শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ২

0
290

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-২
#হালিমা রহমান

আইডিয়াল স্কুলের সামনে এসে ধীরে-সুস্থে ব্রেক কষলো সবুজ রঙা সিএনজি। গাড়িগুলো গলির মুখেই থামে, ভিতরে যায় না।হাতঘড়িতে সময় দেখলো অন্তু।সাতটা সাতাশ বাজে সবে।এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পেরে মোটেও আনন্দ হচ্ছে না তার।শান্ত ঘর থেকে বের হয় সাড়ে সাতটায়। তার মানে সে আজ এখনো বাড়িতে।ঢাকা শহরের বিশ্রী জ্যাম সবার পরিচিত।তবে সকাল সকাল জ্যাম ঠেলতে হয়নি তাদেরকে। একছুটে গাড়ি চলে এসেছে যাত্রাবাড়ি। আজ ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকে থাকতে পারলে ভালো হতো।দুর্ভাগ্য আর ভালো লাগছে না অন্তুর।

” নামো সূচি।”

সূচি হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছিল।দু-তিনবার ডেকে ঘুম ভাঙাতে হলো ওর।গাড়ি থেকে নেমে পিচঢালা রাস্তায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জিজ্ঞেস করলো, ” চলে এসেছি?”

” হুম,এসো।”

গলিটা লম্বা তবে খুব একটা চওড়া না।বড়জোর তিনজন হাঁটতে পারবে হাত ধরাধরি করে।একপাশে সারি সারি টাইলসের দোকান,মুদি দোকান,চায়ের দোকান। হাতের ডান পাশে একটা হোটেলের দেখাও মিললো।বিশাল এক তাওয়ায় পাঁচ-ছয়টা পরোটা একসাথে ভাজছে দোকানি।পরোটা উল্টে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আরো পরোটা বানাচ্ছে।কাজের মাঝে ঘাম চিটচিটে শরীরের বেয়ে পড়া ঘাম দু-হাতে মুছে নিচ্ছে বারবার।কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য। চোখ সরিয়ে নিলো অন্তু।দোকানের পাশেই বিশাল আট তলা বাড়িটা।বছর কয়েকের পুরোনো কালচে সাদা রঙা বাড়ি।বাইরের দেয়াল হরেক রঙা পোস্টারে ছেয়ে আছে।বিশাল মেইন গেট দিয়ে ঢোকার আগে নেমপ্লেটে চোখ যায়।সেদিকে নজর দিলো না অন্তু।বাড়ির নাম ও জানে।দৈত্যের মতো বিশাল এই বাড়িটার নাম
” বিশ্রামাবাস।”

সিঁড়ির গোড়ায় দেখা হলো এক লম্বা-চওড়া ফিটফাট ভদ্রলোকের সাথে। হালকা পায়ে বাইরেই যাচ্ছিলো হয়তো,অন্তুদের দেখে থমকে দাঁড়ালো।ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ” কাকে চাই?”

” আমার ভাইয়া এখানে থাকে।তার কাছেই এসেছি।”

লোকটা গায়ে-গতরে অন্তুর মতোই।বয়সের কোটা হয়তো ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের ঘরে।চেহারায় আলগা গাম্ভীর্য, বয়সের সাথে মোটেই মানাচ্ছে না তা।নেকাবের বাইরে বেরিয়ে আসা সূচির বড় বড় ফোলা ফোলা চোখদুটি তার নজর কাড়লো।আঘাতের দরুন মাত্রাতিরিক্ত ফুলে আছে ওগুলো,দেখলেই খট করে চোখে বাজে।

” কোন ফ্লোরে থাকে আপনার ভাইয়া?”

” সেকেন্ড ফ্লোর।”

“ফ্ল্যাট নং?”

” মনে হয় টু বি।”

” নাম?”

” কাজী শান্ত”– ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিলো অন্তু।বিরক্ত লাগছে এখন।লোকটা নিশ্চিত বাড়িওয়ালা। তাই এতো পোদ্দারি।অন্তুকে নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কিছু ভেবেছে।আশ্চর্য! ওর চেহারা কি চোর-ডাকাত-পকেটমারের মতো?
মনে মনে দাঁত খিঁচিয়ে গালিও দিলো, ” হারামজাদা ব্যাটাছেলে।”

আর কোনো প্রশ্ন এলো না ভদ্রলোকের কাছ থেকে।সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কানে এলো লোকটা গলা উঁচিয়ে ডাকছে, ” তিন্নি, তাড়াতাড়ি আয়।”

কাঠের দরজার সামনে বেল বাজিয়ে দাঁড়াতে হলো অন্তুকে। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করার মাঝেই ওপাশ থেকে দরজা খুলে গেল।দরজার ওদিকে লাবনীর হাসিমুখ, আধখোলা দরজায় মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ” অবশেষে তুমি….

