#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৫ |
———————–
–“এই কোক আমার ছিলো নিদ্র ভাইয়া! তুমি কেন আমার কোক এভাবে খেয়ে ফেললা! তোমার নামে কোক চুরির মা!মলা করবো! এখুনই যাবো আমি পুলিশ কাক্কুদের জেলখানায়।”
এমন সময়ই নূরজাহান প্রবেশ করলো হাতে খুন্তি নিয়ে। চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে এমন একটি চাহনি নিক্ষেপ করলো নিদ্র’র পানে। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“ফ্রিজে কোক রাখা ছিলো সেটা কোথায়?”
ইরা’দ এবার যা বুঝার বুঝে নিলো। তাই নিদ্র কিছু বলার পূর্বেই ইরা’দ বলে ওঠে,
–“আসলে চাচী, খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই আমি-ই কোকটা নিয়েছি। গলা ভেঁজানোও শেষ!”
নূরজাহান নরম হলেন। মূলত কোক এনেছিলেন মেহমানদের জন্য। যাতে যখন তখন মেহমান আসলে আপ্যায়নের বিষয়টি কভার করা যায়। ইরা’দ খেয়েছে বলে কিছু আর বললো না। চলে গেলো। নূরজাহান চলে যেতেই ইরা’দ প্রাণখোলা, শব্দের সাথে হেসে ওঠে। নিদ্র’র এতক্ষণে মুখটা একটুখানি হয়ে গেছে। মুখ ঘুঁচে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা’দ হাসতে হাসতে বলে,
–“চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পরো ধরা। তোকে তো আমি বাঁচিয়ে দিলাম, হারাম খাওয়া থেকে। এখন? কে চুরি করেছে বল তো? কার নামে মা!মলা দেয়া উচিত?”
নিদ্র শুকনো ঢোঁক গিলে ইরা’দের দিকে ভীতগ্রস্ত নজরে তাকালো। ইরা’দ শব্দহীন হাসি দিয়ে বলে,
–“এনে দিবো দু বোতল। সমস্যা নেই!”
নিদ্র এবার আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। দুলতে দুলত্র চলেও গেলো। নওরি নিদ্র’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ইরা’দ এবার নওরির দিকে ফিরে বলে,
–“আপনিও তৈরি হয়ে নিন জনাবা।”
নওরি চমকে তাকালো ইরা’দের পানে। ইরা’দ যেন নওরির চাহনি বুঝলো।
–“সেদিন কী বলেছিলাম, মনে আছে? এত দ্রুত ভুললে চলে নাকি?”
নওরি আমতা আমতা করে বলে,
–“আ..আসলে!”
–“কোনো অযুহাত নয়। দশ মিনিট দিচ্ছি। রেডি হয়ে দ্রুত আসো! আমি অপেক্ষায় আছি।”
——————
নওরি মুগ্ধ হয়ে এক ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ফুলগুলো ইরা’দের বাসাতেও আছে। হলুদ, ছোট ছোট ফুল। সবুজের মাঝে থোকা থোকা হলুদের প্রতীক। মূলত এগুলো ডেইজি ফুল। ডেইজি ফুল নানান রঙের হয়, গোলাপের মতো। নওরি গোলাপের সাথে এই ফুলকেও ভীষণ পছন্দ করে। নওরি এক মুঠো ফুল হাতে নিলো। ঠিক তখনই ইরা’দ এসে হাজির হয়। মুঠো ভর্তি ফুলগুলোর দিকে চেয়ে বলে,
–“আমায় দিবে এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা? আমি তাদের প্রেম অনুভূতিতে আগলে নিবো আমার বুকপকেটে। ঘ্রাণ নিবো, প্রেমের ঘ্রাণ! তুমি চেয়ে দেখবে বুকপকেট রাঙানো প্রেম রঙ্গনাকে। কী সুন্দর হবে তাই না?”
