উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৪৮
‘মৃত ব্যক্তিটি তাহলে আপনার স্বামী?’
সেতু নতজানু হয়ে ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয়,
‘হুঁ দারোগা সাহেব।’
পাবলিকের মারের এক পর্যায়ে নাহিদ প্রাণ হারায়। নাহিদের সম্পূর্ণ শরীরের এক অংশও চেনার উপায় নেই। মুখ থেঁতলে গিয়ে আকৃতি পাল্টেছে। পুলিশ বেশ কিছু সময় জিজ্ঞাসাবাদের পর মিতু, সেতু, নাহিদের লাশসহ নাবিলাকেও থানায় নিয়ে আসেন। জেলের ভেতর পাশাপাশি তিনটি চেয়ারে বসা মিতু, সেতু ও নাবিলা। পাশেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো নাহিদের লাশ। তবে সেই সাদা কাপড় লালে পরিণত হয়েছে নাহিদের রক্তে মেখে। একজন সিনিয়র অফিসার প্রথমে সেতুকে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। সেতুর দ্বিধাহীনতা দেখে অফিসার নাজিম হিকমত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। নাহিদের লাশের কাছে গিয়ে মুখ উন্মুক্ত করে সেতুর উদ্দেশ্যে শুধান, ‘মুখ চেনার কায়দা নেই। চোখ একটা উধাও। চোখ কি আগে থেকেই ছিল না?’
সেতুর স্পষ্ট কন্ঠ, ‘আমি তুলছি। ওর লাগান পাপীর দুনিয়া দেহার অধিকার নাই।’
মিতু থরথর করে কাঁপছে রাগে। আশেপাশের কোন কিছুতেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই। চোখের সামনে নাহিদের লাশ তার সর্বাঙ্গে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কোনভাবেই ক্ষান্ত হতে দিচ্ছে না।
নাহিদের মুখে কাপড় টেনে একজন কন্সটেবলকে লাশ মর্গে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে নাজিম হিকমত সেতুর মুখোমুখি হলেন। বললেন, ‘পুরোটা শুনতে চাচ্ছি৷’
নয়নার সঙ্গে হওয়া ঘটনা, নুরুলের মৃত্যু, মায়া- মিতুর সঙ্গে হওয়া প্রতিটি বিষয় তুলে ধরল সেতু। শেষে বলল, ‘আইজ নিজের হাতে ওরে খুন করতে চাইছিলাম কিন্তু মরলো জনগণের হাতে। এইডাই আমার আফসোস।’
নাজিম কর্কশ গলায় বললেন, ‘তাই বলে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো এত বড়ো অপরাধমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন?’
‘আপনারা তো সাহায্য করেন নাই, তাই ওর ব্যবস্থা আমিই নিছি। খালি চোখটাই আলাদা করতে পারছি ওর দেহ থেইক্যা, অন্যসব আর পারলাম কই?’
সেতুর মিথ্যা স্বীকারোক্তির পেছনে নাবিলা রা করল না। আহাম্মক বনে দেখল ও শুনল। মিতু সহসা বলে ওঠে, ‘মিথ্যা কওয়া ছাড় বুবু। ওর চোখ আমি তুলছি, তুই না। আপনি তো দেখেছেন ম্যাম, তাহলে সত্যিখান বলছেন না কেন?’
নাবিলা থতমত খেল। আমতা-আমতা করে বলল,
‘আ আ আমিতো পুলিশকে ফোন দিতে ব্যস্ত ছিলাম। দেখিনি কিছুই।’
নাবিলা দেখেছিল ঠিকই, তবে বলার প্রয়োজনবোধ করল না।
নাজিম বলল, ‘তার মানে আপনারা দুইবোন-ই দোষী। একজন আরেকজনকে বাঁচাতে চাইলেও আর লাভ হবে না এখন, কারণ আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। আজ দশ বছর ধরে পুলিশের চাকরি করছি আমি।’
মিতুর দিকে চোখ গরম নিয়ে তাকায় সেতু। তারস্বরে সে বলে, ‘তুই বড়ো নাকি আমি বড়ো? আমার উপরে কথা কওয়ার সাহস পাস কেমনে তুই?’
