গল্পের নাম : বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ২৭: মিহি_কোথায়?
লেখিকা: #Lucky_Nova
“লজ্জা পাচ্ছ?”
কথাটা কানে আসতেই মিহি চোখ ছানাবড়া করল। কোলের উপর থাকা আঁচলটা চেপে ধরলো শক্ত করে।
আফসোস হচ্ছে। সময় থাকতে কেটে পরলে এমন হত না।
এরোন সোফা থেকে উঠতেই মিহি কাচুমাচু হয়ে গেল। নিচু করে রাখা মাথাটা আরেকটু নিচু করলো।
এরোন ওর সামনে এসে পকেটে হাত গুজে দাঁড়ালো।মিহির দম বন্ধ হয়ে এলো যেনো।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পকেট থেকে হাত বের করে সোফার দুইপাশের দুই হ্যান্ডেলে রেখে মিহির মুখ বরাবর ঝুকলো এরোন।
মিহি তড়িৎ গতিতে মুখটা একপাশে সরিয়ে নিল। কোনোমতে কাঁপা গলায় বলল,”সরুন।”
ওর কথার মধ্যেই এরোন চট করে ওর গালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
এরোনের এহেন কাজে মিহি শিউরে উঠলো। চোখও কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
এরোন পুনরায় পকেটে হাত গুজলো। মুখে স্বভাব সুলভ হাসি।
“কেউ দেখে নি। এত লজ্জা পেও না।” বলতে বলতে দুইপা পিছিয়ে গেল সে।
মিহি তব্দা খেয়ে মাথা নুয়ে বসে আছে এখনো। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে।
এরোন ঘাড় হালকা নুয়ে মিহির মুখোভাব দেখলো। তারপর নিঃশব্দে বড় করে হেসে নিচের ঠোঁটের এক কোণ কামড়ে ধরলো।
মিহির ত মাটি খুড়ে পাতালে চলে যায় যায় অবস্থা।
“আমার ফিরতে রাত হবে। আর ফিরে যেন আমি তোমাকে আমার রুমেই পাই। ভুলেও অন্য রুমে ঘুমাতে যাবা না। বুঝেছো?”
হুমকি না আদেশ বোঝা গেলো না। মিহি বোঝার চেষ্টাও করলো না। আগের শক থেকেই এখনো বেরুতে পারেনি সে।
এরোন এক হাত দিয়ে মাথা হালকা চুলকে দুষ্টুমির ছন্দে বলল, “বের হব আমি। সো, বের হওয়ার আগে একটা গুডবাই কিস ত দিতেই পারো!”
মিহি চমকে উঠলো। কালবিলম্ব না করে চটজলদি উঠে উপরে ছুটলো সে।
এরোন ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর হেসে বেরিয়ে গেল।
?
ডায়নিংয়ে পিনপিনে নীরাবতা। কেউই কথা বলছে না।
একটু আগেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে।
খাওয়া শেষে রুহুল সাহেব মিহির সাথে কথা বলার জন্য ডায়নিংয়েই বসেছেন।
আরোহী রুহুল সাহেবের পাশে বসা। আর আরোহীর মুখোমুখি মিহি। এরিক নেই। ম্যাচ খেলতে চলে গেছে এরোন বের হবার পরেই।
খাবার খাওয়ার সময় রুহুল সাহেব কোনো কথা বলেন নি। এখনো বলতে পারছেন না। বার কয়েক গলা ঝেড়েছেন শুধু। কিভাবে শুরু করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিও হচ্ছে তার। ছেলে করেছেই এমন উদ্ভট কাজ! যার ধাক্কা এখন ওনাকে সামলাতে হবে।
অবশেষে মুখ খুললেন তিনি। বিব্রতকর ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, “আমি খুবই লজ্জিত এরোনের কাজে! ঠিক করে নি সে একদম।”
মিহি চোখ তুলে তাকালো। সেও হালকা বিব্রতবোধ করছে। কি বলবে বা কি বলা উচিত তা বুঝে উঠতে পারছে না।
