#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১৩
জয়ী মা’কে দেখে দোয়া কালাম পড়তে শুরু করলো। বাঙালি মায়েরা কখনোই ছেলেমেয়ের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করেন না। তাদের কাছে ছেলেমেয়েরা যেমন বড় হয় না, তেমনি সারাজীবন অবুঝ ই থেকে যায়। জয়ীর মা মেয়েকে বলল,
“তুই হুট করে বাসা ছাড়তে গেলি ক্যান? আর লিজা অসুস্থ, তুই স্বার্থপরের মতো বাসা ছাড়লি?”
“আমি তো ভাবীর মায়ের কারণে বাসা ছেড়েছি মা। ওনার হাবভাব সুবিধার না। দেখে ভয় লাগে। যদি বিষ, টিস খাইয়ে আমাকে মেরে ফেলে।”
“কেন? তুই কী করেছিস?”
“আমি কোনো কাজ করি না। খালি ঘুমাই।”
“তুই কাজ করবিই বা কেন! লিজার নিজেরও তো কাজ করা লাগে না। রান্নার লোক আলাদা, কাজের লোক আলাদা। তোর কেন কাজ করা লাগবে?”
জয়ী ঠোঁট উল্টালো। চেহারায় একটা ইনোসেন্ট ভাব এনে বলল,
“আমি কী জানি! তাছাড়া আমি চাকরিও করিনা,ভাইয়ের টাকায় খাই।”
“ক্যান তোর বাপ, মা মরে গেছে যে আরেক মহিলা খাওয়া নিয়ে চিন্তা করবে!”
জয়ী নির্ভার হলো। ভেবেছিল মোটামুটি সাইজের যুদ্ধ লেগে যাবে। এখন বুঝলো যে মা আসলে ওর দলেরই লোক। জয়ীর ইচ্ছে করলো মা’কে জড়িয়ে ধরে বলতে মা আমি তার মানে সত্যিই তোমার মেয়ে।
জুলিনা জানে কিভাবে মানুষ পটাতে হয়। জয়ীর মা’কেও পটিয়ে ফেলল। প্রথমেই বলল,
“আপা আপনারে দেখার কতো যে ইচ্ছা ছিলো! যেদিন থেকে জয়ীকে দেখছি সেদিন থেকেই আপনারে দেখার ইচ্ছা। জয়ী তো ভীষণ ভালো মেয়ে। মা, বাপের শিক্ষা না পাইলে এমন ভালো হয়!”
ব্যস! জয়ীর মা গলে জল। জুলিনার সঙ্গে তার ভাব হয়ে গেল। যে দুদিন থেকেছে জুলিনার সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করেছে। সব দুঃখ, সুখের গল্প করে গেছেন। জয়ীকে নিয়ে তার টেনশনের শেষ নেই। মেয়েটা ভীষণ ই সহজ, সরল। ছোটবেলার এক ঘটনার কারনে বিয়ে করতে ভয় পায়। এসবও জুলিনাকে বলে গেছে।
যাবার সময় জুলিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“জুলি নাটোরে বেড়াতে যাবা কিন্তু। ”
জুলিনাও আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,
“আরে আপা একবার শীত আসতে দেন। নাটোরে গিয়া আপনারে এমন বিরক্ত করব।”
জয়ী জুলিনার হাবভাব দেখে সৌমিকে বলে, এই মহিলা কে দেখছিস! কী জিনিয়াস!
সৌমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আফসোস! ওনার কোনো ছেলে নাই। থাকলে আমি বিয়ে করে নিতাম।”
জয়ী হেসে ফেলল।
***
আদনান কিছুতেই মাথা থেকে জয়ীতাকে নামাতে পারছে না। কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারছে না। জয়ীতার করা কর্মকাণ্ডগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে চলচ্চিত্রের মতো। প্র্যাকটিসেও এর ইফেক্ট পড়েছে। কোচের কাছ থেকে বকাও খাচ্ছে। সবারই এক প্রশ্ন, আদনানের মন টা কোথায় পড়ে আছে। কিন্তু আদনান তো জানে মন মনের জায়গায় ই আছে। সমস্যা হচ্ছে সেই মনে স্ক্রু নড়বড়ে এক মেয়ে ঢুকে পড়ে ওর মাথার স্ক্রু গুলোও নড়বড়ে করে দিচ্ছে। এসবের কোনো দরকার ছিলো! আদনানের নিজের উপর কন্ট্রোল আছে। ধাক্কা খেয়ে খেয়ে দিন কে দিন কঠিন হয়েছে। অথচ মাসখানেক ধরে ওর সবকিছু এলোমেলো লাগছে। রুটিন করা জীবনকেও ভীষণ একঘেয়ে লাগতে শুরু করছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে।
গত সিরিজে ওর পারফরম্যান্স এভারেজের চেয়েও খারাপ। একটা দুটো ম্যাচ খারাপ খেলতেই পারে, কিন্তু কনফিডেন্স লেভেল যে ভয়ানক ভাবে কমে যাচ্ছে সেটা কেন হচ্ছে!
