উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৪০
জিম থেকে বেরিয়ে সুইচ অফ করা ফোন পুনরায় চালু করতেই রাত্রির নাম্বার থেকে আসা অসংখ্য মুঠো বার্তা ও মিসড কলের বিজ্ঞপ্তিতে নিরন্তর বেজে ওঠা ফোনটি ভ্রু-জোড়া অস্বাভাবিক মাত্রায় সংকুচিত করে আনে কাব্যর। এর মধ্যে পাশে পরিচিত কারো কন্ঠ শ্রবণেন্দ্রিয় স্পর্শ করতেই সেদিক ফিরে তাকাল।
‘দিনকাল কেমন যাচ্ছে সাংবাদিক সাহেব? শুনলাম বিবাহিত এক গাঁয়ের মেয়ের জন্য বৈরাগী হয়ে ঘুরছেন খানাপিনা তুঙ্গে তুলে!’
সুপ্ত সাখাওতের ঠোঁটের আলিজে টানটান হাসির বিরাজ। কাব্যর উদ্দেশ্যে বলা তার কথা ও তাচ্ছিল্যের হাসি, মুহুর্তেই লেলিহান শিখার ন্যায় ভয়ানক করে তোলে কাব্যকে। মুষ্টিবদ্ধ করে সুপ্তর দিকে এগিয়ে গেল কাব্য। এক পাশের ভ্রু উপর-নীচ করে বলল,
‘আবার বলুনতো!’
সুপ্ত পরিবর্তনশূণ্য ভঙ্গিতে বলে উঠল,
‘আমি রিপিট করি না। কিন্তু এভাবে তেড়ে আসলেন যে? মারবেন? মারেন। আমি তো সেটাই চাই। মেরে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। আজ তো সাথে করে বডিগার্ডও আনিনি। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না সাংবাদিক সাহেব।’
কাব্য হাত গুটিয়ে আনল। এদিক-সেদিক চেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ‘পীপিলিকার পাখা গজায়, মরিবার তরে। অনেক উঁড়েছেন, উঁড়তে দিয়েছি, তবে আর নয়।’
সুপ্ত কিঞ্চিৎ ঝুকে খ্যাঁক করে বলল, ‘ওহ! বেশ ভালো বললেন। তবে সাংবাদিক সাহেব, আপনি কি জানেন কার্য হাসিলের পথ তিনটা? ছল,বল ও কৌশল। তবে কৌশলের থেকে আমি ছল ও বলে বেশি বিশ্বাসী। আপনার ক্ষেত্রে আমি ছল ও বল দুটোই ইগ্নোর করেছি। কৌশলে বোঝালাম কত, কিন্তু আপনি যে এক নাম্বারের নাছোড়বান্দা। অলরেডি দুদোক আমার দুশো কোটি টাকা আটকে রেখেছে আপনার করা কিছু নিউজের ভিত্তিতে। সেই শোক কিন্তু এখনও কাটাতে পারছি না। তবুও আমি শেষ বারের মতো আপনার নিকট বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি৷ এখনও সময় আছে আমার হাত ধরুন। নইলে আমার ছলচাতুরী ও বলের প্রভাবে দু’মিনিটে আপনার টিকিটাও নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হবে।’
কাব্য ভাবলেশহীন ভাবে পকেটে ফোন পুরে পা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়ালো। এবং বলল,
‘জোর যার, মুল্লুক তার। শুনেছেন নিশ্চয়ই?’
সুপ্ত বলল, ‘অবশ্যই শুনেছি। প্রমাণ আমি নিজেই।’
সামান্য হাসল কাব্য। পরমুহূর্তেই মুখ কঠিন করে বলল,
‘তো জোরটাকেই দমিয়ে ফেলতে হবে। তাহলে না থাকবে জোর, আর না পাবে মুল্লুক। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী।’
সুপ্তর মুখে আতংক। গলার স্বরও তার তেজ হারায়।
‘কি করবেন আপনি?’
‘সারপ্রাইজ! বিশেষ করে আপনাদের মতো কিছু লোকেদের জন্য এমন সারপ্রাইজ সুপার-ধামাকার মতন। আর হ্যাঁ আপনি,,,,’ কাব্যর কথার মাঝে রাত্রির কল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কাব্য মনোযোগী হয়ে ফোন কানে ধরলে ওপাশ থেকে রাত্রির বলা কথায় মুখচোখে একরাশ বিস্ময় ভর করল। সুপ্তকে উপেক্ষা করে কাব্য তার গাড়িতে গিয়ে চড়ল এক প্রকার তাড়াহুড়োর মধ্যে। ধোঁয়া উঁড়িয়ে চলে গেল সুপ্ত সাখাওতের সামনে থেকে। অসীম ক্রোধে শরীর কেঁপে উঠছে সুপ্তর৷ তিনি সহসাই পাশের টাইলস করা দেয়ালে জোরেশোরে লাথি ঘুষি মেরে নিজের রাগ ঝাড়তে লাগেন।
_____
‘তো তুমি গ্রামে ফেরত যেতে চাচ্ছো?’
বাদশার প্রশ্নে মাথা উপর-নীচ করে মিতু। সাথে বলে, ‘আমার মেয়েসহ যাব।’
‘কিন্তু তুমি যে এক বছরের আগে কোথাও যেতে পারবে না!’ বলল বাদশা।
মিতু বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে।
‘এক বছর মানে? এমন কথা তো ছিল না আপনার সঙ্গে!’
‘মেয়েকে পেতে হলে মিনিমাম এক বছর আমার হয়ে কাজ করতে হবে। নইলে মেয়েকে পাওয়ার আশা ছাড়ো।’
মিতুর উগ্রতা, ‘আপনি মানুষ নাকি জানোয়ার? সুযোগ পাইয়া ভালোই মাথায় উঠছেন! আমার পক্ষে আর সম্ভব না, আমার মাইয়ারে ফেরত দেন আমি যামুগা।’
মুহুর্তেই বাদশা ও লুৎফর গগনবিদারী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বাদশা হাসি থামিয়ে বলল, ‘তা যে হওয়ার নয়। কথা দিচ্ছি এক বছর হলেই তোমার মেয়েকে তোমায় বুঝিয়ে দেব। কিন্তু এর আগে কোনরূপ ঝামেলা পাকালে মেয়ের লাশ পাবে, লাশ।’
বুক ফুড়ে কান্না বেরিয়ে আসল মিতুর। আকুতির সুরে সে বলল, ‘দয়া কইরা এমন কথা কইয়েন না। বুঝ হওয়ার আগে থেইক্যা অনেক কষ্ট করতাছি। কিন্তু এহন মাইয়াডারে নিয়া একটু মন ভইরা শ্বাস নিয়া বাঁচতে চাই। সেই সুযোগখান কাইড়া নিয়েন না।’
লুৎফর বলল, ‘আহারে, কি কষ্ট, কি কষ্ট! দেখেন বস, আমার চোখ পানিতে চিকচিক করছে এই অবলা নারীর আত্মগ্লানি শুনে।’ বলে আবারও অট্টহাসি দিল।
মিতুর এবার প্রচন্ডরকম রাগ চড়ে বসল। সে এগিয়ে গিয়ে লুৎফরের এক গালে পরপর দুটো চড় বসিয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড তব্দা খেয়ে রইল লুৎফর। এরপর গলা উঁচিয়ে বললেন,
‘বস একবার মারার অধিকার দিন এই চন্ডীকে। কতো বড়ো সাহস সে আমাকে মারে আবার কথায় কথায় চামচা বলে!’
বাদশা আদেশ দিলে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠে লুৎফরের চঞ্চুদ্বয় জুড়ে। সে মিতুর চুলের মুঠি ধরতে উদ্যত হতেই কাব্য হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল। উচ্চ গলায় ‘মিতুবুড়ি’ বলে উঠতেই চকিতে দরজায় তাকালো মিতু। কাব্যর কাছে ছুটে যাবার আগেই বাদশা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কাব্যর সামনে। সেই সাথে চড়া গলায় বললেন,
‘কি চাই এখানে? আমার পারমিশন ছাড়া আমার ক্যাবিনে কোন সাহসে ঢুকে গেলেন আপনি?’
‘সামনে থেকে সরুন, আমি আমার মিতুবুড়ির সাথে কথা বলবো।’
‘কে মিতুবুড়ি? এখানে কোন মিতুবুড়ি টুরি নেই। ভদ্রতা বজায় রেখে চলে যান,নইলে সিকিউরিটি গার্ড ডেকে তাড়িয়ে দেব।’ বলতেই একজন সিকিউরিটি গার্ড চলেও এলো। মাথা নত করে সে বলল, ‘উনি জোর করে চলে আসছে, আমি আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম।’
বাদশা সিকিউরিটি গার্ডকে না ঘেটে কাব্যর উদ্দেশ্যে বলল, ‘কথা কানে যায়নি আপনার? চলে যেতে বলেছি আমি।’
কাব্য বাদশাকে ঠেলে সরিয়ে মিতুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নতুন মিতুকে বেশ কিছুক্ষণ খুটিয়ে দেখল কাব্য। যতই মিতুর বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটুক, কাব্যর জন্য মিতুর ওই চঞ্চল চোখ ও কাঁপা ওষ্ঠদ্বয়ই যথেষ্ট তার মিতুবুড়িকে চিনতে। মিতুর ভারী চোখ হালকা হয়ে পুনরায় জলে ভরে উঠছে। কাব্য মিতুর দু’বাহু চেপে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
‘এসবের মানে কি? তোর এই হাল, তুই এখানে কেন, এসব কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না।’
মিতু নিশ্চুপ। লুৎফর বলল, ‘আপনি আমাদের মডেলের সাথে আমাদের পারমিশন ব্যতীত নিজ খুশি মোতাবেক কথা বলতে পারেন না। কোন দরকার থাকলে আমার বসের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’
কাব্য তা কানে তুলল না। সে মিতুর চোখের দিকেই নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে। বাদশা ও লুৎফর ঘনঘন চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে মিতুর দিকে। মিতু আঁড়নজরে তা বেশ ভালো করে লক্ষ্য করছে। বাদশা একবার গলায় ছুরি চালানোর মতো করে বৃদ্ধা আঙুল গলায় চালিয়ে ফোনের দিকে ইশারা করে দেখায়। যার অর্থ মিতু বুঝে সারা। মিতু হঠাৎ কাব্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছাড়িয়ে নেয় নিজের বাহুদ্বয়। এরপর উঁচু গলায় বলল, ‘আমি মিতু হই বা যেই হই, আপনার তাতে কি? আমি এখন আর গ্রামের মেয়ে মিতু নই। আমি এখন মডেল মিতু। আমার অনুষ্ঠান দেখেননি আজ?’
কাব্যর চারিদিক থেকে অন্ধকার জেঁকে বসল আচমকা। এ কি শুনছে সে? এভাবে কথা যে তার মিতুবুড়ি বলে না! তবে কি সে ভুল শুনেছে? সে কি ভুল কাউকে মিতু ভেবে বসেছে? কিন্তু ওই চোখ, মুখ যে ভুল নয়। কাব্য আবারও মিতুর দিকে এগিয়ে গেল। তখন মিতু দু কদম পিছিয়ে বলল, ‘আমার স্বপ্ন আমি অনেক বড়ো কিছু হবো। তা পূরণের লক্ষ্যেই গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা। তুমি দয়া করে আমার সব স্বপ্নে পানি ঢেলে দিও না কাব্য ভাই। চলে যাও তুমি। আমি যা করেছি নিজের ইচ্ছেতেই৷ আমি মডেলিং করতে চাই। ভালো কাপড়, ভালো খাবার, সুন্দর একটা জীবন চাই। এর থেকে বেশি কিছুতো চাওয়ার নেই একটা মানুষের৷ আমি ভালো আছি এখানে৷ আর এভাবে চললে সারাজীবন ভালো থাকবো। দয়া করে আমার স্বপ্ন থেকে আমাকে আলাদা করো না। ঝামেলা পাকিয়ো না বাদশা সাহেবের সাথে। তিনি খুব মহৎ একজন মানুষ। তার মতো মানুষ দুটো নেই দুনিয়ায়।’
কাব্য একটু একটু করে পেছালো। বিস্ময়াহত কাব্যর মুখে কথা নেই কোন। মিতু আবারও বলল, ‘আমার কোন বিষয়ে নাক গলিও না। আমি আমাকে নিয়ে ভাবতে পারি। ঠিক ভুল বুঝি আমি। তুমি নিজের চরকায় তেল দিয়ে চলো। আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়িটা থামাও এবার। তোমাকে অসহ্য লাগে আমার। তাই আমার সামনে এসো না তুমি।’
কাব্য ভাঙা গলায় বলল, ‘তুই কি সত্যি নিজ ইচ্ছেতে এসব করছিস?’
‘হুঁ।’ বলল মিতু
‘তাহলে ঠিক আছে, তুই যা ভালো মনে করিস। আমি আর আটকাবো না তোকে। ভালো থাক তুই। এটা চাইতাম এবং চাই। খুব ভালো থাক তুই।’
হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা চোখে মুছে প্রস্থান করে কাব্য। কাব্য চলে গেলে বাদশা করতালির শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে বলে, ‘এক্সিলেন্ট মিতু! দুর্দান্ত অভিনয় করলে। এই খুশিতে ভিডিও কলে আজ যতক্ষণ খুশি মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবে তুমি। লুফু?’
লুৎফর সাড়া দিল, ‘বলেন বস।’
‘কথা বলিয়ে দে মেয়েকে তার মায়ের সাথে।’
‘ওকে বস, এক্ষুনি দিচ্ছি।’
মিতু অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। সে তার অসহায়ত্বের ঘনত্ব তার কাব্য ভাইকে বোঝাতে অক্ষম। এই অসহনীয় ব্যাপারটা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে যাচ্ছে মিতুর সমগ্র বুক-পিঞ্জর।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
বিঃদ্রঃ লিখার সময় হয়না পড়াশোনা ও টিউশনির জন্য৷ আজ কি লিখলাম নিজেও জানি না। ঘুম পাচ্ছে তাই আজকের জন্য এতটাই সম্ভব হলো। আগামী পর্ব বড়ো হবে ও জটিল হবে। সাথে ধামাকাও থাকবে।