কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ১২

0
1105

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১২
জুলিনা সত্যি সত্যিই জয়ীর সঙ্গে এসেছে। ওর জীবন টা এমনিতে একঘেয়ে। না, টাকা পয়সার অভাব সেখানে নেই। কিন্তু যে জিনিসটার কাঙাল সেটার দুঃখ আছে। জয়ীর বাসাটা ছোট। দুই বেডরুম, ডাইনিং, কিচেন। এখানে অবশ্য সৌমি আর জয়ী থাকে। সৌমিও জুলিনাকে দেখে খুশি হলো। জয়ী বলল,

“সৌমি, আন্টি আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকবে। ”

সৌমি হেসে বলল,

“আন্টি একা? আন্টির মা আসবে না?”

জুলিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“তাহলে জীবন থেকে শান্তিও ফুড়ুৎ হয়ে যাবে।”

সৌমি হেসে ফেলল।

**
দুদিন যেতেই জুলিনার এই বাসাটা ভালো লাগতে শুরু করলো। সৌমি, আর জয়ী তো আছেই। সেই সঙ্গে যুক্ত হলো পাশের ফ্ল্যাটের দুটো মেয়ে। জুলিনা অবশ্য সবাই কে বলল যে ও জয়ীর খালা। সবাই ধরে নিলো আপন খালাই। জয়ী আর সৌমি কারোর ভুল ভাঙানোর ধারেকাছে গেল না। বাসাটা কেমন পিকনিক স্পট হয়ে গেল। সপ্তাহের শেষে বৃহস্পতিবার রাত টা চাঁদরাত অর্থাৎ ঈদের আগের রাতের মতো হয়ে গেল। রান্না, বান্না খাওয়া দাওয়া, হৈচৈ সবকিছুতে জুলিনা এতো মজে গেল যে সিদ্ধান্ত নিলো দুইমাসেও এই বাসা থেকে নড়বে না। জয়ী শুনে বলল,

“ঠিক আছে তোমার যতদিন ইচ্ছে হয় থাকো। ”

জয়ী আর জুলিনার সম্পর্কে ইতিমধ্যে তুমি, তুই সম্বোধন এসে গেছে। এখানকার সবাই ই জানে জুলিনা জয়ীর আপন খালা। জুলিনা সারাদিন ঘরেই থাকে। শরীর দূর্বল বলে খুব একটা বেরোয় না। তবে সব জায়গার সব খবর রাখে। তার স্বামী যে জ্বি/নে/র বাদশা আর শাকচুন্নির দলের খপ্পরে পড়ে ভয়ে শিটিয়ে আছে সে খবরও ওর কাছে আছে।

জুলিনার কাছে সব খবর আদান-প্রদান করে ওর বাসার কাজের মহিলা। কোথায় কী হচ্ছে সব খবর জুলিনাকে দেয়ার জন্য উনি অতিরিক্ত টাকাও পান মাস শেষে। তার কাছে শুনেছে যে ওঁর স্বামী গত কয়েক রাত ধরে নাকি ঘুমুচ্ছে না। জ্বি/নে/র বাদশার উৎপাতে।

আজ আবার নতুন এক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ওর কাছে খবর এসেছে যে ওঁকে খুঁজে না পেয়ে আদনান নাকি পুলিশের ধারস্থ হয়েছে। এটা তো বিপদের কথা হয়ে গেল। ওঁকে খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন কাজ না। অন্তত আদনানের পক্ষে তো না।

****
আদনানের মামা গত কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। ওনাকে নাকি জ্বি/নে/র বাদশা ফোন করে বিরক্ত করে। ব্যাপার টা শুনেই আদনান বুঝে গেল এটা জুলিনার কাজ। মামার সঙ্গে আদনানের সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। আদনানের এই মামা খানিকটা বাটপার টাইপের লোক। বাটপারি করে অনেকের টাকা, পয়সা করে বড়লোক হয়েছিল। তবে সে সম্পত্তি ভোগ করতে পারছে না। জুলিনার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন সবকিছু জুলিনার নামে করে দিয়েছিল। পরে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করায় জুলিনার কাছে একরকম লা/ত্থি খেয়ে বিতাড়িত হয়েছে। এখন মাস গেলে হাত পেতে আগের বউয়ের কাছ থেকে সংসার খরচ নেয়। আদনান খবর টা শুনে তাসিন, নওশিন কে নিয়ে মামার বাসায় গেল।

