গল্পের নাম : বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ৩৯: অনুশোচনা
লেখিকা: #Lucky_Nova
হাতের কাছের থাকা জগটা তুলে নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,”কাছে আসলেই এটা ছুড়ে মারবো একদম।”
থমকে দাঁড়িয়ে গেল এরোন। এ আবার কোন মিহি? যেন পুরোই অচেনা।
এরোন একটু থামলো। শান্ত গলায় বলল, “রিল্যাক্স। আর হবে না।”
সে আরেকটু এগিয়ে আসতেই মিহি ধমকে বলে উঠল,”তোকে বলেছি না বের হতে? বের হ। কাছে আসবি না আমার। আসলে যদি না মেরেছি।” বলতে বলতে চোখের জল গড়িয়ে পড়লো মিহির।
এরোন ভড়কে গেল। বুঝলো অনেক বেশিই জ্বালানো হয়ে গেছে।
“আর হবে না সত্যি। কেঁদ না তুমি।”
ক্ষোভে ফেটে পড়ল মিহি। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “কি আর হবে না? কালকে আমাকে একা পাঠিয়ে দিয়ে চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি। আমাকে ফোনও দেন নি। কিছু করেন নি। আমি আসার পর উল্টো আমাকেই কেমন ব্যবহার দিচ্ছেন। আমি কালই চলে যাব। যাবই যাব।”
দৃঢ়তার সাথে যাওয়ার কথা বলতেই মুখ শুকিয়ে গেল এরনোর। এরিকের কথা না শুনলে এসব কিছুই হতো না।
এরোন এগিয়ে গিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টায় বলল, “আমাকে সবটা বলতে ত..”
“আমি কিন্তু সত্যিই মেরে দেবো একদম। মজা করছি না আমি।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে পড়লো এরোন। এরিকের বাচ্চা বলেছিল সব ঠিক হবে। এখন হচ্ছে তো উল্টো! এই এরিককে যদি চরম উচিত শিক্ষা না দিয়েছে!
“আচ্ছা মারো। তাও শান্ত হও।” সিরিয়াস হয়ে বলল এরোন।
মিহি ধার ধারলো না। সত্যি মেরে দিলো।
এরোন হতভম্ব হয়ে গেল। একটু পিছিয়ে না গেলে একদম পায়েই এসে লাগতো। প্লাস্টিকের জগ হওয়ায় পরে ফেটে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। চুইয়ে পানি পড়ছে।
“মেরে ফেলবা নাকি?” আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলল এরোন।
মিহি থামলো না। হাতের কাছে থাকা বালিশটাও তুলে ছুড়ে মারলো এরোনের মুখে। যদিও মুখে লাগার আগেই সেটা ধরে নিলো এরোন। বুঝে গেল যে এই মেয়েকে না থামালে আজ সত্যিই মেরে বসবে। তাই মিহি আরো কিছু হাতে তুলতে না তুলতেই এরোন এগিয়ে এসে ওর হাত দুটো ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে।
কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “এত রাগছ কেন? আগে কথাটা..”
মিহির রাগ কমলো না। সে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কঠোর গলায় বলল, “ছাড়ুন নাহলে কিন্তু কামড় বসাবো আমি।”
“আগে শুনবা তো…”
এরোনের কথার মাঝেই মিহি জোরে দাঁত বসালো হাতে।
“আউচ।” বলে চোখ কুচকে হাত ছাড়লো এরোন। সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা!
মিহি সরে যাওয়ার আগেই এরোন ওকে আবার টেনে আনলো। নিজের কাছে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করে বলল,”একটু তো শান্ত হও।”
মিহি শুনতেই নারাজ। সে ধস্তাধস্তিই শুরু করে দিলো। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে না পেরে দাঁতে দাঁত চিপলো।
যাক দমাতে পারা গেল ভেবে হাসলো এরোন। আর এই হাসি দেখেই গা জ্বলে উঠল মিহির। মুখ এগিয়ে তার গলায় বসিয়ে দিলো এক কামড়।
শব্দ করে উঠে মিহিকে ছেড়ে দিয়ে গলায় হাত দিলো এরোন। আজ অব্দি দেওয়া সবচেয়ে মারাত্মক ছিল এটাই। জ্বলে যাচ্ছে পুরো।
মুখ শক্তপোক্ত করে রাখলেও মনে মনে খুব খুশি হলো মিহি। নেন, হাসেন এখন!
