গোধূলিলগ্ন ৪১

0
256

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৪১

মিতু মায়ার সঙ্গে কথা বলেছে বেশ লম্বা সময় নিয়ে। বেশ রাত হওয়ায় মায়ার চোখ বুজে আসে। বুঝতে পেরে কথায় ইতি টানে মিতু। সে বিছানার এপাশ ওপাশ করল অগণিত বার৷ বারবার নেত্রপল্লবে ভেসে ওঠা কাব্যর জলভর্তি চোখ দুমড়েমুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে মিতুর কাতর মন। মিতু ভেবে পায়না সে আর কত কাঁদবে? চোখের পানিরাও হাঁপিয়ে উঠেছে তার। জমানো কষ্টরা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসল। ক্রন্দনরত মিতু বলছে, ‘তুমি আমারে এত বেশি ভালবাসো ক্যান কাব্য ভাই? আমি অনেক ঋণ জমায় ফেলছি তোমার ধারে। তুমি যেমন মানুষ, তোমার পাশে অমন মানুষই মানানসই। আমি কোন দিক দিয়াও তোমার লাইগ্যা সঠিক না। এই বিষয়খান তোমার লাগান শিক্ষিত পোলা ক্যান বুঝে না? বুঝলে আইজ এত বড়ো একখান ধাক্কা খাইতা না। তুমি আইজকার পর থেইক্যা আর আমারে নিয়া ভাববা না আমি জানি। ভুল বুঝবা আমারে। কিন্তু আমার যে কিছুই করনের লাইগ্যা নাই, কাব্য ভাই! আমার মাইয়ার লাইগ্যা আমি পুরা দুনিয়ার কাছেও খারাপ হইতে রাজী। কিন্তু তোমার চোখের পানি যে আমার বুকখান কাঁপাইয়া দিল। আমার ঘুম আইতাছে না। তোমার চোখের পানি আমারে ঘুমাইতে দিতাছে না। আমার মাইয়ার জীবনের ঝুঁকি না থাকলে, আমি কোন দিনও বাদশার লাগান ওইরহম বেজাত লোকের কথায় উঠতাম-বইতাম না। কাব্য ভাই, ও কাব্য ভাই! তুমি আমারে ভুল বুইঝ্যা নিজেরে কষ্ট দিও না।’
একটু একটু করে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে গেল মিতু। কপাল তার দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বেসামাল হয়ে কান্না করল। হঠাৎ কান্না থামিয়ে ঋজু হয়ে বসল। জোরে জোরে বার কয়েক শ্বাস নিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুত পদক্ষেপে।
______
ফ্যাশন হাউজের পাঁচ তলাটা গুমোট অন্ধকার। মিতু দেয়াল ধরে-ধরে ছয় তলা অবধি চড়ল। সিঁড়ির ডান দিকের দরজা তালাবদ্ধ থাকলেও, বাম দিকের দরজা হালকা খোলা৷ ভেতর থেকে শুভ্র আলো দরজার বাহিরের কিছু অংশ দখল করে রেখেছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ কানে আসলে পাশেই এক কোণের খোলা জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে গেল মিতু। অন্ধকারেও অচেনা ব্যক্তিটির প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে মেরুদণ্ড সোজা হয়ে আসলো মিতুর। ছায়াটা দরজার কাছে পৌঁছালে মিতু বুঝল অচেনা মানুষটি কোন এক বিশাল দেহের মানবীর। মহিলাটা খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার কিছু সময় পর মিতুও ঢুকল। ঢুকে সর্বপ্রথম মিতুর নজর গেল পরিত্যক্ত কাপড়ের ন্যায় পড়ে থাকা ঘুমন্ত মায়ার মুখপানে। মাটিতে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে মায়া। মায়ার ফ্যাকাসে মুখ দেখে মনে হলো কতকাল খায়নি সে! মায়ার হাতে বাঁধন। মিতু দৌড়ে গিয়ে মায়ার হাতের বাঁধন খুলে দিল। এরপর মায়াকে বুকে টেনে অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকল। শরীর দুলে উঠলে চোখ কোচলে মুখ উঁচিয়ে তাকায় মায়া। মিতুর মুখটা চোখে ভাসতেই ‘আম্মু’ বলে দু’হাতের বাঁধনে বন্দী করে নিল মিতুকে।
‘আম্মু তুমি আইছো আমারে নিতে! আম্মু আমার এইহানে একলা থাকতে ভালা লাগে না। একটা খারাপ মহিলা আমারে খালি মারে। আর কয়..’
হঠাৎ থেমে গেল মায়া। তার ভয়কাতুরে দৃষ্টি। মিতু মায়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকাল। বিশাল দেহি মহিলাটি আগুন চোখে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে। মিতুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাড়গিলে চেহারার অধিকারী মহিলাটি হুংকার ছাড়েন, ‘তুই এইখানে কিভাবে আসলি?’
মায়ার বুক মিতুর বুকের সঙ্গে সেঁটে থাকায় মায়ার দ্রুতগামী হৃদ স্পন্দনের তান্ডব বেশ ভালো মতো অনুভব করতে পারছে মিতু৷ মহিলাটি এবার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কিরে বলছিস না কেন? আচ্ছা এবার যে-পথ দিয়ে এসেছিস, সে-পথ দিতেই বেরিয়ে যা। যা,যা!’
