শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১

0
653

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#(পর্ব-১)
#হালিমা রহমান

” একটি শোক সংবাদ,একটি শোক সংবাদ।যাত্রাবাড়ি প্রেমনগর নিবাসী…

চট করে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।সকাল সকাল কান পেতে শোক সংবাদের শেষ অবধি শোনার ইচ্ছে ছিল লাবনীর। কিন্তু এলাকার নাম শুনেই মন খিঁচড়ে গেল। এই গলিটার নাম কে যে প্রেমনগর রাখলো! এই কয়েক মাসে এদিকের প্রায় অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে ওর।সিলেট থেকে এসে ওরা এখানে আস্তানা গেড়েছে বছরের শুরুতে।আশপাশের মানুষজন বেশ বন্ধুসুলভ। বাচ্চাদের স্কুলটাও ভালো।দোকানদার, ফেরিওয়ালাদের মুখে মধুর অভাব নেই।কোনো দরকারে ঘরের বাইরে পা রাখলেই ” ভাবি কী লাগবে,কী লাগবে” বলে পাগল করে দেয়।সবকিছু বেশ ঠিকঠাক।কোনোকিছু নিয়ে অভিযোগের সুযোগ নেই শুধু এই এলাকার নামটা বাদে।প্রেমনগর! হাহ! কেমন অদ্ভুত এক নাম। রোমান্টিকতায় ভরপুর এই নামটা বাচ্চাদের মুখে শুনলে আরো বিরক্ত লাগে।অকারণেই ধমক দিতে ইচ্ছা করে।অন্য বাচ্চাদেরকে কিছু বলতে না পারলেও নিজের ছানা দুটোকে কিছুতেই ছাড় দেয় না। লাবিব,শিলার মুখে এলাকার নাম শুনলেই কান টেনে দেয়। চোখ পাকিয়ে শাসনের সুরে বলে, ” এটা যাত্রাবাড়ি, প্রেমনগর না।বুঝেছিস?”

লাবনীর সকাল কাটে মহা ব্যস্ততায়। শান্তর অফিস সকালে। সাড়ে সাতটার মাঝে বেরিয়ে যায়।বাচ্চারা বেরোয় নয়টায়।ওদেরকে বিদায় করার আগেই নাস্তাটা বানিয়ে রাখতে হয়।দুই বাচ্চার আবদারের শেষ নেই।শান্তটা আরো ছেলেমানুষ। নিত্যদিন রুটি-ভাজি,ডিম সিদ্ধ এদের ভালো লাগে না।তাই রাতেরবেলায় সকালের মেনু ঠিক হয়ে যায়।আজ সকালে পরোটা হলে কাল ডিম-খিচুড়ি।পরশু হয়তো আবার নুডলস অথবা চিকেন স্যুপ। তার পরদিন আবার দেখা যাবে বাপ-ছেলে-মেয়ে তিনজনেই পুরোদস্তুর বাঙালি। সকালে থাকবে মাছ ভাজা,গরম ভাত, তার সাথে ভাজা পিঁয়াজের আলু ভর্তা। তার পরেরদিন আবার অন্যটা। কোনো একদিন এদের মর্জিমাফিক নাস্তা না বানালেই হয়েছে, বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।শেষে পিঠের উপরে দুটো কিল-চড় মেরে খাওয়ানো যায় ঠিকই।কিন্তু কিছুক্ষণ পর হয়তো দেখা যাবে লাবিব গড়গড় করে বমি করে পেটের খাবার ফেলে দিচ্ছে অথবা শিলার পেট খারাপ হয়ে যাচ্ছে।জোর করে কিছু খাওয়ালেই এই এক সমস্যা। এদের পেটে সয় না। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আর পারা গেল না।

ভাজা ডিমগুলোকে তেলের কড়াই থেকে তুলে ডাইনিংয়ে ছুটে এলো লাবনী। দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে লাবিব-শিলা ঝিমাচ্ছে। সোয়া আটটার আগে ঘুম ভাঙে না এদের।আজ খুশির চোটে উঠেছে সাড়ে ছয়টায়। অনভ্যাসে চোখ বুজে আসছে দুটোর।দু-হাতে চোখ রগড়ে আবার বসছে মেরুদণ্ড সোজা করে।

” এই নাস্তা খা। নাস্তা খেয়ে যেয়ে শুয়ে থাক।”

” চাচ্চু কখন আসবে?”

” একটু পরে।তোরা যেয়ে ঘুমা,অন্তু এলে ডেকে দেব।”

দুটো প্লেট টেনে একটাতে লাবিবের খাবার বেড়ে দিলো লাবনী।শিলার বয়স কম বলে ওকে একা হাতে খেতে দেয় না। মেয়েটা এক প্লেট ভাত শেষ করতে এক ঘন্টা লাগায়।
ডাইনিংয়ের পাশেই ওদের শোবার ঘর।চার রুমের মাঝারি একটা ফ্ল্যাটে আসবাবের ফাঁক-ফোকড়ে শান্তিতে হাঁটা দায়।একটু দৌড়াদৌড়ির উদ্যোগ নিলেই কাঠের ভারী জিনিসপত্রের সাথে বাচ্চারা হোঁচট খেয়ে পড়ে। তবে বাচ্চাদের চেয়ে বেশি হোঁচট খায় ওদের বাবা।সময়ে-অসময়ে খাট-সোফার সাথে ধাক্কা খেয়ে শান্ত চেঁচিয়ে ঘোষণা দেয়, ” লাবনী, এই মাসেই বাড়ি ছাড়ব।আরো বড় ঘর না হলে চলছেই না।”

শোবার ঘর থেকে ভেসে আসছে শান্তর পায়ের শব্দ।সে যখন হাঁটে তখন ধু্পধাপ শব্দ হয়।দূর থেকে মনে হয় হাঁটছে না লাফাচ্ছে।কাজী শান্ত,কাজী বংশের বড় ছেলে।তবে গায়ে-গতর অথবা বয়সেই সে বড়।মন-মর্জিতে সে আজো ছেলেমানুষ। লাবনীর গুতোগুতি ও বাচ্চা দুটো হওয়ার পরে জোর করে ভাব-গাম্ভীর্যের মুখোশ মুখের উপরে টেনে এনেছে বটে কিন্তু সময়ে-অসময়ে তা আবার খসে পড়ে যায়।শান্ত ভীষণ হুজুগে,স্বভাবে সন্দেহ প্রবণতা খুব বেশি।কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবসময় দোটানায় ভোগে, এটা না ওটা করে সময় নষ্ট করে।শেষে বিরক্ত হয়ে তার ছোট থেকে বড় প্রায় সব সিদ্ধান্ত লাবনী নেয়।শান্ত অস্থির চিত্তের মানুষ।এক জোড়া জুতো ছিঁড়লেও সে হায় হায় করে।বিচারকের দৃষ্টি মেলে বউয়ের ছোট-খাটো দোষ ধরে আবার লাবনীর একটুখানি যত্নে খুশি হয়ে প্রাণখোলা হাসিতে ভরিয়ে দেয় ঘর-দোর।রঙিন রঙ্গমঞ্চে এ এক আজব কিছিমের মানুষ।
শোবার ঘরের দরজায় টাঙানো নীলচে সাদা পর্দা সরিয়ে কচ্ছপের মতো মাথা বের করলো শান্ত।চোখে-মুখে ঘুম ভাঙার ছাপ।গলা বাড়িয়ে বললো,
” অন্তু ফোন দিয়েছে?”

” উঁহু।”

বউয়ের ছোট্ট উত্তরে চিন্তার ছাপ দেখা দিলো শান্তর মুখে। পর্দার আড়াল থেকে সারা শরীর বের করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো, ” এখনো আসছে না কেন বলো তো? ওদিকে আবার ঝামেলায় জড়িয়ে গেল না তো? ছেলেটা যা গোঁয়ার।এতোবার করে কাল রাতে বললাম ঝামেলায় জড়াতে না, শুনবে আমার কথা? আরেজনের সমস্যায় নিজেকে জড়িয়ে লাভ আছে?”

পরোটার ছেঁড়া অংশটুকু শিলার মুখে গুজে দিলো লাবনী।স্বামীর দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ” তোমার মতো চোখ বুজে সবাই চলতে পারে না।চলতে পারলে বেঁচে যেতো। অন্যের সুখ-দুঃখকেও মাঝে মাঝে নিজের বলে ভাবতে হয়।তাছাড়া ফয়সাল,ফয়সালের বউ তো তোমাদের পর না।ওদের একটা ঝামেলায় যদি অন্তু জড়িয়েই যায় তো চোখ বুজে থাকা সম্ভব? সবাই কি কাজী শান্ত?”

রুষ্ট হয় শান্ত।কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়, ” তোমার মতো সবাই মাদার তেরেসা হয়ে যায়নি।অন্যের দুঃখ-কষ্ট আমার মনে দাগ কাটে না,তোমার মতো আমার মন খারাপ হয় না।আমার পৃথিবী ছোট,গন্ডিটা একটুখানি।আমার চিন্তা-ভাবনার জন্যে তুমি,শিলা-লাবিব আর অন্তু আছে।তোমাদের বাইরে অন্য মানুষের জন্য আমি ভাবতে পারি না।অন্যদের বিষয়ে মাথা গলানোর প্রয়োজন মনে করি না।তাই আমাকে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই,বুঝেছো?”

চূড়ান্তভাবে মেজাজটা চটে গেল লাবনীর। এই একটা জায়গায় ওদের পার্থক্য। শান্ত নিজের গন্ডির বাইরে অন্যদের নিয়ে ভাবতে নারাজ।এদিকে ছোট থেকেই লাবনী পেয়েছে উদার মন-মানসিকতা। রাস্তার অন্ধ-বধির, আসল-নকল ফকির দেখলেও ওর প্রাণ কাঁদে। হাত ভরে দান করতে ইচ্ছা হয়।রাস্তার কানা-খোঁড়া, অসুস্থ,সুন্দর-অসুন্দর কুকুর-বিড়ালকে সযত্নে কোলে তুলে নিজের কাছে নিয়ে আসতে ইচ্ছা হয়। ছোট ছোট পথশিশুদেরকে লাবিব-শিলার মতো আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয়। প্রবল আত্মকেন্দ্রিক স্বামীর সাথে এতো বছর একসাথে, এক ঘরে থাকার পরেও ইচ্ছেগুলো মরেনি এখনো।বরং বয়সের সাথে সাথে দিন দিন এগুলো বট গাছের মতো ডাল-পালা ছড়িয়ে বাড়ছে। অপূরণীয় স্বপ্নেরা সময়ে-অসময়ে মনের কোণে খচ খচ করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়।
সকাল সকাল তর্কাতর্কি করতে ভালো লাগে না।তাই স্বামীর কথার বিপরীতে কিছু না বলে রাগ তুললো মেয়ের উপরে। দু-আঙুলে শিলার মাথা ঠুকে দিলো লাবনী।

” একটু তাড়াতাড়ি খা অমানুষ। তোকে ধরে বসে থাকলে চলবে না।আমার আরো অনেক কাজ আছে। তুই বেশি খেলে তোর বাপের কমে যাবে না।সৃষ্টিছাড়া জানোয়ার হচ্ছিস দিন দিন। ঐ বড় হলে বাপের মতো স্বার্থপরই হবি।”

শান্ত না থাকলে হয়তো মায়ের ভয়ে চুপ মেরে থাকতো শিলা।কিন্তু এখন সেই দুঃসময় নেই।বাবার সামনে তার সাহস আকাশ ছোঁয়। কলিজা ফুলে থাকে বেলুনের মতো। বাবার কাছে তার সাত খুন মাফ।খাবারটুকু দাঁতের ফাঁকে চেপে, মুখের আকৃতি বিকৃত করে, গলায় রঙ-চঙ ফুটিয়ে ভাঙা স্বরে অভিযোগ করলো,
” আম্মু আমাকে খালি মারে আব্বু।”

কথা শেষ হতে না হতেই আরো দুটো কিল পড়লো ওর ছোট্ট পিঠে।সতেজে ধুপধাপ শব্দ করে মেয়ের কাছে ছুটে এলো শান্ত।প্রায় ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করে লাবনীর পাশ থেকে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো।বউয়ের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে শিলার অগোছালো চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে দিতে সান্ত্বনা দিলো,
“কাঁদিস না, এটা তোর শয়তান মা।”

_______________________________

পঁচিশে এপ্রিল,সকাল সাড়ে ছয়টা।ঢাকা শহরের অন্যতম ব্যস্ত ও ঝামেলাপূর্ণ একটি জায়গার নাম সদরঘাট।বুড়িগঙ্গার কালো পানির বুক চিড়ে একে একে বিশাল লঞ্চগুলো ঘাটে এসে থামলে বেশ একটা হৈ চৈ পড়ে যায় ঘাট এলাকায়। ব্যাগ-বস্তা ঘাড়ে-মাথায় অথবা কুলির হাতে সোপর্দ করে,এ ওর পিছনে,সে তার কাঁধের উপরে উঁকি-ঝুকি দিয়ে, দুর্বল বাচ্চা ও বৃদ্ধদের হাতগুলো শক্ত মুঠোতে পুরে, সাবধানে,ধাক্কাধাক্কি থেকে গা বাঁচিয়ে অথবা জনস্রোতে গা ভাসিয়ে, কাঠের তক্তা বেয়ে লঞ্চ থেকে নামার দৃশ্যটি আনাড়ির মনে ভয় জাগানোর মতোই ভয়ংকর।ঢাকা পৌঁছাতে এখন আর আগের মতো দেরি হয় না।নয়া ভোরের শুরু থেকেই বাঁশি বাজিয়ে একে একে দম ফেলতে শুরু করে নির্জীব লঞ্চগুলো। সারা রাত নদীর ওপাড়ের মালপত্তর ও হাজার মানুষ টেনে সাদা রঙা লঞ্চগুলো এখানে এসে বিশ্রাম নেয়। শত শত মানুষের পায়ের ভারে, গায়ের গন্ধে, টার্মিনাল ছাড়ার ব্যগ্রতায়,কুলিদের ব্যস্ততায়,প্লাস্টিকের বোতল কুড়ানি বাচ্চাদের খোঁজাখুঁজিতে সদা অতিষ্ঠ থাকে এই জায়গা।এর উপরে আছে দূষণের যন্ত্রণায় কয়েক বছর আগের মরা নদী বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধ। এক সময়ের সুন্দর যৌবনা নদীর দুর্দশা চোখে পড়ে।অন্তরে ক্লেশ জাগায়।নদীর কোলে জাগা ছোট-বড় শিল্প-কারখানাগুলোর দিকে চেয়ে দেখতে ইচ্ছা করে না,রাগ লাগে।

শক্ত হাতে ব্যাগ ধরে সিএনজির সামনে এসে লম্বা দম নিলো অন্তু।নতুন সূর্য উঁকি দিচ্ছে আকাশের কোণে। শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। লঞ্চ থেকে নামার সময় এই অধম ভীরের মাঝে গা এলিয়ে দিয়েছিল।ঠ্যালা-ধাক্কায় শরীর ঝালাপালা। এসবে অভ্যস্ত নয় অন্তু। লঞ্চ দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারানোর পর থেকে নদী-লঞ্চ-নৌকা এসব বেশ ভয় পায় সে।

” এদিকে আসেন মামা। কই যাইবেন?”

” যাত্রাবাড়ি আইডিয়াল স্কুলের সামনে।”

” আমার গাড়িতেই চলেন তাইলে।”

” কত?”