রুহুল সাহেব বিনম্র ভাবে বলতে লাগলেন, “জেদ অনেক বেশি ওর। তবে মেয়েদের সাথে কখনো খারাপ আচরণ করে নি। সে শিক্ষা আমি দিই নি। তোমার সাথে যে কেনো এমন করলো…। যাইহোক ওর হয়ে আমি তোমার কাছে..।”
“না, না। আপনি কেনো…!” সচকিত হয়ে দুহাত নাড়িয়ে বলে উঠল মিহি।
রুহুল সাহেব স্বাভাবিক ভাবে মিহির দিকে তাকালেন। মিহি আবার মাথা নুয়ে নিলো।
গোপনে একটা নিঃশ্বাস ফেলে একটু সিরিয়াস হয়ে বললেন, “আমাকে সব বলেছে আরোহী। শুনে আমি যতটুকু বুঝলাম তাতে আমার মনে হয়, ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে হলেও আমার ছেলে তোমাকে নিয়ে সিরিয়াস ছিলো। একদম প্রথম থেকেই ছিল। ভালোবাসার নাটকটা করে ঠিক করো নি। তোমার দিদির বরের মত সবাইকে মনে করাটা ঠিক হবে না। বউ পিটানোর অভ্যাস আমার পূর্ব পুরুষদের নেই, আমার নেই, আমার ছেলেদেরও নেই। বরং তোমাকে সারাজীবন আগলে রাখবে সে।”
মিহি আবার চোখ তুলে তাকালো।
“ও রাজনীতির সাথে সেভাবে জড়িত না যেভাবে তুমি মনে করছ। জাস্ট একটা তকমা লাগিয়ে রেখেছে। একটা ক্ষমতা ভাব, এমন। তবে সেটার কোনো অপব্যবহার করে না সে। করলে এতদিনে এ বাড়িতে জায়গা হত না। এভাবে জোর করে বিয়েটা করেও অবশ্য সে ঠিক করেনি। তবে পুরো ব্যাপারটায় আমি ওকে পুরোপুরি দোষ দিতে পারিছিনা। ওইযে বললাম, সে সিরিয়াস ছিলো। মিথ্যাটাকে সত্যি ধরে নিয়েছিলো। তুমিও তাকে অনেকদিন পর্যন্ত মিথ্যা ভাবে বুঝিয়ে গেলে। সে ত সত্যি মায়ায় পরে গেল! এখানে একটু চিন্তা করো, তুমি কি ঠিক করেছো?”
মিহি চোখ নামিয়ে আলতো করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। নিজের ভুলটা হয়তো আঁচ করতে পারছে খানিক।
রুহুল সাহেব নম্রভাবে বলে যেতে লাগলেন, “যত ভয়ই পাও, একজনকে যত খারাপই মনে হোক বা সে সত্যিই খারাপই হোক তার অনুভূতি নিয়ে খেলার ত কোনো অধিকার তোমার নেই! খারাপ মানুষ, ভালো মানুষ সবারই মন আছে। এমনটা করা ঠিক হয়নি মা।”
মিহি দোষী চোখে তাকালো। ভিতরে ভিতরে অনুশোচনা হতে লাগলো ওর।
মৃদু হেসে রুহুল বললেন, “যাইহোক তোমার পরিবারের সাথেও তো কথা বলতে হবে। সব ঠিক করতে হবে। কিন্তু তার আগে তোমার এই সম্পর্কটাকে নিজের ইচ্ছায় মেনে নেওয়াটা দরকার। আস্তে আস্তে হোক সমস্যা নেই। তবে ডিভোর্স আমি নিজেও আল্যাউড করব না। বুঝেছো মা?”
মিহি চোখ তুলে দ্রুত উপর নিচ মাথা নাড়লো।
রুহুল সাহেব যেতেই আরোহী হাসিমাখা মুখে মৃদু স্বরে মিহিকে বললেন,”একবার বিশ্বাস করে দেখো। তোমার দিদির সাথে যা হয়েছে তা তোমার সাথে হবে না। আমাদের পরিবার তেমন নয়।”
মিহি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আরোহী নিঃশব্দে বড় করে হাসলেন। মিহিও প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো।
আরোহী উঠে দাঁড়িয়ে বাকি খাবারগুলো ফ্রিজে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
মিহি চিন্তায় মগ্ন হয়ে পরলো। ভুল ত অনেক করে ফেলেছে। তবে সবার আগে নিজের বাবার কাছে ক্ষমা চাইবে ও। নাহলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা। এখন এরোনও নেই। তাই এখন যাওয়াই ভালো হবে। সে থাকলে তো যেতেই দিতে চায়না!
