গল্পের নামঃ বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ৩৬: মিহি_কি_চায়!
লেখিকা: #Lucky_Nova
আরোহী আর রুহুল সাহেব ফিরে এসেছেন খানিক আগেই।
ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছেন তারা। চোখ মুখে চিন্তার ছাপ। এরিক থেকে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। সে বুঝতে পারছে না যে আসলে হয়েছে টা কী?! এরোনও কিছু বলে নি। এদিকে বাবা মাও কিছু বলছে না।
এরিক অধৈর্য হয়ে তাদের মুখোমুখি সোফাটায় বসলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”এই নিয়ে কয়বার জিজ্ঞেস করলাম? কি হয়েছে বলবা কেউ? কেউ না বললে বুঝব কি করে?”
“তোর বুঝে কাজ আছে?” ছন্নছাড়া ভাবে বললেন আরোহী।
“হ্যাঁ, আছে।” সাথে সাথে বলল এরিক।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আরোহী মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “ঝামেলা হয়েছে। তোর বাবা আগ বাড়িয়ে সব বলেছিল মিহির বাবাকে৷ সব সত্যিটা।”
“তারপর?”
“মিহির বাবা রেগে গেছেন। রেগে যাওয়াই স্বাভাবিক। কোন বাবা তার মেয়ের উপর জোর জবরদস্তি মেনে নেবে? তাই এখন তার ভাষ্যমতে মিহিকে আর জোর করা চলবে না। কারণ মিহি এভাবে ভালো থাকতে পারবে না। সুতরাং মিহি যা চায় সেটাই হবে। মানে মিহি যেহুতু এরোনের সাথে থাকতে চায় না তাই মিহিকে কালই সুস্থ শরীরে বাসায় দিয়ে আসতে বলেছেন। নাহলে তিনি অন্য ব্যবস্থা দেখবেন।”
“মিহি চায় না? তাহলে এরোনের সাথে এসেছে কেন?” সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল এরিক।
“এসেছে কারণ এরোন জোর করে নিয়ে এসেছে। তাও কী সব বলে!” মুখ বাঁকিয়ে বললেন আরোহী।
এরিকের কপাল কুচকে এলো।
আরোহী আরো বললেন,”মোট কথা যাই হয়ে যাক তার মেয়েকে জোর করা চলবে না। আমার ত মনে হয় উনি ব্যক্তিগত ভাবে এরোনকে পছন্দই করেন না। বড় মেয়ের জামাইয়ের কীর্তির জন্য হতে পারে৷ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মিহির অনিচ্ছার কারণ জানতে পেরে। নাকি শুধু শুধুই পছন্দ করে না! কে জানে? লোকটা বড় জটিল।”
“সাথে কুটিলও।” বিড়বিড় করে বললেন রুহুল সাহেব।
“তোমাদের অপমান করেছে?” সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করল এরিক। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।
“অপমান না। আবার সম্মানও না। বলেছে কাল অব্দি সময়, মিহিকে দিয়ে আসার। কি একটা অবস্থা বল তো? উনি সত্যিই পুলিশ জানালে কি হবে ভাবতে পারিস? মিহিও যদি এরোনের বিপক্ষে বলে তাহলে তো আর রক্ষে নেই।”
“মানে মিহি নিজে আসে নি? এরোন নিয়ে এসেছে ওকে?”