” সাড়ে তিনশ দিয়েন।”

ড্রাইভারের কথা শুনে বিরক্তিতে হাড়ে হাড় ঠুকে গেল অন্তুর। ফ্যাসফ্যাসে গলায় প্রতিবাদ করে বললো, ” আমি যাত্রাবাড়ি যেতে চেয়েছি,চাঁদে না।তিনশ টাকায় সদরঘাট থেকে চাঁদে যাওয়া যাবে।”

” তাইলে মামীরে নিয়া চাঁদেই যায়েন মামা।ভাড়ার কথা শুনলেই আপনেরা এমন করেন মনে হয় যেন আমরা ভাড়া না,আপনেগো কইলজাডা কাইট্টা দিতে কইছি।”
ড্রাইভারটা ছোকরা গোছের।তরুণ শরীরে টগবগা রক্ত।মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দিতে দেরি হলো না।অন্তুর দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ফেলে অন্য যাত্রীদের দিকে নজর দিলো ছেলেটা।মনের অবস্থা ভালো নয় বলে অন্তুও জবাব দিলো না আর।ব্যস্ত চোখে অন্য গাড়ির খোঁজ করতেই পাশ থেকে ভেসে এলো এক ভারী বয়সী গলার প্রস্তাব, ” আড়াইশো দিলে আমার গাড়িতে চলেন।”

একটু সামনে হেঁটে গেলে বাস পাওয়া যাবে।বাসে গেলে বড়জোর পঞ্চাশ টাকা খরচা। অথবা রিকশায় গেলে সত্তর-আশি টাকায় অনায়াসে যাওয়া যায়।সিএনজির ভাড়াটা খুব বেশি। তবে এই মুহূর্তে ক্ষতির কথা ভাবার সময় নেই।পা দুটো অসম্ভব রকমের ভারী।কোনোমতেই একে টেনে নিয়ে বাস অবধি হেঁটে যাওয়া সম্ভব না।যেকোনো মূল্যে নিরিবিলি বসে গত দশ-বারো ঘন্টার ঘটনাগুলো আরেকবার ভাবতে হবে। কোনো হিসাব মিলছে না,সুতোগুলো সব কাটা।কাটা সুতোর আগাগোড়া মিলিয়ে নেওয়ার জন্যে ভীড়ের বাস মোটেও উপযুক্ত নয়।
অগত্যা লোকসানটুকু মেনে নিলো অন্তু।বাম হাতে ব্যাগ,ডান হাতের শক্ত মুঠিতে সূচির দূর্বল হাতটা পুরে এগিয়ে গেল সিএনজির দিকে।নীল শার্ট পরা বয়সী ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বললো, ” চলেন কাকা।”

” ঐ হমন্দীর পো,এমন ত্যাজ নিয়া গাড়ি চালান যায়?প্যাসেঞ্জারে এক ট্যাকা ভাড়া কইলেও হাসিমুখে শুনতে হয়। বলদের ছাও, রাগ ঘরে যায়া মায়ের লগে দেহাইছ।”

ছোকরা ড্রাইভারটাকে দাঁত কেলিয়ে খোঁচা মেরে গাড়ি ছুটালেন বয়স্ক ভদ্রলোক। বোঝা গেল,দুজনের মাঝে দলাদলিটা আগে থেকেই ছিল।

কালো রঙা সিটে মাথা এলিয়ে দিলো অন্তু।পাশেই বসে আছে সূচি।ছোট সিট, দুজনে পাশাপাশি। দূরত্বটা খুব কম। মেয়েটাকে মোটেও সহ্য হচ্ছে না অন্তুর।সে ঝামেলাহীন, প্রাণখোলা, নিরীহ মানুষ।তার জীবনযাত্রার মুক্ত আকাশে মূর্তিমান বজ্রপাতের রূপ নিয়েছে সূচি।কাল রাতে মেঘনার ধারে হুট করেই সামনে পড়েছে।এই কয়েক ঘন্টায় শুষে নিয়েছে সব স্বস্তি,ভিতরে পুরে দিয়েছে চরম বিতৃষ্ণা। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে দু-চোখ বুজে আসতেই ফট করে প্রশ্ন জাগলো অন্তুর মনে,
” সূচিকে ও কেন এনেছে সাথে? কী করবে মেয়েটাকে নিয়ে? উদয়পুর থেকে রাতের আঁধারে যাকে কুড়িয়ে এনেছে,তাকে সেই একই গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া সহজ? লোকে কী বলবে?”

চোখ বুজেও শান্তি নেই। পকেট থেকে ফোন বের করে অভ্যস্ত হাতে ফয়সালকে কল করলো অন্তু।কাল রাত থেকে এ নিয়ে অন্তত পঞ্চাশবার হলো।প্রতিবার সেই একই ঘোষণা, সেই একই ঘ্যানঘ্যানে যান্ত্রিক সুর— ” সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।অনুগ্রহ করে…

” আমরা কোথায় যাচ্ছি? আর কত দূর?”

” জাহান্নামে যাচ্ছি আমরা।”— কপাল চেপে প্রায় গর্জন করে উঠলো অন্তু।সূচির ভাঙা কন্ঠ,চোখের কোল খরায় অতিষ্ঠ মাটির মতো শুকনো। অন্তুর কথায় কী বুঝলো কে জানে,গাড়ির দরজায় মাথা রেখে আপনমনে বললো, ” আচ্ছা।”

বাস্তবিকই সূচিকে সহ্য হচ্ছে না অন্তুর।শান্তকে চেনে সে।কাল রাতে সূচিকে পাওয়ার পরে নিজের বড় ভাইয়ের কাছে কল করেছিলো। শান্তর এক কথা, যেখানের মরা সেখানেই মাটি দিয়ে আসতে হবে। অযথা ঝামেলায় জড়ানোর কোনো মানেই হয় না।বলা বাহুল্য ভাইয়ের কথা কানে নেয়নি অন্তু।মানবিকতায় ভেসে যেয়ে সূচিকে নিয়ে এলো নিজের সাথে। অবশ্য বলা ভালো একপ্রকারে বাধ্য হয়েছে আনতে।আর যাই হোক,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই আরেকজনের স্বেচ্ছা মৃত্যুর দৃশ্য দেখা যায় না। কিন্তু এখন? সূচিকে নিয়ে শান্তর কাছে দাঁড়ালে তামাশাটা ঠিক কোথায় ঠেকবে তা অনুমান করা কঠিন কিছু না।ওদের দুজনকে হয়তো ঘরেই ঢুকতে দেবে না। ডান হাতের তালুতে চেহারার ঘাম মুছে সমস্যার সমাধান খোঁজে অন্তু। গোটা সূচিই এখন সমস্যা।ওর কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? এ শহর সূচির কাছে অজানা,অচেনা।ব্যস্ত শহরে একলা গাড়িতে ওকে ফেলে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? বেশি কিছু না,গাড়ি থামিয়ে কোনো এক দরকারের কথা বলে টুক করে নেমে যাবে অন্তু।সূচিকে রেখে পালিয়ে যাবে নিজ গন্তব্যে ।এরপরে চোখের আড়ালে মরুক গে সূচি।ও মরলে অন্তুর কী?

বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই ব্যস্ত চোখে দরজার বাইরে চোখ বুলায় অন্তু।মুখ দিয়ে আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ে, ” কাকা,সামনে রাখুন তো।একটু দরকার আছে আমার।”

গাড়ি থামতেই মোবাইলটা পকেটে পুরে ঝটপট নেমে দাঁড়ালো সে।কানে এলো সূচির গলা।স্থির গাড়ির শক্ত দরজায় মাথা পেতে চোখ বন্ধ করে মিনমিনিয়ে বলছে, ” আসতে অনেক দেরি হবে অন্তু ভাই?”

” না,যাব আর আসব।তুমি বসো।”

আগের মতোই চোখ বুজে পড়ে থাকলো সূচি।শরীরের উত্তাপ জাহান্নামের আগুনের মতো।গত কয়েক ঘন্টায় কতবার জ্বর এসে নেমে গেছে তা গুনে রাখেনি। হাত-পা-পিঠের চামড়ায় কেটে কেটে বসে গেছে বেল্টের দাগ।ডান চোখের কোণটা ফুলে আছে।কাল একটা ঘুষি পড়েছিলো এখানে।কপালের বাম দিকে কেটে গেছে খানিকটা।কাল সন্ধ্যায় নিজেকে বাঁচাতে যখন ভারী পানের কৌটা ছুঁড়ে মেরেছিলো স্বামীর দিকে, তখন বিপরীত দিক থেকে ওর দিকেও ফিরে এসেছে ওটা।লেগেছে কপালের বাম দিকে।ফ্যাড়ফ্যাড় করে ছিঁড়ে গেছে কপালের চামড়া।চোখ বন্ধ করে ভাবে সূচি।মাথাটা ঘোলাটে, তবুও কিছু কিছু স্পষ্ট মনে পড়ে।সময়ের ব্যবধানে একটা মানুষ মরতেও পারে,বাঁচতেও পারে।মোটে চব্বিশটা ঘন্টা আগাগোড়া বদলে দিয়েছে ওকে। কতকিছু ঘটে গেল একটা দিনে!সারারাত জ্বরের সাথে লড়াই করে কাল সকালে এসময়ে ঘুমিয়ে ছিল মরার মতো।প্রতিদিনের মতো ভোরের আগে উঠতে পারেনি।দুর্ভোগের শুরু তো সেখান থেকেই।শাশুড়ির গলাবাজি,অন্তুর আগমন,হুমায়রার একটুখানি মানবিকতা,রোমেলা বানুর সাথে বিশ্রি ঝামেলা,কাউকে কিছু না বলে ভূমির বাড়িতে পালিয়ে যাওয়া,শত কান্ডের পরে আবার কাজী বাড়িতে ফিরে আসা,ফয়সালের রাগ-ক্ষোভের নগ্ন পরিচয় পাবার পরে সবকিছু মিটিয়ে অন্ধকার বিলের পথে পা বাড়িয়ে মরতে যাওয়া— সব তো একদিনেই ঘটলো।মাত্র একদিনের জন্য এতোগুলো ঘটনা খুব বাড়াবাড়ি। দু-একটা ঝামেলা কম হলেও হয়তো সূচি আজ উদয়পুরে বেঁচে থাকতো। চব্বিশে এপ্রিল বড়ই লম্বা একটি দিন।যদি শেষ অবধি বেঁচে থাকে তো এই দিনটার কথা ও কোনোদিন ভুলবে না।
চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতেই আলিঝালি ছাড়া ছাড়া কিছু দৃশ্য মনে পড়ে। মনে পড়ে অন্ধকার পূবের বিলের বৃষ্টিভেজা মাটিতে লেপ্টে বসে আকঁড়ে ধরেছিলো অন্তুর দুটো পা। বিস্ময় ও বিব্রতবোধের যন্ত্রণায় অন্তু যত ছাড়াতে চেয়েছে,সূচি ততোই স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে। কাজী বাড়ির এক ছেলের অত্যাচারে মরতে যেয়ে সেই বাড়িরই আরেক ছেলের পায়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে আকুল নিবেদন করেছে, “আমাকে বাঁচান অন্তু ভাই।আমি কিছুতেই মরতে পারছি না।”

তারপরেই বদ্ধ চোখের পাতায় আরেক দৃশ্যের অবতারণা। মনে পড়ে বিল পেরিয়ে এক পুরোনো টিনের বাড়িতে কিছুক্ষণ ছিল ওরা।সাথে আরো দুজন ছিল। কিন্তু ওদের চোখ-মুখ, আকার-আকৃতি কিছুই মনে পড়ে না।শুধু মনে জাগে একটা কথা, মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে সূচি আরেকবার মরতে গিয়েছিল।দ্বিতীয়বার অবশ্য সাহসের অন্ত ছিল না তার।পুরোনো খুঁটির সাথে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েই দিয়েছিল প্রায়, কোথা থেকে অন্তু উড়ে এলো।এবারেও মরতে দিলো না।ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলে সূচির হাত আগলে বললো, “কাউকে খবর দেব না আমি। আমাকে বিশ্বাস করো? বিশ্বাস করলে আমার সাথে চলো। আর মরতে হবে না।”

আর কিছু মনে পড়ে না।রাত কেটে ভোর হলো কখন,বিশাল মেঘনা পাড়ি দিলো কখন, অন্তুর অবস্থা কী হয়েছিল,ওর নিজের অবস্থা কী হয়েছিল—তা কিছুই জানে না।গত রাতটা কেটে গেছে স্বপ্নের ভিতর।শুধু এটুকুই জানে থাকা,না-থাকার মাঝে একপ্রকারে বেঁচে ছিল সূচি।এতো কিছুর পরে এই বেঁচে থাকাটাই কেমন অনধিকার ঠেকে।পরের ঘাড়ে চেপে সত্যিই ওর বেঁচে থাকা উচিত? কে জানে!