আদনান নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরি বের করলো। যখনই কোনো ব্যাপারে কনফিউজড থাকে তখনই সেটা ডায়েরিতে লিখে রাখে।
আদনান লিখছে,
জয়ীতার সঙ্গে আমার যেদিন দেখা হলো প্রথম সেদিন আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিলো। এরপর আবার দেখা, মামীর সঙ্গে আলাপ, এই বাড়ি আসা। হঠাৎ হাওয়ার মতো আবারও মিলিয়ে যাওয়া! সব টা কাকতালীয়! নাকি এর পেছনে অন্যকিছু আছে!
***
আলম মিয়া দরজা খুলে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। জুলিনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চুল ছোট করে ছাটা। পরনে জিন্স আর ওভার সাইজের টপ। গলায় ওড়না আছে পেচানো। চোখে সানগ্লাস। সন্ধ্যেবেলাও চোখে সানগ্লাস দিয়েছে। ঠোঁটে কটকট বেগুনি রঙের লিপস্টিক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুব শান্তিতে আছে। জুলিনা আলম মিয়াকে বলল,
“কিরে ভুড়িওয়ালা পুরো দরজা নিয়াই তো দাঁড়ায়ে আছ। সরো। ”
আলম মিয়া সরে গেল। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে জুলিনার আগমনে খুব একটা খুশি না। জুলিনা বলল,
“শিগগির টাকা বাইর করো ভুড়িওয়ালা। গত মাসের টা সহ। ”
আলম মিয়া তার স্ত্রীর দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা মেয়েকে ভাত খাওয়াচ্ছে। ছয় বছরের মেয়েকে এখনো ভাত ঢলে ঢলে খাওয়ায়। আদিখ্যেতার শেষ নেই। আলম মিয়ার বউ মিহি স্বরে বলল,
“গত মাস থেকে একের পর এক বিপদ আপা। বাবুর আব্বুর পিছনে গুন্ডা লাগছে। প্রতিদিন ফোন করে পাঁচ হাজার টাকা চায়। না পাঠাইলে বলে তারে তুলে নিয়ে যাবে।”
“ওই বেটি, আমারে আপা ডাকিস ক্যান? সতীন রে কেউ আপা ডাকে? সতীন ডাকবি। আর ভুড়িওয়ালারে গুন্ডারা হুমকি দিবে ক্যান? বাজারে অহরহ গরুর ভুড়ি পাওয়া যায়। এই ব্যটার ত্যালত্যালা ভুড়ি নিয়া কী করবে! ফাজলামি! টাকা না দেয়ার ধান্দা। ”
আলম মিয়া এই মাসের টাকাটা নিয়ে এলো শুধু। জুলিনা টাকা হাতে নিতে নিতে বলল,
“কী ভাবছিলা? আমি মইরা ভুত হইছি, আর আমার টাকায় তোমরা গা’ গতরে তেল বানাবা। ”
আলম মিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“গতমাসের টাকাটা কিস্তিতে দেব।”
“ব্যটা তোমার জিহবা কাটা দরকার। জিব কাটলে এই ভুড়ির তেলও কমবে।”
আলম মিয়ার বউ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে রইলো। জুলিনা হঠাৎই আলম মিয়ার ছয় বছরের মেয়েকে ধমকে বলল,
“ওই বেক্কল তুই হাত দিয়া ভাত খাস না ক্যান? হাত দিয়া ভাত খাবি।”
মেয়েটা মায়ের পিছনে গিয়ে পালালো। আলম মিয়া নরম গলায় বলল,
“জুলি, বাবু ভয় পাবে। ”
জুলিনা চোখে চশমা দিতে দিতে বলল,
“টাকা যেন ঠিকঠাক পাই। টাকা না পাইলে আমার মাথা কিন্তু ঠিক থাকবে না।”
জুলিনা যাবার আগে ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে আলম মিয়ার মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো। মেয়েটা দাঁত বের করে টাকাটা নিতে হাত বাড়ালে জুলিনা সরিয়ে ফেলল৷ ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,
“পরের বার হাত দিয়া ভাত খাবি। আমার সামনে খাবি। তাইলে পাবি। ”
***
নওশিন ফিক করে হেসে ফেলল। জুলিনা চোখের চশমা মাথায় সরিয়ে বলল,
“হাসলি ক্যান? এতোদিন পর আসছি, কোথায় কুশলাদি জিজ্ঞেস না করে দাঁত বের করে দেখাস!”