থমকে গেল লাবনী। আগাগোড়া নীল বোরকায় মোড়ানো সূচিকে দেখে চমকে গেল পুরোদমে।মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।চিনতে সময় লাগলো না , কাল শান্তর মুখে গ্রামের ঝামেলার কথা শুনেছে ও।বিস্ময়ের রেশে সূচির দিকে আঙুল হেলিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলো, ” এটা?”

” সূচি,ফয়সালের বউ।আগে ঘরে ঢুকতে দাও ভাবি,তারপরে সব প্রশ্ন।”

পুরো দরজা খুলে ওদেরকে ভিতরে ঢুকতে দিলেও বিস্ময়ের রেশটা কাটলো না লাবনীর।দরজায় ছিটকিনি তুলতে তুলতে বললো, ” তোমার ভাই এখনো বাসায় অন্তু।”

” জানি।”

শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এলো লাবিব।চাচার বিশেষ অনুগত ভক্ত সে।একগাল হেসে অন্তুর কোমড় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে ধরতে চড়া গলা বাবাকে ডেকে বললো, ” বাবা,চাচ্চু এসেছে।”

” এই তো আসছি।”

অফিসের জন্য পুরো তৈরি হয়ে গেছে শান্ত।বেরিয়ে পড়বে এখনি।হাসিমুখে বসার ঘরে পা দিতেই মুখের রঙ উবে গেল।অন্তুর পাশে দাঁড়ানো সূচিকে দেখে পিত্ত জ্বলে গেল রাগে।চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মুহূর্তেই।মেয়েটাকে না চিনলেও বুঝতে পারছে এই ফয়সালের বউ,ও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা প্রধান আসামী।উত্তেজনায়, রাগে,ক্ষোভে কপাল চেপে ধরলো শান্ত।চিড়বিড়ানো রাগে অতিষ্ঠ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” আমি জানতাম,জানতাম তুই আমার কথা শুনবি না।ছোটবেলা থেকে তুই এমন ঘাড়ত্যাড়া। মানুষ হবি না জীবনে? সারাজীবন অমানুষই থাকবি?”

” ভাইয়া তুমি আগে আমার কথাটা শোনো।আমার আর কোনো রাস্তা ছিল না। ওকে সাথে আনতেই হলো।”

অন্তুর কথায় রাগ কমলো না শান্তর। বরং চড়চড় করে বেড়ে গেল।আঙুল তুলে ধমকে ধমকে বললো,
” ঢং করিস তুই? ওকে আনতেই হলো! কেন তুই কি ওর অভিভাবক? ফয়সালের সাথে নাহয় ঝামেলা হয়েছে,ওর বাবা-মার কী হয়েছে? মরে গেছে সবাই।মেয়ের দায়িত্ব তারা নিতে পারলো না? তুই জনদরদি হয়ে গেছিস? ঝামেলার গন্ধ পেয়েই ওমনি আটকে গেছিস, তাই না? জানোয়ার।”

আরেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলো অন্তু।মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ” তুমি আমার কথাটা তো শোনো আগে।পুরো ঘটনা শুনে তারপর..

” একদম চুপ কর তুই।কী বলবি? আর কী বলার আছে? তুই ভাবতে পারছিস কত বড় ভুল করেছিস? এতোক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই জেনে গেছে ও তোর সাথে পালিয়ে এসেছে।কী বলবে লোকে? বলবে,কাজী বাড়ির বউ চাচাতো ভাসুরের সাথে পালিয়ে গেছে।ছিঃ! ছিঃ! আমি ভাবতেও পারছি না আমার ছোট ভাই আমারই চাচাতো ভাইয়ের বউকে ঘর থেকে নিয়ে এসেছে।সহজ বাংলায়,ভাগায়ে নিয়ে আসছে।ছিঃ!”

