গল্পের নাম : বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ২৩: লোডশেডিং
লেখিকা: #Lucky_Nova
“তুমি ত এখন সম্পূর্ণভাবে শুধু আমার। আর আমি তোমার। এক কথায়, সব রকম রোম্যান্স লিগ্যাল এখন।”
কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই মিহি বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই ছেলে কি বলে এসব?
কথাটা বলে এরোন উঠে দাঁড়াতেই মিহি থমকায়। তাকায় না। শরীর যেন ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
“আমি ফ্রেস হয়ে এসে যেন তোমাকে বিছানায় দেখি। নাহলে জোঁক ছেড়ে দেবো তোমার গায়ে।” কপট হুমকি দেয় এরোন।
‘জোঁক’ কথাটা শোনা মাত্রই মিহি চরম চমকায়।
“I really mean it.” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ফ্রেস হতে ঢুকে পরে এরোন।
মিহি তৎক্ষনাৎ গুটিগুটি পায়ে বাধ্য মেয়ের মত বিছানায় চলে আসে। কারণ এই লোককে বিশ্বাস নেই। যা খুশি করে বসতে পারে। তার উপর জোঁক মানেই ত ভয়ানক ব্যাপার।
বিছানায় শুতে গিয়ে মিহি খেয়াল করে বালিশ দুইটা। আগে ত একটা ছিল। তাছাড়া একটা কম্বলও আছে যা আগে ছিল না। আরোহী দিয়ে গেছে! নাকি এরোনই নিয়ে এসেছে!
আরোহীর ত এতক্ষণে কম্বল নিয়ে আসার কথা! নাকি এই লোককে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন?!
মিহি কম্বলটা খুলে গায়ে দিলো। উল্টো দিকে ঘুরে বিছানার এক পাশে একদম কিনারা ঘেঁষে শুয়ে পরলো সে।
খানিক বাদে বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই নড়েচড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো মিহি। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে। বুক ধুকপুক শুরু করে দিয়েছে। এসবের মানে হয়!
“বিছানায় কি জায়গার অভাব?” কটাক্ষ করে বলল এরোন।
মিহি কথা বাড়াতে চাইলো না। তাই নড়েচড়ে একটু পিছনে সরলো। অস্থিরতা যেন বাড়ছে।
এরোন লাইট অফ করে ওর পাশে এসে শুয়ে পরলো।
মিহি এখনো প্রায় একহাত জায়গা ফাঁকা রেখে শুয়েছে। এরোন কিছুক্ষণ সরু চোখে সেদিকে তাকিয়ে বালিশ এগিয়ে একদম মিহির বালিশের পাশে নিলো।
মিহি আন্দাজ করে চোখ সংকুচিত করে ঘাড় ঘুরালো।
সেই মুহূর্তেই এরোন ওর সাথে এক কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো।
মিহি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। শরীরে যেন শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।
“আ..আপনি না ওই কোনায়..?!” বলতে বলতে মিহি পুনরায় সামনে মুখ ঘুরিয়ে একটু সরে গেল। অর্থাৎ আবার আগের মত কোনায় চলে গেলো সে।
“কম্বল একটাই তাই।”
“আপনি….তাহলে কম্বল… নিয়ে যান। লাগবে না… আমার।” থেমে থেমে বলে মিহি কম্বল গা থেকে সরাতে উদ্যত হলো।
এরোন হাত ধরে থামিয়ে দিলো ওকে। আচমকা হাত ধরায় হকচকিয়ে এরোনের দিকে ঘাড় ঘুরালো মিহি।
তবে চোখে চোখ পরতেই চোখ নামিয়ে ফেলল। বুকের মধ্যে আবার ধক ধক করছে। এদিকে হাঁসফাঁস হচ্ছে খুব।
এরোন ধরে থাকা হাতটা টেনে মিহিকে নিজের দিকে ঘুরালো। মিহি যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল নিমিষেই। জড়সড় হয়ে মাথা নুয়ে ফেলল ও। ভিতরে ভিতরে যেন তোলপাড় চলছে!