***
আদনানের মামার নাম আলম মিয়া। আলম মিয়া মগবাজারে থাকে। যে বাড়িতে থাকে সেটা তার নিজের বাড়ি হলেও এখন জুলিনার দখলে। দোতলার একটা ফ্ল্যাটে বউ, বাচ্চা নিয়ে থাকে। এই বাসায় ওরা এসেছে খুব ই কম। আদনান কে দেখে আলম মিয়ার বউ আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেল। আদনান অবশ্য আপ্যায়ন গ্রহনের ধারেকাছেও গেল না। এই মহিলা আর মামা দুজনের কাউকেই ওর বিশেষ পছন্দ না।

আদনান আলম মিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনাকে কে ফোন করে? ”

“জ্বি/নে/র বাদশা আর তার দলবল। ”

“কোন নাম্বার থেকে ফোন করে? ”

আলম মিয়া মোবাইল টা বের করে নাম্বার টা আদনান কে দিলো। আদনান ট্রু কলার এপে নাম্বার টা দিতেই কনফার্ম হলো যে ওটা জুলিনা।

আদনান জিজ্ঞেস করলো,

“ফোন করে কী বলে?”

“ভয়ানক শব্দ করে। দলবল হৈচৈ করে আর কী যেন বলে! ”

তাসিন হেসে ফেলল। আদনান চোখ পাকিয়ে তাসিনের দিকে তাকালো। তাসিন আস্তে করে বলল,

“সরি।”

নওশিন জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি বুঝলেন কীভাবে যে ওটা জ্বি/ন। মানুষও তো হতে পারে।”

আলম মিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“কী দিয়া ভাত খাই তাও জানে। গত পরশু বলল, তোর কঠিন পাতলা পায়খানা হবে। তাই হইছে।”

তাসিন আবারও শব্দ করে হাসলো। নওশিন এবার ওর হাত চেপে ধরলো।

আদনান বলল,

“আপনার এই সিম টা আমাকে দিন। আমি একটু জ্বি/নে/দের সঙ্গে কথা বলে দেখি।”

আলম মিয়া বিনাবাক্য ব্যয়ে সিম খুলে দিলেন। ভদ্রলোক ভয়ে বেশ মুষড়ে পড়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভদ্রলোকের স্ত্রী ওদের জন্য চা, নাস্তা নিয়ে এলো। খানিকটা আন্তরিকতার ভাব দেখানোর চেষ্টাও করলো। তারপর বলল,

“আমার ধারণা এসব ওই জুলেখার কাজ। তোমাদের মামারে বলি সে বিশ্বাস করে না। দেখো কোথায় গিয়ে আকাম-কুকাম করে।”

তাসিন কঠিন গলায় বলল,

“আপনি জুলেখা জুলেখা করছেন কেন? ওনার দয়ায় এই বাড়ি আছেন সেটা ভুলে যাচ্ছেন কেন!”

ভদ্রমহিলা মুখ কালো করে স্বামীর দিকে তাকালেন। স্বামী বেচারা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।

আদনান তাসিন কে ইশারায় থামতে বলল। আদনান মহিলার উদ্দেশ্যে বলল,

“আমাদের মামীর ভাবনা আমরা ভাবব। আপনি আপনার স্বামীর ভাবনা ভাবুন।’

ভদ্রমহিলা শক্তমুখে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো কথা বলল না। আদনান রা তিন ভাই বোন ওনার দেয়া চা ছুঁয়েও দেখলো না।

***
জয়ীতা শেষ পর্যন্ত সুজয় সরকারের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপর। ত্রিশ বছর ধরে প্যাকেজ নাটক, ধারাবাহিক, টেলিফিল্ম বানাচ্ছেন। সুজয় সরকার বললেন,

“তুমি তো নিজেই নায়িকা হতে পারো। ডিরেক্টর হতে কেন চাইছ?”