” আহ! শান্ত তুমি থামো। আগে অন্তুর কথাও শুনতে হবে তো।এক জিনিস তুমি উল্টেপাল্টে আরেকভাবে বলছো।অন্তুর সাথে তো মেয়েটার প্রেমের সম্পর্ক না।ওরা কি প্রেমের টানে ঘর ছেড়েছে নাকি? আজব! তুমি তাহলে এভাবে বলছো কেন?এই লাবিব ঘরে যা।তোর এখানে কী? বড়রা কথা বলছে দেখছিস না?”

লাবিব দৌড়ে পালিয়ে যেতেই সূচির দিকে নজর দিলো লাবনী।আগের মতোই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অন্তুর পাশে।কিছুই বলছে না।নিচু করে রাখা মুখটাতে নেই বিশেষ ভাবনা।আধখোলা চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় ও আসলে কিছু শুনছেই না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে ঘোড়ার মতো।চোখ দুটো একটু বেশিই ফোলা। কৌতূহল জাগে লাবনীর।ও দুটো ওমন ফুলে আছে কেন?

” ভাবি তুমি একটু বোঝাও তো ভাইয়াকে।আমার কাছে দুটো অপশন ছিল।হয়তো ওকে মরতে দেখতে হতো নয়তো বাঁচাতে হতো।আমি তাই করেছি।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা মানুষকে কী করে মরতে দেখতাম আমি? ভাইয়া কেন বুঝতে পারছে না বলো তো?”

” অন্তু ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলো।আর এই যে, তোমার নাম কী? তুমিও বসো।”

” লাবনী একদম মাদার তেরেসা হওয়ার চেষ্টা করবা না।তুমি ঘরে যাও,এখানে তোমার কোনো কাজ নেই।আর অন্তু, তোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরেকজনের মৃত্যু দৃশ্য দেখতে হবে কেন? হারামজাদা তুই তোর মতো চলে আসতি।ও তোর দায়িত্ব না।ওকে বাঁচানোর দায় তোর না।তুই তোর মতো চলে আসলি না কেন? তুই আবার অযুহাত দিচ্ছিস,ফাজিল।এক্ষনি বের হবি ঘর থেকে।এমনিই এক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছিস আর কোনো ঝামেলা আমি সহ্য করব না।তুই এই মেয়েকে নিয়ে এই মুহূর্তে ঘর থেকে বের হয়ে যাবি।পোদ্দারি করে যেভাবে এনেছিস সেভাবে ফিরিয়ে দিয়ে আসবি।তারপরেই এই ঘরে তোর জায়গা মিলবে,তার আগে না।সবসময় তোমার খামখেয়ালি আমি সহ্য করব না।এই মেয়ে সাথে থাকলে আমার ঘরে তোর জায়গা নাই।ভাই তুই নিজের রাস্তা মাপ।”

একদফা গর্জে থামলো শান্ত।সে আত্মকেন্দ্রিক, শান্তিপ্রিয়, হুজুগে মানুষ।সূচিকে তার সহ্য হবে না এটাই স্বাভাবিক।তবে নিজস্ব অস্তিরতার বলয় ভেদ করে ছোট ভাইয়ের দিকে ভালোভাবে চেয়ে দেখলে বুঝতো,তার উত্তেজনায় রীতিমতো আহত হয়ে উঠেছে অন্তু।মেঘলা আকাশের মতোই মুখ হয়ে উঠেছে থমথমে।কিছুক্ষণ আগে সূচির হাত মুঠি থেকে ছেড়েছিল,এখন আবার তাই শক্ত করে ধরলো।আরেক হাতে ব্যাগের হাতল ধরে সূচির দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললো, ” চলো সূচি।”

শান্তকে একটা কথাও না বলে দু-পা বাড়িয়েই দিয়েছিল সামনে,পথ আগলে দাঁড়ালো লাবনী।কাতর গলায় বললো, ” সবাই মিলে রাগ করলে চলে অন্তু?”