“তোমার এরকম এক্সপ্রেশন দেখলেই ত তোমাকে…।” অন্যরকম ধাঁচে এটুকু বলে থামে এরোন।
কারণ কথাটা শেষ করলে মিহি ছিটকে সরে যাবে।
মিহি প্রশ্নসূচক চাহনিতে মাথা নুয়ে থাকে। সে নুয়ে থাকলেও এরোন তার মুখ ঠিকই দেখতে পাচ্ছে।
এরোন এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মিহিকে বলে, “কিছুনা। ঘুমাও।”
মিহি দ্রুত আবার পাশ ফিরলো। এরোন মাথার নিচে এক হাত গুজে ওর দিকেই কাত হয়ে শুয়ে ওকে দেখতে লাগল। পিছন থেকেও মিহির অস্থিরতা বুঝতে পারছে ও।
“ঘুম পাড়িয়ে দেবো?” ফিচেল গলায় বলে ওঠে এরোন।
কথাটা শুনে মিহির কপালে ভাজ পরে গেল। ঢোক গিলে নড়েচড়ে গায়ের কম্বলটা আরেকটু টেনে নিয়ে মিহি বলল, “আ..আপনি নিজের কাজ করেন।”
“তাহলে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেও।” আবিষ্ট কন্ঠে বলল সে।
মিহি অগোছালো ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। কি বলছে এসব! মাথাটা কি গেছে!
কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আচমকা ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল এরোন। এতে মিহি প্রায় শিউরে উঠল। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “আ..আপনি.. কিন্তু…”
“চুপচাপ ঘুমাও। আর আমাকেও ঘুমাতে দেও।” ঘুম ঘুম আবেশে বলল এরোন।
মিহি থামে না। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফটিয়ই যাচ্ছে।
“ছাড়ার জন্য ধরেছি তোমাকে?”
“আ..আমি নিচে ঘুমাবো।” গোলমেলে গলায় বলেই মিহি আবার নড়াচড়া শুরু করে দিলো।
“আর এক চুল নড়লেই কিস করবো।” কড়া গলায় বলল এরোন।
মিহি থতমত খেয়ে গেল।
“ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দেও।” ভরাট গলায় বলে এরোন চোখ বুজলো।
মিহির হাঁসফাঁস লাগা শুরু হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন কেউ চুল্লির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে ওকে। লোকটা এত কাছ ঘেঁষে ঘুমাচ্ছে কেনো! এ কেমন জ্বালাতন!
?
“মুখের একি অবস্থা! রাতে ঘুমাও নি?” বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন আরোহী।
মিহি একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর মেকি হাসার চেষ্টা করে বলল,”হ্যাঁ ঘুমিয়েছি ত!”
মনে মনে বলল, আপনার অকর্মা ছেলের জন্য খেতে, বসতে, ঘুমাতে কিছুতেই শান্তি নেই আমার।
আরোহী চেয়ার টেনে বসলেন।
“আচ্ছা, নাস্তা করে নেও। আর শোনো, আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে আজ। গ্রামে। সব রান্না করা আছে। শুধু একটু কষ্ট করে গরম করে নিও। ঠিক আছে?”
আরোহীর কথায় মিহির অমায়িক দৃষ্টিতে তাকালো। ইনি না থাকলে ত ওই লোক জ্বালিয়ে শেষ করে ফেলবে ওকে। চিন্তা করেই ঘাম ছুটে গেল মিহির।
আরোহী সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললেন,”কি? কিছু সমস্যা?”
“ন..ন..না।” চকিত হয়ে মাথা নাড়লো মিহি।
“একটু কষ্ট করে থেকো। কাজের মেয়েটাও নেই!” ঠোঁট উলটে বললেন আরোহী।
“আমিও যাই।” আশা নিয়ে তাকিয়ে হুট করে বলে উঠলো মিহি।
আরোহী না বুঝে দুইবার পলক ফেলে বললেন,”হু?”
