ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ১১

0
299

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
| এগারো তম পর্ব |

স্বচ্ছ,পরিষ্কার পানিতে যাবির ভাইয়া মুখখানা ধৌত করে নিলেন। আমি মুখে হাত দিয়ে কূপ থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি। গতকাল রাতের আঁধারে এলাকা দেখা হয়নি। আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে দেখলাম, কূপ থেকে কিছুটা দূরে একটি মাটির মসজিদ রয়েছে। খুব কাছ থেকে দেখলে বুঝা যাবে মসজিদটি মাটির। নানান রং দিয়ে খোদাই করে কারুকাজ করা। আরবি অক্ষর, আয়াত লিখা। ছোট বাচ্চাদের আরবি পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। রুমু,সুমুর কথা মনি পড়ে গেল। গত সপ্তাহে বাসায় এসেছিল দুই দুষ্টু। আমার ঘরে এসেই লেপের নীচে ঢুকে রাজ্যের গল্প শুরু করে দিয়েছিল। গল্পগুলোর মধ্যে একটা গুজব এমন ছিল, –” রাতের আঁধারে আমি আর রুমু কাউকে কিছু না বলে বের হয়েছিলাম। জানো মায়া আপু, আমরা একটুও ভয় পাই নাই। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক অনেক দূরে একটা খেজুর গাছ থেকে দুই দুই কলস খেজুরের রস চুরি করে নিয়ে আসি। তুমি জানো! গাছের মালিক এসেছিল আমাদেরকে ধরতে। এমন দৌড় দিয়েছি গো, মালিক আমাদের ধরতে পারেনি।”
গুজব শুনা ভালো তাই বলে এমন গুজব? দুই দুষ্টু গল্প বলে জোরে জোরে হাসছিল। আমি জানতাভ গল্পটা মিথ্যা কেননা আমাদের বাড়ির বিশ কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো খেজুর গাছ নেই।

মুখের পর পানির ঝাপটা পড়তেই আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। যাবির ভাই পাশে দাঁড়িয়ে। পূর্বের অভ্যাস অনুযায়ী পাঞ্জাবী দ্বারা মাথা মুছে নিচ্ছেন। নিজের কাজ সম্পন্ন করে মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখনো নিজের করা বিশ্রী কাজে অনুতপ্ত। পকেট থেকে আমার দেয়া রুমাল বের করে কিছুক্ষণ দেখে প্রশ্ন করলেন, –” তুমি এঁকেছ?”

–” হ্যাঁ, ভালো লাগেনি?”
–” খুব সুন্দর। তবে সাথে তোমার একটা ছবি থাকলে বেশ হতো। সমস্যা নেই আমি এঁকে নিবো।”

লজ্জায় মাথা নত করে রাখলাম। উনার সাথে আমার ছবি থাকবে। দেখতে কেমন লাগবে? আমার নিশ্চুপতায় উনি আবার বলে উঠলেন, –” থাকবে কতদিন?”
–” সাত থেকে আটদিন।”
–” তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।”
–” নিবো না।”
জাবির ভাইয়া যেন একটু রেগে গেলেন। আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন, –” যার জন্য করি চু’রি সেই বলে চো’র। তোমার জন্য টাকা জমিয়ে ফোন করে কিনে নিয়ে এসেছি। শুধুমাত্র কথা বলার জন্য। আর তুমি বলছো নিবে না?”

ফোনের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। ফোন চালায় কীভাবে তাই তো জানিনা। আর মানুষটা নাকি আমার জন্য ফোন কিনে নিয়ে এসেছে। ভাবা যায়! আমি সরল মনে প্রত্যুত্তরে বললাম, –” আমি তো ফোন চালাতে পারি না। দেখা যাবে পরে আপনার ফোন নষ্ট করে বসে আছি।”

আমার গতকালের দেয়া মেরিল ঠোঁটে লাগিয়ে উনি বললেন, –” ফোন চালানোর পাশাপাশি প্রেমটাও শিখিয়ে দিবো। বাচ্চা মানুষদের নিয়ে একটাই সমস্যা, সবকিছুতেই না না।”

মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবসময় অপমান করে লোকটা। উনি ব্যাগ থেকে ফোনের একটা বক্স বের করলেন। এত বড়ো বক্ত সাথে নেয়া যাবে না তাই ফোন এবং চার্জার আমার হাতে দিয়ে বললেন, –” এই যে, এটা হচ্ছে ফোন। এই ফোনে যখন কল আসবে তখন বাম পাশের দুই নাম্বার বাটনে চাপ দিবে। তাহলেই কথা বলতে পারবে। উলটা পালটা না বুঝে চাপবে না তাহলে ফোন নষ্ট করে বসে থাকবে। তখন আমও যাবে সাথে ছালাও যাবে।”

কথায় কথায় অপমান করা লোকটার স্বভাবে গেল না। মুখফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে আমি সময়ের ব্যপারে বেমালুম। বড়ো মার স্বর কানে আসতেই নড়াচড়া দিয়ে দাঁড়ালাম। যাবির ভাইয়া ততক্ষণে বুঝতে পারলেন এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। ভীত নয়নে বড়ো মার আসার পথে তাকালাম। বড়ো মা এখনো মসজিদে আড়ালে। শুধু স্বর শোনা গেছে।
যাবিরর ভাইয়াকে তাগাদা দিয়ে বললাম, –” এবার চলে যান। নাকি এখানেই থাকবেন? কোথায় থাকবেন? আপনার বন্ধুর বাসা আছে?”

আমার অস্থিরতা দেখে যাবির ভাইয়া হেসে উঠলেন এবং বললেন, –” এটা কী সিনেমা পাইছো কন্যা! যে নায়িকা যেখানে থাকবে সেখানেই নায়কের বন্ধুর বাসা গড়ে উঠবে? আমার কোন বন্ধুর বাসায় এখানে নেই। শুধুমাত্র তোমার জন্যই সাত সমুদ্র তের নদী সরি সরি রাতে এত কষ্ট করে বাসে এসেছি। ফোন সাথে রাখবে কেমন? আমি কল করব।”

যাবির ভাইয়ার কথা এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছি আর অন্য কান দিয়ে বের করছি। আমার সকল ধ্যান, ধারণা মায়ের দিকে। বড়ো মা এসে যদি আমার সাথে উনাকে দেখে ফেলেন তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর মধ্যে যাবির ভাই আবার বললেন, –” আমার কথা কি শুনেছো?”

–” হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি, চলে যান যান তো!”

আমার অবহেলা যেন উনি সহ্য করতে পারলেন না। যাচ্ছি বলে টুপ করে আমার গালে উনার ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেলেন। এবার আমার সম্পূর্ণ ধ্যান যাবির ভাইয়ার দিকে। গালে হাত দিয়ে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। উনি মসজিদের অপর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন। হাতে ইশারা দিয়ে বলছেন চলে যেতে। কিন্তু আমার ধ্যান-ধারণা অন্যদিকে ফিরছে না। উনি মনে হয় বুঝতে পারলেন যে আমি যাব না। অগত্যা হেসে চোখের আড়ালে চশে গেলেন।

–” কি রে মায়া, এখানে কি করছিস? গালে কি হয়েছে ধরে রেখেছিস কেন?”
–” পোকায় কামড় দিয়েছে, মা।”
আমার কথা শুনে বড়ো মা রেগে গেলেন। আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,–” কি বলিস? কী পোকা কামড় দিয়েছে? বিষাক্ত পোকা নাকি, দেখি তো?”

বড় মাকে আর গাল ছুঁতে দিলাম না। বাহানা করে বড়োমাকে সাথে নিয়ে চলে আসলাম বাড়ির আঙিনায়।
————-

ইতিমধ্যে বাবা এসে গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়া শুরু করেছেন। গতকাল রাতের আঙ্কেলের নাম জাহাঙ্গীর আলম। দুই বন্ধু খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন। উনাদের একজন ছেলে আছে। নাম মুলাশলা। আসল নাম মুবিন। মানসিক প্রতিবন্ধী। কথা কাজে ঠিক থাকে না। কথায় কথায় হাসে। আবার রাগ হলে মা’রে। উঠোনে বসে পিঠা খাচ্ছিলাম সেই সময়ে মা মুলাশলার ব্যপারে জানালেন।