সেতুকে উপেক্ষা করে মিতু নাজিমকে বলল,
‘মেনে নিলাম আমরা দুইবোন-ই দোষী। আপনি শাস্তি হিসেবে আমাদের সারাজীবন জেলেই বন্দী করে রেখেন। আমি বলছি না আমার বুবুকে ছেড়ে দিতে। কারণ ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আর আমারও না। তবে নাবিলা ম্যামকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। উনি এসবের সাথে জড়িত নন। খুব বেশি ভালো মানুষ উনি।’
মিতু এবার নাবিলাকে বলল, ‘আমার মেয়েকে দেখে রেখেন ম্যাম। আমি আর আমার বুবু ছাড়া মায়ার কেউ নেই। মেয়েটা আমাদের মতোই কপাল পোড়া। বেশি কিছু না, ওকে তিনবেলা খেতে দিয়েন শুধু।’
নাবিলা কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘থামবে তুমি! আজেবাজে কথা একটাও বলবে না আর৷ কিসের জন্য শাস্তি পাবে তোমরা দুই বোন? সারাজীবন শ্বশুরবাড়িতে স্বামী, শ্বাশুড়ি দ্বারা নির্যাতিত হয়ে এসেছো। এখনও কেন শাস্তি ভোগ করবে তোমরা? তাছাড়া নাহিদকে তোমরা খুন করোনি, সে জনগণের মার খেয়ে মরেছে। যদি তোমরা মারতে….’
নাজিম থামিয়ে নেন নাবিলাকে।
‘কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল নাহিদকে খুন করার। আর একজন সুস্থ সবল মানুষের চোখ উপড়ে ফেলাও কিন্তু শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে।’
নাবিলা বলল, ‘মারতে চাওয়া আর মারার মধ্যে বিশাল পার্থক্য। আমরা সাধারণত কারো উপর রেগে গেলে মুখ দিয়ে চলে আসে যে তাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এর মানে এই নয় যে তাকে মেরে ফেলেছি। পাবলিকের হাতে কত চোর-জোচ্চর মার খেয়ে মরেছে। কই তখন তো তাদের প্রত্যেককে শাস্তি দেওয়া হয়না। তাহলে এখন কেন নাহিদের খুনের আসামী খুঁজছেন আপনারা?’
‘আপনি চুপ থাকুন! আপনাকে কিছু বলতে বলিনি আমি।’
নাজিমের জোরালো ধমকে চুপ করে যায় নাবিলা। সেতু বলে, ‘আপনি মিতুর কথা হুইনেন না। নাহিদের চোখ আমি তুলছি। ওরে মারতে চাইছি আমি, মিতু না৷ জেলে থাকলেও আমি থাকমু খালি।’
‘বুবু!’ চোখ রাঙিয়ে তাকাল মিতু।
‘মা ছাড়া আমার মায়া মইরা যাইব। তোরে ওর প্রয়োজন রে মিতু।’
‘কিছু করার নাই বুবু। আমার গর্ভে জন্ম নেওয়াই মায়ার অপরাধ৷ এই অপরাধের লাইগ্যা শাস্তি পাইতে হইব তারে।’
হঠাৎ নাজিম হুংকার ছাড়েন, ‘আমি কে এখানে? দাম-ই তো দেখছি নেই আমার। সেই থেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছেন আপনারা। আপনারা দুইবোনই শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। সেই সাথে নাবিলাও। আপনাদের সাথে থাকার অপরাধে সেও দোষী। আর আপনি যখন জেনেছিলেন আপনার স্বামী ধর্ষক ও খুনী, তখনই কেন অভিযোগ তুলেননি?’
সেতুর দিকে প্রশ্নটি ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেতু বলল, ‘তহন জানাইলে বিচার পাইতাম? আইচ্ছা আপনি কন, যেই লোক খুন কইরা পুলিশের মুখ বন্ধ করতে পারছিল, হেয় কি আমার লাগান একখান দুর্বল নারীর মুখ বন্ধ করতে পারবো না?’
নাজিমের বিস্ময়াহত কন্ঠ, ‘মানে!’
‘মানেটা হইল, হেয় আমারে ভয় দেখাইছিল। আমার স্বামীরে যহন আমি কইছি তার অপকর্মের ঘটনাডা আমি ফাঁস কইরা দিমু, তহন হেয় আমারে কইছে মায়ারেও মাইরা ফেলাইবো। মায়ার বয়স তহন আড়াই বছর। আমি তো ওরে অনেক আদর করি, নিজেরে ওর মা মনে করি। নাহিদ কইল, মায়ারেও মাইরা ফেলবো কিন্তু পুলিশ তার কিছুই করতে পারবো না। পুলিশগো দিয়া নাকি হেয় পায়ের ধুলাও পরিষ্কার করাইতে পারবো। তাইলে কন আমি কেমনে কমু কাউরে? যে পুলিশরেও ডরায় না, হেয় আর কিসে ডরাইবো? আমার কোন পথ আছিলো না। আমি বুঝতে পারছিলাম নাহিদের লগে পারা সম্ভব না। এহন আপনি কন আমার দোষ, নাকি নাহিদের, আর নাকি আপনাগো লাগান কিছু পুলিশের? কার দোষ এইবার আপনেই কন।’
নাজিম মাথা নুইয়ে ফেলেন সেতুর করা প্রশ্নে। তার শব্দ ভান্ডার ফাঁকা। তিনি বেরিয়ে আসেন জেলের ভেতর থেকে।
_____
দুপুরে জ্ঞান আসে কাব্যর। তবে মিতুর খবর তার কানে পৌঁছে সন্ধ্যার দিকে। বর্তমানে শরীর তার মোটামুটি ভালো হলেও পুরোপুরি নয়। হাসপাতাল থেকে তাকে ডিসচার্জ করবে রাতে। কিন্তু সে সন্ধ্যায়-ই থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে তার মিতুবুড়িকে ছাড়াতে। আসার সময় তার পথরোধ করেন রেখা ও তৌসিফ। কাব্য সকলকে উপেক্ষা করে চলেই আসে স্থানীয় থানায়। তিরিক্ষি মেজাজ তার। অনুমতি নিয়ে সে নাজিম হিকমতের সাথে দেখা করে।
‘এখানে তিন জন মহিলাকে ধরে আনা হয় আজ। আমার প্রশ্ন, তাদের অপরাধ কি?’
নাজিম কাব্যর দিকে এতক্ষণে তাকালেন। চিনতে পেরে হেসে বললেন, ‘সাংবাদিক কাব্য রহমান যে! শরীর কেমন এখন? আপনার দুঃসাহসিক কাজের জন্য পরশু আপনাকে বিশেষ সম্মান দেবেন সরকার নিজ হাতে। সেই বিশাল আয়োজনে আমিও থাকছি।’
‘আমি কি প্রশ্ন করেছি আপনাকে?’
কাব্যর কন্ঠ শীতল, চাহনি বিক্ষিপ্ত। নাজিম বললেন, ‘তারা নাহিদ নামের একজনকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল। চোখে আঘাত করে এক চোখ উপড়ে এনেছে। দূর্ভাগ্যবশত নাহিদ তাদের হাত থেকে ছুটে যাওয়ায় তারা পাবলিক দিয়ে তাকে মার খাইয়ে প্রাণে মেরে ফেলেছে। তবে আপনার সাথে ক্যামেরাম্যান কোথায়? লাইভ করবেন না?’
‘আমি হাসপাতাল থেকে এখানে লাইভ করতে আসিনি অফিসার। আমি তাদের জামিনের জন্য এসেছি।’
‘জামিন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আগামীকাল তাদের কোর্টে তোলা হবে, উকিল ধরেন গিয়ে।’
‘বেশি হয়ে যাবে এখন!’
নাজিম হেসে বলল, ‘আর ইউ সিরিয়াস? সার্কাস করার জায়গা নয় এটা।’
কাব্য যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে, ‘আমি সার্কাস করছি না। আপনি তো নিজেই বললেন পাবলিকের মার খেয়ে নাহিদ মরেছে, তাহলে এখানে তাদের ৩জনকে কেন ইনভলভ করা হচ্ছে?’
‘কারণ তাদের উদ্দেশ্যই ছিল নাহিদকে খুন করার। সেটাই হয়েছে। আচ্ছা আমি যদি এখন আপনার একটা হাত কেটে ফেলি, তাহলে কি আমি শাস্তি পাব না? কোন আইনি উদ্যোগ নেবেন না আমার বিরুদ্ধে?’
কাব্য মাথা কিঞ্চিৎ নেড়ে বলল, ‘অবশ্যই নেব। কারণ আপনি অপরাধ করেছেন।’
‘তাহলে নাহিদের একটা চোখ যে তারা কোটর থেকে বের করে এনেছেন, এটার জন্য অবশ্যই তাদের শাস্তিপ্রাপ্য। নাকি ছেড়ে দেওয়া উচিত?’
কাব্য কয়েক মুহুর্ত সময় নিল ভাবার জন্য। ভেবে বলল, ‘আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারপর বলছি।’
নাজিম সোজাসাপ্টা বলে দেন, ‘সম্ভব নয়।’
‘কেন?’
‘নিয়ম নেই। তবে সাংবাদিক হিসেবে এলে ভাবা যেত।’
‘দেখুন অফিসার, আমি শুধু জিজ্ঞেস করবো তারা এমন কেন করল। আমার বিশ্বাস, এমনি এমনি বা ছোটখাটো কোন অন্যায়ের জন্য এত বড়ো একটা স্টেপ তারা নেবে না। তাই আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দিন।’
‘আপনি যদি এই কারণে তাদের সাথে কথা বলতে চান, তাহলে আমি বলছি কারণ টা।’
‘বলুন, শুনে আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরটি দেব।’
কাব্যর থেকে অনুমতি পেয়ে নাজিম হিকমত সেতুর বলা প্রতিটি ঘটনা সংক্ষেপে পেশ করেন। সবটা শুনে কাব্য সীমাহীন ক্রোধ নিয়ে বলে উঠল,
‘যা করেছে বেশ করেছে। আমার মতে, এমন নরপশুদের জন্য শাস্তিটা কমই ছিল।’
নাজিম চড়া গলায় বললেন, ‘আপনি ভুলে যাবেন না আপনি একজন সাংবাদিক!’
‘আমি ভুলে যাইনি সেটা। তবে আপনি একজন পুলিশ অফিসার। আপনার উচিত ছিল যাদের সাহায্যে নাহিদ তার জঘন্য অপরাধটি ধামাচাপা দিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সেও কিন্তু একজন পুলিশ। আর আপনিও। তাকে প্রশ্রয় দিয়ে আপনি কতটা মহত্ত্বের কাজ করেছেন বলুন আমায়?’
‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?’
নাজিম টেবিলে ঘুষি মেরে আবার বলল,
‘আমাকে আপনি সেই পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কেন মেলাচ্ছেন? আমি কেনই বা তাকে প্রশ্রয় দেব?’
কাব্য বলল, ‘তাহলে তার বিরুদ্ধে এখনও অবধি কোন স্টেপ কেন নেননি?’
‘নেওয়া হবে, খুব শীঘ্রই নেওয়া হবে। সময় তো দিন আমাদের।’
কাব্য করতালি দিল। ঠোঁটে তার তাচ্ছিল্যের নিদারুণ হাসি।
‘নয়নার বেলায় সময় লাগবে। কারণ সেতো গ্রামের মেয়ে। কেসটাও পুরনো। তবে নাহিদের কেসটা তো তাজা। তাই সে সাথে সাথে জাস্টিস পাবে। আর নয়না মেয়েটি? এখনো নয়নার খুনীদের শাস্তি দেখার আশায় দিন-রাত গোনা নয়নার মা-ভাই ও আত্মীয়স্বজনরা বুঝি তুচ্ছ! দশটি বছর ধরে ছটফট করে চলেছে নয়নার মা, ভাই এবং নয়নার প্রতিটি কাছের মানুষ। নিষ্পাপ মেয়েটি বিনা অপরাধে ভয়ানক মৃত্যু যন্ত্রণার শিকার হয়েছে। এই একটা কারণ নয়নার মাকে কতটা ক্ষত-বিক্ষত করছে দিনের পর দিন, তা কি আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন? পারবেন না। আমিও পারবো না। কারণ আমি বা আপনি মা নই। যার মেয়ের সাথে এমনটা হয়েছে কেবল সেই মা-ই বুঝবে কেবল। আর রইল মিতু ও সেতুর ব্যাপারটা। বিয়ের পর থেকে দিন নেই রাত নেই নির্যাতিত হয়ে এসেছে তারা। শারীরিক ও মানসিক, দুই ভাবেই বিপর্যস্ত হয়েছে তারা। মার খেয়ে তাদের হাড়-মাংস পঁচে যাওয়ার মতো হয়েছে৷ তখন কোথায় ছিলাম আমরা? আমাদের মতো আইন ভক্ত লোকেরা? আমরা কেন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াইনি? কারণ কি জানেন? আমাদের আশেপাশে মুখোশধারী কিছু আবর্জনা রয়েছে, যারা নিজেদের সচেতন আইনজীবী মনে করলেও, প্রকৃত অর্থে তাদের ভেতরটা কয়লা। কয়লার ন্যায় কালো তাদের বিকৃত মস্তিষ্ক। এইজন্য আজ সেতু,মিতুর মতো নিপীড়িত নারীরা অতিষ্ঠ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পথে পা বাড়িয়েছে। তারা যদি তাদের ন্যায্য বিচার পেতো, নয়না যদি তার খুনীর যথাযথ বিচার পেতো তাহলে আজকের এই দিনটা আসতো না। আমরা এই দিনটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসেছি। বাধ্য করেছি সেতু, মিতুকে অন্যায় পথে নিজেদের বিচার আদায় করতে। এখনও বলবেন আমি সার্কাস করছি? বলুন অফিসার।’
নাজিম অনুতপ্ত সুরে বললেন, ‘আমি বুঝলে কি হবে? আমরা কি প্রতিটি ঘরে ঘরে, প্রতিটি গ্রামে গিয়ে কে কেমন আছে তা দেখবো? আমরা তো হুকুমের দাশ। উপর থেকে যা নির্দেশ আসে, তাই মেনে নিতে হয়। আমাদের নিজ ইচ্ছে বলতে কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, আপনার প্রতিটি কথায় যুক্তি আছে। আপনি কাল কোর্টে এসব কথা তুলে ধরবেন। আমি আপনাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করলাম। এখানে আর ঝামেলা করবেন না। এখন ব্যাপারটা যখন কোর্ট অবধি এগিয়ে গেছে, তখন সেটা কোর্টের মাধ্যমেই সমাধা করতে হবে। প্লিজ!’