নওরি অবাক নজরে চেয়ে রয় ইরা’দের দিকে। ইরা’দের চাহনিতে আজ অন্যকিছু আছে। একদম ভিন্ন কিছু। আবেদনময়ী চাহনিতে চেয়ে আছে সে নওরির পানে। কী বলবে বা বলা উচিত ভেবে পেলো না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলে ইরা’দ আর উত্তরের অপেক্ষা করে না। হৃদয়কে সান্ত্বনা দিলো, নওরির জন্যে উত্তর দেবার সময় হয়নি৷ এখনো তাঁর সময়ের প্রয়োজন। আরেকটু অপেক্ষা করলে কী-ই বা হয়? ইরা’দ ফোঁস করে কথা ঘুরিয়ে বলে,
–“আচ্ছা বাদ দাও। হসপিটাল এবং এতিমখানা থেকে ঘুরে এসে কেমন লাগলো।”
নওরির হুঁশ আসলো। ব্যথিত নয়নে চেয়ে রয় ইরা’দের পানে। মাঝেমধ্যে ছলছল-ও করে উঠছে দৃষ্টি জোড়া। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
–“কেন আমায় ওসব জায়গায় নিয়ে গেলেন? আমার বিষণ্ণ মন যে আরও বিষণ্ণ হয়ে পরেছে।”
–“নিয়ে গেছি আমার কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণ করার জন্যে। দেখো নৌরি ফুল, কোনো মানুষ-ই প্রকৃত সুখী নয়। “আমার মতো কষ্টের ভাগীদার আর কেউ নেই, কেন ভাগ্য একটু সুখ দেয় না, কেন আমার ভাগ্যে সুখ লেখা নেই” ইত্যাদি অনেক বাক্য-ই আমরা সচরাচর বলি। অথচ দেখো, কতশত মানুষ বাঁচার জন্যে লড়াই করছে, একটুখানি সুখ পাবার জন্যে কাঁতড়াচ্ছে কিন্তু তাও তাঁরা হাল ছাড়েনি।
এতিম বাচ্চাগুলোকে দেখেছো? তাঁরা বাবা-মা ছাড়াও হেসে, খেলে বেড়াচ্ছে। নিজের জন্য বাঁচছে তাঁরা। তাঁরা নিজেদের জীবনটাকে মেনে নিয়েই কিন্তু হাসছে, প্রাণখুলে। এমতাবস্থায় তুমি শক্ত হতে পারছো না? পাবলিক ভার্সিটি ছাড়াও আরও অপশন আছে তোমার জন্যে! সেখান থেকে একটা চুজ করে নাও। রুম বন্দী থাকলে কী তুমি পাবলিকে চান্স পেয়ে যাবে?”
নওরি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে “না” জানায়। ইরা’দ তাঁর দিকে দুই ধাপ এগিয়ে যায়। মৃদু গলায় আওড়ায়,
–“যা বলেছি বুঝেছো?”
–“বুঝেছি।”
–“কতটুকু?”
–“এতদিন ভ্রমে ছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে নিজের সুস্থ, সবল জীবন উপলব্ধি করেছি। এতিমখানার বাচ্চা গুলোকে দেখে মনোবল পেয়েছি।”
–“দ্যাট’স লাইক এ গুড গার্ল। তাহলে প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হচ্ছো তো?”
নওরি নিশ্চুপ। ইরা’দ নওরির নিশ্চুপতা সম্মতি হিসেবে গ্রহণ করে নিলো। নওরির দিকে ঝুঁকে জানায়,
–“টাকার কথা চিন্তা করতে হবে না। বড়ো’রা আছেন। তাঁরা তোমায় পড়াবে। কখনো নিজেকে একা মনে করবে না, ঠিকাছে?”
——————–
অবশেষে নওরি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। ভার্সিটি বাসা থেকে প্রায় পঁচিশ, ছাব্বিশ মিনিটের পথ। রিকশা করে গেলে পনেরো মিনিট লাগে। ইরা’দ প্রতিদিন রিকশা ঠিক করে দেয় আর নওরি প্রতিদিন সেই রিকশা করে যায় এবং আসে। ভার্সিটি ছুটি হলে নওরি প্রায়-ই দেখে ইরা’দ রাস্তার ওপারে বাইক নিয়ে বসে আছে। অবশ্য মাস্ক এবং সানগ্লাস থাকে। তবে নওরির তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। নওরি নিকাবের আড়ালে মুচকি হেসে একটি রিকশা ডেকে উঠে পরে। মনের মধ্যে বিরাট প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। অনুভূতি’রাও কেন যেন আজকাল ভীষণ জ্বালাচ্ছে নওরিকে। নওরি রিকশা করে প্রায় কিছুটা চলে আসতেই তাঁর ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। বয়াগ থেকে ফোন বের করে দেখলো ইরা’দ কল করেছে। মুচকি হেসে কল রিসিভ করে কানে লাগিয়ে বলে,
–“হ্যাঁ, নিদ্র সাহেব বলুন!”
