কাছে কিবা দূরে পর্ব ৮

0
1564

#কাছে কিবা দূরে
#পর্ব-৮
লেখা: Sabikun Nahar Nipa
শুভ্র বারান্দায় পায়চারি করছিল। অভ্র অনেকক্ষন হলো গেছে কিন্তু এখনো ফেরার নাম নেই। এই দুইদিনে শুভ্র একটা ব্যাপার স্পষ্ট বুঝেছে, সেটা হলো তানির অনেক বেশী রাগ। অবশ্য সেটা স্বাভাবিক। মেয়েদের রাগ একটু বেশী ই থাকে। রাগ যেমন বেশী থাকে, সহনশক্তিও তেমন বেশী থাকে। তানির সহনশক্তি কেমন সেটা শুভ্র জানে না, কিন্তু রাগ টা টের পেয়েছে। নাকের ডগায় রাগ!
রাগলে মুখ একদম লাল হয়ে যায়। শুভ্র আপনমনেই হেসে ফেলল। অভ্র এসে দেখলো শুভ্র মিটিমিটি হাসছে। অভ্র জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ভাইয়া?

“কিছু না। বল ওদিকের কি খবর? ”

অভ্র মিথ্যা বলল। বলল, ভাবী তো হেব্বি রেগে আছে দেখলাম। ব্যগপত্র গুছিয়েছে, এক মাস নাকি বাপের বাড়িতে থাকবে।”

শুভ্র অবাক গলায় বলল, মানে?

“মানে একা একা বাপের বাড়ি যেতে হবে বলে ভাবী খুব রেগে গেছে। উঁহু ঠিক রাগ না। সে অপমানিত বোধ করেছে। তাই এবার বাপের বাড়ি গেলে একমাসেও আসবে না। ”

শুভ্র ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, গিয়ে থাকলে থাকবে! সেটা আলাদা কথা। কিন্তু অপমানিত বোধ করেছে কেন? আমি স্ট্রেইট কথা বলতে পছন্দ করি তাই যা বলার বলেছি। তাতে অপমান কেন হবে”

অভ্র দেখলো পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। শুভ্র সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। সিরিয়াস হয়ে গেলে সমস্যা। অভ্র বলল,
“না মানে তোমার যেমন এটা দ্বিতীয় বিয়ে তেমন ভাবীর ও তো দ্বিতীয় বিয়ে। সে যদি বিয়ের পরে একা বাপের বাড়ি যায় সেটা খারাপ দেখা যায়”

শুভ্র কপাল কুচকে ফেলল। বলল, আমার কাজ আছে সেজন্য যেতে পারব না। নাহলে তো আমি ঠিক ই যেতাম।

“হ্যাঁ মানলাম। কিন্তু রিচুয়ালস বলেও তো একটা ব্যাপার আছে বস। আমরা কিন্তু ভাবীকে সাদামাটা ভাবে ওইবাড়ি থেকে এনেছিলাম। এখন যদি একা যায় তাহলে তো লোকে কথা শোনাবেই।”

শুভ্র’র কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। বলল, এটা তো আগে ভেবে দেখিনি।

“হ্যাঁ এইজন্য তো বলছি কাজ বাদ দিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাও”।

“কিন্তু তানি যে রেগে আছে?”

অভ্র হাসি চেপে বলল, রাগ ভাঙাও। দেখ সরি, টরি বললে হয় কী না!

শুভ্র কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, তুই কিছু একটা কর না?

“আমি কেন করব! তাছাড়া আমি বললে রাগ আরও বাড়তে পারে। তারচেয়ে তুমি ম্যানেজ করো। ”

শুভ্র আর কিছু বলল না। চলে গেল। শুভ্র যেতেই অভ্র শব্দ করে হেসে ফেলল। আড়াল থেকে আনিকা এসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, উফ ছোট ভাইয়া তোমার যা বুদ্ধি!

অভ্র হাসি থামিয়ে বলল, আস্তে আস্তে ভাইয়া চলে আসতে পারে। ”

আনিকা গলা খাদে নামিয়ে বলল, এরপর কী হবে?

“মান অভিমান ভাঙার পর্ব চলবে। বুঝলি আনিকা এই দুজন হলো উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। আমাদের কাজ হলো এই দুই মেরু কে একত্রিত করা। যেন তারা বিকর্ষিত না হয়ে আকর্ষিত হয়। ”

আনিকা উত্তেজিত গলায় বলল, উফ! আমার তো খুব এক্সাইটেড লাগছে! আফটার ম্যারেজ প্রেম। হাউ রোমান্টিক!

*****
শুভ্র অনেক চেষ্টা করেও তানির সাথে দেখা করতে পারে নি। দুপুরে খেয়েদেয়ে তানি গেল পার্লারে সাজতে। সাজগোজ শেষ হলে সেখান থেকে চলে যাবে কমিউনিটি সেন্টারে। দুপুরে খাবার সময় একসাথেই খেতে বসেছিল সবাই। তানি আড়চোখে একবার তাকিয়েছে শুভ্র’র দিকে। অভ্র স্পষ্ট বলে দিয়েছে কিছুতেই নমনীয় হওয়া যাবে না। বিড়াল প্রথমেই মারতে হয়। এখন যদি ও নমনীয় হয় তবে শুভ্র ওকে পেয়ে বসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত শুভ্র স্যরি না বলবে ততক্ষণ পর্যন্ত গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হবে। কোনো ভাবেই বুঝতে দেয়া চলবে না যে রাগ পানি হয়ে গেছে। তানি প্রানপনে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কথা বলতে না পেরে ভিতরে ভিতরে উতলা হয়ে যাচ্ছে।

খাবার টেবিলে তানির সঙ্গে যে কথা বলবে সেই সুযোগ ইরার জন্য হলো না। ইরা হড়বড় করে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। শুভ্র বিরক্ত হয়ে অভ্রকে ম্যাসেজ দিলো, “ওই প্যারাওয়ালি কে থামতে বল। এতো কথা বলছে ওর কী মুখ ব্যথা করছে না?

অভ্র ম্যাসেজ দেখে হাসতে গিয়েও হাসলো না। হাসি চেপে রেখেছে। শুভ্র কে অস্থির হতে দেখে খুব ভালো লাগছে।

শুভ্র বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। মাহফুজা শুভ্র কে দেখে বলল, একটু আমার সঙ্গে আয় তো ।

শুভ্র ঘরে যেতেই বলল, আমি আগেই বলেছিলাম যে বিয়ের জন্য কম করে হলেও পনের দিন ছুটি নেবে। যেহেতু এরেঞ্জ ম্যারেজ সেহেতু দুজন দুজন কে জানতে, শুনতেও অনেক সময় লাগবে। কিন্তু এখন বলছ তোমার কাজ আছে?

শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শুধু একটা কথায় এভাবে ফাঁসতে হবে সেটা আগে বোঝে নি। মনে মনে তানির চৌদ্দ গুষ্টির পিন্ডি চটকালো কয়েকবার। হাতজোড় করে অনুনয় করে শুভ্র বলল, মা জননী আমি অত্যধিক ভুল করিয়াছি আপনার পুত্রবধূর সহিত খারাপ আচরণ করিয়া। এরজন্য মার্জনা করুন।

মাহফুজা গম্ভীর গলায় বলল, নাটক বন্ধ কর। আর তানির সাথে আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবি না। ফের যদি শুনি…..

শুভ্র কানে ধরে বলল, ক্ষমা করুন এই বান্দাকে।

****
রাতের ট্রেনে শুভ্র আর তানি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। তানির মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপের কারণ হলো শুভ্র। আজ পার্লারে অনেক সুন্দর করে সেজেগুজে যখন শুভ্র’র সামনে এলো তখন শুভ্র বলল, এটা কী পরেছ তানি? বিয়েতে কেউ সবুজ রঙ পরে?

তানি জলপাই রঙের বেনারশী না পেয়ে সবুজ কিনেছিল। অথচ শুভ্র মুখ, চোখ কুচকে ফেলল সেটা দেখে। তানির কান্না পেল। যার জন্য এতো সাজগোজ সে’ই যদি এইভাবে বলে তাহলে কেমন লাগে।

রিসিপশনে শুভ্র’র কিছু মেয়ে বন্ধু এলো। তাদের তানির একদম ই পছন্দ হলো না। মেয়েগুলো স্মার্ট, স্টাইলিশ হলেও তানির কাছে তাদের মনে হলো চাড়াল, বেহায়া। ওর হাত নিশপিশ করছিল। মেয়েগুলো এতো বেহায়া যে শুভ্র যেখানে যায়, তারাও সেখানে যায়। তানির ইচ্ছে করলো শুভ্র’কে কালিজুলি মাখিয়ে দিতে। তাহলে আর বেহায়া মেয়েগুলো আর ওর দিকে তাকাবে না।

এরপরের ঘটনা আরও মেজাজ খারাপ হওয়ার মতো। শুভ্র’র কলিগ রা শুভ্র’কে জোর করলো তানির সাথে ছবি তুলতে। শুভ্র তখন বলল, তানিকে নাকি সবুজ শাড়িতে গাছের মতো লাগছে। পাশে দাঁড়ালে মনে হবে গাছের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাগে, দুঃখে তানির চোখে পানি এসে গেল। সিদ্ধান্ত নিলো বাসায় ফিরে সবুজ যা যা আছে সব পুড়িয়ে ফেলবে। বাসায় গিয়ে সময় পায় নি তাই ব্যাগে করে সব নিয়ে যাচ্ছে।

ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলছে। জানালা বন্ধ থাকার পরও হিমবাতাস গায়ে লাগছে একটু একটু। তানি বসে আছে জানালার পাশে। শুভ্র আজও ম্যাগাজিন পড়ছে। আসার সময় প্ল্যাটফর্ম থেকে হন্তদন্ত হয়ে ম্যাগাজিন টা কিনে এনেছে। ম্যাগাজিন নিয়ে ফেরার পর বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলল, কভার পেজে ক্যাটরিনার ছবি ছিলো। এমন ভাবে ছবিটা দেয়া যেন মনে হচ্ছিলো আমাকে ডাকছে। তাই ছুটে গেলাম।

তানির ইচ্ছে করলো ট্রেনে না উঠে একদিক চলে যেতে। বিয়ে করা নতুন বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না! উনি যাচ্ছে ক্যাটরিনার কাছে। কপাল খারাপ থাকলেই এমন বর কপালে জোটে।

শুভ্র তানিকে ডেকে বলল, তানি কিছু খাবে?

তানি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, না। আপনি ম্যাগাজিন পড়ুন। ম্যাগাজিন না পড়লে ক্যাটরিনার কষ্ট হবে।

শুভ্র মৃদু হেসে বলল, তুমি কী বাই এনি চান্স ক্যাট কে হিংসে করছ? না মানে তোমাকে সময় দিচ্ছি না কিন্তু ম্যাগাজিন পড়ছি।

তানি জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। শুভ্র নিশ্চুপে হাসলো। বলল, আসলে তুমি রেগে ছিলে তাই আর তোমাকে ডিস্টার্ব করিনি। কিন্তু অনেক টেনশন করেছি। যেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে আছ তাতে দাঁত ভাঙার সম্ভাবনা প্রবল।

তানি চুপ করে থাকলো। শুভ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে এখন বলোতো তোমার রাগ ভাঙাতে আমি কি করতে পারি?

তানি এক নজর দেখলো। শুভ্র’কে দেখে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে।

শুভ্র বলল, আমি কী কানে ধরব? নাকি নাকে খত দেব?

তানি কথা বলল না।

“নাকি সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে যাব? ”

তানি এক নজর শুভ্র’কে দেখে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। ”

“তাহলে কী ট্রেন থেকে লাফ দেব?”

তানির এবার খুব হাসি পেল। হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না। শুভ্র গম্ভীর গলায় বলল, ব্যাস তানি! অনেক হয়েছে। এখানও যদি রাগ না কমাও তাহলে এক লক্ষ জীবানুওয়ালা ট্রেনের টয়লেটের পানি খেয়ে ফেলব।

তানি শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। মাঝরাতে অনেকেই ঘুমিয়ে। হাসির শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকেই সদ্য বিয়ে হওয়া দুষ্ট, মিষ্টি দম্পতি কে দেখছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here