উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৫০
মিনিটের কাটাটা বারোটার ঘর ডিঙিয়েছে। কেমন নিস্তব্ধ, গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে চারিপাশে। মায়া, সেতুকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে, মিতু বারান্দার গ্রিল চেপে রাতের ওই ব্যস্ত শহরের টালবাহানা দেখে চলেছে নীরব দর্শক হয়ে। এত রাতেও রাস্তায় শত গাড়ির লাইন, শত মানুষের আপন পথচলা ও ব্যস্ততা; মনে হরেক ভাবনার দাগ কাটে মিতুর। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে প্রশ্ন নাড়া দেয়,
‘মানুষ এহনও বাইরে ক্যান? জাগনা ক্যান? বাড়ি নাই তাগো?’
প্রশ্নেরা মস্তিষ্ক হয়ে বাহির হতে চাইল না। ভাবনায় খুটি গেড়ে রইল।
মিতুদের আসার কথা শুনে রাতেই মায়াকে নিয়ে কাব্যদের বাড়ি চলে আসে নাবিলা। মিতু, সেতুর আমানত তাদের সহিসালামত বুঝিয়ে দিয়ে চলেও যায়। একসাথে মা ও বড়োমাকে পেয়ে মায়া যেন সাপের পাঁচ-পা দেখে! অনেকদিন পর ছোট মায়া প্রাণ ভরে হেসেছে। পেট ভরে খেয়েছে। শান্তিতে ঘুমিয়েছে।
মিতুর কান খাড়া। ভেতর থেকে ভেসে আসা মায়ার ঘুমকাতুরে অস্পষ্ট কন্ঠটি নীরব বাতাবরণের মাধ্যমে সহজেই মিতুর শ্রবণেন্দ্রিয় স্পর্শ করল। মিতু দ্রুত পায়ে ছুটে গেল ভেতরে৷ সেতু বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মায়া চোখ কোচলে মিতুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘কই গেছিলা আম্মু? আমি না কইছি তুমি আর বড়োমা আমার দুই পাশে শুবা!’
মিতু স্মিত হেসে বলল, ‘শুমু তো। এইযে শুইতাছি।’
মিতু গিয়ে মায়ার অন্যপাশে শুয়ে পড়লে মায়া মিতুর বুকে মাথা রেখে খাদে পরিণত কন্ঠে বলে,
‘শয়তান বাজান নাকি মইরা গেছে আম্মু? ভালাই হইছে, হেয় আর আমগো মারতে পারবো না। আর ধমকাইতেও পারবো না।’
মিতু ধমকে বলল, ‘বাজান তো বাজান-ই, তারে শয়তান কইতে নাই। যে মইরা যায়, তার লাইগ্যা খালি দোয়া চাইতে হয়। মরা মানুষ কেমন আছিলো না আছিলো হেইগুলা মনে রাহনের দরকার নাই। দোয়া চাবি সবার লাইগ্যা, যারা আমগো ধারে আর আইতে পারবো না।’
মায়া ঠোঁট ফুলায়। হয়তো মিতুর কথা পছন্দ হয়নি তার, নতুবা ধমক। তাইতো মিতুকে ছেড়ে সে আবারও সেতুর বুকে ঠাঁই খুঁজল৷ কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে পুনরায় ঘুম জেঁকে বসে মায়ার আঁখিপল্লবে।
দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। মিতুর পাতলা ঘুম ভেঙে যায় সেই শব্দে। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলল। তার চোখ সম্মুখে দাঁড়িয়ে রেখা বানু ও তৌসিফ সাহেব। তাদের চাহনি শীতল, কোমল। মিতু দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। রেখা বলল, ‘কথা বলবো একটু। এত রাতে ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত তোমার নিকট।’
মিতু দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘আরে না, বাড়ি তো আপনাদের। আমি শুনছি, বলুন।’
তৌসিফ বললেন, ‘ভেতরে গিয়ে বলি চলো।’
মিতু বাধ্যের ন্যায় মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা।’
বারান্দায় মাঝারি সাইজের দোলনাটায় রেখা বানু মিতুকে নিয়ে বসেন। তৌসিফ বসা কাউচে। মিতু তার ও রেখার মাঝে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে৷ নীরবতা প্রথমে রেখার দ্বারাই ভাঙে।
‘আমার কাব্য ছোট বেলায় যখন বলতো তোমাকে বিয়ে করবে, এটা তার স্বপ্ন; তখন হাসতাম আমি৷ বলতাম, দেখা যাবে, আগে বড়ো তো হ। ওর সব ছোট থেকে বড়ো বিষয় আমার অজানা থাকতো না। তারপর তোমার বিয়ে হয়ে যায়। ওকে মিথ্যে বলে শহরে নিয়ে আসি আমরা।’
‘কি মিথ্যে?’ মিতুর জিজ্ঞাস্য কন্ঠ।
রেখা বলার আগে তৌসিফ সাহেব জবাব দিলেন,
‘তোমার বিয়ে হয়নি, এটা। দিনের পর দিন মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল আমাদের। ছেলের জন্য স্বার্থপর হয়েছি। স্বার্থ হাসিল হওয়ার পর সত্যিটা যখন স্বীকার করি, তখন সেই ছেলের চোখে হয়ে যাই কালপ্রিট, মিথ্যাশ্রয়ী, খলনায়ক আরও কত কি! সেসবে কষ্ট পেতাম না অবশ্য। কিন্তু কষ্টে বুক ফেটে যেত তখন, যখন ছেলেটা ভেতরে-ভেতরে একটু একটু করে নিঃশেষ হতে শুরু করল। ওটা দেখা সম্ভব ছিল না। আমি খুব করে চাইতাম মানিক আমার ভালো থাকুক। বাবা তো, সন্তানের কষ্টের দায় তো বাবা-মারও কাঁধে এসে পড়ে। আমার ছেলেটা বিশুদ্ধ মাটির মানুষ। আমি মরে যেতেও রাজী ওর সুখের জন্য।’
এরপর আর আগাতে পারলেন না তৌসিফ। চোখের পানিরা তার চোখ নিজ আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে। মিতুর শ্যেনচক্ষু মেঝেতে নত। রেখা আহত গলায় বললেন, ‘রাত্রি মেয়েটা অনেক ভালো। ভাবিনি এমন নির্মম পরিণতি তার কপালে থাকবে! ভেবেছিলাম সে আমার কাব্যকে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখাবে। কিন্তু কাব্যর কাছে তার মিতুবুড়ি ছাড়া দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর, সর্বগুণে গুণান্বিত মেয়েটিও তুচ্ছ। এক্ষেত্রে তুচ্ছ বলতে তেমনটা নয়, যেমনটা বোঝায়। আমি বোঝাতে চাই, আমার পরে ওর কাছে তুমিই শ্রেষ্ঠ রমণী, যাকে সে ভালবাসে৷ আমি আর কাব্যর বাবা, আমাদের ছেলের সুখ দেখতে চাই বাকীটা জীবন। তাই আমাদের নিরাশ করো না। আমি এভাবে বলতাম না যদি আজকের এই সুযোগটা তৈরি না হতো। আমি রাত্রিকেই কাব্যর বউ করে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধির লিখন বদলানো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের কোন সমস্যা নেই। তোমার অতীত নিয়ে কোন মাথাব্যথাও নেই। কাব্য ভালো থাকলে, পুরো জগৎ-টাই ভালো আমাদের কাছে। তুমি মেনে নাও মা।’
মিতু নীরব শ্রোতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে বলল, ‘আমি কাব্য ভাইয়ের পায়ের ধুলা পাওয়ারও যোগ্য না। আমি বিধবা। আমার একটা মেয়েও আছে। আমি অশিক্ষিত। আমার বর্তমানে কোন পরিচয় নেই। আপনারা শিক্ষিত পরিবার। আমার জন্য পদে পদে অপমানিত হবেন সমাজের লোকদের কাছে।’
রেখা কোন বার্তা ছাড়াই মিতুর পা ছুঁয়ে মিনতিপূর্ণ গলায় বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলের সুন্দর জীবন ঋণ হিসেবে দাও। আমি তোমার দাসী হয়ে থাকব।’
মিতুর মাথায় বাঁজ ভেঙে পড়ল যেন। হতভম্ব হয়ে সে দ্রুত রেখার থেকে সরে এসে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে আতঙ্কিত গলাতে বলে, ‘ছি,ছি,ছি, আমার পাপ লাগলো! আর আপনারো। কি করলেন কাকী?’
রেখা কান্না বজায় রাখেন। তৌসিফ বলেন,
‘আমিও ধরবো প্রয়োজনে, তাও তুমি রাজী হয়ে যাও। আমরা অসহায় অভিভাবক, আমার ছেলের সুখের কাছে তথাকথিত ওই সমাজ নিকৃষ্টতর পাথেয়, যেই রাস্তায় কখনো গা ভাসবে না, পথভ্রষ্ট হবোনা, কখনো মনোক্ষুণ্ণ হবে না, আফসোস জন্ম নেবে না। পাছে লোকে কিছু বলবেই, এটা চিরাচরিত সত্য। আমি নামমাত্র শিক্ষক নই। ঠিক-বেঠিক বোঝার ক্ষমতা আছেই বলে গর্ব করে নিজেকে শিক্ষক বলে দাবী করতে পারি। সমাজের সাথে লড়বো দরকার হলে, তাও তুমি পিছিও না।’
মিতু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। অনেক কথা ছিল মনে, কিন্তু সামনের দুটো মানুষের চোখের সচ্ছ পানি, সন্তানের জন্য তাদের অক্লান্ত আহাজারি মিতুর সাজানো যুক্তিগুলোর রফাদফা করে ছাড়ে। ঘোর আপত্তিরা সূদুরে আটকা পড়ে। মিতু সময় নিয়ে বলল, ‘আমার নিজেকে বোঝাতে লম্বা সময়ের প্রয়োজন৷ এছাড়াও আমি বেওয়া, ইদ্দত পালনের সুযোগ পাইনি। আমাকে সেই সুযোগ করে দিলে, উপকার হতো।’
তৌসিফ, রেখা দ্বিধাহীনভাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। বিষয়টি নিয়ে আর ঘাটলেন না।
_______
বিশাল অডিটোরিয়ামটার চারিপাশে ব্যানার ঝোলানো। যেখানে কাব্যর হাস্যজ্বল ছবিটা জ্বলজ্বল করছে সেই সাথে দৃষ্টি আকর্ষণও। মাইকের প্রতিধ্বনির আহবানে শত লোকের ভীড়ে স্টেজে গিয়ে উপস্থিত হয় কাব্য। ঠোঁটে তার নিদারুণ হাসি। সামনের লাইনে বসে তার কিছু চেনা মুখ। যাদের দিকে তাকিয়ে কাব্যর আত্মবিশ্বাস কয়েকশো গুণ মজবুত হলো। বিশেষ করে তার বাবা-মায়ের প্রগাঢ় সেই হাসি, মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেয় কাব্যর। সম্মানী হাতে নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম তাকালেন তার বাবার দিকে। তৌসিফ তখন রুমাল দিয়ে ভেজা চোখ মুছতে ব্যস্ত থাকায় কাব্যর দৃষ্টি খেয়াল করতে পারেননি। কুশল বিনিময় শেষে কেউ একজন কাব্যর ব্লেজারে স্পিকার সেট করে দেয়। এরপর উপস্থাপক লোকটি কাব্যর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার জন্য প্রাণঢালা অভিনন্দন। এবার আমরা সকলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা শুনবো আপনার মুখ থেকে।’
অনুমতি পেয়ে কাব্য বলা শুরু করে,
‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকর্তার জন্য। আসসালামু আলাইকুম, গুড ইভনিং। আমি আমার এ এযাবৎকালের পুরোটা জীবনী সংক্ষেপে তুলে ধরবো। জানি না কতটা পারবো, তবে চেষ্টা করি। আমার মতে সাফল্য মানে, প্রতিটি চড়াই-উতরাই পার করে লক্ষ্যে স্থির থাকা। চড়াই-উতরাই এক ধরনের অসীম ও জটিল প্রক্রিয়া। যা ভেদ করতে হবে অদম্য আগ্রহ ও সাহসের সাথে। সমস্যা, বাধা আসবে-যাবে ততদিন, যতদিন শ্বাসতন্ত্রের কার্যকারিতা অব্যাহত থাকবে। জীবন নামের যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে সর্বোপরি সব ধরনের মেন্টালি, ফিজিকালি সাপোর্ট দিয়ে এসেছে আমার বাবা-মা। তারা না থাকলে আমি আজ এখানে আসতে পারতাম না। আজকের এই আয়োজনের প্রধান আকর্ষণ হতে পারতাম না। তাই সৃষ্টিকর্তার পরে তাদের স্থান আমার আজকের এই সাফল্যের জন্য। এরপর আমি। আমার ইচ্ছাশক্তি না থাকলে তো হতো না কিছুই। এছাড়াও আরো অনেকেই সাহায্য সহযোগিতা করেছে। তাদের কাছেও কৃতজ্ঞ আমি। আমি আজ আমার দেখা পাঁচজন সেরা মানুষকে নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই। প্রথমেই আমার বাবা, যিনি স্বভাবতই আমাকে শাসন করে এসেছেন ছোট থেকে। তবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আর শাসন করতে দেখিনি তাকে। দায়িত্ব শেষ বলে হয়তো। জানা নেই এর উত্তর। তবে আমার জীবনের একটা মূল্যবান বিষয় নিয়ে তিনি মিথ্যে বলেছেন৷ আমার মাও তাকে সাপোর্ট দেয়। যেটা আমার কাছে প্রতারণা হলেও, অন্যদের কাছে সঠিক বলে মনে হবে। তো যাই হোক, আব্বু আমাকে গড়তে নিজেকে করে তুলেছিলেন কঠোর, স্বার্থপর ও বিচক্ষণ। আমার কাছে তিনি সবচেয়ে প্রিয়। আমার আদর্শ। তিনি আমার মাথার উপরের ডালপালা ছড়ানো এক বটগাছ। যার ছায়া আমি উঠতে-বসতে পেয়ে এসেছি। আমরণ পর্যন্ত পেতে চাই। তারপর বলবো আমার মায়ের কথা। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সে। ঠিক এই কারণটার জন্যই তার উপর সবচেয়ে বেশি অভিমান হয়েছিল আমার, যখন জানতে পারি সেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাকে অহেতুক স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছে। আমি শুধুমাত্র তার কাছেই সবকিছু ভেঙে বলার সাহস পেতাম। আমার দেখা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষটি আমার মা। কখনো একটা আঁচ অবধি আমার গায়ে লাগতে দেননি আমার মা। তার কাছে আমি খুব আদরের। ঠিক যেন যত্ন করে তুলে রাখা কোন শো-পিস। আমার মা আমাকে যতটা আদর স্নেহ দিয়েছেন, ততটা দুনিয়ার কেউ দিতে পারেনি। আর পারবেও না। তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে আমার জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তারপর বলবো রাত্রির কথা। তিনি আমার সহকর্মী, আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আজ আমাদের মাঝে না থেকেও সর্বদাই তিনি আমার দেখা সেরা পাঁচ জনের একজন হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন, যতদিন আমার দেহে প্রাণ থাকবে। আমি ভাবতাম, নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে শুধু আমিই পারি, কিন্তু উনি তো আমার থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে! আমি তাকে, আমার প্রতি তার ভালবাসাকে কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছি। এটা সে বুঝেও কখনো ক্ষেপে যাননি আমার উপর। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কখনো খারাপ চিন্তা নিয়ে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেননি। বরং প্রতিনিয়ত আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে সাহায্য করার একটা সিঙ্গেল সুযোগও উনি হাতছাড়া করেননি। শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করেছেন আমাকে সাহায্যের মাধ্যমে। তার রক্ত রঞ্জিত হাতটি দিয়ে লিখে গিয়েছিলেন ঘরের শত্রু বিভীষণের নাম। আমি অবাক! সত্যিই অবাক।
এমন একটা মানুষকে ভালবাসতে না পারা আমার চরম ব্যর্থতা। আমি এটা নিয়ে পরে বলছি। তারপর বলবো মহীয়সী একজন নারীর কথা। যে কি না নিজের স্বামীকে তার অপকর্মের জন্য উৎসর্গ করে দিতে দু’বার ভাবেনি। লড়াই করেছেন আপন মানুষদের জন্য। নিজের জীবন নিয়ে যার ছিল না বিন্দুমাত্র মায়া-মোহ। আমি সেতু নামের সেই মহীয়সী নারীকে মন থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আপনি আপনার সাহসিকতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখুন, দোয়া করি। তারপর বলবো আমার জীবনের আরও একটা মূল্যবান অংশের কথা। বাবা-মায়ের পরে যার স্থান, সে আমার মিতুবুড়ি। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আমার আলাদা এক শহর। যেখানে রোজ একবার হলেও আমি চক্কর কেটে আসি। যার জন্য আমি রাত্রির মতো নির্ভেজাল মানুষটির বিশুদ্ধ ভালবাসাকেও প্রত্যাখ্যান করতে দু’বার ভাবিনি। মিতুবুড়ি আমার কাছে সেরারও সেরা। আমার শৈশব, আনন্দ, স্মৃতি, আবেগ, ভালবাসা, প্রথম ও শেষ প্রেম। মা-বাবা যেমন অদ্বিতীয় হয়, তেমনই আমার জীবনে যদি বিশেষ কোন নারী স্থান পায়, তবে সেটা মিতুবুড়িই। তাকে আমি আমার সবটা দিয়ে ভালবেসে ফেলেছি। তাকে ভোলা যেমন অসম্ভব, তেমনই ভাবে তার জায়গা অন্য কারো নেওয়াও অসম্ভব। তাকে তো আমি আমার জীবনের সঙ্গে জড়াইনি, তাহলে কেন ইচ্ছে করে বের করবো? আমার ক্ষমতা নেই তাকে মন থেকে মোছার। আমার কাছে তার পরিচয় একটাই, সে আমার এবং একান্ত আমার মিতুবুড়ি। এর বেশি কিছু জানতে চাইনা আমি, বুঝতেও চাইনা আমি। এই পাঁচজন ব্যতীত আরও একজন আছে, যার কাছ থেকে বন্ধুত্বের আসল রস আহরণ করা শিখেছি। দুনিয়ায় তার পথচলা খুব কম সময়ের, কিন্তু তার কাজ, অন্যকে আপন ভেবে নেওয়ার গুণ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আপনারা অনেকেই শুনেছেন হয়তো নয়নার নামটি। মিতুবুড়ি আমার যেমন অত্যন্ত প্রিয়, তেমন তারও ছিল। ভরসা পেতাম ওর কাছে মিতুবুড়িকে গচ্ছিত রেখে৷ আরেকটা কথা বলবো। আপনারা কেউ করতালি দিবেন না। আমি যাদের নিয়ে এতগুলো কথা বলে ফেললাম, তাদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন। এতটাই, ধন্যবাদ সকলকে।’
কাব্য স্টেজ থেকে নামামাত্র তৌসিফ সাহেব আবেগপ্রবণ হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে রাখলেন দীর্ঘক্ষণ। সে যেমন কাব্যকে কল্পনায় দেখতেন, আজ তেমনটাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। মিতু ও সেতু আসেনি অনুষ্ঠানে। তবে টিভির পর্দায় দেখছে তারাও।
_____
ইদ্দত শেষে মিতুকে পুনরায় ঘিরে ধরল তৌসিফ, রেখা। সাথে সেতু ও নাবিলাও। মিতু দুটো শর্তের মাধ্যমে সম্মতি দেয়। সে চায় বিয়েটা জাঁকজমকহীন, সাধারণ ভাবে সম্পন্ন হোক। কাব্য তার বাবা-মায়ের একটাই সন্তান বিধায় তারা প্রথমে মিতুর শর্তটি নাকচ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলের সুখের জন্যই পরমুহূর্তে মেনে নিলেন। মিতু চায় বিয়েটা তাদের গ্রামে হোক। অবশ্য এটা কাব্যরও চাওয়া। দুপুরের মধ্যভাগে বিয়ের যাবতীয় কার্যক্রম, বিয়ে পড়ানো থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। অন্যসব আয়োজন তেমন জমজমাট না হলেও খাবারের আয়োজন ছিল বিশাল। পুরো গ্রামের লোকদের পেট ভরে খাইয়েছেন তৌসিফ। কেউ নালিশ জানানোর সুযোগ পায়নি এক্ষেত্রে।
সেই নদী, কচুরিপানা, বিকেল বেলা, আর দুটি হৃদয় আবারও এক হলো। পুরনো অভ্যাস, অনুভূতিগুলো উজ্জীবিত হয়ে উঠল আরও একবার। কাব্য ক্ষেত থেকে শর্ষে ফুল তুলে এনেছে একগাদা। মিতু গ্রামের বধূর ন্যায় বাংলা শাড়ি পড়ে চুল খোপায় গুজে রেখেছে। আজ তাদের বিয়ে হয়েছে। অথচ বর-বউয়ের কোন সাজই নেই তাদের শরীরে। এটা অবশ্য কাব্যর ইচ্ছার ভিত্তিতে হয়েছে। তীব্র গরম থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যেই মূলত বর-বউয়ের সাজ ছেড়ে আসা। কাব্য নিজ হাতে তার মিতুবুড়ির খোপায় হলুদ শর্ষে ফুল গুজে দিল। নদীর কিনারা ঘেঁষে বসা কাব্য ও মিতু। আগের সেই দুবলা ঘাস আর নেই। তবে অবহেলায় পড়ে থাকা শূন্য জায়গাটা সেই একই অবস্থা ধরে আছে। সেই শূন্য জায়গাটা পরিপূর্ণ হলো দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটে।
মিতু কিছুই বলছে না। কাব্য মিতুর চোখে মুখে বিষন্নতার আভা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতায় নিমজ্জিত থাকার পর মিতুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কাব্য গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে। বলে,
‘কিছু বলবি না মিতুবুড়ি?’
মিতু কাব্যর দিকে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে চাইল। চোখের কার্ণিশে পানি কণা তার চিকচিক করছে। কাব্য আলগোছে সেই পানিটুকু মুছে দেয়।
‘আজকের মিতু আর কয়েকবছর আগের মিতুর মধ্যে অনেক ফারাক আছে। সেই মিতু কিছুই বুঝতো না। আর এই মিতু অনেক কিছু বোঝে। বুঝলাম তুই অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছিস রে মিতুবুড়ি।’
‘কিভাবে বুঝলে তুমি?’ অকপটে প্রশ্ন ছুড়ল মিতু।
‘তোর চোখের ঘনত্ব দেখে। মুখের ওই বুঝদার ভাবটি দেখে। আসলেই বড়ো হয়ে গিয়েছিস।’
‘বড়ো না হয়ে কি আর পারি বলো? জীবন পদে পদে বড়ো বানিয়েছে আমাকে। আমি ইচ্ছা করে কিছুই হইনি। বরং আমাকে জোর করে বড়ো বানানো হয়েছে।’
কাব্য অসন্তোষ এমন ভাব নিয়ে বলল, ‘ফিল নেই, কোনই ফিল নেই ধুর!’
মিতু আহাম্মক বনে গেল কাব্যর কয়েক শব্দের কথায়।
‘কিসের মধ্যে কি, পান্তা ভাতে ঘি! কি বললে তুমি?’
কাব্য উচ্চস্বরে হেসে ওঠে৷ বলে,
‘আমার বোকা মিতুবুড়ি, আমি বলতে চাইলাম তোর মধ্যে মিতুবুড়ি টাইপ সেই ফিল আসছে না।’
মিতুর উৎকন্ঠা, ‘তাহলে কিভাবে আসবে কাব্য ভাই?’
কাব্য অভিমানী কন্ঠে বলে, ‘আমার মিতুবুড়ি তো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে না! আপনি কে ম্যাম বলুনতো?’
এবার মিতু উচ্চস্বরে হেসে উঠল৷
‘তুমি না চাইতা আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি? তাহলে এখন আবার উল্টো সুর ধরছো কেন?’
বিরক্তি নিয়ে কাব্য বলল, ‘ধুর, তখন চাইতাম যাতে তুই সুন্দর করে কথা বলার অভ্যাস করতে পারিস। তোর ভালোর জন্যই বলতাম৷ কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে তুই অমনটাই ঠিক ছিলি। আমি কিছু জানি না, আমার সেই আগের মিতুবুড়িকেই চাই। চাই মানে চাই।’
‘আইচ্ছা কাব্য ভাই।’ বলে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল মিতু। কাব্য মোহাবিষ্ট হয়ে দেখল সেই হাসি। ঘোরলাগা কন্ঠে সে বলল, ‘তোর হাতটা ধরি মিতুবুড়ি?’
কাব্যর এহেন কথায় মিতুর হাসিতে ব্যাঘাত ঘটে। সে তার ডান হাতটা কাব্যর দিকে এগিয়ে দেয় কোন কথা ছাড়াই৷ কাব্য মিতুর হাতটি নিজ আয়ত্তে আনতে বেশি সময় লাগায় না। বুকের বাঁ-পাশটায় ঠেসে ধরে মিতুর হাতটি।
শীতল কণ্ঠে বলে, ‘আমার থেমে যাওয়া হৃদযন্ত্র অনেক বছর পর প্রকৃত অর্থে আজ সচল হয়েছে। তুই আমার জীবনে চলার পাথেয়। কাব্য তার মিতুবুড়িকে ছাড়া মূল্যহীন। ওই গাঙচিল, ভরা গাঙ, ভাসমান শ্যাওলারা, আর গোধূলিলগ্ন, সবটাই অপূর্ণ যদি কাব্য ও মিতুবুড়ি এক না হয়। বুঝলি?’
মিতু মাথা নাড়ে। বলে, ‘তুমি আমার লাইগ্যা আকাশকুসুম ভাবনা।’
কাব্য ভ্রুজোড়া কুচকে তাকায়। কৌতূহলী চোখে বলে, ‘হুঁ?’
‘আরে ব্যাকরণ বইতে যে বাগধারা পড়ছিলাম, ক্যান তুমি পড়ো নাই?’
কাব্য আরেকবার গগণ কাঁপিয়ে হেসে বলে,
‘এইবার ফিল আসছে মিতুবুড়ি টাইপ। তুই কোনদিনও পাল্টাবি না নিজেকে। এমনটাই থাকবি শুধু আমার জন্য। যখন একা নিরালায় থাকবো দুজন, তখন তুই হয়ে যাবি বারো বছরের পাকনীটা, আর আমি হবো আঠারো বছরের সেই মিতুবুড়ির পাগলটা। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে কিন্তু আমি যে তোমার জীবনখান নষ্ট কইরা দিলাম। তুমি চাইলে অনেক ভালো মাইয়া পাইবা। রাত্রি আপায় তোমারে অনেক ভালবাসছিল। হেয় আমগো মইধ্যে নাই এহন। কিন্তু তার লাগান মাইয়া আরও অনেকেই আছে। খুঁজলে ঠিক পাইয়া যাইবা।’
কাব্য দু’দিকে মাথা নাড়ায়।
‘উহু, আমি আমার মিতুবুড়িকেই চাই। আর তাকেই চাইব অনন্তকাল পর্যন্ত। তবে রাত্রির ভালবাসাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। আমি এও মানি, ভালো লাগলেই যে সবসময় ভালো লাগার মানুষকেই পেতে হবে, এমনটা সমীচীন নয়। একতরফা ভালবাসা ভিত্তিহীন বলা যায়। একতরফা ভালবাসায় কোনো স্বপ্ন বুনতে নেই৷ কারণ এই ভালবাসায় কোনো গন্তব্য থাকে না। আমি এত কিছু বলতে চাইনা। আমি বলবো, যে যাকে চায় তাকে না পেলে হা-হতাশ করায়ার কিছুই নেই। যার সাথে মনের মিল হবে, তার সাথেই ভাগ্য জড়িত। এজন্য নিজের ভালবাসা জোর করে অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিতে নেই। জোর করে মনের মধ্যে ভালবাসার জাগরণ হয়না। হলে এমনিতেই হবে। এটা রাত্রি বুঝতে পেরেছিল বলেই কোনরূপ জোর খাটিয়ে ভালবাসা আদায় করার প্রয়াস চালায়নি। সে বুদ্ধিমতীর পরিচয় দিয়েছে এক্ষেত্রে। এছাড়াও তুই আমাকে দিয়েই দেখ। তোকে ছাড়া জীবন চলছিল আমার। কিন্তু ভাগ্য যে সেই তোর কাছেই টেনে আনবে, তা কখনোই ভাবতে পারিনি। তবে আশা ছিল তোকে পাবার। বর্তমানে পেছনে যা হয়েছে সব দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চাই আমি। নতুন করে বাঁচতে চাই। তোকে নিয়ে বাঁচতে চাই। দিবি তো সেই সুযোগ আমায়?’
‘আমিও বাঁচতে চাই কাব্য ভাই। বাঁচার মতন বাঁচতে চাই। কিন্তু আমারে যে অন্য পুরুষ ছুঁইছে। সেইডা কি তোমার মাথায় একবারও আহে নাই?’
কাব্যর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘না, আসেনি। আনতে চাইও না। আমার আব্বু-আম্মু আমাকে নিজের চোখে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহুর্ত ছটফট করতে দেখেছে। যতই নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতাম না কেন, তাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারিনি কখনো। আমার সাথে তারাও কম মরণ যন্ত্রনা সহ্য করেনি৷ যদি তেমনটাই ভাবতাম, তাহলে প্রতিটি অবসরে তোকে নিয়ে চিন্তা করতাম না। এক কথায়, ভালবাসার অধিকারটাই হারিয়ে ফেলতাম। আমার দিক থেকে সব ঠিকই আছে। শুধু তুই মনের দিক থেকে ঠিক কর নিজেকে। তাহলে কোন কিছুতে বাঁধাপ্রাপ্ত হবি না। মন থেকে কালো অতীতকে জলাঞ্জলি দিয়ে দে। দেখবি বাকীটা জীবন ভালো থাকবি। আর কোন দ্বিধার দেয়াল আছে কি তোর মনে?’
মিতু খাদে নামানো গলায় বলল, ‘আমি আর কি কমু? তোমার মতো মানুষ হারিকেন জ্বালাইয়া খুঁজলেও আরেকটা পাওয়া যাইতো না। এমন একখান মানুষরে ফিরায় দেওয়ার ক্ষমতা আমার লাগান ক্ষুদ্র মানুষের নাই। দশ বছর আগে না বুইঝ্যা ভুল করছিলাম দেইখ্যা আইজও করমু নাকি? না, করুম না। তুমি এমন একজন মানুষ, যার পায়ের ধুলা পাইলেই জীবন ধন্য হইয়া যাইবো। সৃষ্টিকর্তার পাঠানো শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি আমার লাইগ্যা। তোমার মায় রত্নগর্ভা। আর তোমার বাপেও অনেক ভাগ্যবান। কারণ তুমি তার সন্তান।’
‘তাই? আর তুই? তোর কথাও বল। বাবা-মায়ের পরে তুইতো সেই মানুষটা, যাকে এত বেশি চাই আমি।’ কাব্যর প্রশ্নের পৃষ্ঠে মিতু পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
‘তুমি আমারে ঠিক কতখানি ভালবসো কাব্য ভাই?’
কাব্য স্মিত হাসি দিয়ে মিতুর মাথাটা তার বুকের মাঝে রাখল। মোহনীয় কন্ঠে বলল,
‘আমি আমার মিতুবুড়িকে কতটা ভালবাসি, তা পরিমাপযোগ্য নয়। তোর জন্য অসীম ভালবাসা জমা আমার হৃদয়ের খামে।’
মিতুর কন্ঠে আড়ষ্টতা,’সত্যি কাব্য ভাই? তুমি আমারে এত্ত বেশি ভালবাসো?’
‘হুম তিন সত্যি৷ আগে থেকেই বললাম নইলে তুই যা মেয়ে, তিন সত্যি না বলা অবধি মাথা খাবি আমার।’
কপট রাগ নিয়ে কাব্যর থেকে দূরে সরে আসল মিতু। কপালে ভাজ ফেলে বলল,
‘যাও আর কথাই কমু না তোমার লগে। আমি তো খালি মাথা খাই। তোমার মাথা আস্ত থাহুক। আমার কাছে আইতে কে কইছে?’
কাব্য ঔৎসুক করে বলল, ‘ওমা তাই নাকি? তাহলে আমি আবারও চলে যাই শহরে। দেখি কোনো সুন্দরী রমণীর দেখা মেলে নাকি। আমি তাকে আগেভাগেই বলে রাখবো, আর যাই খাও না কেন, সাবধান! আমার মাথা খেওনা।’
কথাটি বলে ঠোঁট চেপে কাব্য মিতুর দিকে তাকায়। দেখলো নাক, গাল ফুলিয়ে তার দিকেই চেয়ে মিতু। কাব্য হেঁচকা টানে পুনরায় মিতুকে তার বুকে নিয়ে এলো। দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
‘খুব সুন্দর করে সেজেছিস আজ। ভালো লাগার বিষয় টা হলো, তুই আজ আমার জন্য সেজেছিস। জানিস কত ইচ্ছে ছিল আমার তোকে বউ সাজে দেখার! তোর কাছে প্রকাশও করেছিলাম সেই ইচ্ছেটা। আজ পূরণ হলো তা। একটা বিষয় মাথায় রাখবি, কাব্যর মিতুবুড়ি তুই। শুধুই কাব্যর মিতুবুড়ি। এই পরন্ত বিকেল, রাঙা গোধূলিলগ্ন সাক্ষী হয়ে থাকবে তোর আর আমার অমর প্রেমের উদাহরণ হিসেবে।’
মিতু চোখ বুজে কাব্যর বুকে মাথা ঠেকিয়ে আছে। এই প্রথম ভালবাসার মানে বুঝল মিতু, বুঝল প্রেমের মানেও। কাব্যও যেন রোজকার একঘেয়েমি দগ্ধ জীবন থেকে নিস্তার পেল। হাজারো বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে আরো একবার জয় হলো ভালবাসার। সমাপ্তি ঘটল বিভীষিকাময় বিতৃষ্ণার।
______
দশ বছর পর…..
রোজ একের পর এক রোগী দেখতে-দেখতে সেতুর সময় কোন ফাঁকে চলে যায়, সে নিজেও জানে না। তার গত দশ বছরের লম্বা জার্নিটা সহজ ছিল না। শ্রম দিয়েছিল বলেই না আজ তার স্বপ্নকে জয় করতে পেরেছে। বিয়ে করেনি আর। ইচ্ছে হয়নি তাই। মায়াকে ঘিরেই তার বাকীটা জীবন কাটাতে চাচ্ছে। মায়া স্কুলে যাবার পথে ও ছুটি হলে আসার পথে নিয়ম করে তার বড়োমাকে এক ঝলক হলেও দেখে যায়। গ্রামের গরীব, দুস্ত গর্ভবতী নারীদের সেতু বিনা মূল্যে সেবা দিয়ে থাকে। এতে অবশ্য তার খুব ভালোই লাগে। দিন শেষে ক্লান্ত সেতুর মহৌষধ মায়ার এক টুকরো মন সতেজ করা হাসি। মায়া এবার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেতু রাতে চেম্বারেই থেকে যায়। এটাই তার ছোটখাটো সংসার। মায়া মাঝেসাঝে সেতুর সঙ্গে ঘুমোয়। আজও মায়া বায়না ধরেছে সেতুর সঙ্গে ঘুমোনোর। তবে এক্ষেত্রে সেতু জারি করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা,
‘আজ বাড়ি চলে যা, আমার ঘুমোতে বেশ রাত হয়ে যাবে।’
মায়া ডানপিটে স্বভাবের৷ বিশেষ করে সেতুর নিষেধাজ্ঞা সে কখনোই মানেনি।
‘আমি যাব না বড়োমা। বাসায় বলে এসেছি থাকবো এখানে। তাছাড়া আগামীকাল শুক্রবার, থাকলে কি বলোতো?’
‘তুই কথা শুনিস না কেন বলতো?’
‘তুমি কথা শোনার মতো কিছু বলেছো কি কখনো?’
‘আচ্ছা থাক। পরে কিছুক্ষণ পর পর কিন্তু বলতে পারবি না, বড়োমা আমার পাশে এসে শোও! আমি কাজ শেষ না হওয়া অবধি শুতে পারবো না বলে দিলাম।’
মায়া বাধ্যের ন্যায় মাথা নাড়ে শুধু। তারপর টেবিলে পড়ে থাকা সেতুর অ্যাপ্রোনটা গায়ে জড়িয়ে বলে, ‘দেখো তো আমায় ভালো লাগছে না বড়োমা? আমিও বড়ো হয়ে তোমার মতোই হবো। তারপর তুমি না চাইলেও তোমার কাছে কাছেই রাখতে হবে আমাকে। তাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।’
মায়ার সরল মনে বলা কথাটি সেতুকে গুরুতর ভাবে আঘাত করল।
আহত গলায় সেতু বলল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে তাড়িয়ে দেই তোকে? বাড়িতে থাকলে একটু ছোট বোনটাকে দেখতে পারিস। মিতুর তো কত কাজ থাকে সারাদিন। আমার চেম্বার থেকে তোদের বাড়ি মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, তাও দেখ না মিতু আসার সময় পায়, না আমি সময় পাই। কিভাবেই বা পাবো বলতো? আমি তো ঘাড় নাড়ারও সময় পাই না বলতে গেলে। আর মিতুর তো তোদের সবার পেছনে ছোটার জন্য হলেও দিনের ২৪টা ঘন্টা কম পড়ে যায়। তার উপর তোর বাবা তো সবসময় বাড়ি থাকে না। এইজন্য বলি মার সাথে থাক। সে কাজ করল আর তুই বোনটাকে দেখে রাখলি নাহয়। তাছাড়া তুইতো বড়ো হচ্ছিস, একটু মাকে সাহায্য তো করতে পারিস নাকি? একদম মিতুর স্বভাব পেয়েছিস তুই। ছোট বেলায় মিতুটাও এমন ছিল। মা একা সব কাজ করতো, আর তার ভাইটাকে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়ার মতো ফুরসত থাকতো না৷ বরং তেনার টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যেত না!’
মায়া এতক্ষণ দু’কানে হাত ঠেসে রেখেছিল। কানের থেকে হাত সরিয়ে এনে সে বলল,
‘আর কিছু বলবে তুমি?’
সেতু মায়ার পিঠে চড় বসিয়ে বলল,
‘বাড়ি যা, যা এখনই!’
মায়া টেবিলের উপর চড়ে বসে বলল,
‘যাব না। তুমি সবসময় এমন করো খালি। আচ্ছা একদিন তো আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাব, তখন কি আর চাইলেই তোমাকে এসে বিরক্ত করতে পারবো বলো?’
সেতু ক্ষণকাল ভাবনায় ডুবে রইল। মায়া ঝাঁকুনি দিতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে চড়া কন্ঠে বলল,
‘যেতে হবে না তোকে শ্বশুরবাড়ি-টারি। একদম ওই নাম মুখে আনবি না।’
মায়া আহ্লাদে আটখানা হয়ে জড়িয়ে ধরে সেতুকে। প্রায় সমান-সমান লম্বা দুজন। সেতুর তুলনায় মায়া এক কি দুই ইঞ্চি বোধয় বেশি হবে লম্বায়।
‘আমাকে এত ভালবাসো যে বিয়েই দিতে চাওনা। সেই তুমিই আবার তাড়িয়ে দাও। আজব তো তুমি বড়োমা!’
সেতু আলতো ছুঁয়ে দেয় মায়ার মুখশ্রী। বলে,
‘তোর জন্যই জোর পাই রে। আগামীকাল তোদের বাড়ি যাব ভাবছি। তোর বাবা এসেছে শুনলাম। গিয়ে যে দেখে আসবো, তার উপায়ও নেই। তোর বাবা বড্ড বেশি ভালো। আজ তার জন্যই আমার জীবন বদলেছে। দেখে না আসলে, কেমন দেখায় বল?’
‘হুম বড়োমা, জানোতো বাবা আমার জন্য আর বোনের জন্য একরকম জামা,একরকম জুতো এনেছে। আগেরবার বোনের আমার জামাটা পছন্দ হয়ে যাওয়ায়, তার সে কি কান্না! তাই এবার বুদ্ধি করে বাবা আমাদের জন্য একরকম জামা এনেছে।’
সেতুর চোখ ছলকে আসে পানিতে। মায়া দেখার আগে সে দ্রুত চোখে জমা হওয়া পানিটুকু মুছে নিয়ে বলে,
‘তুই, আমি, মিতু, আমরা কেউ-ই কপাল পোড়া নই। একটা সময় ভুল ভাবতাম আমি। আমরা তিনজন নাকি কপাল পোড়া। অথচ আমরাই সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী।’
মায়ার জিজ্ঞাসুক কন্ঠ, ‘কি করে বড়োমা?’
‘এইযে আমরা বেস্ট একজন মানুষকে পাশে পেয়েছি। তোর বেস্ট একজন বাবা আছে, মিতুর বেস্ট একজন স্বামী আছে আর আমার বেস্ট একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু আছে। তাহলে ভাগ্যবতী কারা হলো?’
মায়া উৎফুল্লতা নিয়ে বলল, ‘আমরাই বড়োমা।’
_______
কাব্য ও মিতুর বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তাদের একটি কন্যাসন্তান আসে৷ তৌসিফ নাতনির নাম রাখেন তিলোত্তমা। তিনি গতবছর জ্বর আসায় বিছানায় পড়ে যান। এরপর সাত দিনের মাথায় জগৎ সংসারের মায়া ত্যাগ করেন৷ তার চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি শোকাভিভূত হয় কাব্য৷ তিলোত্তমাকে সংক্ষেপে তমা বলেই ডাকে সবাই। তিলোত্তমার সাথে মায়ার বেশ ভাব। তবে মায়া যখনই তাকে পড়তে বসাবে, তখনই তাদের ভাবটা আর স্থায়ী থাকেনা। বুঝিয়ে সুঝিয়ে, ছলে-কৌশলে যতটা পারে তমাকে দিয়ে পড়িয়ে নেয় মায়া।
শহরে আসা-যাওয়া লেগেই থাকে কাব্যর। গ্রামে খুব একটা থাকা পড়েনা কাজের সুবাদে। তবে যখন আসে, তখন তার মিতুবুড়ির পছন্দের চানামুঠ সাথে করে আনতে কখনোই ভোলে না কাব্য। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও এই একটা বিষয় সর্বদাই তার মগজে স্থায়ীভাবে রয়ে যায়-ই যায়। গ্রামে আসার দিন কিনেছিল তবে, তাড়াহুড়ায় দোকানেই ফেলে আসে। ভুলটি হয়ে দাঁড়ায় কাব্য ও মিতুর মাঝে বিশাল দূরুত্বের দেয়াল। রাত হয়ে যাওয়ায় চানামুঠ আনতে বাসা থেকে আর বের হয়নি কাব্য। পরদিন সূর্য মাথায় চড়তেই বেরিয়ে পড়ে সে। চানামুঠ এনে তার মিতুবুড়ির মাথা ঠান্ডা করে তবে ক্ষান্ত হয়৷ মিতুও গলে যায়।
বর্তমানে কাব্য তার ছোট মেয়ে তিলোত্তমাকে নিয়ে লুডু খেলায় মত্ত। মেয়ে বায়না ধরায় কাব্য না করতে পারেনি। তমা উল্টো পাল্টা দান দেয়, কাব্য কিছু বলে না। মেয়ের তালে তাল মিলিয়ে চলে। মিতু চায়ের সঙ্গে কিছু বিস্কুট ও মুড়ি-চানাচুর এনে গভীর মনোযোগে বাবা-মেয়ের লুডু খেলা দেখতে বসে। তমা দুই ঘন্টা হলো কাব্যকে জায়গা থেকে নড়তে দিচ্ছেনা৷ এতে করে মিতু বিরক্ত হলেও, কাব্যকে এক মুহুর্তের জন্য হলেও বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখল না। এ নিয়ে মিতুর মনে প্রশ্ন জাগে, ‘তার ধৈর্য্যে কুলায় কিভাবে?’
হঠাৎ কাব্য বলে ওঠে, ‘ভাবছিস এত ধৈর্য কোথা থেকে সঞ্চয় হচ্ছে?’ বলে চায়ের কাপে চুমুক বসায় কাব্য।
মিতু হকচকিয়ে বলে, ‘তুমি কি করে জানলে?’
‘তোর মুখের হাবভাবই বলে দেয় রে আমার বোকা মিতুবুড়ি!’
‘আর কি কি বলে আমার হাবভাব?’
‘লুডু খেলবি?’
‘না।’
‘কেন? হারবি বলে?’
‘আমি মনে হয় হারাইনি কখনো?’
‘তা হারিয়েছিস। তবে হারতে দিয়েছি বলেই হারাতে পেরেছিলি।’
মিতু চোখ ছোট করে এনে বলে, ‘হারলে মানুষ কত কথাই বলে! যাও তো।’
তমা বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছাড়ে। বিরক্তিতে অতিষ্ঠ তমা বলে, ‘আমি দাদীর কাছে গেলাম।’
তমা চলে গেলে মিতু মায়ার জায়গায় গিয়ে বসে। লেলিহান দাবালনের মতো দাউদাউ করছে মিতুর চোখ দুটো। আক্রোশ ভরা কন্ঠে সে বলে,
‘চলো এইবার দেখি কে জিতে।’
কাব্য দুদিকে মাথা নেড়ে বলে, ‘তমাকে তাড়ানোর ট্রিক ছিল ঝগড়াটা।’
মিতু এবার আরও কয়েক দফা রেগে বলল,
‘তুমি একখান ধুরন্ধর লোক!’
‘জানি।’
কাব্যর অকপট স্বীকারোক্তি মিতুকে ধৈর্যহারা করে দেয়। সে উঠে চলে যাবার জন্য উদ্যত হলে কাব্য পথরোধ করে দাঁড়ায়। চড় দেওয়ার মতো করে হাত বাড়িয়ে বলে, ‘মার চিনিস?’
‘মারবা নাকি?’
‘হুম দেখবি?’
‘দেখাও।’
কাব্য মুখ বাড়িয়ে আলতো করে মিতুর ওষ্ঠে চুমু খেল। ঠোঁটের প্রগাঢ় হাসিটা ধরে রেখে বলল,
‘আরও দেখাই?’
মিতু অগ্নি চোখে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে হিসহিসিয়ে বলল, ‘তোমার চুলে পাক ধরছে সেই খেয়াল কি নাই? বুইড়া বয়সে ভীমরতি হইছে নাকি?’
কাব্য খানিক শব্দ করে হাসল। মিতুকে ঘুরিয়ে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে থুতনি মিতুর ঘাড়ে ঠেকায়। ঘোরগ্রস্ত গলায় বলে, ‘আমার সম্পূর্ণ চুল, গোঁফ, দাঁড়ি সাদা হয়ে গেলেও তোর প্রতি আমার ভালবাসা এক রত্তিও কমে যাবে না। বরং বয়সের সাথে বাড়তেই থাকবে৷ আমি কি ভালবাসা কমানোর জন্য ভালবেসেছি নাকি?’
মন ভরে আসে মিতুর কাব্যর ওই তৃপ্তিদায়ক কথায়। আত্মতুষ্টির এই সময়টা যদি এখানেই থমকে যেত, তাহলে কতই না ভালো হতো!
মিতু গাঢ় কন্ঠে কাব্যকে ডাকে, ‘কাব্য ভাই!’
‘হুঁ?’
‘তুমি এত বেশি ভালবাসো ক্যান আমারে? আমার নিজেরে নিজেই হিংসা করতে মন চায়। আমারেও একটু ভালবাসতে শিখাও তো তোমার লাগান কইরা।’
কাব্য স্মিত হাস্যে জবাব দেয়, ‘আমিতো ভালবাসতে জানি কেবল৷ শিখাতে নয়। আর মানি, ভালবাসার নেই কোনো অন্ত, আছে অসীম সাহস ও প্রেম অফুরন্ত।’
(সমাপ্ত)
বিঃদ্রঃ ভুলগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং প্রত্যেকেই অবশ্যই অবশ্যই নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করবেন গঠনমূলক কিছু মন্তব্যের মাধ্যমে। ধন্যবাদ সকলকে এতটা পথ আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য।