কাব্য নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিল। তিনি চলে যাবার জন্য উদযোগ পাতলে নাজিম বলল,
‘আপনি চাইলে সেতু,মিতুর সাথে দেখা করতে পারেন কিছু সময়ের জন্য।’
‘না, দেখা হবে আগামীকাল। আসি। আল্লাহ হাফেজ।’ বলল কাব্য।
_______
পরদিন মিতু,সেতু ও নাবিলাকে কোর্টে তোলা হয়। নাবিলার হাসবেন্ড এসেছেন কোর্টে। তিনি গতকাল নাবিলার জামিন করাতে চাইলে, নাবিলা ঘোর আপত্তি জানান। জজ সাহেবের নির্দেশে কার্যক্রম শুরু করা হলো। প্রথমে প্রশ্নবিদ্ধ হলো মিতু। সে কিতাব ছুঁয়ে সত্য বলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এরপর উকিল সাহেব তার উদ্দেশ্যে বলে,
‘আপনি মৃত নাহিদের পেছনে দৌঁড়াচ্ছিলেন। এর মানে তার উপর সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল আপনার। যদি পাবলিক নাহিদের শরীরে হাত না দিত তাহলে আপনি তাকে খুন করতেন?’
মিতুর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘জ্বি করতাম। এবং আমি আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাচ্ছি। নয়নার খুন ও আমার মেয়ের অপহরনের পেছনে নাহিদের হাত রয়েছে -আমার বুবুর থেকে যখন আমি এসব জানতে পারি, তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই নাহিদকে খুন করার। তার এক চোখ আমিই উঠিয়ে আনি। আমার বুবু নয়।’
সেতু তখন কিছু বলার জন্য উতলা হলে ধমক প্রয়োগ করে তাকে থামিয়ে নেওয়া হলো। আবারও অনুমতি পেয়ে মিতু বলল,
‘আমি নাহিদকে সুযোগ দেই পালানোর। তার খুনীর পরিচয় পাওয়ার ইচ্ছে ছিল একান্ত আমারই। তবে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসায় তারাও ভাগীদার হয়ে যায়। এছাড়াও আমার স্বামী নুরুলকেও আমি খুন করতে চেয়েছিলাম। তবে সে বাদশার হাতে খুন হওয়ায় এই সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যায়। এই দুটো খুনের তীব্র ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও, আমি তা পূরণ করতে পারিনি। তবে এটা সত্য, তারা অন্যদের হাতে না মরলেও, হয় আমার হাতে মরতো নইলে আমি মরতাম তাদের হাতে। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষরা হলো নয়না, বুবু, মায়া আর কাব্য ভাই। সবাই যার যার জায়গায় আমার কাছে প্রিয়। একেক জন একেক কারণে প্রিয়। নয়না আমার নিজের বোনের থেকে কম কিছু না। আমি এখনও ভাবি ও আছে। ওর কথা, আমার জন্য ওর ভালবাসা, মায়া, আমার বিপদকে নিজের বিপদ ভেবে মোকাবেলা করা, আমাকে কেউ খারাপ কিছু বললে পায়ে-পা লাগিয়ে ঝগড়া করা, আমার হয়ে প্রতিবাদ করা এসব কিছু আমি ভুলতে পারবো না। মেয়েটা আজ আমাদের মাঝে নেই। এটা মেনে নেওয়া কতটা অসম্ভব আমার পক্ষে, আমি সেটা বলতে পারবো না। তাকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছিল নাহিদ। নয়না বলতো আমরা একই ঘরের দুই ভাইকে বিয়ে করবো যাতে আমরা সারাজীবন আলাদা না হতে পারি। কিন্তু নাহিদ আমাদের আলাদা করে দিল। আমার নয়না অনেক কষ্ট নিয়ে মরেছে, আমি এটা ভাবলে দম বন্ধ লাগে আমার। মরার সময় আমার নয়না বাঁচার জন্য নাহিদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল- এটা ভাবলে আমার বুক ফেটে যায়। কেন বাঁচিয়ে রাখলো না নয়নাকে? ধর্ষণ করলেও বেঁচে ছিল আমার নয়না! এটা হলেও হতো। কিন্তু জীবনের মতো তাকে দূরে পাঠিয়ে দিল নাহিদ। আমার আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, নয়নার সাথে একটু দেখা করতে চাই। ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই, আমি তোর খুনীরে শাস্তি দিতে পারছিরে নয়না! তুই এইবার একটু হাস, আমি তোর সুন্দর মুখটা মন ভইরা দেহি।’
মিতুর ভুবন কাঁপানো সেই কান্নায় চোখ ভারি হয় অনেকের। উকিল সাহেব এবার সেতুকে প্রশ্ন করে,
‘আপনার স্বামী খুন হয়েছে, এতে আপনি শোক পালন না করে বরঞ্চ আনন্দিত। কিন্তু কেন? স্বামী তো মেয়েদের অলংকার। আপনি কিভাবে পারলেন নিজের স্বামীকে আঘাত পেতে দেখতে? কেন বাঁধা দিলেন না আপনার বোনকে?’
