছি। পরবর্তী স্টেপ কি হবে তার জন্য খুবই এক্সাইটেড হয়ে আছি।

উনি আমাকে বলেন সবজি কিছু ধুয়ে নিয়ে আসতে। আমিও তাই করলাম। কলপাড় থেকে সবজি ধুয়ে নিয়ে এসে দেখি উনি বড় একটা পাতিল নিয়েছেন। এবং সেখানে তেলে পেঁয়াজ রসুন ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর আরেকটা কাজ করলেন, শুঁটকিগুলো কোনরকম ধুয়ে ওই পেঁয়াজ রসুনের মধ্যে ছেড়ে দিলেন। সাথে মশলাতো আছেই।

আমার হাত থেকে সবজিগুলো নিয়ে সেগুলো ছেড়ে দিলেন ওই পাত্রের মধ্যে। আমি চিৎকার দিয়ে দিয়ে বলছি, –” যে এগুলো কি করছেন?”
প্রত্যুত্তরে বলেন, –” আরে শুঁটকি রান্না করব না?”

–” আপনাদের দেশে কিভাবে শুঁটকি খায়?”
আমার কথা উনি চুপসে গেলেন। মাথার চুলকে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন, কীভাবে শুঁটকি খায়?
কিন্তু মনে করতে পারলেন না।

–” তাহলে আপনি রেসিপি জানেন না?”
উনি থমথমে স্বরে বললেন,
–” এত প্রশ্ন কেনো করছো বউ? সবজি হোক, শুঁটকি হোক, সবকিছু মিলে তো পেটের ভিতরই থাকবে। সেগুলো তো আবার হজম হয়ে বেরিয়ে আসবে। তোমার মতো এভাবে ভাবলে তো এই জীবনে আর রান্না করে খেতে পারব না।”

উনার কথা শুনে সেদিন কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, এই জীবনে না জানি আরো কত কুখাদ্য রেসিপি আমার স্বামী রান্না করে আমাকে খাওয়ায়। বিশ্বাস করেন আপনারা, সেদিনের রেসিপি আর গলাধঃকরণ করতে পারিনি। শুঁটকির পঁচা গন্ধে আমার পেটের ভেতর সবকিছু গুলিয়ে আসছিল। আমার অবস্থা থেকে সেদিন উনি ডিম ভাজি করে খাইয়ে দেন।

আমাদের জীবন এভাবেই চলছে। দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি দিয়েই আমাদের জীবন সুন্দর করে তুলছি।

চলবে.. …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here