এরোন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেঁচকা টান দিয়ে আনলো ওকে সরাসরি দাঁত বসালো গলায়। ব্যথাতুর আওয়াজ তুলে চোখ মুখ খিচলো মিহি। সময় নিয়ে ব্যাথাতুর নয়নে তাকালো এরোনের দিকে।
“আমিও দিতে পারি।” ভরাট গলায় বলল এরোন।
ঠোঁট ফুলিয়ে একহাতে গলা ছুঁয়ে দেখল মিহি। অসভ্য লোকটা সত্যিই কামড়েছে। জ্বলে যাচ্ছে একদম।
“কখন থেকে বলছি শান্ত হও। শুনলে এমন হতো?” চোখ পাকিয়ে বলল এরোন।
“সরুন দূরে থাকুন একদম।” তেজী কণ্ঠে বলল মিহি।
“রাগ করেছ? কিন্তু কেন? নিজেই তো গেস্টরুমে থাকার জন্য কত কাহিনী করতা!” কটাক্ষ করে বলল এরোন। ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি।
মিহি বুঝল যে এরোন কথার ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছে ওকে।
“হ্যাঁ গেস্ট রুমেই থাকব এখন থেকে। যান আপনি নিজের ভাইকে গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমান। ভুলেও আমার কাছে আসবেন না।” কটাকটা গলায় বলে দিলো মিহি।
“আর যদি আসি।” বলেই একদম নিজের সাথে মিশালো মিহিকে।
একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মিহি।
“আমি কিন্তু আবার কামড়াবো।” হুমকি দিয়ে বলল মিহি।
এরোনের হাসিটা আরেকটু বাড়লো। চোখ বড়সড় করল মিহি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”ম..মোটেও আমাকে ভুলানোর চেষ্টা করতে আসবেন না। আমি একদম ক্ষমা করব না৷ আপনি খুব খারাপ।”
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মিহি।
এরোন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। মাত্রই কতো তেজ দেখাল। এখন আবার কাঁদে কেন?
“আপনি খুবই খারাপ।” নতমুখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেই যেতে লাগল মিহি।
এরোন জড়িয়ে ধরলো ওকে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই মিহি ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইতেই আরো শক্ত করে ধরলো এরোন।
আদুরে গলায় বলল,”সরি।”
মিহি একটু শান্ত হলো।
এরোন বলল, “অনেক ভালোবাসো?”
“মোটেও বাসি না। খারাপ লোক আপনি।” মুখ ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বলল মিহি।
হেসে ফেলল এরোন।
“তাহলে ফিরে আসলা যে!”
“আমি কিন্তু চলে যাব একদম।” কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল মিহি।
“কোথায়?”
“যেখানে ইচ্ছা। আপনি যান গিয়ে ঘুরে বেড়ান। কাল যেমন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তেমন।”
“ও.. এই জন্য রাগ করেছ?” বুঝতে পেরে সুর টেনে বলল এরোন।
এমন ভাব ধরা কথায় মিহি কপাল কুচকে মাথা তুলে তাকালো এরোনের দিকে। হাসছে সে!
“আমাকে রুমে আটকে না রাখলে আমি সেই কখনই তোমাকে তুলে আনতাম জানো?”
“মানে!”
“মানে আমাকে আটকে রেখেছিল এরিক যাতে তুমি নিজে আসো। নাহলে তোমার বাবা পুলিশ নিয়ে আসলে একটা বড়সড় ঝামেলা হতো। তোমাকেও কিনা নিয়ে যেত।” সবকিছু বুঝিয়ে বলল এরোন।
মিহি হা হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এজন্যই সে আসে নি। মানে আসতে চেয়েও আসতে পারে নি!
“অপেক্ষা করেছিলা?” মুচকি হেসে বলল এরোন।
চোখ নামিয়ে নিলো মিহি। করেছিলই তো। সারারাত জেগে অপেক্ষাই করেছিল।
এরোন সিক্তকণ্ঠে বলল “আমি অনেক মিস করেছি তোমাকে। অনেক। জানো?”
মিহি তাকালো এরোনের দিকে। কি মায়া সেই চাহনিতে। চোখে চোখ রাখতেই সম্মোহন লেগে যায় যেন।
এরোন একটু থেমে ম্লান গলায় বলল,”ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আর আসবাই না। আমিও তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। তুমি..”
মিহি কথার মাঝখানেই পায়ের পাতায় ভর রেখে গলা জড়িয়ে ধরে চুমু এঁকে দিলো এরোনের গালে।
তারপর শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুজে বলল,”আমি তোমাকে চাই, এরোন। সারাজীবনের জন্য চাই।”
চোখের কালো মনি প্রসারিত হয়ে এলো এরোনের। হৃদকম্পন দ্রুততর হয়ে গেল মুহূর্তের ভিতরে। এ কয়েকটা শব্দ যে অনুভূতির সৃষ্টি করল তা কখনোই ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
এটা সত্যিই স্বপ্ন নয়। বাস্তব! মিহি সত্যিই চায় তাকে।
খুশি আভায় চোখ মুখ ছেয়ে গেল এরোনের।আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মিহিকে। এত খুশি সে আগে কখনোই হয় নি।
“মিস করলে আমার সাথে দেখা হবার পরেও এমন কেন করলেন?” শান্ত গলায় অভিযোগ করে বলল মিহি।
“না করলে তুমি এভাবে স্বীকার করতা?”
“এজন্য এভাবে কষ্ট দেবেন? আমি কতটা টেনশনে ছিলাম জানেন?!”