সেতু উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সকলে সেতুর সেই হাসি দেখল হতবিহ্বল, হতবুদ্ধি, নির্বাক হয়ে। হাসি থামিয়ে সেতু বলল, ‘কার লাইগ্যা শোক পালন করমু? কার লাইগ্যা চোখের পানি ফেলমু? ওই জল্লাদের লাইগ্যা? ওরে আমি স্বামী মানি না। দুনিয়ায় খারাপ মানুষ বহু আছে। কিন্তু ওর লাগান খারাপ দুইডা নাই। আমরা দুইবোইন আইজ বিধবা। আমরা স্বামীর লাইগ্যা এক ফোঁট চোখের পানি ফেলার হুকুম পাইনাই চোখ থেইক্যা। এর পেছনের কারণ কি আমরা? না, আমরা না। তারা নিজেই। আমগো শরীরে ক্ষতর দাগ গুইন্যা শেষ করন যাইব না, এত দাগ! হেরা দুই ভাই বউ না কামলা আনছে। গাধার লাগান খাইট্টা মাইর-গুতা খাওয়া কামলা। আমি মা হইতে পারি নাই। জানি নাহিদের লগে সংসার করলে পারুমও না। কিন্তু তাও আমি ওরে ছাড়ি নাই। কারণ বিয়া একবার যহন করছি, ওর বাড়ি থেইক্যা লাশ যাইব নইলে বিধবা হইয়া পইড়া থাকুম। এই নিয়ত কইরা ছাড়ি নাই ওরে। কিন্তু মা না হইয়াও আমি মায়ার মা হইয়া উঠছিলাম। কিন্তু ওয় হের দিকেও হাত বাড়াইছে। আপনারা তো আমগো শাস্তি দেওনের লাইগ্যা কাঠগড়ায় তুলছেন, অন্যায় করছি বইল্যা। কিন্তু হেরা যে অন্যায় গুলা করছে, এইগুলা কি আপনাগো চোখে পড়ছে? পড়ে নাই। আর জীবনে পড়তোও না। তাই নিজের স্বামীরে ছোডো বোইনের হাতে তুইল্যা দিয়া খুন করার অনুমতি দিছি। আমিও সাহায্য করছি মিতুরে। ওর হাতে না মরলেও নাহিদ আমার হাতে মরতোই। আমি ছাড়তাম না ওরে। আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন শেষ করছে বাপ-মায়। সুখে সংসার করতে চাইছিলাম হেইডাও ভাগ্যে জুটে নাই। দেখছেন খেয়াল কইরা আমগো দুই বোইনের গতরের রঙ? দুধে-আলতা গায়ের রঙ আমগো। কিন্তু কপাল পোড়া! সুন্দর হইলেই তার কপালে সুখ থাহে না। এর লাইগ্যা ভাইগ্য লাগে। যেইডা আমগো মতো মাইনষের হাতে নাই। আমরা দুই বোইন মাইর খাইতে-খাইতে পাথর হইয়া গেছি, তাও আমরা মরি নাই। আমার স্বামী, শ্বাশুড়ি, ভাশুর হেই লাইগ্যা আমগো রে কৈ মাছের প্রাণ কইতো। জীবনে কি আছে আমগো কষ্ট ছাড়া? বাপের বাড়িতে কষ্ট করছি খাবারের জন্য, আর বিয়ার পর তো কষ্টের শেষ নাই। কষ্টও হাঁপায় গেছে। কষ্ট এখন আমগো দেইখ্যা পালাইতে চায়। কিন্তু আমরা তারে ধইরা ফেলাই। এহন কথা হইল, আমরা কপাল পোড়া যহন হইছি, তহন মৃত্যুর আগে তরি কপাল পোড়াই থাকতে চাই। মওত আইলে তো ভালোই। বাঁইচ্যা যাই তাইলে। এহন আপনারা আমগো সাহায্য করেন আমার বোইনরে আর আমারে ফাঁসির রায় দিয়া। তাইলে আত্মহত্যাও হইব না, আর পোড়া কপাল থেইক্যাও মুক্তি পামু।’
মিতু এসে সেতুকে জড়িয়ে ধরলে সেতু হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। কিছু সময় নীরবতা পালন হয় সেতু, মিতু ব্যতীত সেখানে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মধ্যে। কাব্য ও তৌসিফ সামনের কাতারের চেয়ারগুলায় বসা। তাদের হৃদয়ও কাঁদছে।
মিতুকে বুকে জড়িয়ে সেতু বলল,
‘আমার ছোডো বোইনডার বিয়া হইছে মাত্র বারো বছর বয়সে। হেই বয়স থেইক্যা যেই ঝড় গেছে ওর উপর দিয়া, আমি তো ভাবছিলাম কয়দিনের ভিত্রেই ওয় মইরা যাইব৷ কিন্তু ওর রক্ত আর আমার রক্ত তো এক৷ আমি যহন দাঁত কামড়াইয়া সহ্য করতে পারছি, ওয় ক্যান পারবো না কন? ওয় তো আমার থেইক্যাও বেশি কষ্ট করছে। ১৩-১৪ বছরে বাচ্চা প্রসব কইরা ছেলেরে হারাইছে। তহন তো আমার বোইন সন্তান কি হেইডাই বুঝতো না। নিজেই তো পোলাপান আছিলো। তারপর জন্ম দেয় মায়ারে। হেরপর আস্তে আস্তে আমার বোইনডা বড়ো হইতে থাহে। মা হওয়া মানে একটা