” আমি রাগ করছি না বড় ভাবি।আমার ভাইয়ের কথা শুনেছো? সে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে আমার যন্ত্রণায়।আমার পুরো কথাও শুনতে রাজি না ভাইয়া।কাল রাত থেকে আমার অবস্থাটা কী হয়েছে তা আমার মুখের দিকে তাকালেই বুঝবে।আমার বড় ভাইয়ের শুধু বয়সটাই বেড়েছে,বোধশক্তি এখনো সেই দশ বছর আগের মতো।কতবার বললো বেরিয়ে যেতে! যাব,আর একটা মুহূর্ত তোমাদেরকে বিরক্ত করব না।”

” কোথায় যাবে তুমি? বড় ভাই একটা কথা বললেই এভাবে রাগ করতে হয় না।একটা অস্বাভাবিক কাজ করেছো,তার ফল তো কিছুটা ভোগ করতেই হবে। তোমার ভাইয়ের অবস্থাও বুঝি, তোমার অবস্থাও বুঝি।দেখি যাও,যেয়ে বসো।ওর নামটা এখনো বললে না আমাকে।”

” সূচি।”

অন্তুর মুঠো থেকে সূচির হাতটা ছাড়িয়ে নিলো লাবনী।সূচির শীর্ণ হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আঁতকে উঠলো।সূচির দিকে চেয়ে বিস্মিত গলায় বললো, ” তোমার দেখছি অনেক জ্বর! দাঁড়িয়ে আছো কীভাবে?দেখি নেকাব খোলো।”

সূচির হোলদোল নেই।সেকেন্ড কয়েক অপেক্ষা করে নিজেই খুলে দিলো লাবনী।দু-পাশের পিন খুলে আরেকদফা চমকে উঠলো।সূচির সারা মুখে আঘাতের চিহ্ন।নাক-গাল ফুলে আছে,নাকের নিচে জমাট বেঁধে আছে শুকনো রক্ত। কপালের পুরো আঘাতটা এতোক্ষণে দেখা যাচ্ছে।বামপাশে প্রায় কনিষ্ঠ আঙুলের সমান করে কাটা।এইটুকু একটা মেয়ের মুখে এতো আঘাত মানাচ্ছে না।আহা! কে যেন ইচ্ছে করে বিশ্রীভাবে ঘেটে দিয়েছে ওকে।
অস্ফুটে প্রশ্ন করলো লাবনী, ” তোমাকে এমন করে কে মারলো? ফয়সাল? দেখি এসো, তুমি আমার সাথে এসো।জ্বরটা একটু মেপে দেখি।”

” লাবনী! পোদ্দারি করবে না বলে দিচ্ছি।অন্তুকে বেরিয়ে যেতে দাও।অসভ্য ছেলে দোষ করেছে।ক্ষমা না চেয়ে আবার এই অচেনা শহরে রাগ করে ঐ মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে! বেরিয়ে যাক।কোন ঘাড়ত্যাড়া অসভ্যের জায়গা নেই আমার বাড়িতে।”

শান্তর কথায় বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে সূচিকে নিয়ে রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট রুমটাতে চলে গেল লাবনী।ছোট একটা রুমে একটা টেবিল,একটা খাট।আর কিছুই নেই।দরজা ভেজিয়ে সূচির দিকে চেয়ে নরম গলায় বললো, ” বোরকা খোলো সূচি।”

টেবিলের উপর থেকে থার্মোমিটার খুঁজতে খুঁজতে সূচির বোরকা খোলা শেষ।গায়ে এক সাইজ ছোট একটা কালো রঙা থ্রি-পিস।হাঁটুর উপরে উঠে যাওয়া আঁটসাঁট কামিজটা যেন গিলে খাচ্ছে মেয়েটার শরীর।থার্মোমিটার ঠিক জায়গায় গুজে দিতে দিতে জামার বাইরে বেরিয়ে আসা সূচির দেহাংশে সচেতন চোখে নজর বুলিয়ে নিলো লাবনী।হাতে জায়গায় জায়গায় চওড়া চওড়া দাগ।গলার কাছে আঙুলের দাগও নজরে পড়লো।সারা শরীরটার উপরে কে যেন যথেচ্ছা তান্ডবলীলা চালিয়ে গেছে।কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই বাসি ঘামের গন্ধের সাথে আরো একটা উটকো গন্ধ নাকে এলো ওর।পরিচিত গন্ধ,রজঃস্বলা অবস্থায় এই গন্ধটা নিজের শরীর থেকেও আসে। কয়েক সেকেন্ড থেমে কিছুটা সংকোচ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি কি এখনই গোসল করবে সূচি?”

উপর-নিচে মাথা দোলায় সূচি।

” ঠান্ডা পানি ঢালার দরকার নেই।তুমি বসো, আমি কুসুম গরম পানি দিচ্ছি।আমার জামা হবে না তোমার।শাড়ি পরতে জানো?সুতির শাড়ি পরতে পারবে?”

” পারব।”

” বসো তাহলে।”

রুম থেকে বেরোতেই দুই ভাইয়ের দিকে চোখ গেল।একজন সোফায় বসে আছে কপাল চেপে,আরেকজন অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে নিচের দিকে চেয়ে।শোবার ঘরের দিকে ছুটতে ছুটতে অন্তুকে উদ্দেশ্য করে আদেশ ছুঁড়লো, ” লাবিবের ঘরে চলে যাও অন্তু।ফ্রেশ হও, তোমার সাথে কথা আছে।”
_____________________________

আজ অফিসের জন্য বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে গেল শান্তর। প্রতিদিন যাওয়ার আগে বাচ্চা দুটোকে আদর করে, লাবনীকে কিছুক্ষণ বিরক্ত করে, তারপর ঘরের দরকারি জিনিসের ফর্দ জেনে অফিসের জন্য ছুটতো।আজ এসব কিছুই হলো না।সবকিছুতে অনাড়ম্বরের ছাপছোপ।মুখখানা হাঁড়িপানা করে ঘর ছাড়ার আগে বউকে ডেকে শাসিয়ে গেছে শান্ত, ” আমি বাড়ি ফিরে ঐ মেয়েকে ঘরে দেখলে তোর খবর আছে লাবনী।তোর জনদরদ ছুটিয়ে দেব।”

লাবনী সেরের উপরে সোয়া সের।স্বামীকে বিদায় দেওয়ার মুখে চোখ পাকিয়ে বলে, ” বাড়ি ফিরে আবার সিনক্রিয়েট করলে তোর খবর আছে শান্ত।রাতের খাবার জুটবে না বলে দিচ্ছি।ঝামেলা করার ইচ্ছে থাকলে বাইরে থেকে খেয়ে আসবি।”

কথার শেষে স্বামীর মুখে উপরে ধাম করে দরজা আটকে দিলো লাবনী।বলা বাহুল্য,তারা এককালের সহপাঠী।সমবয়সীও বটে,তার উপরে লাবনী শান্তর চেয়ে মাস দেড়েকের বড়।ঝগড়া লাগলে বয়সের এই সামান্য ব্যবধানটুকুর জের টেনে সিনিয়রের রূপ নেয় লাবনী।ওদের মনোমালিন্যের ভাষাই তুই-তোকারি।

” তোমার সাথে ওইটা কে ছিল চাচ্চু?”

” তোর একটা খালামনি।”

” আব্বু খালামনিকে দেখতে পারে না কেন?”

” তোর বাপের স্বভাব “– লাবিবের কঠিন প্রশ্নের উত্তর অন্তুকে দিতে হলো না।ঘরে পা রেখেই চোখ-মুখ কুঁচকে উত্তর দিল লাবনী।ছেলের দিকে চেয়ে বললো, ” যা ঘরে যা,শিলার পাশে যেয়ে শুয়ে থাক।একটু পরে স্কুলে যাবি।”

” তুমি সবসময় আমাকে বের করে দাও আম্মু।ভাল্লাগে না,আজকে আমি স্কুলেই যাব না।”– খ্যানখ্যান করে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে গেল লাবীব।খাটের উপরে হাত-পা মেলে শুয়ে ছিল অন্তু।লাবনীকে দেখে উঠে বসলো।খাট থেকে একটু দূরে চেয়ার টেনে বসলো লাবনী।

” ব্যাপারটা কী হলো বলো তো? সূচিকে কোথায় পেলে? ওকে যখন তোমার ভাই মেরেছে তখন কি তুমি সামনে ছিলে? কিছু বলোনি তোমার চাচাতো ভাইকে?জানোয়ারের মতো মেরেছে হারামীটা।”

” আমি ছিলামই না সামনে।সূচির মুখে শুনেছি বাড়িতে নাকি কেউই ছিল না।”

” তাহলে মেয়েটাকে পেয়েছো কোথায়?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চশমা খুলে মুঠোতে নেয় অন্তু।ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয়, ” দুর্ভাগ্যের জেরে নদীর পাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছি।”

একটু দম নিয়ে ধীরে ধীরে পুরোটা বলা শুরু করলো অন্তু।

” আমি কালকে সকালে গিয়েছিলাম ঐ বাড়িতে।তখনই শুনেছি চাচীমা চিল্লাচিল্লি করছে ওর সাথে।সূচির আজ কয়েকদিন যাবৎ জ্বর।জ্বরের ঘোরে একটু বেলা অবধি ঘুমিয়েছিল,তা নিয়েই বকাবকি করছিলো।আমি বড়জোর এক ঘন্টা ছিলাম সেখানে।এরপর চলে এসেছি।আমার ভার্সিটির এক ফ্রেন্ডের নাম ইমন।লঞ্চঘাটের সাথেই বাড়ি ওদের।ওখানে দাওয়াত ছিল।আমি ইমনদের বাড়িতেই ছিলাম।সাড়ে আটটায় লঞ্চ ছাড়ার কথা।চাচীমাকে বলেছিলাম লঞ্চে উঠার আগে একবার দেখা দিয়ে আসব।বিকালের দিকে ঘুমিয়ে গেছিলাম, উঠতে উঠতে সন্ধ্যা হল।ভেবেছি আর যাব না।আটটায় ব্যাগ নিয়ে ঘাটে গেছি,যেয়ে দেখি লঞ্চ নাই।ঘাটের লোকজনের কাছে শুনলাম উদয়পুরের আগের ঘাটে নাকি আমাদের লঞ্চের সাথে আরেক লঞ্চের তুমুল ঝামেলা হয়েছে।মারামারিও হয়েছে কিছুটা।লঞ্চ আসতে আসতে নয়টা বাজবে।হাতে এখনো সময় আছে। ভাবলাম ইমনদের বাড়িতে আর যাব না,চাচীমার সাথে একবার দেখা করে আসি।পূবের বিল দিয়ে গেলে বেশিক্ষণ লাগে না।যেই ভাবা,সেই কাজ।অন্ধকারে পথে একটু দূরে যেতেই দেখলাম ওকে।ঘাট থেকে একটু দূরে একদম নদীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।”

” তারপর? তুমি অন্ধকারে চিনেছিলে?”

” না,প্রথমে তো নজরই পড়েনি।পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় চোখ পড়লো।প্রথনে ভাবলাম অন্য কেউ।হয়তো ওদিকেরই কোনো বাড়ির মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম,মাথায় এলো ঐ মহিলা হয়তো বিপদে পড়েছে।আকাশও মেঘলা হয়ে আসছে,অন্ধকার বিলে বিপদে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।ফোনের আলো জ্বেলে আবার পিছনে গেলাম।সেই আলোতেই দেখলাম ওটা আর কেউ না,আমাদের সূচি।”

অন্তুকে দম নিতে দিলো না লাবনী।আগ্রহী শ্রোতার মতো আবার প্রশ্ন করলো, ” তারপরে?”

” তারপরের কথা বলতে আর ইচ্ছে করে না বড় ভাবি।আমাকে চিনতে পেরে হুড়মুড় করে কেঁদে লুটিয়ে পড়লো।আমার পা জড়িয়ে ধরে সে কি আর্তনাদ! ওকে বাঁচানোর অনুরোধ আমার কাছেই।আমি যতোই ছাড়াতে চাই ও ততোই আরো জড়িয়ে ধরে।বিড়বিড় করে অনেক কিছুই বলেছে কাঁদতে কাঁদতে।বেশি কিছুই বুঝিনি।শুধু এটুকু বুঝেছি ফয়সাল ওকে মেরেছে,ও তাই আত্মহত্যা করতে এসেছে।জানোয়ারটা যে মেরেছে সেটা তো দেখেই বুঝেছি।কিন্তু ওখানে ওকে ধরে বসে থাকলে চলবে না।ফয়সালকে খবর দিতে হবে,বউয়ের দায়িত্ব ওর।সূচিকে ওর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।অগত্যা সূচিকে সাথে নিয়ে আবার ছুটলাম ইমনদের বাড়ি।সূচির জামা-কাপড় ছিল কাদায় মাখামাখি।ইমনের বউকে বললাম পাল্টে দিতে।এদিকে আমি বোধহয় পঞ্চাশটা কল দিয়েছে ফয়সালের ফোনে।যতবার কল দেই ততোবার বন্ধ দেখায়। চাচীমাকে দিলাম,চাচীমা ফোন ধরে না।মেজ ভাবিকে দিলাম,কে যেন ধরলো।ধরে বললো, মেজ ভাবি ঘুমায়।টেনশনে পরে ভাইয়াকে কল করলাম।ভাইয়ার অবস্থা তো জানোই।উল্টো আমাকেই অস্থির বানিয়ে ফেললো।টেনশনে মাথা কাজ করছিল না।কাউকে ফোনে পাচ্ছি না।পরে ভাবলাম ইমনের বাড়িতে সূচিকে রেখে আমি ফয়সালকে খুঁজতে যাব।এদিকেও বিপদ,এই কথা শুনেই ইমন বেঁকে বসলো।ও কিছুতেই সূচির দায়িত্ব নেবে না,কিছুক্ষণের জন্যেও না।ওর কথায় অবশ্য যুক্তি আছে।আমাকে না পেয়ে মেয়ে যদি আত্মহত্যা করে বসে তখন ও কী করবে? দায় তো ওর না।সূচির পাগলামি দেখেছে একটু একটু। যেভাবে কাঁদছিল,বিলাপ করছিল অঘটন ঘটানো অস্বাভাবিক কিছু না।বসার ঘরে বসেই ওর সাথে বাক-বিতন্ডা চলছিল আমার।বারবার বুঝিয়েছে আমি ফয়সালকে ডেকেই চলে আসব,বেশি সময় লাগবে না।ইমন ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি।কিছুতেই আমাকে ছাড়া একা সূচিকে ও বাড়িতে রাখবে না।আমার গলাও উঁচু হচ্ছিলো,ইমনও চড়া গলায় বিরোধিতা করছিল।এমন সময় ওর বউ দৌড়ে এসে খবর দিলো সূচি খুঁটির সাথে ওড়না প্যাঁচাচ্ছে।ছুটে গেলাম,যা ভেবেছি ঠিক তাই।আমাদের কথা-বার্তা শুনেছে হয়তো,তাই আবার ফাঁসি দিতে গেছে।ইমনের বউ একটা জামা পরিয়ে দিয়েছে তার ওড়না দিয়েই ফাঁস দিচ্ছে।অর্থাৎ, সে মরতে পারবে কিন্তু ও বাড়িতে ফিরতে পারবে না।এরপরে আমি আর কী করতে পারতাম বড় ভাবি? তুমিই বলো? ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো রাস্তা ছিল আমার? ওকে চোখের আড়াল করলেই মরতো।আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম? তুমিই বলো,এটা করা যায়?”

” তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি।কিন্তু একটা কথা বলো অন্তু,ওর বাবা-মা তো ছিল।স্বামীর কাছে আশ্রয় না পেলে সেখানে যাবে।মরতে গেছে কেন?”

” আমি কিছুই জানি না ভাবি।শুধু নিজের চোখে যা দেখেছি তাই বলেছি।মনে হচ্ছে সকালে আমি চলে আসার পরে বড় কোনো ঝামেলা হয়েছে।নয়তো ফয়সালই বা কেন এতো মারবে বউকে?”

” সেটাই তো।আচ্ছা, তুমি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসো।আমি সূচির কাছে যাই।এখনো মেয়ের শরীরে একশ তিন জ্বর।ও যে এতোকিছুর মাঝে এখনো সজ্ঞানে বেঁচে আছে এজন্য ধন্যবাদ।”

উঠে চলে যাচ্ছিলো লাবনী।পিছন থেকে কিছু একটা ভেবে আবার ডাকলো অন্তু।

” বড় ভাবি”

” হুম।”

” কাল বিরবির করে সূচি বারবার বলছিল ফয়সাল ওকে তালাক দিয়েছে।”

“তাই নাকি!”

” হ্যাঁ, কিন্তু আমার কেন যেন বিশ্বাস হলো না।তুমি একটু ভালোভাবে জিজ্ঞেস করো তো।আমার মনে হলো তালাকের ব্যাপারটা সূচি বানিয়ে বলছে।মেরে-ধরে তালাক দেওয়ার মতো ছেলে তো ফয়সাল না।তুমি একটু জেনে নিও।”

” ঠিকাছে।”

লাবনী বেরিয়ে গেলে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো অন্তু।টানা তিন-চার ঘন্টা না ঘুমালে ও হয়তো আজ বাঁচবেই না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here