“আর আমার টেনশন হয় নি? তোমার সাথে ওমনটা করতে কি পরিমাণ কষ্ট হয়েছে জানো? অসম্ভব ছিল।”
“মিথ্যুক। দেখার সাথে সাথেই যা ব্যবহার দিলেন আপনি! খারাপ লোক।” কপট রাগের সহিত বলল মিহি।
“দেখার সাথে সাথেই এসেছিলাম। তুমি ঘুমোচ্ছিলে। তখন মন ভরে দেখে নিয়েছিলাম বলেই তো নাটক করতে পেরেছিলাম।” মুচকি হেসে বলল এরোন।
ভ্রু বাঁকিয়ে মাথা তুলে তাকালো মিহি। আকাশ থেকে পড়ে বলল, “কী?”
এরোন নিঃশব্দে হাসলো। গালের পাশের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
মিহি চোখ বন্ধ করে মৃদু হেসে পুনরায় জড়িয়ে ধরলো এরোনকে।
“খেয়েছ কিছু? দুপুর থেকেই তো খাও নি মনে হয়।” জিজ্ঞেস করল এরোন।
মিহি ঠোঁট উলটে সায় দিলো, “হ্যাঁ। এখন খিদে পেয়েছে।”
“আমারো।” নিঃশব্দে হাসল দুজনেই।
?
খাওয়া শেষ করে বিছানায় এলো দুজন। মিহি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো এরোনকে। কাল কতটাই না দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। কত খারাপ ভাবনা উদয় হয়েছিল।
আজ ঠিক তার উল্টোটা। মনে আলাদা রকমের প্রশান্তি, প্রফুল্লতা। নিঃশব্দে হেসে এরোনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মিহি।
“এটা করলে যে এত কাজ হবে আমি তো ভাবতেই পারি নি।” অবাক হয়ে বলল এরোন।
“কী?”
“এইযে তুমি একদিনের দূরত্বে এতটা বদলে যাবা! আচ্ছা, তাহলে আরো কয়েকদিন দূরে থাকলে কি করতে!” ঠোঁট এলিয়ে হেসে ভ্রু উঁচু করে নামালো এরোন।
মিহি ভ্রুকুটি করল।
“কী করতা? বলো?!”
“আবার জ্বালানো শুরু আপনার?” চোখ পাকিয়ে বলল মিহি।
“জানতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু আমিই তো থাকতে পারতাম না। একদিনেই তাই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ভাগ্যিস চলে এসেছ তুমি।” স্বগোতক্তি করে মৃদু স্বরে বলল এরোন।
“না আসলে কি করতেন?”
“তুলে নিয়ে আসতাম আবার। আমার দ্বারা থাকা সম্ভব হত না।” সহজ স্বীকারোক্তি এরোনের।
তবে এটা শুনে মুখটা ম্লান হয়ে গেল মিহির। লোকটা কতটা ভালোবাসে! কিন্তু এতদিন ও তা বুঝতেও চায় নি। তীব্র অনুশোচনা হতে লাগলো মিহির।
ভেজা কণ্ঠে বলে উঠল, “প্রথম থেকেই তো আমি ঠকিয়েছিলাম আপনাকে। একবারের জন্য চিন্তা না করে নিজের জন্য আপনার সাথে নাটক করে গিয়েছিলাম। তাও কেন প্রতিশোধ নিলেন না আপনি? ক্ষতি করলেন না কেন কোনোরকম?”
অনুশোচনায় চোখ ভিজে গেল মিহির।
“ক্ষতি করলে ভালো হতো?”
“অন্য কেউ হলে অবশ্যই করতো।” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মিহি।
এরোন ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে হাসিমুখে বলল,”সেদিন যে বলেছিলা বিয়ে করে প্রতিশোধ নিয়েছি আমি। ক্ষতি করে দিয়েছি তোমার। মনে নেই?”
মিহি চোখ কুঞ্চিত করল।
“ওটা কোনো প্রতিশোধের মধ্যেই পড়ে না। আর আপনি নিজেই বলেছিলেন প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করে নি আমাকে।”
“তাহলে কীসের জন্য বিয়ে করেছি?”
“বিয়ে করেছেন কারণ…।” চোখে চোখ রেখে কথাটা শেষ করতে পারলো না মিহি। একটু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো সে।
এরোন স্নিগ্ধ চাহনিতে চেয়ে ঝুকে এলো মিহির দিকে।
মিহি চোখ তুলে তাকালো একবার।
এরোন নিমজ্জিত কণ্ঠে বলল, “তোমার ক্ষতি করার চিন্তা আসেই নি কখনো। একবারের জন্যও আসে নি। তোমার সাথে খারাপ কিছু করার ইচ্ছা কখনো ছিলও না আমার।”
চোখের জল গড়িয়ে আপনাআপনিই পড়লো মিহির।
“আমি ভুল করেছি অনেক বড়।” ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল মিহি।
“হিস! কেঁদো না।” আদুরে গলায় বলে চোখের জল মুছে দিলো এরোন।
“ভুল যেহেতু করেছই তাই ভুলের মাশুল অন্যভাবে দেও।”
মিহি নাক টেনে চোখ মুছতে মুছতে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো এরোনের দিকে।
এরোন ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে মিহির কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলতেই কান লাল হয়ে গেল মিহির।
লজ্জায় এরোনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে বলল,”আমি পারবো না।”
এরোন হেসে ফেলল নিঃশব্দে।
(চলবে…)