#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১১
মেয়েটার মধ্যে একটা কিছু আছে। এই ব্যাপার টা বুঝতে আদনানের সময় লাগলো। আর যখন বুঝেছে তখন মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই টাইপ কথাগুলো আসলে বাস্তবে হয় না। রাতারাতি ঠিকানা পাল্টে গায়েব হয়ে যাওয়া ব্যাপারগুলো মূলত সিনেমার কনসেপ্ট। জয়ীতা নিজেই ইচ্ছে করে ওর সামনে ধরা দিতে চাচ্ছে না। দারোয়ান থেকে শুরু করে মোড়ের দোকানদার পর্যন্ত সবাই ই এক কথা বলছে। জানি কিন্তু বলব না। জয়ীতা আপু মানা করছে। আদনান ঠান্ডা হয়ে ব্যাপার গুলো হজম করছে। ভেতরে ভেতরে ও যে জয়ীতাকে সেদিনকার ঘটনা র ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে উদগ্রীব সেটা কাউকে বুঝাতে পারছে না।
জুলিনাকে নিয়ে আদনান তেমন একটা উদ্বিগ্ন না। ওর উদ্বেগ জয়ীতাকে নিয়ে। কিন্তু ভাব দেখাচ্ছে জুলিনাকে খোঁজার। তাসিন,নওশিন দুজনেই জুলিনাকে নিয়ে চিন্তিত। জুলিনার অনেক পাগলামী থাকলেও এই পাগলামীর সঙ্গে ওরা পরিচিত না। আর তাছাড়া জয়ীতাও ওর বাসায় নেই। ওদের ধারণা জয়ীতাকে খুঁজে পেলেই মামীকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
নওশিন আদনান কে বলল,
“আমার মনে হয় জয়ীতাকে খুঁজে পাওয়া গেলেই মামীকে খুঁজে পাওয়া যাবে।”
“তাহলে জয়ীতাকে খুঁজলেই হয়। ”
“কিন্তু খুঁজব কোথায়? ও তো সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের ব্লক করে দিয়েছে। ফোন নাম্বার টাও অফ।”
আদনান কপাল কুচকে বলল,
“তোদের হঠাৎ ব্লক কেন করলো?”
“জানিনা। ”
তাসিন বলল,
“আমরা তো ও’কে কিছু বলিও নি। ”
নওশিন বলল,
“আমি বলেছিলাম। আমি মামীকে বলেছিলাম যে জয়ীতাও তো একটু বাড়াবাড়ি করছে।”
আদনান নওশিন কে বলল,
“তুই হঠাৎ এই কথা মামীকে কেন বলেছিস?”
“মামী তোমার নামে উল্টাপাল্টা বলছিল তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।”
আদনান আর কিছু বলল না। ওর মাথার মধ্যে অন্যকিছু চলছে। জয়ীতা তাসিন, নওশিন কে ব্লক করলেও ও’কে তো আর ব্লক করে নি৷ করার কথা না কারণ ও তো জয়ীতার সঙ্গে এড ছিলো না।
আদনানের ভাবনায় খানিকটা ভুল ছিলো। জয়ীতা ও’কেও ব্লক করে দিয়েছে। তবে এবার আদনানও নাছোড়বান্দা। আরেকটা একাউন্ট তৈরী করলো জয়ীতার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।
***
জয়ীতা মাসখানেক হলো বাসা ছেড়েছে। বাসা ছাড়তে অবশ্য অনেক ঝামেলাও করতে হয়েছে। লিজা হঠাৎ করেই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল। তার মা যশোর থেকে সোজা মেয়ের বাসায় এসে উঠলো। ভাবখানা এমন যে বাচ্চা দুনিয়ায় আসা না অবধি কোথাও যাবেন না। ভদ্রমহিলা আসতেই জয়ীতার সমস্যা হয়ে গেল। হাজার টা প্রশ্ন, এতো রাত জেগে কী করো! কোনো কাজ কেন করো না! বইসা বইসা এমনে খাও খারাপ লাগে না! জয়ীতা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেও কাজ হচ্ছিলো না। সরাসরি বেয়াদবি করাও ওর স্বভাবে নেই। সবচেয়ে বড় কথা লিজা এসব দেখেও চুপ করে থাকে। জয়ীতা মুখে যাই বলুক লিজা যে সত্যিই ও’কে বাড়ি থেকে বের করতে চায় সেটা ওর বিশ্বাস হয় না। কিন্তু পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলার অত্যাচারের পরিমাণ দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছিল। মহিলা রীতিমতো ওর ঘরে আড়ি পাততে শুরু করেছিল। তবে একটা সুবিধা হয়েছে যে উনি আসার পর অনীশের মাথা থেকে বিয়ের ভুত নামিয়েছে। উনি কঠিন গলায় বলেছে জয়ীতা খুব একটা ভালো মেয়ে না। দুপুর একটা পর্যন্ত ঘুমায়। চা ছাড়া কিছু বানাতে পারে না। তাছাড়া ঘরে বসে গেঞ্জি পরে থাকে। এসব শুনে অনীশের মা’ও মোড়ামুড়ি শুরু করেছে।
জয়ীতা এই ঘটনা শুনে লিজাকে বলল,
” ওহ মাই গড! ভাবী তোমার ভাইয়ের জন্য কাজের লোক খুঁজছিলে?”