মাইয়ার জীবনে এমন একখান দায়িত্ব, যেইডা বুঝতেও একটা বয়স লাগে। আমার বোইন বুঝার বয়সডাতেই মা হইয়া যায়। এইগুলা কিন্তু সহজ না। ওই মুহুর্তডা অনেক কঠিন। আমি বেশিদূর পড়ি নাই। ৮ম পাশ। কিন্তু এই ব্যাপারগুলা পড়ছি বিধায় জানি। মা শুধু জন্ম দিলেই হয়না, মা হইতেও নির্দিষ্ট বয়স লাগে। আমার বোইন বুঝতো না, লজ্জা পাইতো। আমি ধইরা ধইরা শিখাইতাম সব। বয়সের সাথে ঠিকই বুঝছে সন্তান কি। হেই সন্তানের লাইগ্যা আমার গেরামের সাধাসিধা বোইনডা আইজ শহরের ম্যাডামও হইয়া গেল! তাইলে বুঝেন মায়ের কি ক্ষমতা! হেরা সব পারে তার সন্তানের লাইগ্যা। মা মানেই অল-রাউন্ডার। অনেক কইছি, এইবার আপনারা আমগো শাস্তি দেন।’
সেতু থামলে মুহুর্তেই হাতে তালির শব্দে ছেয়ে গেল চারিপাশ। জজ সাহেব নিজেও শামিল হয় সেই শব্দ তুলতে। প্রসন্ন মনে তিনি বলেন, ‘তোমাদের শাস্তি দেওয়ার অধিকার কারো নেই। বিনা কারণে তোমরা শাস্তিভোগ করে এসেছো। এখন তোমরা হাসবে। বাকীটা জীবন ভালো থাকো দোয়া করি। আমার নাম্বার দিয়ে দেব। যখন সাহায্য লাগবে আমি আছি মা। যা করেছো ঠিক করেছো, তবে এরপর থেকে কোন বিপদ হলে প্রথমে আমাকে স্মরণ করবে। মনে থাকবে?’
সেতু ও মিতু সমস্বরে বলল, ‘আমরা শাস্তি চাই।’
জজ সাহেব বললেন, ‘তোমাদের শাস্তি দিলাম ভালোভাবে বাঁচার। এখন থেকে কেউ আসবে না তোমাদের কষ্ট দিতে। তোমাদের মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকো। আমি তোমাদের সারাজীবনের খরচ বহন করতে চাই। যদি সেই সুযোগ পেতাম?’
মিতু বলল, ‘আমরা কষ্ট করে খেটে খাব কাকু, আমরা খেটে এসেছি এবং খাটবো।’
আরও কয়েক দফা খুশি হলেন জজ সাহেব।
‘এমন চিন্তার মেয়েরা এত কষ্ট করেছে এইটুকুন বয়সে! আমি স্পিসলেস। তোমাদের জন্য অনেক দোয়া ও প্রার্থনা। ভালো থাকো।’
তখন কাব্য সহসাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার কিছু কথা আছে। যদি সুযোগ দিতেন জজ সাহেব।’
জজ সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ অবশ্যই। আসুন কাঠগড়ায়।’
কাব্য কাঠগড়ায় উঠে জজ সাহেবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘সেতু ও মিতুর ব্যাপারে যা বলতাম, তার সবই সেতু বলে ফেলেছে। আমি তাই আর সেটা নিয়ে বললাম না। তবে আমি অনুরোধ করছি, নয়নার খুনের ব্যাপারটায় যারা যারা জড়িত, তাদের প্রত্যককেই গ্রেফতার করা হোক। এমনকি তাদের খুব কঠিন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে করে ধর্ষক ও প্রশ্রয়কারী উভয়ই এমন জঘন্য কাজ করার আগে বহুবার ভাবে।’
জজ সাহেব বললেন, ‘অবশ্যই। নাহিদকে যেই পুলিশ-দারোগারা সাহায্য করেছে, তাদের প্রত্যককেই গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হলো। এবং কেউ যদি নয়নার মতো এমন নির্মম খুনের শিকার অথবা অন্য যেকোন ভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে আর সেই অভিযোগ যদি স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা নাকচ করে, তাহলে মুখ বুজে সহ্য না করে সেই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কত রকম মাধ্যম রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানানোর, তা অবলম্বন করবেন। তাহলেই তো বিষয় টা ভালো লোকেদের কাছে পৌঁছাবে। নতুবা অত্যাচারী পার পেয়ে জুলুম করেই যাবে। যেমন কাব্য রহমানদের মতো কিছু সচেতন সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের অসুবিধা গুলো তুলে ধরবেন। আশা রাখি আপনারা এবার থেকে সতর্ক হবেন। আপনি কি আর কিছু বলবেন মিস্টার কাব্য?’