মিহি হালকা হাসার চেষ্টা করল। তারপর মুখ খুলে কিছু বলতে যাবার আগেই এরোন বলে উঠল, “No, you can’t go.”
দুইজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো এরোনের দিকে। ফোন হাতে দাঁড়িয়ে পরেছে সে। মিহির দিকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে চেয়ে প্রসস্থ হেসে বলল,”তুমি গেলে খাবার গরম করবে কে বলো! তোমাকে ত থাকাই লাগবে।”
মিহি ঢোক গিলে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল ওর। এরোনের হাবভাব সুবিধার মনে হচ্ছে না।
আরোহী নিঃশব্দে হাসলেন।
“হ্যা তুমি থাকো। কালই চলে আসবো আমি আবার। শুধু শুধু জার্নি করে লাভ নেই।”
মিহির মুখটা বাংলার পাঁচের মত হয়ে গেল। এর পর কি বলবে বুঝতে পারলো না। যাওয়ার রাস্তাটা পাকা করার আগেই রাস্তাতে গাছ ফেলে দিল এই লোক।
মিহির ইচ্ছে করছে ঘাড় মটকাতে। শুধু যদি সুযোগটা পায়!
?
এই এত বড় বাড়িটায় বলতে গেলে ওরা দুইজন আছে এখন। এরিক সেই সন্ধ্যার আগে আসবে না। আর এরোনের বাবা কাল আসবে। আরোহীও একটু আগে বেরুলো।
আরোহী যেতেই মিহি নিজের রুমে এসে ঢুকলো। এমনিই অনেক ক্লান্ত লাগছে ওর। একটা ঘুম না দিলেই নয়। ছোট থেকেই কেউ ওকে ধরে ঘুমালে ও ঘুমাতে পারেনা। যার জন্য রাতে শান্তিতে একটুও ঘুমাতে পারেনি।
শান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো মিহি।
অতঃপর দুপুর পর্যন্ত লম্বা ঘুম দিলো সে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো।
ব্যাপার কি! ওই লোকের খবর নাই কেনো! আরোহী যাবার পর থেকেই আশেপাশে আসেনি।
বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে সরাসরি রান্নাঘরে চলে এলো ও। রান্নাঘরে আসার সময়ও আশেপাশে চোখ বুলিয়ে এরোনকে দেখতে পেলো না।
কোথাও ত নেই! গেলো কোথায়! হালকা অবাক হলো মিহি।
আশেপাশে নেই মানেই ত ভালো। নিজেকে নিজে বলল মিহি।
শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে চুলগুলো হাত খোপা করে নিলো সে। ফ্রিজ খুলে খাবার গুলো বের করে একে একে গরম করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
তারপর টেবিলে এনে সাজালো।
সাজানোর শেষে চেয়ারে বসতে বসতে আবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো ও।
বাহিরে গেলো নাকি?! কিন্তু সদর দরজা ত ভিতর থেকে বন্ধ।
কপাল কুচকে কিছু একটু চিন্তা করে মুখ ফুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মিহি।
একা একাই খাওয়া শেষ করল মিহি।
এখন খাবার গুলো এভাবেই রেখে দেবে নাকি ফ্রিজে রাখবে সেটা নিয়ে দ্বিধাদন্দে পরলো সে।
একবার জিজ্ঞেস করতে ত সমস্যা নেই। জিজ্ঞেস করে আসলেই ত হবে। কিন্তু যেতেও ত ভয় ভয় করে।
শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতেই গেল সে।
পা টিপে টিপে এরোনের ঘরটার দরজার সামনে এসে উঁকি দিলো মিহি। কেউ নেই। হঠাৎ কিছু একটা দেখে চোখ সংকুচিত হয়ে এলো ওর। বেশ অবাক হলো ও।
বড়সড় একটা গোলাপী রঙের হ্যালো কিটি পুতুল ড্রেসিং টেবিলের পাশের ইজি চেয়ারে বসানো।
এ বাদে বেলকনির দরজায় একটা হ্যালো কিটি ডোর বেল। ডোর বেলেই দৃষ্টি আটকে গেল মিহির। মারাত্মক সুন্দর সেটা।
মিহির ইচ্ছে করছে ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু নিজেকে শাসিয়ে সামলালো সে। তারপর গটগট করে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। সেই লোকের কোনো খবর নেই। বাহিরেও ত যায় নি। ভিতরেও ত দেখা গেল না সারাদিনে। এ কেমন অবাককর বিষয়! উধাও হয়ে গেলো নাকি!