লিজা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“নিজের ঘরে রান্না করা, টুকটাক কাজ করা মানে তো কাজের লোকের কাজ না?”
“তাহলে কাজ জানা ম্যান্ডাটরি কেন? নিজের ঘরে একটু একটু করে কাজ শিখলেই তো হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কাজ জানা মেয়ে খোঁজার দরকার নেই। দায়িত্ব কাঁধে চাপলে কাজ আপনা আপনিই শিখে যাবে।”
লিজা বাঁকা হাসি হেসে বলল,
“তোমার কী মনে হয়, তোমার জন্য রাজপুত্র আসবে।”
লিজা একটু ভেবে বলল,
“না রাজা আসবে। ”
“এতো কনফিডেন্স?”
“হ্যাঁ। নিজেকে রানী ভাবতে ভালো লাগে।”
লিজা হো হো শব্দ করে বিশ্রী রকমের হাসলো। জয়ীর নিজেরই খারাপ লাগলো সেই হাসি। লিজা বলল,
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার শেষ অবধি পঁচা শামুকে পা কাটবে। ”
“যেমন? ”
“অনীশের মতো ভালো ছেলেকে পায়ে ঠেলছো তো! দেখো কপালে কী জোটে?”
জয়ীতা মৃদু হেসে বলল,
“ভাবী তুমি আমার উপর রেগে আছ? অনীশ কে রিজেক্ট করার কারনে?”
“রাগ করাটাই স্বাভাবিক না? ছেলেটার এতো ভালো প্রোফাইল থাকা সত্যেও তোমার কাছ থেকে রিজেকশন পেতে হলো। ”
জয়ীতা আর তর্কে গেল না। লিজা ওর সমস্যাগুলো আসলে বুঝবে না। বুঝানোর চেষ্টা করেও লাভ নেই৷ যখন বুঝিয়ে লাভ হবে তখন বুঝালেই হবে।
জয়ীতা পরদিন ই জিহাদ কে বলল ও বাসা ছাড়বে। জিহাদ ভাত মাখা বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো। বলল,
“তুই বাসা ছাড়বি কেন?”
জয়ীতা হাই তুলে বলল,
“ভাবী আর তার মায়ের অত্যাচার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ”
লিজার মা’ও ভাত খেতে বসেছিল। খাওয়া বন্ধ করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। লিজাও তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“জয়ী এসব কী বলছ!”
জয়ী নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“প্রতি মাসে বাসা ভাড়াটা পাঠিয়ে দিও। আর ভাবীর মা’কে তো মনে হয় গুলি করেও এক বছরে নামানো যাবে না৷ তাই একবছর পর দেখা হচ্ছে। ”
জিহাদ আগুন চোখে লিজার দিকে তাকালো।
***
জুলিনা অনেক দিন ধরেই হসপিটালে। জয়ীকে খবর দিলেও ও একবারও দেখতে যায় নি। জুলিনা অসুস্থ অবস্থায়ও প্রায় ই ফোন করেছে সৌমিকে। জয়ী ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছে না ভেবে আরও বেশী চিন্তিত হয়ে পড়লো। সব শুনে জয়ী যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। জয়ীকে দেখে জুলিনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। একগাল হেসে বলল,
“তুমি কেমন আছ? সব ঠিক আছে? এতো টেনশন করছি তোমার জন্য!”
জয়ী লজ্জা পেল। ও এই মহিলাকে এড়াতে কতোকিছু করলো, আর এই মহিলা ওর খোঁজ না পেয়ে টেনশন করেছে!
জয়ী মৃদু হেসে বলল,
“আপনার এই অবস্থা কেন?”