কাব্য বলল, ‘না মিলর্ড, ধন্যবাদ আমাকে বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।’
কাব্য নেমে গেলে তৌসিফ কাঠগড়ায় উঠে জজ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার কিছু কথা ছিল মিলর্ড।’
জজ সাহেব হতে নির্দেশ আসলো বলার।
তৌসিফ বললেন, ‘আমি নিজেকে সাংবাদিক কাব্যর বাবা হিসেবে পরিচয় দেইনি কখনো। কারণ আমার কাছে আমার পরিচয়, আমি একজন শিক্ষক। মানুষদের শিক্ষা দেই আমি। কিন্তু কিছু মানুষরা শিক্ষাকে মর্যাদা দিতে জানে না। জানলে অকালে মেয়েদের বিয়ে দিতো না। ওইযে আমার সামনে দাঁড়িয়ে দুজন ফুলের মতো মেয়ে, তারা আজ ঝরে পড়েছে তাদের বাবা-মায়ের বোকামির জন্যই। তাদের বাবা-মা যদি পড়াশোনা নিয়ে সচেতন হতো, তাহলে মেয়ে দুটো আজ এভাবে কপালের দোষ দিতো না। দোষ ভাগ্যের নয়, দোষ কিছু মূর্খ মানুষের। যারা নিজেদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেন স্ব-ইচ্ছায়৷ তারা তাদের ছেলে মেয়েদেরও ধাক্কা দিয়ে সেই অন্ধকারের দিকেই ঠেলবে। কারণ তারা তো সেখানেই বেড়ে উঠেছে। আমার ইচ্ছে, প্রতিটি ঘরে শিক্ষার আলো জ্বলুক৷ সেই সাথে মনেরও। আমি সেতু আর মিতুর জীবনী গ্রামে-শহরের প্রতিটি স্থানে পৌঁছানোর নির্দেশ চাচ্ছি। এতে করে অভিভাবকেরা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করবে। শিক্ষাকে মূল্য দেবে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর মেরুদণ্ড ছাড়া কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। ছেলে-মেয়ে উভয়ের শিক্ষা একটি সফল-স্বাধীন দেশ গড়তে সক্ষম। ধন্যবাদ মিলর্ড।’
জজ সাহেব আরো একবার করতালি দিলেন। তার সাথে যোগ হলো সবাই৷ একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে জজ সাহেব বললেন, ‘আপনার কথাগুলো বাঁধিয়ে রাখার মতো। আপনি সেরা বাবা। তবে আপনার ছেলের জন্য নয়৷ আপনার জন্য আপনার ছেলে ভালো কিছু শিখতে পেরেছে। কাব্যকে কম-বেশি প্রায় সবাই চেনে তার ভালো কাজের মাধ্যমে। তাকে কোন ক্রেডিট দেওয়ার আগে সেই ক্রেডিটের প্রথম ভাগিদার আপনি। তারপর সে। আপনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আদর্শ। শিক্ষার্থী কেবল যে নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের, তা কিন্তু নয়। যে শিক্ষা দেয়, তার কাছে প্রতিটি অজ্ঞাত ব্যক্তি শিক্ষার্থী। যেমন আমিও আপনার শিক্ষার্থী কারণ আপনার থেকে আমি শিখলাম, ছেলে-মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। ভালো থাকবেন আপনারা সবাই। আজকের মতো বিদায়।
এক এক করে সকলে কক্ষ ছাড়ছে। কাব্য, মিতু ও সেতুর দিকে এগিয়ে গেল। প্রসন্নচিত্তে সে বলল,
‘তোমরা দেখিয়ে দিলে, গ্রামের মেয়েরা কতটা শক্তিশালী ও সাহসী। আমি গর্বিত তোমাদের দুই বোনকে নিয়ে। একই সাথে তোমরা অন্যদের জন্য শিক্ষামূলক প্রচারণা ও দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করলে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ…