উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৪৯
‘সব ঠিক আছে, কিন্তু তোমরা দুজন একটা অন্যায় করেছো আমার সঙ্গে।’
কথাটা বেশ তীর্যক ভঙ্গিতেই সেতু ও মিতুকে কেন্দ্র করে বললেন তৌসিফ সাহেব। মিতু ও সেতু একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সমস্বরে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
তৌসিফ আহত কন্ঠে বলল, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। তবে মিতুর আমাকে দেখে মুখ লুকিয়ে রাখার কারণ বুঝিনি আমি। আমার সাথে কথা বললে কি তাকে কটু কথা বা অপমান করতাম? তার সঙ্গে ভেঙে কথাও বলতে চেয়েছিলাম গতকাল সকালে। সে মুখ ঢেকে শুধু মাথা নাড়ল। আমি কি এমন অন্যায় করেছি যার জন্য অপমানিত হলাম তার থেকে?’
তৌসিফ কথাগুলো সেতুর দিকে মুখ করে বলেছেন। সেতু, মিতুর দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে চাইলে মিতু বলল, ‘আমি ভয় পেয়ে তাকাইনি আপনার দিকে। আপনাকে অপমান করার সাহস বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। আপনি অপমান পাওয়ার মানুষও নন। আমি দুঃখিত আমার আচরণে। আপনি চাইলে আমি আপনার পা ধরে মাফ চাইতে একবারও ভাববো না।’
ধমকে ওঠেন তৌসিফ, ‘বোকা মেয়ে! আমি বুঝেছি তুমি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিলে। আসলে কিছু পরিস্থিতির সঠিক কারণ থাকে না। যাই হোক, এখন তোমরা আমার বাসায় চলো। মুখ চোখের অবস্থা দেখা যাচ্ছে না একেবারেই।’
নাবিলা বলল, ‘না আঙ্কেল, সেতু আর মিতু আমার সাথে আমার বাড়ি যাবে। ওদের মেয়ে মায়া তো অপেক্ষা করছে।’
তৌসিফ কিছু বলেনি। কাব্য বলল,
‘আপনি অনেক উপকার করেছেন সেতু ও মিতুর। আমাকেও কম সাহায্য করেননি। তবে আমি ধন্যবাদ দেব না। শুধু বলবো, আপনাদের মতো ভালো মনের মানুষরা দিন শেষে ভালো থাকুক।’
নাবিলা হেসে বলল, ‘আমার খুব শান্তি লেগেছে ভালো কাজ করে। আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি মিতু, সেতুর কাছ থেকে। সন্তানের জন্য একজন মা কতটা সাহসী হতে পারে-তা মিতুর সঙ্গে পরিচিত না হলে জানতেই পারতাম না। এত গুলো বছর পরও বন্ধুর জন্য তার দায়িত্ববোধ সত্যি আমাকে বিমোহিত করেছে। মিতু তার বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পেরেছে। এই দিকটা শিক্ষামূলক লেগেছে আমার। আমাদের প্রত্যেকেরই বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। অন্যদিকে সেতুর সাহসিকতা আরেকটা শিক্ষনীয় বিষয়। তাদের দু’বোনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব রুখে দাঁড়ানো দিকটাও অতুলনীয়। এছাড়াও তাদের থেকে আরও অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি। তাদের সবচেয়ে বড়ো গুন তারা ভালবাসতে জানে। পরকে আপন ভেবে তার জন্য কাঁদতে জানে। এমন দুজন মহান নারীদের জন্য কিছু করতে পেরে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে করছি। তাই আমি আমার কাজের জন্য কোন বাহবা পেতে চাইনা স্যার।’