নওশিন হাসি চাপার চেষ্টা করলো। ভাগ্যিস তাসিন নেই। বেচারি থাকলে হাসতে হাসতে অসুস্থ হয়ে যেত। জুলিনা জিজ্ঞেস করলো,
“আদনান কই?”
“ঘরে আছে। আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?”
“এক বন্ধুর বাসায়?”
“কোন বন্ধু?”
জুলিনা চোখ পাকিয়ে নওশিনের দিকে তাকালো। বলল,
“তুই কী আমার মা? এসব প্রশ্ন করতেছিস!”
“আপনি জানেন আপনার জন্য আমরা কতো টেনশন করছি। পুলিশে কমপ্লেইন ও করছি।”
“কোনো বাপের পোলারাও তো আমারে খুঁজে পাইলো না। তোরা আমার জন্য টেনশন ক্যান করছস? আমি তো তোদের কেউ না! তোদের জিহবায় অনেক ধার হইছে।”
আদনান বসার ঘরে ঢুকতেই হকচকিয়ে গেল। আজ ও হেসে ফেলল। এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মামী একা এসেছেন? দলবল নিয়ে আসেন নি?”
জুলিনা নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“তোর নাকি আমার সঙ্গে কথা আছে।”
আদনান জুলিনার মুখোমুখি বসে বলল,
“এখনই শুরু করবো নাকি আগে চা খেয়ে নিবেন?”
জুলিনা নওশিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাগো অনেক দিন তোর হাতের চা খাই না। যা তো এক কাপ চা নিয়ে আয়।”
নওশিন বুঝলো ও’কে কৌশলে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ও হেসে বলল,
“আচ্ছা। ”
নওশিন চলে যেতেই জুলিনা জিজ্ঞেস করলো,
“আদনান তোর কী একটা বিয়ে করার ইচ্ছে নাকি অনেকগুলো করার ইচ্ছে? তোর মামা পিশাচ টার ভাগ্নে তুই। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
আদনান সেকথার জবাব না দিয়ে জুলিনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার গেটাপের হঠাৎ চেঞ্জ কী জয়ীতার জন্য? ”
****
এখন সময়টা বর্ষাকাল নাকি গ্রীষ্মকাল জয়ীতা বুঝতে পারছে না। এতো গরম! অথচ বৃষ্টির কোনো নাম গন্ধ নেই। মাঝেমধ্যে মেঘ ডাকে। ব্যস! অতটুকুই। জয়ীতা বসে আছে রিকশায়। শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। বিরক্তিকর জ্যাম ছাড়ছেই৷ ত্রিশ সেকেন্ড রিকশা চলে ত্রিশ মিনিট জ্যাম শুরু হয়।
কলাবাগান মোড়ে আসার পর ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এমন কপাল! বৃষ্টির জন্য আক্ষেপ করলো অমনি বৃষ্টি শুরু হলো।
হঠাৎ জয়ীতার চোখে বড় একটা বিলবোর্ড চোখে পড়লো। ডিজিটাল বিলবোর্ডে কয়েক সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন। বোধহয় কোনো মোবাইল সিম কোম্পানির। আদনান একপাশে দাঁড়িয়ে, অন্যপাশে একটা মেয়ে। ফোন কানে নিয়ে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। জয়ীতা অনেকক্ষন ছবিটা দেখলো। আদনান কে এতো সময় ধরে বোধহয় এই প্রথমই দেখা।
রিকশাওয়ালা জয়ীতার উদ্দেশ্যে বলল,
“মামা চিনা কাগজ টা গায়ে জড়িয়ে নেন। বর্ষা বাড়ছে। ”
জয়ীতা তখনও বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির পানি ফোঁটায় ফোঁটায় আদনানের গায়ে পড়ছে৷ ওর গায়েও পড়ছে।
চলবে….