“আর বোলো না। দুনিয়ায় এতো মানুষ থাকতেও ডেঙ্গু কেন আমারে ধরলো বুঝি না।”
জয়ীতা ভালোভাবে জুলিনাকে দেখলো। রোগ, ভালোই কাবু করে ফেলেছে। অনেক রোগা লাগছে।
জুলিনা তার দুঃখের ঝুলি নিয়ে বসেছে। মেয়েরা অনেক দিন পর বাপের বাড়ি গেলে যেমন মায়ের সঙ্গে সুখ, দুঃখের ঝাপি নিয়ে বসে তেমন। জুলিনা বলছে,
“আর বইলো না, রাতে আসে না এক ফোঁটা ঘুম। সারারাত চেয়ে থাকি। দুনিয়ার হাবিজাবি চিন্তা। একজন কাছে থাকলে তাও গল্পটল্প করা যায়। তারপর কী করছি শোনো, আমার আরেকটা সিম আছে৷ ওইটা দিয়া ভন্ডরে রাত বিরাতে ফোন করে জ্বালান শুরু করছি। ”
জয়ী জিজ্ঞেস করলো,
“ভন্ড কে?”
“যার সঙ্গে আমার বিয়ে হইছিল। সেই খবিশ টা। এখন তো তার বউ আরেক বেডি। সেইটা রাস্তার বেডি। পাতি শেয়ালের মতো স্বভাব। একদিন তোমারে দেখায়ে আনব। দেখলেই থু* দিতে মন চাইবে।”
জয়ী হেসে ফেলল।
জুলিনা আবারও বলল,
“ভন্ড রে ফোন করে নানান ভাবে ভয় দেখাই। বেচারা ভয়ে দোয়া কালাম পড়ে, আল্লাহ রে ডাকে। যাক আমার উছিলায় মোনাফেক টা একটু আল্লাহ রে ডাকে।”
“কিভাবে ভয় দেখান?”
“নানান শব্দ করি, আজগুবি শব্দ। গলায় কাপড় দিয়া বলছি আমি জ্বিনের বাদশা। ”
জয়ী খিলখিল করে হাসতে লাগলো। জুলিনা নিজেও হেসে ফেলল। বলল,
“সময় কাটে না তাই এইসব করি। ভন্ড’র বউও ভয় পাইছে। পেয়ারের জামাই রে পড়া পানি খাওয়ায় উঠে। ”
জয়ী হেসে বলল,
“আর আপনার মা? উনি একা আছেন না?”
“হ্যাঁ। উনি একাই ভালো থাকেন। গালিগালাজ কম করেন। পাপও কম হয়। ”
“তাসিন রা কেউ আসে নি?”
“নাহ! কাউকে জানাই ই নি। ওরাও বদমায়েশ। ওর ভাইটা চিকন মডেলগুলার সাথে বন্ধুত্ব করে। শুধু বন্ধুত্বই অন্য কিছু না। সেই চিকন ছেমরি গুলা উল্টাপাল্টা বুদ্ধি দেয়। ওইগুলোয় তো ভাত কম খায় তাই মাথায় কুবুদ্ধি বেশী। ”
জুলিনার হাবিজাবি কথা জয়ী মনোযোগ দিয়ে শুনলোও না। এই ভদ্রমহিলার জন্য ওর খুব মায়া হচ্ছে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে অথচ কেউ দেখার মতো, থাকার মতো নেই। জয়ী আবারও বলল,
“একা একা ছিলেন খারাপ লাগেনি?”
জুলিনা হেসে বলল, ধুর বোকা মেয়ে! আমার কী খারাপ লাগার বয়স আছে! ওসব মান, অভিমানের বয়স তো তোমাদের।
জয়ী মৃদু হাসলো। বলল,
“হাসপাতাল আমার ভালো লাগে না। রোজ রোজ আসতে পারব না। ”
জুলিনার মন টা খারাপ হয়ে গেল। জয়ী আবারও বলল,
“আপনি আমার সঙ্গে আমার বাসায় চলুন। আমার ছোট্ট বাসা হলেও আপনার থাকার জায়গা হবে। এবার থেকে নাহয় রাত জেগে আপনার ভন্ডকে আমিও বিরক্ত করব। আমিও অনেক আজগুবি শব্দ করতে পারি। আপনি জ্বিনের বাদশা আর আমি পরীর রানি। ”
জয়ীতা হাসতে লাগলো। জুলিনাও হাসছে। চোখে পানিও এসে যাচ্ছে। হসপিটালের বিছানায় শুয়ে বেশী করে ঝাল ঝাল ভর্তা চটকে ভাত খেতে ইচ্ছে করছিল। রাগ করে কাউকে বলে নি। এই মেয়েটাকে বললে নিশ্চয়ই আনাড়ি হাতে করে খাওয়াবে। এই মেয়েটা আসলেই বড্ড ভালো। নাহ জুলিনার মানুষ চিনতে আর ভুল হয় নি।
চলবে….