#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১৯
#হালিমা রহমান
ঢাকায় পা রাখার পরে গত দু’মাস থেকে সময়টা বেশ ভালো যাচ্ছে সূচির।গত দু’মাসে সে শিখেছে অনেক কিছু। লাবনী ওর পুরোনো ভাঙাচোরা ফোনটা দিয়েছে সূচিকে।তা দিয়ে ইউটিউব ঘাটাঘাটি করে ও।এ কয়েকদিনে ও টাইপিং শিখেছে,গুগল থেকে তথ্য খুঁজে বের করতে শিখেছে, লাবিব-শিলার স্কুলে একা একা যেতে শিখেছে, ভগ্নাংশ ও শতকরার অঙ্ক নতুন করে শিখেছে,চিকেন ফ্রাই করতে শিখেছে আর সবশেষে অন্তুর কাছ থেকে শিখেছে রাত জেগে গল্পের বই গেলা।ওর সকাল শুরু হয় শিলাকে দিয়ে।কোমড়ের কাছে ভেজা ভেজা ভাবটা শুকিয়ে যাওয়ার আগেই লাফ দিয়ে উঠে।প্রতিদিন শেষ রাতের দিকে আদুরে বিড়াল ছানার মতো বুকের উপরে শুয়ে থেকে আস্তে করে হিসু করে দেয় শিলা। এ যেন মেয়েটার একটা রোগ।লাবনীর কিল খাওয়ার পরেও কাজ হয় না।ঘুম থেকে উঠে কাঁদো কাঁদো স্বরে শিলা যখন মিনমিন করে বলে, ” আমি ইচ্ছা করে করি না তো খালামনি।হয়ে যায়।আমি কী করব?”; সূচি তখন রাগ করতে পারে না মোটেও।এ এক জীবন্ত পুতুল।এদের সাথে রাগ করার সাধ্য কার?
বাচ্চাদেরকে স্কুলে আনা-নেওয়া অথবা ছাদে কাপড় মেলে দেওয়ার কাজটা সানন্দে করে দেয় সূচি।রান্নার সময়ে টুকটাক লাবনীকে সাহায্য করে।ওটা তখন গল্পের সময়।তেলের উপরে মাছ ছেড়ে দিয়ে প্রেমের গল্প শোনায় লাবনী।
” জানো শান্তর সাথে আমার পরিচয় কীভাবে? একই ভার্সিটিতে পড়তাম।একদিন একটা নোট চেয়েছিলাম ওর কাছে।দেখোই তো কেমন সন্দেহবাতিক।আমাকে দিলো না কিছুতেই! কাকতালীয়ভাবে পরের দিন ওর নোটটা চুরি হলো।ও ছিল টপার।দোষ দিলো আমাকে।বললো, আমি নাকি ওটা ঝেপে দিয়েছি।চিন্তা করো কেমন বেত্তমিজ ছিল! এতো কেঁদেছিলাম সেদিন।আমার ছোট ভাইয়া তখন রাজনীতি করতো।ভাইয়াকে দিয়ে মার খাওয়ানোর প্ল্যান করেছিলাম আমি।কিন্তু এরপরে…..
এরপরে গল্পের মাথায় গল্প যোগ হয়।লম্বা হতে হতে শিলার জন্মে এসে ঠেকে।গল্পগুলো মুখস্ত সূচির।তবুও প্রতিবার নতুন লাগে।কখনো কখনো নিজেও আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে।পেঁয়াজ কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে, ” আপু, বৃদ্ধাশ্রমে আমার কাজ কী?”
” অনেকটা হেল্পিং হ্যান্ডের মতো।”
” ওটা কী জিনিস?ওদের কাজ কী?”
সংকোচ ঝেড়ে গুছিয়ে বলে লাবনী।
” খুব বেশি কাজ না।আমি নিজে দেখেছি।অনেক মানুষ আছে।ওখানের মান ভালো,সবচেয়ে বড় কথা তোমার জন্য ওটা একদম সেফ। কী আর কাজ? হয়তো বুড়োদের একটু খেয়াল রাখা।ঔষধগুলো ঠিক সময়ে দেওয়া।টুকটাক কাজ করে দেওয়া।খাবারের সময় একটু সার্ভ করা।এই তো।আপাতত এই কাজটাই কন্টিনিউ করো।সামনে ভালো কিছুর খোঁজ পেলে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে আসব।”
শুরুর দিকে সময় খুব একটা কাটতো না।লাবিব-শিলা স্কুলে থাকতো।লাবনী হয়তো ব্যবসায় নয়তো রান্নার কাজে ব্যস্ত।ওর কাজে সাহায্য করতে পারতো না বলেই একা থাকতে হতো সূচিকে।অন্তুর চোখে পড়তেই কলেজ যাওয়ার আগে তাড়াহুড়ো করে একটা বই ধরিয়ে দিলো হাতে।ও কী করে যেন বুঝে যায় সূচিকে।
কপালকুণ্ডলা, নামটাই কেমন কঠিন।বঙ্কিমবাবুর বইয়ের আধা পৃষ্ঠাও বুঝলো না সূচি।বিরস মুখে বইটা ফেরত দিতেই ঘর কাঁপিয়ে হাসে অন্তু।চশমার ফাঁকে ওর চোখ দুটোও নাচে হাসির চোটে।ভ্রু নাচিয়ে বলে, ” সেদিন তাড়াহুড়ো করে এই বই দিয়েছিলাম? মনেই নাই আমার।বুঝেছো কিছু?”
” এক পাতাও না।”
” এ তোমার কর্ম নয় বালিকা।দেখি এদিকে দাও।তোমাকে কী বই দেওয়া যায় বলো তো।উমমম…
হিমু দেব? না থাক।ওটা পরে।ফেলুদা পড়ো।তোমার বসে যাওয়া মাথাটা খুলবে।মগজ ঝালাইয়ের জন্য খুব উপযুক্ত এটা।”
বাদশাহী আংটি দিয়ে শুরু। তারপর থেকে এ অবধি কতগুলো গিলেছে তা জানা নেই সূচির।মাঝে একদিন কবিতা পড়েছিল।বনলতা সেন।অন্তু মাঝে মাঝে আবৃত্তি করে দুটো লাইন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ যেন শ্রাবন্তীর…. তারপরে যেন কী? এতোবার শোনার পরেও মনে থাকে না সূচির। কিন্তু গুনগুন করে গানের মতো চুপিচুপি যখন আবৃত্তি করে,তখন বেশ লাগে।সূচি মন দিয়ে শোনে।ওরও ইচ্ছে জাগে এভাবে আবৃত্তি করতে।কিন্তু হয় না,কথাগুলো ওর মনে থাকে না।
গত ত্রিশ দিনে লাবনীর সাথে চার জায়গায় ঘুরতে গেছে ও।চিড়িয়াখানা,রবীন্দ্র সরোবর,জাদুঘর ও মিলিটারি মিউজিয়ামে।ঢাকার জ্যাম দেখে ওর মাথা ঘুরে গেছে,বিশাল ফ্লাইওভার দেখে ওর চোখ বেরিয়ে গেছে,সামনা-সামনি বাঘ-সিংহ দেখে চোয়াল ঝুলেছে, কুমিরের খাঁচায় শুয়ে থাকা কুমিরটাকে দেখে ওটাকে কুমিরের শুটকি মনে হয়েছে, শুকনো জিরাফ দেখে হতাশ হয়েছে,রবীন্দ্র সরোবরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওর পা ব্যাথা হয়েছে,জাদুঘর গিয়ে নাদানের মতো সব দেখেছে।এতো এতো অভিজ্ঞতার ভীড়ে থই পায় না ও।মনেই পড়ে না কোথায় ছিল,কেমন ছিল,আশেপাশে কারা ছিল।ওর ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয় দুঃসময় ভুলে যাওয়া খুব সহজ।চোখ বন্ধ করলাম আর ভুলে গেলাম।ব্যাস! ঝামেলা শেষ।
_______________________________
ফয়সাল বাড়ি ফিরেছে তিনদিন পরে।শরতের এক উজ্জ্বল রবিবারের খটখটে মধ্যাহ্নে। উদয়পুরে মেলার বহর অনেক।এক-আধটু উপলক্ষ্য পেলেই হয়।ওমনি মেঘনার পাড়ে সারি সারি দোকান বসে।শরতকে ঘিরে আবার তাবু পড়েছে মেঘনার তীরে।হরদম মাইকিং,বাচ্চাদের হুটোপুটি,ব্যবসায়ীদের প্রচারণায় কান ঝালাপালা।বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে সকাল থেকে তিন-চারটে অটো মাইকিং করতে করতে ছুটেছে গ্রামের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি। রোমেলা বানু যারপরনাই বিরক্ত।বুড়ো বয়সের স্বাস্থ্যগত অবনতির পরে এতো হুজ্জত, এতো চেঁচামেচি সহ্য হয় না।কানে বাজে।মাথা ধরিয়ে পাগল করে ছেড়ে দেয়।কাজী বাড়ির পুরোনো উঠোনে দাঁড়িয়ে আপনমনে বকছিলেন মেলা কর্তৃপক্ষকে।বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেই ছেলেকে চোখে পড়লো।সদ্য স্বাস্থ্য ভাঙা শরীর,সদা এলোমেলো চুলের নিচে কাটা দাগওয়ালা কপাল আর তার নিচে বসে যাওয়া চির বিষন্ন চোখ দুটো।এক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মায়ের কাছে ও যেন সুখ,শান্তি, স্বস্তির অপর নাম।বুকের উপর থেকে গত কয়েকদিনের বিরাট পাথরটা নেমে গেল। মাথায় গেড়ে বসা দুশ্চিন্তার পোকারাও নেমে গেল মূহুর্তেই।খুশির দমকে কিছুটা বেসামাল, কিছুটা ছেলেমানুষ হয়ে উঠলেন রোমেলা বানু।চামড়া ঝুলে যাওয়া চুড়িহীন শীর্ণ হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ” আহো আব্বা।শরীর ভালো তোমার? এমন শুকায়া গেছো ক্যান?”
এক ফালি ঝকঝকে হাসি পিছলে গেল ফয়সালের সুন্দর ঠোঁট দুটোর উপর দিয়ে।ছুটে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাকে।যেন পারলে বুকের মধ্যে পুরে নেয়।রোমেলা বানুর মাথাটা ওর ঠিক বুকের মাঝখানে ঠেকে।ছেলের গা থেকে ভেসে আসা ঝাঁঝালো বুনো গন্ধে ঝা ঝা করে উঠলো তার ভিতর বাহির।পেট উগলে উঠলেও ঘৃণা হলো না মোটেও।বরং আনন্দের আতিশয্যে শক্ত করে চেপে ধরলেন ছেলেকে।দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো খুব সাবধানে।তিনি বিস্মিত,হতভম্ব,আনন্দিত।কতদিন পড়ে ছেলেটা কাছে এলো! এই বেপরোয়া,অবাধ্য ফয়সালটার উপরে তার কত লোভ তা কি কেউ জানে? উঁহু, কেউ জানে না।তিনি নিজেও মাত্র সেদিন জানলেন।এ তো আর আগের সেই স্বকীয়তাহীন ম্যাড়ম্যাড়ে ফয়সাল নেই।এখন এই বেয়াদব, অবাধ্য ছেলেটাই তার প্রধান দুর্বলতা।এর পায়ে পায়ে যে বিপদ জড়ানো।এর মন ভঙ্গুর,স্বাস্থ্য ভাঙা।একটি মায়ের মন উতলা করার জন্যে এরকম একটি সন্তানই যথেষ্ট।
” তোমার শরীর ভালো আম্মা? বড় ভাইয়া বলছিল তোমার নাকি শরীর খারাপ।”
” খারাপ হইব না? বুড়া বয়সে এতো চিন্তা সয়? তুই কি মায়ের কষ্ট বুঝোছ? একটুও বুঝোছ না।”
মায়ের অভিমানের বিপরীতে মুচকি হাসলো ফয়সাল।রোমেলা বানুকে ছেড়ে দিয়ে আহ্লাদী গলায় বললো, ” বুঝি তো।”
” কচু বুঝোছ।বুঝলে আমার চোখের সামনে সামনে থাকতি।এমন পালায়া বেড়াইতি না।তোরে দুই মিনিট না দেখলে আমার কইলজাডা ক্যামন খামচায় তা তো তুই জানোছই না।”
” আর পালাব না।”
” আল্লাহর কসম ক।”
” কসম কাটা লাগবে না। আমি এক কথার মানুষ।”
উঠোনে বসে আয়না দেখে দেখে শেভ করছিল আফজাল।তাই এতোক্ষণ এদের মা-ছেলের আহ্লাদে কথা বলতে পারেনি।কাজ শেষে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে উঠে এলো।হাতের আয়নাটা চেয়ারের উপর রেখে মুখখানা যথাসম্ভব গম্ভীর করে
হুঙ্কার ছাড়লো, ” কই ছিলি এতোদিন?”
” তপুদের বাসায়।তুমি তো জানোই।”
” ও কি তোর গার্জেন? ওদের বাসায় কী?”
” ওর কাছে শান্তি পাই আমি।”
” তাই বলে পাঁচদিন! তুই আজকে গুনে গুনে পাঁচদিন পরে বাড়ি ফিরেছিস বেয়াদব।”
” তাতে তোর কী? তোরে ধমকাইতে কে কইছে? চুপ কইরা থাক আফজাল।”– সহসা ধমকে উঠলেন রোমেলা বানু।
সেকেন্ড তিনেক আফজালও জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে রইলো। তারপরে ছোট ভাইয়ের সামনে অপমানটুকু হজম করে থম মেরে রইলো।গায়ের সবটুকু জোর মাটিতে খাটিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে চলে গেল ঘরে।
” ভাইয়ার সাথে ওমন করা উচিত হয়নি তোমার আম্মা।”
” হ এহন তো এমন কইবাই।যার লেগা চুরি করি হেয় কয় চোর।”
” আমার হয়ে ওকালতি করার দরকার ছিল না।বড় ভাই হয়ে আমাকে এতটুকু শাসন করার অধিকার তার আছে।আমার খারাপ লাগতো না।বরং ভাইয়ার অধিকারবোধ দেখলে ভালো লাগতো।আমিও বুঝতে শিখতাম পৃথিবীতে এখনো আমার অভিভাবক আছে।আমি একা নই।”
রোমেলা বানু ছেলের কথার খেই ধরতে পারেন না।ওর প্রতি একটুখানি প্রশ্রয়ও যে ছেলের ভালো লাগবে না তা কে জানতো?
” ভাইয়ার সাথে তুমি আর এমন করবে না আম্মা।কখনোই করবে না।ভাইয়ার সাথেও না,ভাবীর সাথেও না।মনে রেখো আমাকে দিয়ে তোমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।ভবিষ্যৎ যদি কিছু থেকেই থাকে তাহলে তা ওদের কাছেই।”
হতভম্ব রোমেলা বানুকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল ফয়সাল।ঘরে ঢুকলো না।নরম পায়ে ঘরের পাশের ভিটার দুয়ারে চলে গেল।হুমায়রা তখন রাঁধছে।রাক্ষুসে উনুনের মুখে গুজে দিচ্ছে একের পর এক চ্যালাকাঠ।গনগনে আগুনের তাপে ওর সুন্দর মুখটা রাঙা হয়ে আছে।মিল নেই,তবুও ওকে দেখে আচমকা সূচিকে মনে পড়লো ফয়সালের।এমন করে ঐ মেয়েটাও একদিন রাঁধতো।চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল হতচ্ছাড়া স্মৃতির দল।এতোই স্পষ্ট যে মনে হলো চোখ মেলে সূচির কপালের ভাঁজগুলোও ও দেখলো।
” বড় ভাবী।”
চমকে তাকায় হুমায়রা।দুয়ারে ফয়সাল দাঁড়ানো।এই প্রথম।আলাদা হওয়ার পরে এই প্রথমবার ফয়সাল এসে ওদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে।স্বেচ্ছায় স্বাভাবিকভাবে এভাবে ডাকছে।অবাকের আতিশয্যে তরকারিতে আধা চামচ লবন ফেলার কথাও ভুলে গেল।
” কী রান্না করো?”
” হ্যাঁ?”
ফয়সাল হাসে।এগিয়ে এসে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে।হাসিটুকু ধরে রেখে ফের প্রশ্ন করে, ” কী রান্না করো?”
” লাউ দিয়া শিং মাছ।”
” আর?”
” মুগের ডাইল।”
” ভাত রান্না শেষ?”
” না তো।ক্যান?”
” ভাত বেশি রান্না করো।আজকে তোমাদের ঘরে আমার আর আম্মার দাওয়াত।”
” হ্যাঁ!”
” আরে অবাক হচ্ছো কেন? সত্যি বলছি।আজকে আমরা এখানে খাব।”
” আম্মা খাইব?”
” আমি বললে অবশ্যই খাবে।দেখো না আম্মা এখন আমার ভক্ত? যা বলি তাই করে।”– চোখ টিপে হুমায়রার অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ায় ফয়সাল।রোমেলা বানু বড় ছেলের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন।ফয়সাল যখন গমগমিয়ে বড় ভাইকে ডাকতে ডাকতে তার শোবার ঘরে ঢুকছিল,তখন দুটো নারীর চোয়াল ঝুলে পড়লো। বিস্ময়ের ঠ্যালা-ধাক্কায়,একই সময়ে,একই সাথে।
____________________________
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ খামারে এলো ওরা।আফজাল ও ফয়সাল, ফয়সালের হাতে বিরাট একটা জাল।আফজালের হাতে ডেটল সাবান,দু’ভাইয়ের জামা-কাপড় আর একটা হাঁড়ি।ওরা আজকে মাছ ধরবে।আফজালের মনে খুশির ঝিলিক।রূপালি মাছের গায়ের মতো চকচকে ওর চোখ দুটো।দেশে আসার পরে এই একটা বেলা অবশেষে এলো যা মনে রাখা যাবে।ফয়সালকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে।আফজালের ঘরে ঢুকে ও তখন প্রথমে ক্ষমা চাইলো।তারপর দু-একটা মামুলি কথা বলে ভাইকে বগলদাবা করে নিয়ে এলো খামারে।আজ ওরা মাছ ধরবে।আফজালের শখ এটা।দেশে থাকতে বর্ষাকালে ওকে ঘরে পাওয়া দায় ছিল।রাত-বিরাতে বন্ধু-বান্ধবের দল জুটিয়ে মাছ ধরতে ছুটতো বিলে বিলে।কত ভালো ছিল তখনকার দিনগুলো! টাকার প্রয়োজন না থাকলে ও কখনো বিদেশে পড়ে থাকতো না।কখনো না মানে কখনোই না,কস্মিনকালেও না।
রোদ পড়ছে মাথার উপরে।মুখে,গলায় ভর করা ঘামের বিন্দু হাতের উল্টোপিঠে মুছে নিলো ফয়সাল।জালটাকে ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করলো, ” তুমি পানিতে নামবে ভাইয়া?”
” হ্যাঁ।তুই জাল ফেল,আমি নামি।”
” তোমার সাঁতার মনে আছে?”
” হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন?”
” বিদেশে ছিলে এতোদিন।ভুলেও তো যেতে পারো।”
গা কাঁপিয়ে উচ্চস্বরে হাসলো আফজাল ।ভ্রু নাচিয়ে বললো, ” বিদেশে থাকি বলে একদম সাহেব হয়ে গেছি ভাবছিস? না রে,বিদেশে থাকলেই কেউ বাবু হয়ে যায় না।তোরা যে দেশে কত শান্তিতে আছিস তা তোরা নিজেরাও জানিস না।সময়ে সময়ে এমন হয় যে আমরা বাংলায় কথা বলার মানুষও খুঁজে পাই না।সব তো আর বাঙালি না।”
ঠিক করে জালটাকে পানিতে ছুঁড়ে দিলো ফয়সাল।গভীর মনোযোগ দিয়ে আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো,
” তোমার কাজটা কী ভাইয়া?”
” লোহার শ্রমিক।”
” খুব কষ্টের কাজ?”
” কষ্ট তো সব কাজেই আছে।অবশ্য তোর যে আরামের কাজ তার চেয়ে আমারটা একটু কঠিনই।প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো।এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।”
” বেশি কষ্ট হলে অন্য জায়গায় কাজ করলেই তো পারো।”
” এই কাজ সব জায়গায় একই রকম।পরিশ্রম সব শরীরের উপর দিয়ে যায়।কিন্তু মাস শেষে কষ্টের উপার্জনটা যখন দেশে পাঠাই তখন আর কষ্ট হয় না রে।এর জন্যই তো সব।হ্যাঁ রে ফয়সাল, আম্মা টাকা নিতে চায় ?”
” ভাবী আম্মাকে একবার দিয়েছিল দেখেছিলাম।”
” একবার! কিন্তু আমি প্রতি মাসে পাঠাই।”
অস্বস্তিরা গলার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে।সংকোচটা কোনোমতে গিলে মিনমিন করে উত্তর দেয় ফয়সাল, ” ঐ একবারই আম্মা টাকা নেয়নি।ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ভাবীর পায়ের কাছে।তারপর থেকে আর দেয়নি।”
” ওহ।তোর ভাবী আমাকে ঘটনাটা বলেনি।”– বেদনায় কালো হয়ে আসা মুখটাকে লুকাতেই পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো আফজাল। পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে প্রসঙ্গ বদলায় ফয়সাল, ” ভাইয়া আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিবে আজকে?”
” কী করবি?”– পালটা চিৎকার ভেসে আসে পানি থেকে।আফজাল ততোক্ষণে একটা ডুব দিয়ে উঠেছে।
” লাগবে।আমার কাছে টাকা নেই।শপিং করব।”
” আচ্ছা দেব।”
” কখন দিবে?”
” কখন লাগবে?”
” বিকালে।”
” আচ্ছা।”
মাছ খুব একটা পায়নি ওরা।দু-তিনটে তেলাপিয়া নিয়েই সন্তুষ্ট। ফেরার পথে ছয়টা গোল বেগুন ও তাজা কুমড়ো শাক এনেছে খামার থেকে।আফজাল বাজার থেকে কিনে এনেছে ঢাউস সাইজের একটা রুই মাছ।দেশে ফেরার পর এই প্রথম একসাথে বসে খাবে।একটু বড় কিছু না হলে চলে না আসলে।
দিনটা আজকে অন্যরকম সুন্দর।আফজালদের টুনটুনির ঘরের মতো ছোট্ট ঘরের বারান্দায় খেতে বসেছে সবাই।লোডশেডিং চলছে বলেই আয়োজন এখানে। বাইরে থেকে বাতাস আসে।ভিতরে ভ্যাপসা গরম।শান্তিতে খাওয়া যাবে না।
আরেক চামচ কুমড়ো শাক পাতে নিয়ে এক লোকমা ভাত গোগ্রাসে গিললো আফজাল।রুই মাছের বড় মাথাটা তুলে দিলো রোমেলা বানুর পাতে।ইশারায় বললো, ” খাও আম্মা।”
রোমেলা বানুর মুখখানা ভারী।ফয়সাল বলেছে বলেই আসা এখানে।ছোট ছেলের মুখের উপরে না করতে পারেননি।বড় ছেলের উপরে আগের রাগ পড়ে গেছে এখন।কিন্তু তবুও ওর ঘরে বসে একসাথে খাওয়ার মতো মাখোমাখো সম্পর্কটা এখনো হয়নি।হুমায়রাকে দেখলে আগের মতো বকেন না ঠিকই।কিন্তু মাঝে মাঝে জ্বিভটা যে টনটন করে তা অস্বীকার করতে পারেন না।
ফয়সাল খেতে পারে না বেশি।দুটো বেগুন ভাজা দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে উঠে যেতে চাইলে বাদ সাধে হুমায়রা।সংকোচ জড়ানো গলায় বলে,
” কিছুই তো খাইলা না।মজা হয় নাই খাওন?”
” মজা হয়েছে ভাবী।আমি বেশি খেতে পারি না।রেখে দাও রাতে খাবনি।”
” বাসি পেটে সইব?”
হুমায়রার সাবধানী খোঁচাটুকু গায়েই মাখলো না ফয়সাল।আঁড়চোখে মায়ের দিকে চেয়ে কৌতুক করে উত্তর দিলো, ” সবার সাথে বাবুয়ানা দেখাই না।তুমি দিলে বিষও পেটে সইবে।”
হাত ধুয়ে-মুছে শান্ত পায়ে নিজেদের ঘরের দিকে আসে ফয়সাল।ভাতঘুমের নাম করে দরজা আটকে নিজের বিছানায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।চার দেয়ালের মাঝে সারাদিনের জন্য এই প্রথমবার হাঁফ ছাড়ে ও।কপাল কুঁচকে আসে।বুকের নিচে অব্যবহৃত বালিশ চেপে ধরে ঘনঘন দম নেয়।আশ্চর্য! স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অভিনয় করা কত কঠিন! ও তো পারে না।ওর দম বন্ধ হয়ে আসে।শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।অভিনয়ে ও বড্ড আনাড়ি।
______________________________
ভালো সময় দ্রুত যায়।অন্তত আফজালের কাছে তাই মনে হয়।শরতের যে রবিবার শুরু হয়েছিল ম্যাড়ম্যাড়েভাবে তাই এখন বেশ উজ্জ্বল। মধ্যাহ্নে ফয়সালের বাড়ি ফেরাটা ঠিক জাদুর মতো।ছোট ভাইয়ের এইটুকু স্বাভাবিক আচরণ এমন একটি সুন্দর দিন উপহার দেবে তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি।
বিকালে দু ভাই মিলে প্রথমে বাজারে গেল।মোড়ের দোকানের দুই কাপ ঘন চা খাওয়ার পরে হাঁটতে হাঁটতে গেল অটোর কাছে।একটা অটো ভাড়া করে ছুটলো মেঘনার পাড়ে।হুটহাট প্ল্যানিং।তাও ভাগ্যিস পকেটে টাকা ছিল।আফজালের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টুকটাক জিনিস কিনলো ফয়সাল।একটা শখের হাঁড়ি,হুমায়রার জন্যে দুটো চুলের কাঁটা,মায়ের জন্য একটা টাঙ্গাইল শাড়ি।তারপরে নিজের পকেট হাতড়ে ভাইয়ের জন্যে তিন দোকান বেছে কিনলো তিনটে ঝুনঝুনি আর হাতি-ঘোড়া।আফজালের চক্ষু চড়কগাছ।ভ্রু তুলে প্রশ্ন করলো, ” এগুলো দিয়ে আমি কী করব?”
” নিজের কাছে রেখে দাও।পরে কাজে লাগবে?”
” মানে!”
চোখ টিপে দেয় ফয়সাল।ভীড় বাঁচিয়ে কানে কানে বলে, ” মানিক আসবে না আবার? ওকে দিও।বলবে ওর চাচা আগে থেকেই জানতো।তাই আগেভাগেই কিনে রেখেছিল।”
পিঠের উপরে দুমদাম কিল পড়তেই ও-পাশ থেকে শোনা গেল আফজালের ধমক, ” বেয়াদব হচ্ছিস দিন দিন।লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েছিস ফাজিল? আমি তোর কত বড়!হিসাব আছে?”
এক সেকেন্ড পরেই চাপা হাসি গোপন করে বাচ্চাদের জিনিসগুলো নিজেই ছোট ভাইয়ের হাতে চালান করে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, ” তুই দিস মানিককে।ওর চাচা তো মরে যায়নি।তাহলে আগেভাগে আমি কেন?”
” হায়াত-মওতের কথা আল্লাহ জানে।মরতেও তো পারি।”
” আল্লাহ না করুক।চুপ থাক ফাজিল।”
সন্ধ্যা ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরে ওরা।দুজনে ক্লান্ত-শ্রান্ত।মনের অবস্থা দুজনের দুরকম।তবুও আফজালের হাসিমুখ দেখে স্বস্তি পায় ফয়সাল।কতদিন পরে ও কারো সুন্দর হাসির কারণ হলো! সন্ধ্যার মুখে তেলের পিঠা বানিয়েছিল হুমায়রা।গোটা চারেক পিঠা সাবাড় করে, আফজালের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে ঘরের খিল আঁটে ফয়সাল।বদ্ধ ঘরে কী করেছে কে জানে! ঠিক ঘন্টা দেড়েক পরে আবার তাকে দেখা গেল উঠোনে।কাঁঠাল গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে, যেখান থেকে পশ্চিমের পুকুরটা আবছা চোখে পড়ে।এদিকে রাতের বেলা আলো কম আসে।ছেলেটার হাতে মাঝারি সাইজের একটা পুটলি।ওটা মাটিতে ফেলে দিয়ে থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ফয়সাল।হুশ ফিরলো মায়ের ডাকে।
” ও ফয়সাল! কী করোছ? কী ওগুলি?”
রোমেলা বানু কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা বুঝলোই না ও।উত্তর না দিয়ে আরেক হাতের বোতল থেকে খানিকটা কেরোসিন তেল ঢেলে দিলো পুটলির উপরে।মিনিট দুয়েকের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে চুপচাপ চেয়ে রইলো।হতভম্ব রোমেলা বানু দু-পা এগিয়ে এলেন সামনে।আবছা আলোতেও স্পষ্ট দেখলেন সূচির বিয়ের শাড়িটা।পুটলি বাঁধার কাজে ওটাই ব্যবহৃত হয়েছে।ওর পেটে আরো কতগুলো শাড়ি-কাপড়,হাবিজাবি।
কাপড় পোড়া গন্ধে ততোক্ষণে বাইরে এসেছে আফজাল ও হুমায়রা।দূর থেকে কান্ডটা হুমায়রা বুঝলেও আফজাল বুঝলো না।কাছে যেয়ে নাক চেপে ধরে বললো, ” করছিস কী?কী এগুলো?”
” ঘরটা পরিষ্কার করলাম ভাইয়া।এগুলো আবর্জনা।”
চার ভাঁজ করা সূচির সেই শেষ চিঠিটা পকেট থেকে বের করে প্রকাশ্যেই আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিলো ফয়সাল।আগুন কাগজটাকে গপগপ করে গিলে নেওয়ার আগেই অজানা কারণে ঘরের দিকে ছুটে গেল ছেলেটা।আবছা আলোয় ছোট ভাইয়ের চোখ দুটো একবার মাত্র দেখার সুযোগ হলো আফজালের।ক্লান্ত,শ্রান্ত,ঝিমিয়ে আসা দুটো চোখের ভাষা জটিল।
” শুনেন, ফয়সালরে আজকে অন্যরকম দেখাইতাছিলো না?”
” হুম।একদম অন্যরকম।”
কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে মানুষের গায়ে তাপ ছুঁইয়ে আগুনটা তখন গিলে খাচ্ছে সূচির ফেলে যাওয়া জিনিসগুলোকে।ধীরে ধীরে নয়,তাড়াহুড়ো করে গোগ্রাসে।মুছে দিচ্ছে একটি সূচির শেষ চিহ্ন।
চলবে…
(পরের পর্বে সারপ্রাইজ)