আরোহী সবটা গুছিয়ে নিলেন। তারপর মিহিকে বললেন, “তুমি গিয়ে রেস্ট নেও। নাহলে টিভিও দেখতে পারো।”
মিহি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও ইতস্তত করতে লাগলো।
আরোহী চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কি!
মিহি আমতা আমতা করতে লাগলো।
“নির্দ্বিধায় বলো।” আশ্বস্ত করলেন আরোহী।
“আমি আজই মানে এখনি একটু বাসায় যেতে চাই। প্লিজ! খুব মনে পরছে বাসার কথা।”
বলতে বলতে মিহির মুখ মলিন হয়ে এলো।
আরোহী বুঝতে পেরে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকালেন।
“এভাবে বলার কি আছে! অবশ্যই যাবে। আমিও যাব চলো।”
মিহি অবাক চোখে তাকালো। আরোহী কিছু একটা আন্দাজ করে বিনয়ী ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “গেলে সমস্যা হবে?”
“ন..না, না। সমস্যা হবে কেনো!” মেকি হেসে বলল মিহি।
আরোহী হাসলেন। বললেন, “ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। তুমি একাই যাও আপাতত। আমি আর এরোনের বাবা একসাথে যাব। আমি এরোনকে জানিয়ে দিচ্ছি। পারবে ত একা যেতে!”
“পারবো।” খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো ওর মুখ।
?
সন্ধ্যে গড়িয়েছে। চারিদিক আঁধারে ঘেরা। আকাশে মনে হয় চাঁদ নেই আজ। গাড়ি মিহির বাড়ির সামনে এসে থেমেছে অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু মিহি এখনো সাহস করে নামতে পারছে না। ভয় হচ্ছে ওর। কিভাবে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে বুঝে উঠতে পারছে না। কপালে চিন্তার ভাজ পরে গেছে।
“ম্যাডাম, নামবেন না?” ড্রাইভার নম্র গলায় প্রশ্ন করলো।
মিহির ভাবনার সুতো ছিড়লো। একপলক ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে “হু” বলে নেমে পরলো।
ড্রাইভার গেল না। কারণ আরোহী ড্রাইভারকে আসার আগে বলেই পাঠিয়েছেন যে মিহি বাসার নির্বিঘ্নে ঢুকেছে নিশ্চিত করে তবেই ফিরতে।
মিহি ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে কাঁপা হাতে গেটটা টেনে খুললো। থমকে থমকে আসা হৃদস্পন্দনের সাথে সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। দরজা খোলা শুধু হালকা এগিয়ে রাখা।
মিহি ঠোঁটে ঠোঁট চিপলো। ভয় হচ্ছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে পা রাখলো ও।
রাহি আর দিপালী বসার ঘরে বসে টুকটাক কথা বলছিলেন। দরজার কড়মড়ে আওয়াজে গলা উঁচিয়ে তাকালেন দুজনেই। মিহিকে দেখে অবাক, বিস্ময়, খুশি সবের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠলো তাদের মুখে।
উঠে দাঁড়ালেন তারা।
মিহি ছলছলে চোখে তাকিয়ে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওর মাকে। দিপালিও ধরলো। তার চোখের জল চলে এলো।
সিক্ত কন্ঠে বললেন,”এলি শেষ পর্যন্ত!”
মিহি উওর দিল না। ফোঁপাতে লাগলো। রাহি এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
কান্নাকাটি চললো কিছু সময়। তারপর নিজের হাতে মিহির চোখ মুছে দিলেন দিপালি।
কপট চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,”বোকা! ঘটনা ঘটিয়ে, দুনিয়া রটিয়ে, তারপর কাঁদে!”
মিহি মাথা নুয়ে নাক টানছে।
“হয়েছে থাক!” আহ্লাদী ভঙ্গিতে বললেন রাহি।
মিহি নিজেকে সামলে সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করলো,”বাবা?!”
“উপরে আছে। নিজ দায়িত্বে যা। বকা খেয়ে আয়। এরোন রোজ খায় বকা।” বলেই রসিক হাসি হাসলেন দিপালি। রাহিও তাল মিলান।
চোখ মুছে বোকা চাহনিতে তাকায় মিহি। জিজ্ঞেস করে, মানে?