কাব্য বলল, ‘ভালো লোকেদের মহৎ গুণ তো এটাই যে তারা ভালো কাজের জন্য ক্রেডিট পেতে চান না। আমি বিশ্বাস করি, দুনিয়ায় যেমন খারাপ মানুষদের অভাব নেই, তেমনই ভালো মানুষেরও। আর বাঁচতে হলে একে অন্যের সহযোগিতা লাগবেই৷ আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন কারণে অন্যের উপর নির্ভরশীল। কারণ কারো একার পক্ষে সবকিছু ঠিকঠাকমতো সামলানো অসম্ভব। সেই সাথে এটাও মানি, শেষ হাসিটা ভালোরাই হাসে। অসৎ যতই তাদের পাপের সম্রাজ্য নিয়ে অহংকার করুক না কেন, একদিন তাদের সকল অহংকার গুড়িয়ে যাবেই। তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। সঠিক সময়ের অপেক্ষা মাত্র।’
তৌসিফ বললেন, ‘ঠিক বলেছো কাব্য। পৃথিবীতে ভালো ও অসহায় লোকেদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আল্লাহ কাউকে না কাউকে সময়মতো ঠিক পাঠিয়ে দেন। এটাও কিন্তু প্রমাণ হলো তোমার আর নাবিলার মাধ্যমে। সব কিছুই যেন একই সূত্রে গাঁথা। ওইযে একে অন্যের উপর নির্ভরশীলতা।’
‘আসলেই আব্বু। তবে রাত্রির কথা না বললে নয়। তার মনটাও উদার,সচ্ছ। এমন পরোপকারী মানুষদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতে ইচ্ছে করে আমার।’
রাত্রির কথা উঠতেই তৌসিফের মুখের রঙ পাল্টে গেল। একরাশ উদাসীনতা নিয়ে তিনি বললেন,
‘সব ভালোদের সাথে ভালো হয়না কাব্য। এককালে সুখ তো এককালে দুঃখ। এটা জীবনচক্রের চরম দুটি পর্যায়। যে শুরু থেকে সুখে থাকে সে জীবনের একটা পর্যায়ে দুঃখ ভোগ করে। আর যার শুরুটাই জীবন সংগ্রাম দিয়ে, তার শেষটা সুখের, আনন্দের। যাজ্ঞে সেসব। সেতু, মিতু কি তাহলে নাবিলার সঙ্গে যাচ্ছো?’
মিতু বলল, ‘আমরা এখন গ্রামে যেতে চাই স্যার। কারণ আমাদের শ্বাশুড়ির সঙ্গে এখনও হিসেবটা পাওনা। বেশি কিছু না, দুটো কথা শোনাতাম শুধু।’
সেতু সায় দিল। নাবিলা বলল, ‘আমিও যাব তোমাদের সাথে।’
তৎক্ষনাৎ বাধ সাধে সেতু, ‘না আপা, আপনের সংসার আছে। আপনারে আর কষ্ট দিমু না। পারলে আমার মায়ারে আজকের দিনডা দেইখ্যা রাইহেন। ওরে কইয়েন কাইল ওর মা আর বড়োমা ওরে নিতে আইব। এই উপকারখান কইরেন আপা!’
‘ওকে দেখার জন্য লোক আছে আমার বাড়িতে। কিন্তু তোমরা দুজন গ্রামে কি করে যাবে? টাকা তো নেই তোমাদের কাছে।’
সেতু নাবিলার হাত দুটো নিজের হাতে এনে বলল,
‘আছে আমার ধারে। যা আছে ওই টাকা দিয়া গেরামে যাইয়া আবার ফিরা আইতেও পারুম। কিন্তু!’
‘কিন্তু কি?’
‘কিন্তু এইহানে থাইক্যা আমরা তিনজন করুম কি? আমগো তো থাহার জায়গা নাই। থাকলে নাহিদের বাড়ি, কিন্তু সেইহানে আমি আর থাকতে চাইনা।’
নাবিলা বলল, ‘থাকতে হবে না। আমার বাড়িতে থাকবে। আমি তোমাদের পাশে থাকতে চাই।’
কাব্য নাবিলার উদ্দেশ্যে বলল, ‘সব ভালো কাজ আপনি একা করলে হয়? আমাকেও সুযোগ দিন। আমি আছি সেতু, মিতু ও মায়ার পাশে। আমি চাই সেতু তার স্বপ্ন পূরণ করুক। যেটা তার বাবা-মায়ের জন্য ভেঙে যায়।’
করুণ চোখে তাকাল সেতু। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘স্বপ্ন মানে?’