ধপ করে পাশে এসে বসলো অন্তু।মুহূর্তেই গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করেছে।পিছনে ফেলে যাচ্ছে অচেনা রাস্তাঘাট,বাড়ি-ঘর, যানবাহন।সাথে আনা পানির বোতল ও এক প্যাকেট বিস্কুট সূচির দিকে এগিয়ে দিলো অন্তু।খসখসে গলায় বললো, ” খেয়ে নাও।”

খাবারের দিকে ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে রইলো সূচি।মনে পড়লো কাল দুপুর থেকে ও অভুক্ত।সারাদিনে খাওয়ার সুযোগটুকু মিলেনি।

” আপাতত এগুলোই খাও।হোটেলে নাস্তা খুঁজেছিলাম,পরোটা কিনতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।সময় নেই এখন।কী হলো? ধরো।”

” দু-পাশের দাঁতে অনেক ব্যাথা অন্তু ভাই।খেতে পারব না।”

অন্তুর কপাল কুঁচকে আসে।

” দাঁতে ব্যাথা!! কেন?”– সেকেন্ড কয়েক ভাবতেই উত্তরটা নিজে নিজেই মুখে জোগায়।অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে,
” ফয়সাল ঘুষি দিয়েছে গালে?”

” কয়েকটা চড়ও দিয়েছে।”

আগের মতোই চুপচাপ গাড়ির দরজায় মাথা ঠেকিয়ে পড়ে রইলো সূচি।ইচ্ছে করলে হয়তো খেতে পারতো। ইচ্ছেটাই হচ্ছে না আর।দূষণের শহর থেকে থেমে থেমে শ্বাস নেয় সে।অন্তুও হেলান দেয় গাড়ির সিটে।মাথা এলিয়ে দিতেই বুঝতে পারে দু-পাশের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে অকারণেই।গাড়ি থেকে নেমেই পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার।কিন্তু বিবেকের দংশনে পারেনি।ভিতর থেকে উথলে এসেছে প্রশ্ন,
পালিয়েই যদি যাবে তো কাল দুই দুইবার মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়েছে কেন? যে একবার বাঁচাতে পারে সে আবার ইচ্ছে হলে মারতেও পারে?
একগাদা অশুভ চিন্তার মাঝেও রজনীগন্ধার মতো এক শুভ্র চিন্তার উদয় হয়েছে মনে।মনে পড়েছে, সূচি কাল সন্ধ্যা থেকে কিছু খায়নি।অমনি কুবুদ্ধিরা পালিয়ে গেল। অন্তুর মানবিকতাবোধ অনেক।দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা খাবার কিনে ফিরে এসেছে গাড়িতে।পালাতে আর পারলো কই?

” সূচি তোমার জ্বরটা কি বেড়েছে?”

” মনে হয়।”

” শরীর অনেক খারাপ লাগছে?”

” বোধশক্তি নেই অন্তু ভাই।ব্যাথা-ট্যাথা বুঝতে পারছি না,চোখ দুটো বুজে আসছে।মনে হচ্ছে আর জেগে থাকতে পারব না।”

আঁতকে উঠলো অন্তু।খুব অনুরোধের সুরে বললো,
” অজ্ঞান হয়ো না প্লিজ।এই মুহূর্তে অজ্ঞান হলে তোমাকে আমি সামলাব কী করে? আরেকটু জেগে থাকো,এই তো কাছাকাছি চলে এসেছি।”

আর শোনা যায় না সূচির গলা।মনে মনে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করে অন্তু, ” শান্ত ভাই যেন বাসায় না থাকে। প্লিজ আল্লাহ,ভাইয়া যেন অফিসে চলে যায়।একটু দয়া করো খোদা।”

নিজের ভাই হাতের তালুর মতো চেনা।সুতরাং সে বাসায় থাকলে জল ঠিক কতটুকু গড়াবে তা এক জানে আল্লাহ,আরেক জানে স্বয়ং কাজী শান্ত।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here