খাবারের পর্ব সেরে ঘরে চলে আসি। ওড়নার নিচে লুকিয়ে রাখা কালো ছোট ফোনটার দিকে নজর দেই। আমাদের এলাকায় ফোন খুবই কম। কারোর ফোন ব্যবহার করা দেখে যে শিখে নিবো তার সুযোগ পাই নি। হঠাৎ টিংটিং করে ফোন বেজে উঠলো। প্রথমে ভয় পেয়ে যাই, ফোনটা হাত থেকে পড়ে যেতেও পড়তে দেইনি। বড় মা বাবা যদি শুনতে পায় তাহলে চরম বিপদে পড়তে হবে। কীভাবে রিসিভ করতে হবে তা তো ভুলে গিয়েছি। বর্তমানে মহা বিপদে পড়ে গেলাম। ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়েই গেল। ফোনের আওয়াজ যেন বাহিরে না যায় তার জন্য ফোন বালিশের নিচে রেখে চাপ দিয়ে বসে ছিলাম। ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবারো হাতে নিলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন ব্যাগের ভিতর ঢুকতে যাবো তখন আবারও ফোনটা বেজে উঠে। টিং টিং টিং আওয়াজ করে যাচ্ছে। অবশেষে মনে করলাম কী বলেছিলেন উনি। সেই অনুযায়ী চাপ দিয়ে কানে ধরলাম।

–” যাক ভালোভাবে ফোন রিসিভ করতে পেরেছো। এত দেরি করলে কেন?”

–” আপনি কি চলে গেছেন।”
–” আমি এখনো রাস্তায় হাঁটছি। বাসতো বারোটার আগে পাবো না। তাই হেঁটে হেঁটে জায়গা দেখছি।”

–” আমাকেও সাথে নিয়ে যান। এখানে ভালো লাগছে না।”

–” সব সময় যে প্রেমিক পুরুষকে সময় দিতে হবে সেটা কোন বিধানে নেই। পরিবারকে সময় দাও। এই কয়েকদিন পরিবারের সাথে হেসে খেলে সময় কাটাও। তারাও খুশি হবে, তুমিও আনন্দ পাবে। বলা তো যায় না কতদিন তাদের কাছে আর থাকবে।”

–” এভাবে বলবেন না। যা হবে পরিবারের মতে হবে। অমতে কিছুই হবে না।”

–” সেটা সময় বলে দিবে। আপাতত রাখছি। পরে কথা হবে।”

ফোন কে’টে গেল। এদিকে আমি পড়েছি মহাবিপদে। আবার যদি ফোন আসে তখন আবার বিপদে পড়তে হবে। কিছুক্ষণ বসে থেকে বুদ্ধি বের করলাম। ফোনকে কীভাবে লুকানো যায় পেয়েও গেলাম। আমার ওড়নার ভিতর ফোন রেখে মোটা করে পেচিয়ে নিলাম। এরপর ঘরে আলমারির ভেতর রাখা কাপড়ের ভাজে ফোনটা রেখে দিলাম। যেন শব্দ হলে বাহিরে না আসে।

–” তুমি এখানে কি লুকাচ্ছো?”

কারো কথার আওয়াজ এ পিছনে ফিরে তাকালাম। ফোন যে লুকিয়েছে দেখে ফেলেছে কিনা ভেবে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। আগন্তুক মানুষটা আমার নিকট এসে বলল, –” যা লুকিয়েছো আমি দেখে ফেলেছি। আমি সবাইকে বলে দিব।”

বলে আগন্তুক বাহিরে চলে গেল। মা মা বলে চিৎকার করছে আমার কানে আসছে। এবার আমি ভয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। বিড়বিড় করে বললাম, –” এবার কী হবে?”

চলবে…….

[আসসালামু আলাইকুম পাঠকগণ। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গল্পটা নব্বই দশকের সময় নিয়ে লিখছি। আশাকরি অতীত, বর্তমান সময় নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না। ভালো থাকবেন সবাই।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here