“মানে আবার কি! রোজ রোজ আসে তখন তোর বাবার পিছনেই এসে লেগে থাকে। জ্বালিয়ে মারে তোর বাবাকে একদম। কথায় আছে না! যেমনি বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল। সেই রকম।” বলতে বলতে হেসে ফেললেন দিপালি।
“রোজ আসেন!” আকাশ থেকে পরলো মিহি।
দিপালি হাসি সীমিত করে সন্দিহান চোখে তাকালেন।
“কেনো তোকে বলে নি? আজও ত এসেছিলো দুপুরের পরেই।”
মিহি বোকা, বোবা চাহনিতে চেয়ে রইল।
রাহি আর দিপালি ভ্রুকুটি করে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেলেন।
রাহি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেলেন, “আশ্চর্য ত! কিছুই জানিস না? বলে না?”
মিহি বিপাকে পরে যায়। কি বলবে বুঝতে পারেনা। লোকটা ত সত্যিই বলে নি এ বিষয়ে কিছু!
“যাইহোক, ও কই? আসেনি?” রাহি আবার প্রশ্ন করেন।
মিহি কিছু বলতে যায় তার আগেই অর্নি এসে হাজির হয়।
খুশিতে আটখানা হয়ে বলে,”আরে~~, মিহি দিদি! তুমি?! কখন এলে?”
ছুটে আসে অর্নি। জড়িয়ে ধরে মিহিকে। মিহিও ধরে।
ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উৎসুক ভাবে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “জিজু কই? আসেনি?”
মিহি চোখ বড়সড় করে তাকায়।
“কিহলো? আসেনি?” মাথা দুলিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে অর্নি।
“ন..না। একাই এসেছি।” মনে মনে হালকা হিংসা হয় মিহির। সবাই এত ওকে নিয়ে পরেছে কেনো! বাড়ির মেয়ের দামই নেই? রোজ রোজ এসে এই লোক সবাইকে হাত করে নিয়েছে!
“কেনো আসেনি?” উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে অর্নি।
মিহি হা হয়ে যায়।
“কাজ আছে হয়তো রে বাবা! থাম তুই একটু।” রাহি চুপ করায় অর্নিকে।
অর্নি মুখ ফুলানোর ভান করে।
এই লোক একয়েক দিন প্রতিদিন এসেছে? কই একবারো ত বলল না! আর এসে কি জাদু টোনা করলো যে সবাই পটলো! মিহির মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে।
“উপরে যা। গিয়ে দেখা করে আয়।” ছমছমে মুখে বললেন দিপালি।
মিহির আবার ভয় হতে লাগলো। বাবার সামনে কোন মুখে যাবে!
তাও কিঞ্চিৎ মাথা নেড়ে উঠে গেলো উপরে।
জোয়েল সাহেবের রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। বুকের মধ্যে টিপটিপ করতে শুরু করেছে।শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে উঁকি দিলো মিহি ঘরটায়।
জোয়েল সাহেব জালনার পাশে চেয়ার টেনে বসে পেপার পড়ছেন। না তাকিয়েও মিহির উপস্থিতি টের পেলেন। তবুও ঘুরে তাকালেন না।
খানিক আগেই নিচে যেতে গিয়ে দেখেছিলেন মিহি এসেছে। তাই আর নিচে যান নি। ফিরে এসেছিলেন রুমে।
মিহি কোনমতে ঢুকলো ঘরটায়। অজানা অপরাধ বোধ জাগছে তার মনে। শ্বাস আটকে আসছে। কথাও ফাঁস লেগে আছে গলার কাছে। কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না।
মিনিট দুয়েক হলো মিহি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে হয়ে মাথা নিচু করে আছে। জোয়েল সাহেব আঁচ করতে পারছেন। সাথে এটাও বুঝতে পারছেন যে মেয়ে কথা বলতে চেয়েও পারছে না। তার ছোট মেয়ে বরাবরই দোষ করে ক্ষমা চাইতে আসলে এমনই করে।
না পারে কিছু বলতে না পারে চলে যেতে।
জোয়েল সাহেব খবরের কাগজে দৃষ্টি রেখে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে ভরাট গলায় বললেন, “কি বলতে চাও?”
মিহি চমকে মাথা তুলল। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। ছলছল করে উঠল চোখ দুটো। যেকোনো মুহূর্তেই অশ্রু গড়াবে। কিন্তু মুখে কথা আসছে না। কিছুতেই আসছে না।
আরো কিছুক্ষণ কেটে গেলো নিভৃতে। মিহি মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
জোয়েল সাহেব এখনো খবরের কাগজেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছেন। তবে তার মনোযোগ সেখানে নেই। মেয়ে যে কাঁদছে তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। ভিতরটা চিনচিন করে যাচ্ছে তার।
নিঃশব্দে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন কয়েকটা। নিজেকে সামলে থমথমে গলায় বললেন, “রুমে গিয়ে ফ্রেস হও। যাও।”
মিহি চোখ তুললো। অবাক হলো বেশ। তার বাবা তাকে বের হয়ে যেতে বলে নি!
চোখমুখে খুশির আভা ফুটে উঠলো ওর। মনের মধ্যে একটু জোর পেল যেনো। দ্রুত বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরে হাঁটুতে মাথা রেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল ও।
জোয়েল সাহেব বেশ থমকালেন। রাগ জেদ সব সরিয়ে স্নেহের সহিত হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়।
?
বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে নয়টার বেশিই বেজে গেলো এরোনের।নিজের রুমে ঢুকেই প্রথমে মিহিকে খুঁজলো সে। নাহ, সে নেই!
মেয়েটাকে ও বলে গিয়েছিলো ওর রুমে থাকতে। কিন্তু তাও কেনো কথা শোনেনা!
হালকা বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে মিহির রুমটায় গিয়ে ঢুকলো এরোন। এ রুমেও খুঁজে না পেয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল ও। গেলো কোথায়!
বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ড্রয়িং রুমে নেমে এলো ও। বিচলিত চোখে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজলো ওকে। ড্রয়িং রুম, ডায়নিং, কিচেন এমনকি বাহিরের বাগানেও সে নেই।
হৃদস্পন্দন থেমে গেল যেন। হিমশীতল হয়ে গেল ভিতরটা। অতি দ্রুত আবার উপরে উঠলো ও। ঘুরে ঘুরে সব ফাঁকা রুমগুলো চেক করতে লাগলো। কোনো রুমেই নেই!
পালিয়ে গেছে? প্রশ্ন জাগতেই ভিতরটা মুচড়ে উঠলো।
ধরফরিয়ে আরোহীদের রুমের দরজা ধরাম করে খুলে ভিতরে ঢুকলো ও। আরোহী চমকালেন। এমন করে দরজা খুলেছে যে, যেকেউ চমকাবে।
আয়নার সামনে বসেই প্রশ্নসূচক অবাক চোখে তাকালেন তিনি। রুহুল সাহেবও চমকে শোয়া থেকে উঠে বসলেন।
ঘরের এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল এরোন। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতেই প্রচন্ড উৎকন্ঠা হয়ে বলল, “মিহি কই? ওকে পাচ্ছি না কেনো? কোথায় ও? বলেছিলাম না ওকে দেখে রাখতে?”
আরোহী আর রুহুল সাহেব উভয়েই স্বস্তির পাওয়ার ভঙ্গিতে তাকালেন। এই ব্যাপার!
“কি? কিছু বলছ না কেনো? কোথায় ও?” আরো বিচলিত হয়ে পরলো এরোন।
“এত হাইপার হবার কি আছে? যেখানে আছে ভালোই আছে।” থমথমে মুখে কটাক্ষ করে বললেন রুহুল সাহেব।
এরোন সন্দিহান চোখে তাকালো রুহুল সাহেবের দিকে। ভুল বুঝলো যে, ওর বাবাই হয়তো চলে যেতে দিয়েছে মিহিকে।
চেতে উঠলো ও। রাগের সাথে জোর গলায় বললো,”কোথায় সরিয়েছ ওকে? বলেছি না ওকে আমি ছাড়বো না?! তাও যেতে কেনো দিয়েছো? এখনি বলো কোথায় ও?”
রাগে ফুঁসতে লাগলো এরোন।
আরোহী আর রুহুল সাহেব দুজনেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এ কোন এরোনকে দেখছে তারা!
(চলবে…)
(বেশি বড় পর্ব দিয়ে ফেললাম আজ?)