“হু। মিহির বাবা কিছু বলার আগেই মিহিকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে এরোন। যা বলে বেরিয়ে এসেছে তা তো মিথ্যা। মিহি ত এক ঘরেই থাকতে চায় নি। সে কিনা হবে প্রেগন্যান্ট! আর মিহির বাবাকে যতদূর বুঝলাম তিনি তার মেয়ের ইচ্ছাকেই হয়তো গুরুত্ব দেবেন। প্রেগন্যান্ট ফ্রেগন্যান্ট হলেও মানবেন না। কি একটা অবস্থা! এরোনটার যে কী হবে?” বিষাদময় হয়ে এলো আরোহীর মুখ।
“মিহি তারমানে আসতে চায় নি? ওর বাবার কাছেই থাকতে চেয়েছিল?” কপালে গাঢ় ভাজ পড়ে গেল এরিকের।
“ওকে কিছু বলার সুযোগই ত দিল না এরোন। তার আগেই উদ্ভট কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল মিহিকে নিয়ে। এখন কী হবে বল তো? মিহিকে হারিয়ে এরোন যদি পাগলের মত হয়ে যায়, উল্টাপাল্টা করে? যদি করে তাহলে তোর বাবাকে কিন্তু আমি নিজের হাতে শেষ করব।” তেতে উঠলেন আরোহী।
রুহুল সাহেব হকচকিয়ে তাকালেন আরোহীর দিকে।
“আশ্চর্য! আমি কি করে জানবো যে…।”
“জানো না ত দাদাগিরি দেখাতে গেলে কেন? এরোন এজন্যই মানা করে তোমাকে কিছু বলতে। বেশি বোঝো তুমি। আমিও বলেছিলাম যে এরোন আসুক তারপর কথা শুরু করো। নাহ! তার এখনি বলা লাগবে। এরোন এসে কথার মধ্যে কথা বলবে! তাই এখনি বলি। সম্পর্কে মিথ্যা থাকা ভালো না। যত্তসব।” মুখ ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে রাগী স্বরে বললেন আরোহী।
রুহুল সাহেব মুখ খুলে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই এরিক বলে উঠল,”বাবা ঠিকই করেছে।”
এরিকের কথায় অবাক হয়ে তাকালেন আরোহী।
“এরোন আর কত অপমান, অবহেলা করবে? অনেক হয়েছে।”
আরোহী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
এরিক স্থির দৃষ্টিতে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন আমি যা যা প্রশ্ন করি সেগুলোর উওর দিবা, মা। কোনোরকম এক্সট্রা কথা না বলে, প্যানিক না করে। ওকে?”
“তোর আবার কী প্রশ্ন?” অনাগ্রহী গলায় প্রশ্ন করলেন আরোহী।
?
এরিক আপন মনে কী যেন ভেবেই চলেছে। গভীর ভাবে। এতসময় খুটিনাটি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছে মায়ের কাছে। সব শুনে এখন চিন্তা করছে কিছু।
এরোন প্লেট গ্লাস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রুহুল সাহেব আর আরোহীকে দেখে মুখোভাব শক্তপোক্ত করে ফেলল। তাদের দিকে দ্বিতীয় বার আর তাকালো না সে।
আরোহী তাকিয়ে রইল এরোনের দিকে। রুহুল সাহেব সেভাবে সরাসরি তাকাচ্ছেন না।
আরোহী এরোনকে কিছু যে বলবেন সে সাহসও পাচ্ছেন না। কিন্তু মিহির বাবার কথাগুলো ত বলতে হবে। সকালে বলবেন? সকাল হতেও তো দেরি নেই। ইতিমধ্যে রাত দুটো বাজছে।
এরোন প্লেট গ্লাস রেখে উপরে উঠে গেল।
এরোন যেতেই আরোহী করুন গলায় এরিককে বললেন,”কী করি বল তো? মিহিকে কাল না পাঠালে ওর বাবা এসে যদি সত্যিই হাঙ্গামা করে?”
“করবে না।”
“তুই কীভাবে জানিস করবে না?”
“কারণ মিহি কাল বাসায় যাবে।” স্বাভাবিক ভাবে বলল এরিক।
“মানে?” হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন আরোহী।
রুহুল সাহেবও বুঝলেন না কিছুই।
এরিক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,”নিশ্চিন্তে থাকো। কালই সব বুঝবা।”
?
সকাল সাড়ে আটটার মত বাজে। মিহি গোসল সেরে বেরিয়েছে। চুল মুছতে মুছতেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই দরজার টোকা দিল কেউ।
মিহি তোয়ালেটা ইজি চেয়ারে রেখে এগিয়ে গেল দরজার কাছে।
এগিয়ে রাখা দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে এরিককে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল ও।
এরিক বুঝল। মৃদু হেসে বলল,”ভালো আছ?”
মিহি একটু থতমত খেয়ে গেল।
কয়েকবার পলক ফেলে মাথা নেড়ে ছোট করে বলল,”হু। আপনি?”
“আমিও।”
“উ..উনি ত বাহিরে গেছেন।”
“জানি। আমার তোমার সাথেই দরকার।”
মিহি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার সাথে কী দরকার?
এরিক ঠোঁটে ঠোঁট চিপে কিছু ভাবলো তারপর সরাসরি প্রশ্ন করল, “তুমি কি এরোনকে ভালোবাসো?”
বেশ চমকে গেল মিহি। হঠাৎ এমন অবাঞ্চিত প্রশ্নে দৃষ্টি অগোছালো হয়ে এলো ওর।
এরিক স্বাভাবিক মুখো ভঙ্গিমায় ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,”বাসো না?”
মিহি যেন গ্যারাকলে পড়ে গেল। হঠাৎ কী জিজ্ঞেস করছে এসব? তাও এভাবে!
এরিক আরেকটু অপেক্ষা করে ভাবগতি লক্ষ্য করল।
তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে বলল, “যাইহোক, উওর এখনি দিতে হবে না। আপাতত আমার সাথে চলো।”
মিহি বোকাবোকা চাহনিতে তাকালো। ওর সাথে যাবে মানে? কোথায় যাবে?
এরিক হাতের ইশারায় ওকে অনুসরণ করতে বলে তাড়া দিল, “তাড়াতাড়ি।”
মিহি আড়ষ্ট হয়ে গুটিগুটি পায়ে অনুসরণ করল এরিককে। এরিক বাসার বাহিরে নিয়ে এসে গাড়িতে উঠতে বলল মিহিকে।
মিহি আমতা আমতা করতে লাগল।
“জলদি।” এরিক তাড়া দিলো আবার।
মিহি উঠতেই এরিক গাড়ি স্টার্ট দিল।
অনেক সময় ধরেই মিহি বুঝতে চেষ্টা করতে লাগল যে ওরা যাচ্ছে টা কোথায়?
“এরোনকে তোমার কেমন মনে হয়?” হাসিমুখে প্রশ্ন করতে করতে মিহির দিকে একপলক তাকালো এরিক।
মিহি এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকালো এরিকের দিকে। এরোনের বিষয়ে এত প্রশ্ন করছে কেন হঠাৎ?
“হু?” প্রশ্ন করলো এরিক।
মিহি কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না। সংকোচের বেড়াজালে পড়ে গেল।
উলটো প্রশ্ন করল, “ক..কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
এরিক বুঝলো ও এড়িয়ে যাচ্ছে।
“গেলেই দেখতে পাবা।” বলল এরিক।
এরিক সারা রাস্তা আর প্রশ্ন করলো না। ওর সন্দেহ আছে যে মিহিও এরোনকে পছন্দ করে। কিন্তু ও বুঝতে পারছে না।
কিন্তু বুঝতে ত হবে। ওর বাবার হাঙ্গামা করার আগে ওকে বুঝতে হবে আর ওর বাবাকেও ওকেই বুঝাতে হবে।
মিহির বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো এরিক। মিহি বাড়ির দিকের রাস্তায় ঢুকতে দেখেই অবাক হয়েছিল কিন্তু প্রশ্ন করে নি।
আসলে এরিক কী চাচ্ছে?
এরিক গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে এসে মিহির পাশের দরজাটা খুলতে খুলতে বলল,”নেমে পড়ো। চলে এসেছি।”
মিহি ইতস্তত করে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে বেরুতে বেরুতে মিনমিনে গলায় বলল,”এখানে কেন…?”
এরিক প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো। গাড়ি লক করে মিহিদের বাড়ির দিকে এগুতেই মিহিও ওকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। কিন্তু অজানা আশংকায় অস্বস্তি হচ্ছে মিহির। নিজের বাড়িতে আসতে পারায় ত খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু তা কেন হতে পারছে না?
বাড়ির ভেতরে ঢুকেই জোয়েল সাহেবের মুখোমুখি হলো ওরা। তিনি ড্রয়িং রুমেই বসে ছিলেন। হয়তো চিন্তা করছিলেন মেয়েকে কীভাবে ওই বাড়ি থেকে নিয়ে আসা যায়।
কিন্তু আগে ভাগেই মেয়েকে উপস্থিত দেখে একটু অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ওরা যে ঝামেলা ছাড়াই মেয়েকে দিয়ে যাবে ভাবতেই পারেন নি তিনি।
এরিক দুইহাত পিছনে ধরে ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রাখলো। হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করল, “কেমন আছেন আঙ্কেল?”
এরিককে চিনতে পারলেন না তিনি। তবে রুহুলের সাথে চেহারার মিল দেখে ধারণা করলেন এটা এরোনের ভাই হতে পারে। আস্তে করে মাথা নেড়ে “ভালো” কথাটা বললেন জোয়েল সাহেব।
এরিক নিজের পরিচয় না দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় গেল।
“দিতে এসেছি আপনার মেয়েকে।”
কথাটা শুনে পীলে চমকে উঠল মিহি। হতবিহ্বল হয়ে তাকালো এরিকের দিকে। এসব কী বলছে!
জোয়েল সাহেবের মুখ গম্ভীর। তবে হালকা বিস্মিত হয়েছেন তিনি।
এরিক হয়তো বুঝতে পারলো। বোঝারই কথা। কারণ গতরাতেই যে ছেলে তার মেয়েকে ছাড়বে না বলে নিয়ে গেছে সে এত সহজে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলো কীভাবে? এই প্রশ্ন যে কারো মনেই জাগবে।
“আসলে আমরা ভেবে দেখলাম যে সত্যিই জোর করে কিছু হয় না। আপনার মেয়ে যেহেতু আমার ভাইকে পছন্দ করেই না তাই জোরাজোরি করে কি লাভ? তাই দিয়ে যাচ্ছি।”
মিহির ভিতরটা হিমশীতল হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। এরিক এসব কী বলছে! দিয়ে যাচ্ছে মানে কী?
“ভয় নেই। আমার ভাই আগ বাড়িয়ে এখানে আর জীবনেও আসবে না।”
থমকে গেল মিহি।
“ও আপনার মেয়েকে বেশি ভালোবাসে আর সম্মান করে তো তাই আপনাদের কারো চোখে পড়ছে না। সবাই সস্তা ভাবছেন!”
সামান্য তাচ্ছিল্যের সাথে বলতে বলতে মিহির দিকে একপলক তাকালো এরিক।
মিহির চোখমুখে বিচলিত ভাব স্পষ্ট।
“কিন্তু কী বলুন তো? আমি ওকে আর সস্তা হতে দেবো না। ও আর জ্বালাবে না আপনাদের।”
মিহি ম্লান চোখে তাকালো এরিকের দিকে।
এরিক স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে জোয়েল সাহেবকে বলল, “কিন্তু আপনার মেয়ে যদি একান্তই চায় তাহলেই সব হতে পারে। মানে…যদি সে নিজ ইচ্ছার ফিরে আসতে চায় অবশ্যই আসতে পারে। তার জন্য আমাদের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা থাকবে। অর্থাৎ এবার কোনো জোরাজুরি না, যা হবার সবার সম্মতিতেই হবে।”
“আমার মেয়ে কেন চাইব?” বলে উঠলেন জোয়েল সাহেব।
এরিক ভাবুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,”হ্যাঁ সেটাই তো! আপনার মেয়ে কেন চাইবে?! কিন্তু যদি চায় তাহলে নিশ্চয়ই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে আটকে রাখবেন না?”
ভ্রুকুটি করলেন জোয়েল সাহেব।
“আমি বলতে চাচ্ছি, যদি মিহি নিজ ইচ্ছায় এরোনের কাছে ফিরতে চায় তাহলে তাকে বাধা দেবেন না। কারণ আপনার মেয়ে রাজি না বলেই তো এতকিছু! তাই রাজি হলে নিশ্চয় আপনি সব মেনে নেবেন।”
জোয়েল সাহেব কিছু বললেন না। কারণ মিহির ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
“আসছি তাহলে।”
মিহি চমকে তাকালো এরিকের দিকে। সত্যিই কি রেখে যাবে নাকি?
এরিক সিরিয়াস চোখে মিহিকে বলল,”ভেবে দেখো তুমি কী চাও। যেটা চাও সেটাই করো।”
বলে বেরিয়ে গেল সে সদর দরজা দিয়ে।
মিহি অস্থির হয়ে উঠল। ঘামতে শুরু করলো শরীর। ভিতরটা কেমন যেন করছে।
“কী হয়েছে?” জোয়েল সাহেব প্রশ্ন করলেন মিহিকে।
মিহি চোখ তুলে তাকালো তার দিকে।
“তুই কি সত্যিই ওকে পছন্দ করিস না?” দিপালি সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন।
এহেন প্রশ্নে ছ্যাত করে উঠলো মিহির ভিতরটা। মিহি তাকালো ঘাড় ঘুরিয়ে। দিপালি এতসময় রান্নাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন।
“এটা কেমন প্রশ্ন?” দিপালেকে চোখ রাঙালেন জোয়েল সাহেব।
দিপালিও তেজ দেখালেন। বললেন,”তোমার অতিরিক্ত জেদের জন্য দয়া করে মেয়ের জীবনটা শেষ করো না। ছেলেটা যথেষ্ট ভালো। আর সে যে ভালো তা কি এতদিনেও বুঝলে না!”
“তারমানে তুমি চাচ্ছো যাকে আমার মেয়ে ভালোবাসে না তার সাথে থাকবে? আর কোন এমন ভালো ছেলে আছে যে জোর করে বিয়ে করে? ভদ্রতা থাকলে এটা করা সম্ভব হত?”
“তোমার মেয়ে প্রেমের নাটক করলে এখন ওর কি করার থাকবে? তাও যে বাজে কিছু করে নি সেটাই কি অনেক না?”
জোয়েল সাহেব কটমট চাহনিতে চেয়ে বললেন,”কী বলতে চাইছ তুমি?”
”আমি ওকে জোর করছি না। শুধুমাত্র জিজ্ঞেস করছি ও কি চায়? সত্যিই যদি ফিরতে না চায় তাহলে ডিভোর্স টা সেরে ফেলুক। তোমার মেয়ের চেয়ে ভালো মেয়ে পাবে সে!”
মিহি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল ওর মায়ের দিকে।
দিপালি মিহিকে বললেন, “তুই বল তো তুই কি চাস? তোর বাবার ত্যাড়ামির জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না।”
জোয়েল সাহেব চটে গেলেন, “ওই ছেলে ওর জীবন নষ্ট করেছে। তুমি আমার দোষ দিচ্ছ কেন?”
দিপালি জোয়েল সাহেবের কথায় কান দিলেন না। মিহির দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললেন,”তোর বাবা হেরে যেতে চায় না তাই এমন করছে। তোর বাবার পাল্লায় পড়িস না। ছোটোলোক ধরনের বাচ্চামি করছে তোর বাপ।
?
দুপুরের পরেই বাসায় ফিরলো এরোন। এরিক সোফায় বসে ওরই অপেক্ষা করছিল। কারণ এরোন মিহিকে দিয়ে আসার ব্যাপারে কিছুই জানেনা। জানলে তো যেতেই দিতো না।
কিন্তু মিহিকে বাসায় দিয়ে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মিহি নিজে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হোক। আর ওর বিটলা বাপটাকে বুঝিয়ে, মুখ বন্ধ করিয়ে ফিরে আসুক।
“এসেছিস?” এরিক উঠে দাঁড়ালো।
এরোন ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল, “তুই যে বললি শপে প্রবলেম হয়েছে! কই? সব ত ঠিকই ছিল।”
“ওহ আচ্ছা।”
“কী ‘ওহ আচ্ছা’?” বিরক্ততে কপালে ভাজ পড়লো এরোনের।
এরিক হাসলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “তোর ফোনটা একটু দে না!”
হাত বাড়ালো এরিক।
“কেন?”
“আগে দে ত!”
এরোন সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ফোনটা বের করে দিলো। এরিক ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “এবার আয় আমার সাথে।”
এরোন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
এরিক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, “আগে আয় তো!”
বাহিরে থেকে এসে এসব উটকো ঝামেলা ভালো লাগছে না এরোনের। তাও গেল সে এরিকের পিছু পিছু।
এরিক এক পাশের গেস্ট রুমে এসে ঢুকলো। পিছনে পিছনে এরোনও ঢুকলো।
এরিক চোখের ইশারায় বসতে বলল ওকে বিছানায়।
“সমস্যা কি তোর?”
“বউয়ের বেলায় তো মেলা ধৈর্য তোমার বাছা!” তেড়ছা ভাবে বলল এরিক।
“ফালতু না বকে কাজের কথা থাকলে বল।”
“বস আগে।”
ইচ্ছা না থাকলেও বসলো এরোন।
এরিক হাতের পাশের চেয়ারে রাখা অনেক গুলো পানির বোতল থেকে একটা বোতল তুলে নিয়ে বোতলের মুখ খুলল। বোতলটা এরোনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,”পানি খা আগে। ঘটনা শোনার পর গলা দিয়ে আর পানি নাও নামতে পারে।”
“মানে?”
“আরে, পানি খা। তারপর বলি। তুই-ই দেরি করাচ্ছিস।”
এরোন বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বোতলটা নিলো। পানি খাওয়া হলে এরিক বোতলটা আটকে রেখে দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুজলো।
“কী?” বিরক্ত হয়ে উঠল এরোন।
“মিহি কি তোকে বলেছে ও তোকে ভালোবাসে?”
আস্তে আস্তে বিরক্ত ভাব সরে গেল এরোনের মুখ থেকে। গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
“তোর মনে হয় না সম্পর্কটা জোরাজোরি করে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।”
“সোজা ভাবে বল কী বলতে চাস।”
“মিহি কি চায় সেটা জিজ্ঞেস করেছিস কখনো? আমার তো মনে হয়, না।”
“আমার মনে হয় ও…।”
“সেটা তোর মনে হয়। একান্তই তোর নিজের৷ আমি মিহির কথা বলছি। আমার মতে, তোর ওকে একা ছেড়ে দিয়ে দেখা উচিত ও কী চায়। তোকে চায় নাকি চায় না। তোকে আদৌ গুরুত্ব দেয় নাকি দেয় না।”
“কোনো দরকার নেই।” একরোখা মনোভাব নিয়ে বলল এরোন। সকালেও এরিক এরকম কিছু বলেছিল ওকে। তখনো ও ‘না’ করে দিয়েছিল। এত এক্সপেরিমেন্ট করার দরকার নেই। মিহি আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে সেটাই ঠিক আছে।
এরিক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এরোন এমনটা বলবে সেটা ওর অজানা ছিল না। তাও ভালোভাবে বুঝাতে চেয়েছিল।
“আর কিছু? নাহলে রুমে যাব আমি।” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো এরোন।
এরিক মনস্থির করে নিলো। সে যা ভেবেছে সেটাই করবে।
“আমি একটা কাজ করেছি।” স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ও।
“কি কাজ?” সরু চোখে তাকিয়ে বলল এরোন।
এরিক এরোনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দরজার পাশ থেকে সরে বাহিরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল এরোন।
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজার লক ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করতেই বুঝলো ওপাশ থেকে লক করে দেওয়া হয়েছে।
এরোন মহা বিরক্ত হয়ে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল,”কি সমস্যা তোর? এসব কি ধরনের ফাজলামি।”
এরিক লকের সাথে সাথে হুকও লাগালো। তারপর তালা টিপে দিতে দিতে সিরিয়াস গলায় বলল,”তোর বউ নিজ ইচ্ছায় এ বাড়িতে ফিরে না আসা অব্দি এখানেই থাকবি তুই।”
ভারি চমকালো এরোন।
“ম..মানে? মিহি কোথায়? কি করেছিস তুই ওর সাথে?”
(চলবে…)