‘স্বপ্ন মানে তুমি ডাক্তারি পড়বে।’
‘সেইডা কেমনে সম্ভব?
‘সবই সম্ভব। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। বয়সের কাছে ইচ্ছা হার মানবে- এটা কোন যথেষ্ট অযুহাত
নয়। বয়স যতই হোক, বয়সে কি আসে-যায়? আজ হলেও মরবো আর কাল হলেও। এই বাঁচা ও মরার মাঝে ইচ্ছেটা কেন অপূর্ণ থাকবে? তুমি আর আমি সমবয়সী। তাই তোমার বয়সটা আমি আন্দাজ করতে পারছি। আর এটাও আন্দাজ করছি যে তুমি পারবে। শুধু নিভে যাওয়া ইচ্ছাশক্তিকে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে তোমায়। মানুষ চাইলে প্রাণ দেওয়া ব্যতীত অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।’
মিতু, সেতুকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘রাজী হইয়া যা বুবু। জীবনের শুরুতে না পারলি, শেষটায় নিজেরে গুছাইয়া নে। তুই অনেক মেধাবী, আমি জানি পারবি তুই।’
একে একে সবার অনুরোধে রাজী না হয়ে পারল না সেতু। সে বলল, ‘আমি পারুম ইনশাআল্লাহ।’
সেতুকে জড়িয়ে ধরে মিতু বলল, ‘একদিন কমু তোরে, তুই আমার ডাক্তার বুবু।’
‘ডাক্তার বুবু’ কথাটি ভীষণ করে আবেগাপ্লুত করে তুলল সেতুকে। সেই সাথে উন্মুক্ত হতে থাকল ঘন আস্তরে ঢেকে যাওয়া তিলে তিলে গড়া স্বপ্নেরা।
____
কাব্যকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য আগামীকাল অনুষ্ঠিত বিশাল আয়োজনের জন্য সে মিতু ও সেতুর সঙ্গে গ্রামে যেতে পারেনি। তারা দুই বোন একাই শিমুলতলীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পৌঁছাতে ঘন্টা চারেক লাগে। নুরুলের চার তলা ফাউন্ডেশনের বাড়িটা এখন পাওনাদারদের দখলে। জীবনের দশটি বছর এই বাড়িটাকে নিজের শরীরের একটা অংশ হিসেবে জান-প্রাণ দিয়ে দেখাশোনা করেছে মিতু। আজ সেই বাড়ির উপর তার কোন অধিকার নেই! ভাবতেই বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। বর্তমানে সেতু ও মিতু দেওয়ান বাড়ির ছোট ছেলে, মৃত নাহিদ দেওয়ানের বাড়ির উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে। তাদের বিস্ময়াহত চাহনি উঠোনের মাঝখানটায় ছুটোছুটি করা মছিদার পানে। আঁচল তার বুক থেকে নেমে মাটিতে মিশেছে। সহসা রশিদা ছুটে আসলেন। মছিদার হাত টেনে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,
‘ভেতরে চল আপা। এভাবে দৌঁড়াস না।’
মিতু, সেতু এগিয়ে আসে। চোখের সামনে সেতু, মিতুকে দেখে রশিদা তার কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। সেতু দুর্নিবার কৌতূহল নিয়ে বলল,
‘কান্দেন ক্যান খালা? আর আপনার বোইনের চলনবলনের এমন ঢক ক্যান বুঝলাম না!’
রশিদা কন্ঠে কান্না ধরে রেখে জবাব দিলেন,
‘নাহিদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর কিছুক্ষণ কান্না করল। স্বাভাবিকই ছিল রে আমার আপা। কিন্তু গতকাল রাত থেকে আপা আমার পাগলের মতো আচরণ করছে। দেখনা তার চেহারার হাল!’
কয়েক মুহুর্তের জন্য বোধবুদ্ধিহীন হয়ে পড়ল মিতু ও সেতু। মুখে কথা আসলো না উভয়ের। তাদের ওই বিস্ময়কর মুখশ্রী সমানে দেখে চলেছে পাষাণ মছিদার বর্তমান অবস্থা। ইনি কি সেই মছিদা, যার চোখ কুঁচকে যেত সেতু, মিতুর মুখ দর্শন হলে! রশিদা বলল, ‘আপাকে নিতে থানা থেকে পুলিশ এসেছিল। আপার এমন অবস্থা দেখে নিল না। কিন্তু ওরা আবার আসবে আপাকে পাগলাগারদে ভর্তি করানোর জন্য। আল্লাহ এটা কেন হলো? আমার আপা যেমনই হোক, আমার আপা তো!’
রশিদার ভুবন কাঁপানো কান্নায় সেতু ও মিতুর হৃদয় গলে গেল। তারা দু’বোনের মন যে মমের তৈরি। তারা ক্ষমাশীল। তাইতো মছিদার থেকে হাজার কষ্ট পেয়েও আজ সেই মছিদার জন্যই তাদের চোখের কোণে পানির অস্তিত্বের দেখা মিলে। মছিদা হঠাৎ মাটিতে গড়াগড়ি করতে লাগে। তার মুখে ভিত্তিহীন, অহেতুক কিছু প্রলাপ জড়িয়ে। নোংরা, আবর্জনা যে মানুষটির সবচেয়ে অপছন্দের, যিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অবলম্বনে এক চুলও কৃপণতা দেখাননি, আজ তার এমন বিপরীত স্বত্বা মেনে নেওয়া সত্যিই অসম্ভব সকলের পক্ষে। সেতু ফুস করে তপ্ত নিশ্বাস ত্যাগ করল। মিতুর হাতটা বুকের সঙ্গে সেঁটে নিয়ে বলল, ‘দেখ মিতু, আমার বুক লাফাইতাছে কেমনে! জীবনে এই প্রথম এনার লাইগ্যা আমার কষ্ট হইতাছে। উনি সুস্থ হইয়া যাক দোয়া করি।’
মিতুর চোখ সরছেই না মছিদার উপর থেকে। দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ রেখে সে বলল, ‘অন্যের ছেলে-মেয়েরে যারা নিজের মানতে পারেনা, তাগো অভিশাপ দেয়; এমন মন-মানসিকতার মানুষরা একদিন নিজের ছেলে-মেয়ের মাধ্যমেই চরম শিক্ষা পায়। আমগো অভিশাপের গাঙে ডুবায় রাখতো। অন্যের লাইগ্যা কুয়া খুড়লে হেই কুয়ায় নিজেরেই ডুইবা মরতে হয়৷ মার কাছে সবচাইতে প্রিয় হইল গিয়া তার সন্তান৷ তারা হারাইয়া গেলে, হেই মার ধারে বাঁচা-মরা সমান রে বুবু। আমি বুঝিরে এহন, ভালো কইরাই বুঝি। কিন্তু আমার তাও কষ্ট লাগতাছে ওনার লাইগ্যা। ওনার লাইগ্যা কষ্ট হওয়া তো উচিত না আমগো। তাও ক্যান নিজেরে বুঝাইতে পারতাছি না ক তো বুবু?’
সেতুর নির্বিকার উত্তর, ‘আমারও একই দশা। কিন্তু কি, আইজ তার এই অবস্থার লাইগ্যা হেয় নিজেই দোষী। হেয় মা, হেয় পাপীও। যেই মা ছেলেমেয়েরে উস্কানি দেয়, তাগো ভুল না শুধরাইয়া বাঁচানের লাইগ্যা উইঠ্যা পইড়া লাগে, হেই মা জঘন্য পাপী। তার তিনজন সন্তানই সুস্থভাবে মরে নাই। তাগো মরণই ছিল মাইনষের হাতে। একজন পাপী হইলে তার শাস্তি হয় একরহম, আর একজন মা পাপী হইলে তার শাস্তি হয় আরেকরহম। মার কাছে তাগো সন্তানরা হইল গুপ্তধন। অনেক সাধনার পর, নয়-দশটা মাস কত যন্ত্রণা সইহ্য কইরা একজন মায় সেই গুপ্তধন হাসিল করে। হেই সন্তানের, হেই গুপ্তধনের মরামুখ দেহা মানেই একজন মার লাইগ্যা দুনিয়ার সর্বশেষ শাস্তি৷ হেয় উপযুক্ত শাস্তি পাইয়া গেছে, অন্য আর কোন শাস্তি হের গায়ে লাগবো না এহন।’
‘ঠিক কইছোস রে বুবু। কিন্তু তাও, আমরা অমানুষ না। কেউ শাস্তি পাইলে, তার উপর আর রাগ রাহার প্রয়োজন নাই। এহন কি ফিরা যাবি শহরে?’
মিতুর প্রশ্নের পৃষ্ঠে তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না সেতু। সে গিয়ে সিঁড়ির উপর বসে। বলে, ‘আম্মারে নাকি পাগলাগারদে নিয়া যাইব পুলিশ, একবারে দেইখ্যাই যাই।’
সেতু এতক্ষণে মছিদাকে ‘আম্মা’ বলে সম্মোধন করল। যেই ডাকে ছিল অফুরন্ত মায়া, টান ও অঢেল স্নেহ।
________
নাহিদের নির্মম পরিণতি ও মছিদার মানসিক- ভারসাম্যহীনতার সংবাদটি প্রায় শত গ্রাম ছাড়িয়েছে। এ যাবৎ হিসাব ছাড়া মানুষজন মছিদাকে দেখে গেল, এখনও সেই ধারা অব্যাহত। দুপুরের মধ্যভাগে মছিদাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেন্টাল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। রশিদা ছাড়াও আরও অনেক নিকটস্থ আত্মীয়রা সেখানে উপস্থিত। বুকভরা বেদনার সঙ্গে মছিদাকে বিদায় জানাতে হলো সকলকে। বেশ সময় নিয়ে মনের শোক কাটিয়ে যখন দু’বোন পুনরায় ঢাকা ফেরার উদযোগ করে, তখন তাদের সামনে নতজানু মাথার গাট্টাগোট্টা দেহের অধিকারী একজন মাঝবয়সী পুরুষ এসে দাঁড়ান।
সেতু গিয়ে তার মুখোমুখি হলো। চোখ টলটলে তবুও ঠোঁটে চওড়া নিদারুণ হাসি টেনে আনলো সে। হাসি মুখেই বলল, ‘তুমি অনেক খুশি হইছো না বাজান? মাইয়াগো সুখ দেইখ্যা নিজেরে সামলাইতে পারতাছো না দেইখ্যাই তো এমনে মাথা নুইয়া খাড়াইয়া আছো। দেহি তোমার চোখ দিয়া সুখের পানি পড়তাছে নাকি!’
আবুল কালাম এসেছেন বেশ ভালো সময় হয়ে গেছে। তার সূদুর প্রসারি দৃষ্টি মেয়েদের দেখছিল এক দৃষ্টে। তবে মেয়েদের সামনে আসার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছিলেন না বিধায় আড়ালেই গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন।
সেতুর কথার পিঠে কোন জবাব আসল না আবুল কালামের পক্ষ হতে। মিতু করতালির সহিত বলল,
‘বুবু তুই আমার লাগান হাত তালি দিতাছোস না ক্যান ক তো? দে,দে, তুইও দে। হাতে তালি দে। নাকি মজা আরও দেহানো বাকী আমগো?’