নওরির এরূপ ব্যবহারে ইরা’দ বেশ চমকালো। চমকানো সুরে বললো,
–“আবার বলো তো, শুনতে পাইনি!”
–“আবার মানে?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসলো নওরি।
–“যা বলেছো সেটা রিপিট করো কুইক!”
নওরি নিঃশ্বাস ফেলে আলতো স্বরে বলে,
–“হ্যাঁ নিদ্র সাহেব বলুন!”
ইরা’দ সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললো। তাঁর হৃদয়ের বাগানে যেন শত রঙিন প্রজাপতির আনাগোণা হয়েছে। হৃদয় উড়ছে যেন তাঁর। নিজেকে সামাল দিয়ে ইরা’দ বললো,
–“চলে গেছো?”
–“হ্যাঁ।”
–“আমি তো দেখলাম না।”
–“আপনি-ই তো বলেছেন আমাদের দেখা করাটা সম্ভব না।”
–“হ্যাঁ তা ঠিক। আচ্ছা, সাবধানে যাও৷ বাসায় গিয়ে কল দিবে, আচ্ছা?”
———-
এভাবে দেখতে দেখতে নবীন বরণের প্রোগ্রাম চলে আসলো। চিফ গেস্ট হিসেবে আসছে ইরা’দ। এমনটাই শুনেছে নওরি। আজ নওরি অনেকদিন পর বাগানে আসলো। মালি একপাশে ঘাস কাটছে। ওনাকে দেখে মুচকি হাসলো নওরি। ওনার সাথে বেশ ভাব জমেছে নওরির। সেই প্রথম দিনের পর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। তবে ঘনঘন বাগানে আসতে পারে না নওরি। ফ্রিশা তো এতদিন পর বের হতে পেরে এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে।
নওরি মালির সাথে কুশল বিনিময় করে সেও ডেইজি ফুলগুলোর কাছে গেলো। কয়েকটা ছিঁড়েও নিলো। ছিঁড়ে পিছে তাকাতেই দেখলো কিছু জামা-কাপড় রশিতে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে একটি শার্ট নওরি চিনতে পারলো। এটা ইরা’দের। নিশ্চয়ই মৌসুমি এখানে জামা-কাপড় রোদে দিয়ে গেছে। হাঁটুর সমস্যার কারণে ছাদে উঠতে পারেন না তিনি। তাইতো এই বাগান-ই তাঁর স্বস্তি।
ছেলের জামা-কাপড় সে নিজেই ধোঁয়। বাদ-বাকী জামা-কাপড় কাজের মেয়ে ধুঁয়ে দেয় এবং ছাদেও দিয়ে আসে। নওরি শার্টের বুকপকেটের দিকে তাকাতেই তাঁর মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো ইরা’দের বলা সেই কথাগুলো। নওরি কল্পনা করলো, কেমন হবে ইরা’দের বুকপকেটে ফুলগুলো রাখলে? আপনমনে হেসে বললো নওরি।
ইরা’দ হাই তুলতে তুলতে বারান্দায় এসেছিলো। যেই নওরিকে দেখলো তখন থেকে ইরা’দের স্থির দৃষ্টিপাত নওরির পানে। নওরির চাল-চলন, ভাব-ভঙ্গি ইরা’দ নিবিড়ভাবে দেখছে। কতটা মনোযোগী সে। যখন দেখলো নওরি হাতে ফুল নিয়ে তাঁর-ই শার্টের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা’দ কিছু একটা আন্দাজ করে হাসলো। নওরির হঠাৎ বারান্দার দিকে চোখ গেলে নওরি অপ্রস্তুত হলো। ইরা’দ মুচকি হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে নওরিকে “হাই” জানালো। নওরি বিষম খেলো। ফুলগুলো নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হলো নওরি কেটে পরলো। ফ্রিশাও তাঁর পিছু নিলো। ইরা’দ নওরির হন্তদন্ত হয়ে চলে যাওয়া দেখে প্রাণখুলে হাসলো।
——————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম।