#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১৭
#হালিমা রহমান
আকাশে কৃষ্ণাপঞ্চমীর চাঁদ।থালার মতো বিশাল চাঁদটা প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয়ে আসছে।আধখানা চাঁদের চেয়ে একটু বড় চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত চারদিক।চন্দ্রাবতী আকাশ সিংহাসনের বেশ খানিকটা উপরে বসে যখন ঝলমলিয়ে হাসছে তখন ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বারোটার একটু এদিক-ওদিক।গ্রামবাসীর কাছে এ ঠিক মধ্যরাত।মানুষ থেকে শুরু করে গোয়ালের গরু-ছাগল,খোপের হাঁস-মুরগী,বাড়ির সামনের আধ পেটা খেয়ে নেতিয়ে যাওয়া নেড়ি কুকুরগুলো অবধি ঘুমাচ্ছে।শুধু ঘুম নেই সূচিদের ঘরে।অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মমিন শেখের ঘুম কমে গেছে।সারাদিন নামমাত্র ঘুমে কাটিয়ে রাতের বেলা দিব্যি জেগে থাকেন।গলায় শব্দ হয় না,কথা বলার ক্ষমতা নেই,হাত-পায়ের নড়ন-চড়ন অবধি বন্ধ,মাঝে মাঝে মাথাটাও কাজ করে না– এ এক অদ্ভুত শাস্তি যেন।রাত বাড়তেই অতীত চোখের উপরে ভাসে।একে একে স্মৃতির পসরা সাজে মনে।সেই বিয়ের আগের কথা,প্রথম যৌবনের কথা,ঘরের কর্তা বনে যাওয়ার গল্প,ভূমি-সূচির জন্ম,মেয়েদের ছোটবেলার কথা,ওদেরকে হাতে বন্দী করে বর্ষার দিনে কুঁচো চিংড়ি ধরার কথা–সব মনে পড়ে একে একে।এসব ভাবতে ভালো লাগে।মনে করতে আনন্দ হয়।কিন্তু এরপরে আর ভালো লাগে না।ভূমির বিয়ে,সূচির দিনকাল,ছোট মেয়েটার বিয়ে,বিয়ের পরের চারটে মাসের কথা ভাবলেই মনটা খিঁচড়ে যায়। ভিতর থেকে গলগলিয়ে আসে বোবা কান্না।শব্দ হয় না বলে নিঃশব্দেই কাঁদেন তিনি।পাশের বালিশেই সাহিদা বানু তখন ঘুমিয়ে কাদা।সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে রাত কোথা দিয়ে কাটে তাই বোঝেন না।তবে মাঝে মাঝে স্বামীর অস্থিরতায়,গলার ভিতরের অর্থহীন অদ্ভুত “উ আ” শব্দে ঘুম ঘুম চটকাটা ভেঙে যায়।তখন আলগোছে অর্ধাঙ্গের বুকের উপরে হাত বুলিয়ে দেন।নিঃশব্দে বুঝিয়ে দেন ভেঙে পড়ে লাভ নেই।সময় বদলায়,পরিস্থিতি বদলায়,মানুষ বদলায়।
ইশতিয়াকের খুব পরিশ্রম যাচ্ছে আজকাল।সপ্তাহে পাঁচ দিনই অফিস থেকে ফিরে সোজাসুজি শ্বশুরবাড়ি চলে আসে।রাতের বেলা এখানে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে টুকটাক শ্বশুরের সেবা করে।বিশেষত মমিন শেখের হাত-পায়ের ব্যায়ামটা ইশতিয়াকই করায়।ভূমি পারে না।বাবার ওতো ভারী ভারী হাত-পা তুলে ওঠা-নামা করলে সেলাইয়ে চোট লাগে।সাহিদা বেগমের বুড়ো হাড়।দু-তিনবার বার হাতটা একটু ব্যায়াম করাতেই টনটনে ব্যাথায় জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাছাড়া, মমিন শেখ মল-মূত্র ত্যাগের কাজটা এখন বিছানাতেই করেন।সারাদিনে স্বামীর সেবা শেষ করে এই কাঁথা কাপড় ধুইয়ে ব্যায়ামের দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য আর থাকে না।তাই শেষ ভরসা ইশতিয়াক।এতো গেল একবেলার কথা।নিজের সংসার সামলে এ ঘরের বাজার-সদাই,চাষের জমির দেখাশোনা ও শ্বশুরের চিকিৎসার ধাক্কাটা এখন ইশতিয়াকের কাঁধেই।জমিগুলো বর্গা দিয়ে দিয়েছে।অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার নিয়ে আসে।আর ছুটির দিনে মমিন শেখকে নিয়ে ছোটে হাসপাতালে।ভোলা জেলার সরকারি থেকে শুরু করে প্রাইভেট– এমন একটা হাসপাতাল নেই যা ওরা ভেজে খায়নি।একটু ভালো চিকিৎসার আশায় ছুটির দিনগুলোতে ছুটে বেরিয়েছে এ মাথা থেকে ও মাথা।কিন্তু ফলাফল বিশেষ ভালো হচ্ছে না।সব জায়গায় একই পরামর্শ,একই উপদেশ, একই চিকিৎসা,একই ঔষধ, মমিন শেখের অবস্থাও একই–সেই আগের মতোই।
আজ এ বাড়িতে আসার ইচ্ছা ছিল না ইশতিয়াকের।শত কিছুর পরেও এ বাড়িতে ও এখনো ঠিক সহজ হতে পারে না।সবাই যখন কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকায় তখন ভারী ইতস্ততবোধ হয়।ও যখন বুঝতে পারে ভাবী মহল থেকে শুরু করে আলেয়া দাদি,ঐ পাশের দর্জি বাড়ির লোকেরা আড়ালে-আবডালে ওর প্রশংসা করে তখন ভীষণ লজ্জা হয় ওর।তাই নিত্য আসতে ভালো লাগে না।এই ভালো না লাগার কারণ শ্বশুরের প্রতি অশ্রদ্ধা নয় স্রেফ বিব্রতবোধ।
কিন্তু আসবে না আসবে না বললেও আজ আসতেই হলো।মমিন শেখের খিঁচুনি উঠেছিল সন্ধ্যার দিকে।ভূমি যখন ফোন করে অস্থির গলায় খবরটা দিলো তখন আর না এসে থাকতে পারলো না।এদিকে ডাক্তার বাড়ি বয়ে এসে রোগী দেখে না।অগত্যা এই অসার মানুষটাকে ভ্যানের উপরে নিয়েই আবার ছুটতে হলো উদয়পুর হাসপাতালে।চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এক লাফে রাত সাড়ে এগারোটা।সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে পা দুটো আর চলছে না।হাঁটু ভেঙে আসছে।শার্টের দুটো বোতাম খুলে ঝট করে বিছানায় ঝাপ দিলো ইশতিয়াক।সূচির ঘরের তোশকটা ভারী খুব।গা এলিয়ে দিলেই এক মুঠো স্বস্তি ধরা দেয়।
ইভানকে মনির কাছে রেখে ভূমিও ছুটেছিল হাসপাতালে।এসে আগে ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।ও এখন প্রায় প্রতিদিনই সকালবেলা এ বাড়িতে চলে আসে।কখনো রান্না করে খাবার নিয়ে আসে আবার কখনো এসে এ বাড়ির রসুইঘরের দায়িত্ব নেয়।এতোকাল বাড়ি থেকে দূরে ছিল বলেই হয়তো এখন খুব মায়া কাজ করে বাড়ির জন্যে।বুড়ো খেজুর গাছের কাছে পা রাখলেই বাড়ি ফেরার আনন্দ হয়।অসুস্থ বাবার প্রতি এখন আর খুব একটা রাগ হয় না।কারো প্রতিই আসলে বিদ্বেষ নেই।সবটাকে দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে।কেবল সময়ে-অসময়ে সূচিকে খুব মনে পড়ে।ও যে নেই এ কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না এখনো।সূচির ছোট্ট ঘরের আলনা,জামা-কাপড়,বইয়ের টেবিল ও খুঁটিতে ঝোলানো ছোট আয়না দেখলেই মনে হয় এরাই সূচির অস্তিত্ব। মনে হয় যেন মেয়েটা মরেনি,কয়েকদিনের জন্য অন্য কোথাও বেড়াতে গেছে।চলে আসবে আবার।ভূমিকে নিজেদের বাড়িতে দেখে রোদ ছোঁয়া চকচকে কুমড়ো ফুলের মতো ঝকঝকে হাসবে।গায়ের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে একদম ঢুকে যাবে ওর সাধের বড় আপার বুকের ভিতরে,ঠিক আগের মতো।
” ইশতি,এই ইশতি।উঠো,ঘুমিয়ে যাচ্ছ কেন? উঠো না,এই।খাবে না? এই ইশতি।”
এই কয়েক মিনিটেই ভারী ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা।ক্লান্ত শরীরের কাছে বউয়ের সোহাগের চেয়ে ঘুম ঢের ঢের ভালো।তাই ভূমির ডাক শুনে মেজাজ চড়ে গেল সপ্তমে।চট করে চোখ খুলে নাকের পাটা ফুলিয়ে ফেললো মুহূর্তেই।
” তোমার কমন সেন্স কি দিন দিন কমে যাচ্ছে ভূমি? আমি আশ্চর্য না হয়ে পারি না।”
দু-হাতের আগলে জড়িয়ে রাখা ছোট ইভানকে বিছানার মাঝে শুইয়ে দিলো ভূমি।নেতিয়ে যাওয়া ক্লান্ত গলায় খাপছাড়া একটা প্রশ্ন করলো, ” ক্লান্তি কি একা তোমারই আছে? আমার নাই?”
” আমি ঘুমাচ্ছিলাম ভূমি।এরকম ডাকাডাকির কোনো মানে হয় না।”
” ডাকাডাকি কি সাধে করি? তোমার খাওয়া-দাওয়া লাগে না? ভাত খাবা না?”
” না, খাব না।ঘুমাব।প্লিজ চোখের সামনে থেকে যাও।বিরক্ত লাগছে।”
আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়লেও ঘুম এলো না ইশতিয়াকের চোখে।ভূমির সাথে ওর ধমকা-ধমকির সম্পর্ক নেই।চোখ পাকিয়েও তাকায় না খুব একটা।তাই আজ ঘুম ভাঙার পরে হুট করেই ধমকে উঠেছে বলে অনুশোচনা হলো।মুহূর্তেই হাত বাড়িয়ে ভূমিকে কাছে টেনে বললো, ” সরি।”
” তুমি এতো ভালো কেন বলো তো? একদম লুতুপুতু টাইপ ভালো।আমার কাছে কেমন ম্যান্দা ম্যান্দা লাগে।পুরুষ মানুষের একটু রাগ-জেদ না থাকলে কেমন যেন লাগে।ভাল্লাগে না।তুমি এখন থেকে রাগ করবে।একদম বাড়াবাড়ি টাইপ রাগ।ঠিকাছে?”
ভূমির ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা না থাকলেও ইশতিয়াকের খুব হাসি পেল।ভিতর থেকে উগলে আসা হাসিটুকু খুব সাবধানে পিছলে গেল ঠোঁটের উপর দিয়ে।
” আচ্ছা এখন থেকে অনেক রাগ করব।আমাকে তো ম্যান্দা ম্যান্দা লাগে।এবারে আর লাগবে না।পান থেকে চুন খসলেই যখন বেল্ট খুলে পেটাব তখন খুব পুরুষ পুরুষ লাগবে।ভাল্লাগবে তো?”
শেষ কথাটা একদম খচ করে গেঁথে গেল ভিতরে।কোমড়ের বেল্ট আর মারধর– দুটো শব্দের সাথে কোথাও না কোথাও সূচি জড়িয়ে। সারাদিনের অবসরে এই মাঝরাতে বোনের কথা মনে পড়তেই মনটা হুট করে খারাপ হয়ে গেল ভূমির।কাঁদে না, আগের মতো কেবল উদাস হয় নিমিষেই।
ইশতিয়াক হয়তো বোঝে প্রিয়তমার উদাসীনতা।খারাপ লাগে ওর।ও কি আর জানতো মজা করে বলা কথাটাই পরিবেশটাকে বদলে দেবে এক লহমায়? মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া কথা তো আর ফেরত নেওয়া যায় না।তাই সতর্কতার সাথে প্রসঙ্গ পালটে ফেলে।
” আম্মা কী করে?”
” আব্বাকে খাওয়ায়।”
” আম্মা তোমার সাথে কথা বলে?”
” বলে কিন্তু টুকটাক।মন খারাপ করে থাকে সবসময়।”
” তা তো থাকবেই।যেয়ে ভাত নাও প্লেটে, আসছি আমি।আম্মাকে ডাক দিও।একসাথে খাব।”
” আচ্ছা।”
ভূমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই বাধা আসে পাশের মানুষটার কাছ থেকে।ইশতিয়াকের মাথা তখন বালিশ থেকে খসে পড়ে গেছে বউয়ের কোলের উপরে।চরম আদরে হাতের দশটি আঙুল ভূমি গুজে দিলো ইশতিয়াকের চুলে।
” ভূমি,ইভানকে গল্প বলার একটা টপিক পেলাম।”
” মানে?”
” মানে হচ্ছে ইভান যখন বড় হবে তখন ওকে একটা গল্প বলব।”
” কী গল্প?”
” ওর মায়ের গল্প।আমি ছেলেকে গল্প বলব,একসময় ওর মা খুব হাসতে জানতো।”
” এখন জানে না?”
” একটুও না।আমার ছেলে বড়ই অভাগা।ও হয়তো কখনোই ওর মাকে হেসে গড়িয়ে পড়তে দেখবে না।”
চুলের গোড়ায় শক্ত টান পড়লো ইশতিয়াকের।ভূমির মনে পড়লো সত্যিই ও অনেকদিন হাসেনি।মেয়েটা অবাক না হয়ে পারে না।আশ্চর্য! এই মানুষটার কাছ থেকে কি কিছুই লুকানোর জো নেই?
_______________________________
সূচির দিনকাল যে কত ভালো যায় তা ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়।ওকে যারা দেখেছে তারা সহজেই স্বীকার করবে গত দু-আড়াই মাসে মেয়েটার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।চোখের নিচের কালিগুলো উধাও হয়েছে কবে তা জানা নেই।ভাঙা চোয়ালে একটু একটু মাংস জমছে।লিকলিকে শরীরে হাড়গোড়ের উপরে পড়েছে মাংসের আস্তরণ। মোটা হয়েছে সামান্য।সদা হাস্যোজ্জ্বল, সদা পরিপাটি,সদা বিনয়ী মেয়েটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই গত এপ্রিলে উদয়পুর থেকে অন্তু অন্য একটা সূচিকে কুড়িয়ে এনেছিল।ভবিষ্যতে চাকরি নিশ্চিত,বর্তমানে বিশ্রামাবাসে আশ্রয় নিশ্চিত,দুশ্চিন্তা নেই,উদয়পুরের অধ্যায় বন্ধ,সঙ্গ দেওয়ার মতো লাবনী আছে,সময় কাটানোর জন্য লাবিব-শিলার মতো দুটো ছাত্র আছে আর সবশেষে আছে অন্তুর মতো একজন দায়িত্ববান শুভাকাঙ্ক্ষী। দিন কাটানোর জন্য আর কী লাগে? মাঝে গলার কাঁটার মতো ছিল তিক্ত অতীত।মাঝে মাঝে আগের কথাগুলো মনে করে ভারী কষ্ট হতো সূচির।ওর দম বন্ধ হয়ে আসতো।৷ বিশ্রি একটা হীনমন্যতা কাজ করতো।মনে হতো ও ঘাড়ের উপরের বোঝার মতো।ঘর থেকেই বেরোতে ইচ্ছে করতো না। কি বাজে একটা অবস্থা ছিল তখন! কে জানে ওর এই অবস্থা কার কার নজরে পড়েছিল।এক বিকালে অন্তুর সাথে বসার ঘরে মুখোমুখি দেখা।ছেলেটার নজর এড়াতেই ও প্রায় পালিয়ে যাচ্ছিলো। অন্তু পিছন থেকে ডাকলো।মিষ্টি হেসে পুরুষালি ভরাট গলায় প্রশ্ন করলো, ” ভালো আছো সূচি? আজকাল তো তোমার দেখা পাওয়াই ভার।”
ইতস্ততবোধ এড়াতে সূচি প্লাস্টিকের মাপা হাসি হাসে।ঘটনাটা ঘটেছিল উদয়পুর নেওয়ার জন্য অন্তু যখন জোরজবরদস্তি করেছিল তার কিছুদিন পরে।অন্তুকে তখনও ভয় হয় সূচির।অন্তু কিন্তু সূচির কৃত্রিম হাসিটুকুকে পাত্তাও দিলো না।বরং সোফার গায়ে হেলান দিয়ে বললো, ” তোমার স্টুডেন্টদের কী খবর?”
” ভালো।”
” জ্বালায় তোমাকে? যা বিচ্ছু!”
” না,ওরা আমার ভক্ত।”
” ভক্ত হলেই ভালো।পড়াতে সমস্যা হয় না তো তোমার? অঙ্ক-টঙ্ক না বুঝলে বলবে আমাকে।এখন তো আবার সৃজনশীলের যুগ।একটু দক্ষ না হলে ভালো করা কঠিন।”
লাবিবের ভগ্নাংশ ও শতকরার অঙ্কগুলো নিয়ে সত্যিই ঝামেলা হচ্ছিলো সূচির।কিন্তু বলতে মুখে বাধে।লাবনী শুনলে কী বলবে? নিশ্চয়ই ঠাট্টা করবে। বলবে, মহাপন্ডিত বাচ্চাদেরকে পড়ায় ঠিকই অথচ সামান্য ফোরের অঙ্কই পারে না।ছিঃ! ছিঃ! কি লজ্জার কথা।সূচির মাথা কাটা যায়।আরেকজনের সামনে ইমেজ ধরে রাখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেখানে সূচি তো খুবই ছোট মানুষ।
” সূচি,প্রত্যেকটা জিনিসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে।এসব নির্ভর করবে তোমার পরিস্থিতির উপরে।তোমার অবস্থা অনুযায়ী যে আচরণ করা উচিত ঠিক সেটুকুই তুমি করবে। এই অবস্থায় কিন্তু লৌকিকতা-সামাজিকতা তোমার জন্য নাজায়েজ। কারণ কি জানো? সামাজিকতা দেখানোর মতো অবস্থা তোমার এখন নেই।এখন তোমার একমাত্র কাজ হচ্ছে দুটো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা।
আগে বেঁচে থাকো তারপরে সুদিন যখন আসবে তখন আমাকে তোমার বাড়িতে ডেকে চা খাইয়ে সামাজিকতা দেখিও।বুঝেছো? আজকে সন্ধ্যায় লাবিবের অঙ্ক বইটা নিয়ে আসবে আমার কাছে।দুজনে মিলে সমস্যার সমাধান করব।আশা করছি এক-দুদিনের লেকচারই যথেষ্ট তোমার জন্য।”
সূচি অবাক হয়।মাথা নিচু করে প্রশ্ন করে, ” আপনি কি করে জানলেন অন্তু ভাই?”
” লাবিব বলছিলো তুমি ভগ্নাংশের অঙ্কগুলো করাচ্ছো না।সামনেই ওর পরীক্ষা।তখনই বুঝলাম।তুমি নিজের সমস্যা আমার কাছেই বলতে পারো সূচি।তুমি আমার কাছে আমার স্টুডেন্টদের মতোই।শিক্ষক হিসেবেই দেখতে পারো আমাকে।আর পৃথিবীতে এই এক জাতির কাছে লজ্জা পেয়ে লাভ নেই।যত লজ্জা পাবে ততোই লস।”
সন্ধ্যার মুখেই বই-খাতা বগলে করে বসার ঘরে চেয়ার টেনে অন্তুর মুখোমুখি বসলো সূচি।সেদিন সন্ধ্যায় একটা কান্ড ঘটেছে।শান্ত বরাবর সন্দেহবাতিক অস্থির চিত্তের মানুষ।সূচিকে সে সন্দেহই করে।অন্তুর মুখোমুখি সূচিকে বসতে দেখেই ধা করে পায়ের রক্ত উঠে গেল মাথায়।কিন্তু ভদ্রতার পর্দা খসিয়ে সূচিকে কিছু বললো না।বললো লাবনীকে।ঘরের মধ্যে চেপে ধরলো বউকে।
” আমি তোর কোনো কাজ-কারবার বুঝতে পারছি না লাবনী।তুই কি মানুষ? যার ঘরে এমন জোয়ান দেবর আর স্বামী,সে কী করে একটা সোমত্তা মেয়েকে ঘরে রেখে রেখে তুনুতুনু করতে পারে? সংসারে আগুন লাগানোর ইচ্ছা তোর?তুই কি অমানুষ?”
” অমানুষ কি না জানি না কিন্তু তোর মতো পাষাণ না।এটা যদি তোর ছোট বোন হতো তখন কী করতি? ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারতি?”
তেতে উঠে শান্ত।বউয়ের কাঁধ চেপে ধরে হুঙ্কার ছাড়ে, ” আমি তোর মতো মাদার তেরেসা না বেয়াদব।সবাইকে আমি মা-বোন ভাবি না।”
” আমিও তোর মতো স্বার্থপর না বেয়াদব।আমি একটা মেয়েকে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারি না।বলেছি তো,জানুয়ারিতে চলে যাবে ও।ততোদিন তোর সহ্য হয় না?”
রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় লাবনী।সূচিকে অন্তু তখন মিশ্র,প্রকৃত ও অপ্রকৃত ভগ্নাংশ বোঝাচ্ছে।ভাবখানা এই পৃথিবীর কোনো কিছুতে ওর আর কোনো মনোযোগ নেই।সূচির গা গুলিয়ে আসছিলো।চোখে ঘোলা দেখছিল উগলে আসা কান্নার জন্যে।অন্তু সেদিকে পাত্তাও দিলো না।কেবল সূচিকে বিদায় দেওয়ার আগে বললো,
” সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট বলতে একটা কথা আছে সূচি।আমার কাছে এই টপিকের উপরে খুব সুন্দর একটা বই আছে।আজ রাতে এটা তুমি পড়বে।তোমার জন্য অত্যাবশ্যক এটা।বেঁচেই যখন আছো তখন যেনো-তেনোভাবে বাঁচবে কেন? যোগ্যতা ছাড়া এখানে কেউ বাঁচতে পারে না।”
এরপর থেকে অন্তুর কথাগুলো মাঝে মাঝে ভাবতো সূচি।লাবনী হচ্ছে আরেক অভিভাবক।দুজনে একসাথে সময় কাটানোর সময় বড় বড় লেকচার দিতো লাবনী।চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দার্শনিকের মতো বলতো, ” খারাপ সময় থাকবেই সূচি।আজকে আমি যেই লাবনী তোমার সামনে বসে আছি আগে কিন্তু এই লাবনী ছিলাম না।পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে পরিস্থিতি কম দেখিনি।যখন বিয়ে হয়েছে তখন আমরা দুজনেই ছিলাম বেকার।দুটো বেকারের সংসারের কষ্ট ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না।অথচ আজ দেখো,আমার ব্যাংক-ব্যালেন্সের হিসাব জানলে তুমি অবাক হবে।মেঘ কেটে সূর্য ঠিকই উঠে।ঝিমিয়ে গেলে প্রথম সূর্য দেখবে কী করে? সূর্য দেখার জন্যও তো পিঠ টান করে বসে থাকতে হবে। মেরুদন্ড ব্যাথা হয়ে যাবে।তা যাক,কষ্ট ছাড়া কে কবে সুখ পেয়েছে বলো? মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছো বলেই যে পড়েই থাকতে হবে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়।উঠে দাঁড়াও,দেখবে নতুন করে হাঁটার আনন্দ নব জন্মের চেয়ে বেশি সুন্দর।”
সূচি তো কথাগুলো এক কানে সেধিয়ে আরেক কানে বের করে দেয়নি।বরং মাথায় ও বুকে জমিয়ে রেখেছে। তাই তো ও আজকাল খুব ভালো থাকতে শিখে গেছে।খারাপ সময়ে মনের জোর না থাকলে চলবে কেন?
চলবে…