আবুল কালাম হাতজোড় করল। আজ মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। আবুল কালাম তার চোখ মাটিতে গেড়েই বললেন, অনেক বড়ো ভুল কইরা ফেলাইছি মা তগো লগে। মাফ কইরা দে এই পাপী বাপটারে।’
সেতু তারস্বরে গর্জে উঠে, ‘মাফ! তাও আবার তোমারে! আমার হাসতে মন চাইতাছে না, আমারে হাসাইয়ো না। পারলে হাত তালি দিয়া বিজয় উৎসব পালন করো। মাইয়াগো সুখ নিয়া শুকরিয়া আদায় করো।’
‘হামারে মাফ কর মা। তোর আর মিতুর পাও ধরুম, তাও মাফ কর।’
আবুল কালাম কিছুটা নিচের দিকে ঝুকলেন। পরমুহূর্তেই সেতু দু কদম পিছিয়ে গেল। বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
‘খবরদার! পাপের বোঝা আমার ঘাড়ে টাইন্যা আনবা না কইয়া দিলাম। তোমারে আমি মাফ কইরা দিছি হেই কবেই। মনে কোনো ঘেন্না নাই তোমার লাইগ্যা। কিন্তু মাফ করলেও একজন সন্তান হিসাবে মাফ করছি কেবল। মানুষ হিসাবে তোমারে জীবনেও মাফ করতে পারুম না। কোনদিনও না। তুমি আমার কাছে কোনদিন মাফ চাওয়া নিয়া কিছু কইতে আইবা না। আইজ ভাইঙ্গা আর কি কমু? সবই তো চোক্ষের সামনে। আর কিছু কওয়ার নাই। মায় তো ফাঁকি দিয়া গেল না। তারেও আমি মাফ কইরা দিছি। আমার পক্ষ থেইক্যা মাফ করলাম তোমাগো দুইজনারে। কিন্তু মিতুর পক্ষ থেইক্যা না। ওর দিক দিয়া আমি জীবনেও তোমারে মাফ করতে পারুম না। মিতু যদি মাফ করে করুক, কিন্তু আমি করুম না। আমার লগে যা হওয়ার হইছে। সেইডা না জাইন্যা আমার ভালোর লাইগ্যাই করছিলা মানলাম। কিন্তু মিতু! ওর বেলায় একই ভুল কেমনে করতে পারলা? তোমরা তো অবুঝ শিশু না। জাইন্যা হুইন্যা কেমনে পারলা বয়স্ক এক বুইড়ার লগে মিতুর বিয়া দিতে? না, তোমরা ক্ষমার অযোগ্য। আমি একজন মানুষ হিসাবে কোনদিনও তোমারে মাফ করতে পারুম না। শুধুমাত্র মিতুর জীবনডা নষ্ট করার লাইগ্যা তুমি আর মায়, সারাজীবন আমার চোখে খারাপ হইয়া থাকবা। অচেনা হইয়া থাকবা। কোনভাবেই মাফ করা সম্ভব না।’
‘একটা সুযোগ দে মা ক্ষমা পাওয়ার!’
সেতু বলল, ‘দিমু, যদি তুমি মিতুরে দশ বছর আগের জীবন ফিরায় দেও তাইলে।’
আর কথা বের হয়না আবুল কালামের কণ্ঠনালী হতে। সেদিন তিনি হাজার কেঁদেও মেয়েদের মন গলাতে পারলেন না। কারণ সেতু, মিতু সাফ বলে দেয়, তারা তাদের বাবাকে মাফ করলেও একজন লোভীকে কখনোই মাফ করতে পারবে না। আজ সেতু ও মিতু নিজেদের উদাহরণ দিয়ে সমাজের মানুষের সামনে তুলে ধরল, মেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে হলেই সেই মেয়ে সুখী হয়না। যার সাথে সংসার করবে সেই মানুটার থেকে সুখ না পেলে, ধন-সম্পদে প্রকৃত সুখ কখনোই আসে না। তারা মনে প্রাণে চায় এখন থেকে প্রতিটি মেয়ের অভিভাবকরা যেন সাবধান হয়ে মেয়েদের মূল্যায়ন করতে শিখে। এবং মেয়েদের অপরিণত বয়সে বিয়ে না দিয়ে, তাদের পড়াশোনা করিয়ে ছেলেদের সমান গড়ে তোলে। তাহলেই আর কোন মেয়ের অবস্থা মিতু ও সেতুর মতো হবে না।
_____
বিকেল ছ’টার বাস ধরল মিতু,সেতু। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে থামল সেই বাস। মিতু আশেপাশে তাকালে দূর থেকে হাত নেড়ে ‘মিতুবুড়ি’ বলে ডেকে উঠল কাব্য৷ কাছে গিয়ে বলল, ‘আজই আসতে কে বলেছে? বলেছিলাম না আগামীকাল সকালের গাড়ি ধরতে?’
মিতু মৌনতা ধরে রইল। সেতু বলল,
‘কই থাকতাম আমরা? সব রাস্তাই তো বন্ধ।’
‘কেন নাহিদের বাড়ি তো এখন তোমারই।’
সেতু হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, ‘লাগবো না হেই বাড়ি। হিয়াল, বিলাই থাহুক সেইহানে।’
কাব্য বিষয় টা নিয়ে আর আগালো না। প্রসঙ্গ বদলাতে বলল, ‘রাতেই যখন চলে আসবে, তখন আমিই তো তোমাদের সাথে যেতে পারতাম।’
‘কি দরকার আপনার? এত বেশি নাক গলানোর কি আছে আমাদের ব্যাপারে?’
মিতুর হঠাৎ করে উগ্রবাদী হয়ে যাবার কারণটা ঠাউর করতে পারল না কাব্য ও সেতু।
সেতু চোখ রাঙিয়ে মিতুর উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোর কি হইছে আবার? কাব্যর লগে এমনে কথা কস ক্যান?’
মিতুর দ্বিধাহীনতা, ‘অনেক করেছেন উনি, আর না। আমরা কৃতজ্ঞ থাকব তার কাছে। এখন ওনাকে যেতে বল। এমনিতেই তার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলেছি আমরা, আর চাই না।’
‘তুই কিন্তু মাইর খাবি মিতু!’
‘আমি মার খাওয়ার মতো কিছু বলিনি। আমি একজন বেওয়া। মানে বিধবা। ঝামেলায় ছিলাম বলে আজকে শহরে এসে ঠেকেছি। রঙ, ঢং করার ইচ্ছে নিয়ে আসিনি। ঝামেলা শেষ। এখন আমার পরিচয় আমি বিধবা।’
‘সেইডার লগে কাব্যরে কথা হুনানোর কি সম্পর্ক?’
‘আমি জানি না।’
‘রাস্তার মইধ্যে মাইর খাবি কইয়া দিলাম!’
‘ইচ্ছা তোর।’
সেতু মারার জন্য উদ্যত হলে কাব্য বাধ সাধে।
‘ছাড়ো ওকে। তোমরা কি নাবিলার বাড়িতে যাবে? চলো নামিয়ে দেই।’
সেতু ঘোর আপত্তি জানায়, ‘আমার স্যার আমারে কইছে তার বাসায় যাওনের লাইগ্যা, আমি সেইহানেই যামু।’
মিতু বলল, ‘নাবিলা ম্যাম রাগ করবে বুবু।’
‘করুকগা, হেয় ফোন দিলে কইয়া দিমু মায়ারে কাব্যগো বাইত্তে দিয়া যাইতে। মায়া আমার লগেই থাকব আমি জানি।’
‘তোর লজ্জা করবে না অন্য একজন পরপুরুষের বাসায় থাকতে? তুইও তো বেওয়া।’
‘আমার সমস্যা নাই কোন। তুই যা তোর নাবিলা ম্যামের বাইত্তে।’
মিতু ভাবলেশহীন ভাবে বলল, ‘তাই যাব।’
দু কদম বাড়ালে মিতুর পথরোধ করল সেতু। কুটিলভাবে বলল, ‘গেলে আমারে আর বুবু কইতে পারবি না। মনে থাহে যেন।’
‘বুবু তুই!’
সেতু নাছোড়বান্দার মতো বলল, ‘যা কইছি তাই।’
মিতু আর রা করল না। সেতুর জেদের কাছে তাকে হার মানতেই হলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।