জয়ীতা হেসে ফেলল। বলল,

“ওটাই আমার প্যাশন। আর পড়াশোনাও ওই লাইনে।”

“কিন্তু ওটা কিন্তু সহজ না। এর আগে কিছু কাজ করেছ?”

“টুকটাক। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন কিছু শর্ট ফিল্ম। ”

“আচ্ছা। ”

“তাহলে আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাব তো?”

“এসো। দেখি তোমার আগ্রহ কেমন। ”

জয়ীতা খুশি হলো। ফাইনালি কাজের একটা সুযোগ হলো। এতদিন শুধু এফডিসিতে গিয়ে কাজ ই দেখেছে। যাক এবার একটা কাজের সুযোগ অন্তত হলো।

জয়ীতা বাসায় ফিরে দেখলো ভয়ংকর জিনিস অপেক্ষা করছে। ডাইনিং টেবিলে কঠিন দৃষ্টি নিয়ে মা তাকিয়ে আছে। তার পাশে বসে কাজু বাদাম চিবুচ্ছে জুলিনা। জুলিনা জয়ীকে দেখে বলল,

“এই তোর ফোন বন্ধ ক্যান? আপা সেই কোন সকালে আসছে। ”

জুলিনার কথাবার্তা আর আপা ডাকার ধরনে মনে হচ্ছে জয়ীর মা ওর সত্যিকারের বোন। জয়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী জানি ওর কপালে এখন কী অপেক্ষা করছে।

***
আদনান ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। জ্বি/নে/র বাদশার সঙ্গে কথা বলবে বলে নিজের ঘুমের বারোটাও বাজিয়েছে। অন্যান্য সময় ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ঘুমাতে গেলেও দুদিন ধরে তা হচ্ছে না। ফলস্বরূপ সকালে উঠতেও হচ্ছে দেরিতে। পুরো ব্যাপারটায় আদনানের জয়ীতার উপর রাগ হচ্ছে। ও এক হাজার পার্সেন্ট নিশ্চিত যে জুলিনা জয়ীর সঙ্গেই আছে। আর এই জ্বি/ন সংক্রান্ত ব্যাপারে জয়ীও যুক্ত আছে।

আদনান জ্বি/ন এর কাছ থেকে ফোন পেল আরও দুদিন পর। পর পর দু’রাত অপেক্ষা করেও ফোন না পেয়ে অপেক্ষা করা বন্ধ করে দিয়েছিল৷ হঠাৎ করে মাঝরাতে ফোনের শব্দ পেয়ে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ফোন ধরে হ্যালো বলার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে হাহাহোহো শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। শব্দটা বিশ্রী রকমের। কানের মধ্যে ঢুকলে অসহ্য লাগে। তবে ভয়ের কিছু না। এটা যে মানুষের কাজ সেটা স্পষ্ট। এরপর মহিলা ভয়েস একটু মোটা গলায় বলল,

“কীরে খাটাশ দেশী ঘি আর খাবি?”

আদনান গলা চেনার চেষ্টা করলো। মনে হচ্ছে জুলিনার গলাই। জুলিনার বলা কথাগুলো পাশ থেকে আরও দুই তিনটা গলা নকল করে যাচ্ছে। আদনান ফোন টা কেটে সুইচ অফ করে মোবাইল টা রেখে দিলো।

ভোরবেলা আদনান নিজের নাম্বার থেকে জুলিনাকে ফোন করলো। জুলিনা ঘুমের মধ্যে ফোন ধরতেই আদনান জিজ্ঞেস করলো,

“জুলিনা মামী?”

জুলিনা ঘুমঘুম গলায় বলল,

” হ্যাঁ। কে?”

“আমি আদনান। ”

জুলিনা ফোন কেটে দিলো। আদনান ওর নাম্বার কোথায় পেল! নিশ্চয়ই ভুড়িওয়ালা আলইম্যা নাম্বার দিয়েছে। ওর শরীরের তেল, চর্বি ছুটাতে হবে।

আদনান জুলিনাকে টেক্সট পাঠালো,

“মামী বাড়ি আসুন। কথা আছে। আপনার পছন্দ করা মেন্টালি সিক, স্ক্রু নড়বড়ে মেয়েটাকে বিয়ে করতে আমি রাজী। এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে সামনাসামনি হওয়া প্রয়োজন।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here