মিতুর বাঁকা প্রশ্নবাণ, ‘যাব না, কি করবেন?’
‘কি করবো দেখবি তুই?’
এহেন প্রশ্নে মিতুর জবার, ‘দেখবো।’
মহিলাটি তেড়ে গিয়ে মায়ার হাতের ডানা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মিতু মহিলাটির হাত মোচড়ে মায়াকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মহিলাটির আর্তচিৎকারে মায়ার সব ভয় উবে গিয়ে হাসি ফুটল। মহিলাটি লম্বা হলেও বেশ হ্যাঙলা, পাতলা। শরীরে তেমন শক্তি নেই বললেই চলে। তিনি নিজেকে মিতুর বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর জন্য মিতুর হাত খামচে ধরে। উপায় না পেয়ে মিতু তার বিনুনি ধরে টান দিল। ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে ‘আহহ’ শব্দ করে উঠল মহিলাটি। মিতু তাকে ঠেলেঠুলে বাথরুমে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। এরপর বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে মায়াকে নিয়ে অতি সন্তর্পণে সদর দরজায় এসে পৌঁছাল। তবে দরজার কাছে টুল পেতে বসা মাঝবয়সী পাহারাদারকে দেখে থমকে গেল মিতু। মিতুকে থেমে যেতে দেখে মায়া বলল, ‘থামলা ক্যান আম্মু? চলো আমরা পালাই।’
মিতু মায়ার মুখ ঠেসে ফিসফিস করে বলল,
‘চুপ, আস্তে কথা ক। ওইযে দরজার ধারে দারোয়ান বহা। হেয় আমাগোরে দেখলে বাইরে যাইতে দিব না। তারপর আবার আমাগো বন্দী কইরা রাখবো।’
মায়ার মুখে মিতুর হাত থাকায় সে কিছু বলতে পারল না। মিতু বলল, ‘একখান বুদ্ধি আছে আমার ধারে, মায় যেমনে কমু হেমনে করতে পারবি?’
মায়া মাথা নাড়লে মিতু মায়ার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। শুনে মায়া খিলখিল করে হেসে উঠল। ধমকে মিতু বলল, , ‘হাসতে কই নাই তোরে। যা কইছি তাড়াতাড়ি যাইয়া কর, নইলে আমরা মা-মাইয়া জীবনেও এইহান থেইক্যা বাইরাইতে পারুম না।’
‘যাইতাছি তো আম্মু।’ বলল মায়া।

মায়া ঘাড় ঘোরাতে ঘোরাতে দারোয়ানের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। তখন রাত ভালোই। এগারোটার মতো। চকিতে মায়ার দিকে চোখ রাখে দারোয়ান। চড়া গলায় বলে, ‘এই পিচ্চি, কি চাই তোমার? ভেতরে ঢুকলা কখন?’
মায়া হঠাৎ কান্না করে দিল। গলায় অদ্ভুৎ আওয়াজ তুলে সে বলল, ‘আম্মু তুমি কই? আমি হের রক্ত খামু। হেয় আমারে ঝারি দিছে। আম্মু তুমি আমারে সাহায্য করো। আমি জানি তুমি এই আম গাছেই আছো। নাইম্যা আহো আম্মু। আমার খিদা লাগছে।’
মায়ার মাথার উপর বিশাল এক আমগাছ। যার ডালপালা ছাড়িয়ে মেইন গেইট অবধি পৌঁছেছে। মিতু খুব দ্রুত গাছে চড়তে পারে। মায়া যতক্ষণ দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলেছে, ততক্ষণে মিতু টুপ করে গাছে চড়ে গিয়েছিল। কথা ছিল; মায়া মিতুকে আমগাছ থেকে নামতে বললেই, মিতু গাছ থেকে লাফ দিবে। সাজানো মোতাবেক হলো সব। দারোয়ান এত সময় মায়াকে পাগল ভাবছিল। কিন্তু মিতুর হঠাৎ আগমনে হাটু কাঁপুনি দিয়ে উঠল তার। লাফিয়ে পড়ায় মিতুর চুলগুলো মুখের সামনে এসে দলা পাকিয়েছে। যার ফলে দারোয়ান লোকটার ভয়ের মাত্রা কয়েকশো গুণ বেড়ে গেল। মিতু এক হাত সটান করে এলোপাতাড়ি পা ফেলে দারোয়ানের দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে বলল,
‘কোনডায় তোরে ঝারি মারছে ক খালি আমারে!’
মায়া দারোয়ান লোকটার দিকে হাত উঁচিয়ে বলল,’এই শুকনা হাড্ডিয়ালা ব্যাডায়। আমি হের রক্ত খামু।’
মিতু পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল, ‘রক্ত, হাড্ডিগুস্ত সব খামু আমরা মা-মাইয়া মিল্লা। তুই আগে শুরু কর মা।’
মায়া ‘আইচ্ছা আম্মু’ বলে এগিয়ে যেতে নিলে দারোয়ান লোকটা ঠুস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাই দেখে মা-মেয়ের মধ্যে হাসির রোল পড়ল। সেখান থেকে বেরিয়ে মায়াকে নিয়ে একটা রিকশা ধরল মিতু। গন্তব্য বনানী ছয়।’
_____
পরদিন নতুন মুদ্রা প্রচলনের কার্যটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হওয়ার পর থেকে দেশ জুড়ে বিশাল আকারের হাঙ্গামা ছেয়ে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যে পুরাতন হাজার ও পাঁচশত টাকার নোট জমা দিয়ে নতুন আবিষ্কৃত হাজার ও পাঁচশত টাকা ব্যাংক থেকে বদলি করিয়ে নেওয়ার নির্দেশ আসলো সরকার কর্তৃক। এর সাথে বিশেষ কিছু শর্তও জারি করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম শর্তটি হলো, যারা পঞ্চাশ হাজার টাকার উর্ধ্বে নগদ টাকার বদলি করাবেন, তাদের অবশ্যই সেই টাকার উৎসস্থলের প্রামাণ্য দলিল ব্যাংককে জমা দিতে হবে। এরপর জমাকৃত পুরাতন টাকা নতুন টাকায় রুপান্তরিত হবে, নতুবা তা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। আর যাদের আগে থেকে ব্যাংকে হিসাব খোলা রয়েছে, তাদের কোনরূপ ঝামেলা পোহাতে হবে না। তারা নির্ঝঞ্ঝাটে নতুন মুদ্রা পেয়ে যাবে চাহিবামাত্র।
সুপ্ত সাখাওত এ পর্যায়ে দু’বার জ্ঞান হারিয়েছেন। দ্বিতীয়বার জ্ঞান ফেরার পর তিনি বেশ কিছু সময় মৌনতা বজায় রাখলেন। তার পাশেই নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে সাজিদ। সুপ্ত শীতল কণ্ঠে সাজিদের উদ্দেশ্যে শুধায়,
‘তোকে না বলেছিলাম কাব্যর দিকে ঈগলের দৃষ্টির মতো নজর রাখার জন্য? তুই কি করলি? দুই দুইবার বড়ো বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেল আমার, তাহলে তোকে দিয়ে লাভ কি হলো বলতে পারিস?’
নড়বড়ে কন্ঠে সাজিদ বলল, ‘শালায় খুব চালু। চুপচাপ থাকে, মাথায় কি চলে না চলে কিছু ধরা যায়না। কোনদিন কাজের কথা ছাড়া বাড়তি কিছুই বলেনি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে ধমকে চুপ করিয়ে দেয় শালা শুয়োর।’
সুপ্ত সীমাহীন ক্রোধে সাজিদের ঘাড় চেপে সোফার সঙ্গে চেপে ধরে বলল,
‘অকর্মার ঢেকি! তোকে খালি খালি ভরসা করেছি। আমার সব শেষ। এখন আমি এতগুলো নগদ টাকা নিয়ে কি করবো? ওগুলো তো এখন কাগজ মাত্র। দাম নেই কোন। হায় কপাল!’ দুঃখে কপাল চাপড়ান সুপ্ত সাখাওত। সাজিদ বলে, ‘আপনি এইবার আর কাব্যকে ছাড় দিয়েন না। আমার মতে ওর জন্য সবচেয়ে বড়ো শাস্তি ওর বাবা-মার মৃত দেহ। তাহলে ও এমনিতেই মনোবল হারিয়ে শেষ হয়ে যাবে। এতে ওর শিক্ষাও হবে।’
সুপ্ত তাচ্ছিল্য করে হাসল। পরমুহূর্তে কন্ঠে উগ্রতা এনে বলল, ‘আমি কি এটা ভাবিনি ভাবছিস? ওই সাংবাদিকের বাচ্চা খুব বেশি শেয়ানা। আগেভাগেই ওর পরিবারকে সরিয়ে রেখেছে। আমি লোক পাঠিয়েছিলাম ওর বাড়ি। তালা ঝুলানো, কেউ নাই।’
‘তাহলে একটা উপায় আছে কাব্যর পরিবারের খোঁজ পাওয়ার। বলবো কি?’
সুপ্ত এক নজর সাজিদের দিকে চেয়ে ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। হা-হুতাশ করে বললেন, ‘আর কি উপায়? সব শেষ আমার। আমি এখন দেউলিয়া।’
সাজিদ উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, ‘রাত্রির মাধ্যমে কিছু জানা যেতে পারে কাব্য সম্পর্কে। ওতো কাব্যর সাথে বেশি মিশে। আমি নিশ্চিত ও কিছু না কিছু জানে। আপনার আবার উপরে উঠতে সময় লাগবে ঠিকই, কিন্তু এখন শত্রুপক্ষকে ছেড়ে দিলে পরবর্তীতে আপনার জন্য আরও অনেক ধরনের সমস্যা বয়ে আসতে পারে।’
সুপ্ত বিস্ময় নিয়ে তাকায় সাজিদের দিকে। ক্ষুব্ধ চোখে বলে, ‘চল, আমিও যাব।’
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here