মিহির মনে হচ্ছে আরোহীর সাথে গেলেই ভালো হত। এভাবে হা করে একা বসে থাকতে থাকতে যেন দম বন্ধ লাগছে।
নিচে গেল মিহি। রান্নাঘরে ঢুকে নিজের জন্য গরম গরম চা বানিয়ে নিলো এক কাপ। সেই চা নিয়ে ডায়নিংয়ে বসতে না বসতেই পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল।
মিহি হতবুদ্ধির মত থ মেরে কয়েক সেকেন্ড বসে রইল।লোডশেডিং! তাও এই সময়!
ঘুটঘুটে অন্ধকারে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো মিহি। কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখতে পাওয়ার কথাও না।
অন্ধকারে যেন চারপাশ ছমছমে হয়ে আছে। মিহি ঢোক গিলল। চটজলদি পা তুলে নিলো চেয়ারে।
বুকের মধ্যে আচানক টিপটিপ করতে লাগল ওর। মুখটাও কাচুমাচু হয়ে এলো। এখন এই অন্ধকারে কোথায় মোম খুঁজবে ও!
একে ত নতুন পরিবেশ তার উপর কেউই আজ বাসায় নেই। ভয়ে পুরো শরীর শিরশির করে উঠছে যেন।
মিহি চোখ খিচে, ঠোঁট কামড়ে ধরে কারেন্ট আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
অনেক কষ্টে পাঁচ মিনিট যাবত অপেক্ষার পরও এলো না। এভাবে আর সম্ভব না। উনিও কি বাসায় নেই!
থাকলে আসছে না কেনো!
আর না থাকলে ত আজ ভয়ে শেষ হয়ে যাবে ও।
মিহি দুশ্চিন্তায় নিজের শাড়ি খামচে ধরলো। তরতর করে ঘামছে ও। আর পারা যাচ্ছে না।
মিহি ছটফট করতে করতে কাপা গলায় মিনতিপূর্বক বলল,”আ..আপনি কি আ..আছেন? প..প্লিজ আসুন না এ..একটু।”
বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো মিহি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ এখনো আঁটসাঁট করে বন্ধ করা। খুললেই যেন ভয়ানক কিছু দেখবে।
আরো এক মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু তার আসার কোনো সারাশব্দ নেই।
ভয়ে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে মিহির। লোকটা কি ইচ্ছে করেই ওকে জব্দ করতে চাইছে!
কিন্তু ওর ত ভয় করছে।
“আ..আপনি কি ইচ্ছে করেই আসছেন না?” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মিহি।
“আ..আমি ভয় পাই। আসুন না একটু।”
এবারো কোনো সারা পেলো না মিহি। ভয়ে দুই হাটু হাতে জড়িয়ে ধরে মাথা গুজে নিলো ও।
তবে কি সত্যিই বাসায় নেই! সত্যিই না থেকে থাকলে!
ভয়ে এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো মিহি।
“রিল্যাক্স কাপকেক! আমি থাকতে কোনো ভূত ছুঁতে পারবে তোমাকে?”
(চলবে…)