#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|দশম পর্ব |
সায়াহ্নের শেষ লগ্নে তীব্র কুয়াশায় ঢেকে গেছে পৃথিবী। দোকানপাট বন্ধ করে দোকানিরা বাসায় চলে যাচ্ছে। বাস থেমেছে বন্ধ একটি দোকানের পাশে। পুরো রাস্তায় বাবা এবং বড়ো মাকে একা সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছি।
বেশি বড়ো না হলেও বড়ো বলাই চলে। এমন একটি ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ফটকটি লাল টাইল্স দিয়ে কারুকাজ করা। মসজিদের গম্বুজ আকৃতি উপরে যার মধ্যে খোদাই করে লিখা,’ হাজী লাজীম মুন্সী বাড়ির প্রধান ফটক।”
এই রাতে আত্মীয়ের বাড়ি আসা বিব্রতকর। জানি না উনারা আমাদের দেখলে কী মনে করবেন। মাটির রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি। চাঁদের আলোয় যতটুকু বুঝা যাচ্ছে রাস্তা খুবই উঁচু নীচু। বাবার কোলে ঘুমন্ত মালা। মেহেদীকে জোর করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বড়ো মা এবং আমার হাতে ব্যাগপত্র। বাবা একটা বাড়ির আঙিনায় দাঁড়ালেন। মালাকে বড়ো মার কোলে দিয়ে বাবা দরজায় দুইবার কড়াঘাত করলেন। হ্যারিকেন হাতে একজন লোক দরজা খুললেন, চোখে মোটা চশমা। বাবার মুখের সামনে হ্যারিকেন ধরে আবেগে কান্না করে দিলেন। বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, –” আমগোর রনোক দেহি! কত বছর পর দেখলাম। এতদিনে এই বন্ধুর কথা মনে পড়েছে?”
বাবার নামের ইজ্জত পাঞ্চার করে চশমা পরিহিত আঙ্কেলের বুক কাঁপল না? নামের বিষয়ে আমি খুবই সাবধান! ফট করে বললাম, –” আমার বাবার নাম রৌনক চৌধুরী।”
লোকটি হ্যারিকেন হাতে বাবার পিছনে খেয়াল করলেন। বড়ো মা এবং আমাকে দেখে উনার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করলেন। এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, –” মায়া না! ছুডু বেলায় দেখছিলাম। বড়ো ভাবীও আইছে দেখি। আসেন, ঘরে আসেন।”
বাবার সাথে আজকে এখানে না আসলে বুঝতেই পারতাম না, সমাদর কাকে বলে। রাতেই টাটকা সবজি গাছ থেকে তুলে এনে রান্না করেছেন।
রাতে ঘুমানোর জন্য আমাকে আর মালাকে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বড়ো মা আমাদের সাথে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি অমত করে দেই। মালাকে সাথে নিয়ে ঘুমাতে পারব বলে দেই। আমি খুব করে চাইছি এই ছয় সাতদিনে বাবা এবং বড়ো মায়ের মাঝের অভিমানের দেয়াল ভেঙ্গে যায়। যেনো পরবর্তীতে বড়ো মা বাবাকে দেখে কষ্ট, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।
সকল কিছুর মধ্যেও যাবির ভাইয়ার কথা ভুলিনি। উনাকে খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বিদায় নেওয়ার সময়কার চাহনি। আমাদের এলাকায় মুঠোফোন আসেনি। শুধুমাত্র যাদির টাকা আছে তারা ব্যবহার করে। বাবার একটা ছিল, মা ভেঙে ফেলেছে। আপাতত চিঠি বা মানুষের মাধ্যমে খবরাখবর আদান প্রদান হয়।
আকাশের বুকে বড়ো চাঁদ উঠেছে। বড়ো মায়ের মোটা শাল গায়ে জড়িয়ে ঘরের কাঠের জানালা খুলে দিলাম। ঠান্ডা শীতল বাতাস এসে মুখে বাড়ি খেলো। হাতের আংটির উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, –” খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে, প্রিয়।”
—————–
সকাল বেলা মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে ঘুম ভেঙে দিল। মালা জড়সড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। শীতের মোটা কাঁথা ভালোভাবে মালার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম। উঠোনের একপাশে মাটির চুলায় গরম গরম চিতই পিঠা এবং ভাপা পিঠা তৈরি করা হচ্ছে। বড়ো মা এবং আরেকজন মহিলা বসে বানাচ্ছেন। বড়ো মার মুখে লাজুক হাসি। অনেক বছর পর এই হাসি দেখলাম। মনটা ভরে গেল। আমাকে দেখে মা কাছে ডাকলেন, –” মায়া, এদিকে আয়।”
মুচকি হেসে মার কাছে পিড়ি পেতে বসলাম।
–” উনি তোর বাবার বন্ধুর বউ। পূর্বে আমাদের অনেক সখ্যতা ছিল। পরিস্থিতির চাপে সব এলোমেলো হয়ে গেছে।”
–” হো গো ফলবানু, ঠিক কইছো। তোমার শাশুড়ি হেইদিন যদি কসম না দিতো তাইলে সুকের সংসার আজ নরকের সংসারে পরিণত হইতো না।”
–” সে সব কথা বাদ দিন বুবু। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে।”
দুজন রমণীর কথা শুনছি। ভাবছি, আমার মা এমন কেনো? মিলেমিশে থাকলে আজকে বাহিরের কেউ আমাদের পরিবারকে নরক বলতে পারত না। বড়ো ভার ডাকে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। আমার দিকে একটা কয়লা এগিয়ে দিয়ে বলেন, –” মায়া, কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে নে। এখানে ব্রাশ পাবি কই। ঐ যে ঐখানে কূপ আছে। আমি বালতিতে পানি তুলে রেখেছি। ভুলেও আগ বাড়িয়ে পানি তুলবি না। তাড়াতাড়ি আয়, পিঠা খাবি।”
কয়লা হাতে ময়লা চোখে বড়ো মার কার্যকলাপ দেখছি। যতটুকু বুজতে পারলাম, আজ কেন এই ছয় সাতদিন কয়লা দিয়েই দাঁত ময়লা করতে হবে। দাঁত মেজে যাচ্ছি আপনমনে। গ্রামে লোকজন সকলেই কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে তাই লজ্জা না পেয়ে কূপের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছি। মায়েরা সবসময়ই সকলে কাজে সন্তানদের সাবধান করে দেন। আমাকেও করেছেন যেন কূপে কাছে না যাই। মানুষ নিষিদ্ধ কাজে বেশি আগ্রহী। হঠাৎ মনে ইচ্ছে জাগলো কূপের গভীরতা দেখার। হাত ধুয়ে কূপের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঁকি ঝুঁকি মেরে পানি দেখার চেষ্টা করছি। ঠিক তখনই পরিচিত স্বর কর্ণধারে আসে। কেউ বলছে, –” আমাকে একা ফেলে এসে দেখছি, এখানে খুবই ভালো আছো।”
সেই পরিচিত স্বর, পরিচিত গায়ের ঘ্রাণ। পিছনে ফিরে তাকালাম। যাবির ভাইয়া দাঁড়িয়ে। পাঞ্জাবীরর উপর গায়ে কালো শাল জড়িয়ে। আমাকে দেখা মাত্রই হেসে দিলেন। আমার কাছে এসে ঠোঁটের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা কয়লার কালি মুছে দিলেন এবং বললেন, –” হাতে পায়ে বড়ো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাচ্চামো যাই নি।”
–” আপনি এখানে কীভাবে?”
–” এসে কী খুব দোষ করেছি?”
–” না তো, তবে ঠিকানা পেলেন কোথায়?”
–” বলবো না। রাগ করেছি, আমি আগে ভাঙাও।”
বড্ড বিপদে পড়েছি। রাগ,অভিমান ভাঙায় কীভাবে, জানা নেই। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম। যাবির ভাইয়া আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার কাছে গিয়ে কাঁপা হাতে হাত ধরলাম। উনি অবাক হলেন। এই প্রথম নিজ ইচ্ছায় ছোঁয়ায় খুশি হলেন। আমিও বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে নিতে চেয়েও পারলাম না। আমাকে ধরে কূপের অপর প্রান্তে নিয়ে বসে পড়লেন। আমার হাত উনার বক্ষঃস্থলের বাম পাশটায় শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমি অনুভব করছি যাবির ভাইয়ার হৃদপিন্ড খুব জোরেই বেজে চলছে। উনার চোখ বন্ধ। সময় পাড় হচ্ছে। বড়ো মা আমার চিন্তা করবেন। আস্তে স্বরে যাবির ভাইয়াকে ডেকে বললাম, –” মা চিন্তা করছে।”
কিছুক্ষণ পর যাবির ভাইয়ার কাতর স্বর শুনতে পেলাম, –” তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম অপরাহ্নের শেষ লগ্নে। হাসিমুখে খেলছিলে আপনমনে। কেউ যে অপলক দৃষ্টিতে তোমার অজান্তে তোমাকে দেখছে তা কি জানতে? বয়স কতই বা ছিল তখন! পনেরো কী ষোল? প্রতিদিন বিকেল বেলায় তোমাকে না দেখলে কাজে মন বসতো না। তখনও জানতাম না তুমি ভাবীর প্রিয়। সেদিন ভাবীর সাথে হাঁটতে বের হয়ে তোমার বাড়ির সামনে আসলাম। তোমাকে সেই তেলযুক্ত অবস্থায় দেখেও চমৎকার লাগছিল। সেদিন বুঝেছিলাম। তুমি খুবই ছোট। তারপর অনাকাঙিক্ষত সেই ঘটনা। তুমি ভাবী আমার উপরে পড়ে গেলে। বিশ্বাস করত মায়া, তোমার ভয়ার্ত চেহারা দেখে পুনরায় তোমার প্রতি দুর্বল হই। মনকে অনেক বুঝাই যে তুমি ছোট কিন্তু মন কথা শুনতো না। এরপর তোমার দুই ভাই বোনকে পড়াতে সুযোগ পেলাম। দিনে দিনে তোমার দুষ্টুমি কাছে আসা দেখে বুঝতে পারলাম তুমিও আমাকে পছন্দ করো। কিন্তু অল্প বয়সে মনের অনুভূতি জানাতে চাইনি। তাই তোমাকে এড়িয়ে চলতাম। অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে আটকাতে, পারিনি। অবশেষে তোমাকে বলেই ফেললাম।”
অবাক নয়নে দেখছি উনাকে। আমার আগেই উনি আমাকে পছন্দ করতেন কিন্তু আমি ভাবতাম উনি বিরক্ত হতেন। মনে মনে খুশি হলাম। উনার কথার প্রত্যুওরে বললাম, –” বললেন না, কীভাবে ঠিকানা পেলেন।”
–” গতকাল তোমার চলে যাওয়ায় অন্তরে ব্যথা সৃষ্টি হয়। ভাবীর সাথে তোমাদের পুরোনো সম্পর্ক। উনাকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন, দূরাত্মীয় বলতে তোমাদের এই একজনই আছে। তাই তোমাদের পরের বাসেই ছুটে চলে আসলাম।”
মুখের ভেতর কালি নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যায়! মুখে থুথু জমা হয়েছে। আমার হাত এখনো যাবির ভাইয়ার হাতের মুঠোয়। আমি উম উম করে হাত ছাড়তে বলছি। কিন্তু যাবির ভাইয়ার কোন হেলদোল নেই। আমার হাত আরো শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। সময় অতিবাহিত হচ্ছে আর আমার পেটের ভেতর গুরুমগুরুম শব্দ হচ্ছে। আর এক মিনিট মুখে থুথু জমিয়ে রাখলে বমি করে দিবো। ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। ওয়াক ওয়াক করে বমি করে দিলাম যাবির ভাইয়ার মুখের উপর।
যাবির ভাইয়া চোখ খুলে,মুখ বন্ধ করে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এরপর আমারই ওড়না দিয়ে মুখ মুছে বললেন, –” এটা কী করলে,মায়া? আমি এবার বাড়ি ফিরব কীভাবে?”
চলবে………