#কাছে_কিবা_দূরে
লেখা:সাবিকুন নাহার নিপা
পর্ব-৩
সারারাত তানির ঘুম হলো না। কিন্তু শুভ্র নিশ্চিন্তে ঘুমালো। তানির এখন আর কোনো ভয় নেই। বিয়ে শব্দটায় যে আতংক ছিলো এখন সেটাও নেই। ওর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে সেটা হলো এই দেখতে সুন্দর সিনেমার নায়কের মতো লোক টা এখন থেকে শুধু ওর। শুভ্র’র সাথে তানির দেখা হয়েছিল অনেক বছর আগে। সে’বার খালামনির বাসায় বেড়াতে গিয়ে তানি খালাতো বোন সুমির সাথে কলাবাগান গিয়েছিল। সেদিন ছিলো ঝুম বৃষ্টি। বাসা থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। কিন্তু যেই রাস্তায় পা দিলো অমনি শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। কিছুদূর যাওয়ার পর তানি সিদ্ধান্ত নিলো বাসায় ফিরে যাবে। কারন ওর বৃষ্টি সহ্য হয় না। একাই একাই ফিরে আসছিল। রাস্তাঘাটে তখন বৃষ্টির পানি জমে গেছে। তানি বুঝতে না পেরে বেখেয়ালে ড্রেনে পড়ে গেল। পায়ে পা লেগে পড়ে গেল। কোমড় পর্যন্ত ভিজে গেল ড্রেনের নোংরা পানিতে। যে কয়েকজন লোক দেখেছিল তার হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছিলো কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। কিন
শুভ্র দৌড়ে এলো। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ। ছুটে এসে তানির হাত ধরে বলল, তুমি কী খুব ব্যথা পেয়েছ?
তানি ততক্ষনে কাঁদতে শুরু করেছে। শুভ্র হাত ধরে তুলে বলল, আরে এটা তো এক্সিডেন্ট। তুমি কাঁদছ কেন?
তানি হাপুস নয়নে কেঁদেই চলছে। শুভ্র বলল, তোমার বাসা কোথায়?
তানি হাত উচিয়ে মিনিট দু’য়েকের দূরত্বে একটা বিল্ডিং দেখালো। শুভ্র বলল, যাও চলে যাও। কাছেই তো।
তানি চলে গেল। শুভ্র চলে যেতে বললেও ওর পিছু পিছু এলো। একদম গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু না নিজের নাম বলল, আর না তানিকে নাম জিজ্ঞেস করলো।
তানি এরপর যে’কদিন ওখানে ছিলো প্রায় প্রতিদিন সে জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতো শুভ্র’র খোঁজে। কিন্তু দেখা পায় নি। এরপর রাজশাহী চলে এলো। পরের বার আবার যখন ঢাকা গেল তখন ও মনে মনে চেয়েছে আরেকবার ছেলেটার সাথে দেখা হোক। কিন্তু হয় নি। একসময় তানি ব্যস্ত হয়ে গেল পড়াশোনা নিয়ে। এরপর বিয়েও হলো। তবুও ঝুম বৃষ্টির সময় ছেলেটাকে মনে পড়তো আর বুকের ভিতর টা হু হু করে উঠতো। আজ সেই মানুষ টা তানির এতো কাছে আছে যে ইচ্ছে করলেই ছুয়ে দিতে পারবে। সেই অধিকার টুকুও পেয়ে গেছে কাগজে সই করে।
শুভ্র’র ঘুম ভাঙলো খুব সকালেই। দেখলো তানি রাতে যেমন বসে ছিলো তেমনই বসে আছে। আঁতকে উঠে বলল,
“এই তানি তুমি আবার সারারাত এই ভাবে বসে ছিলে নাকি?”
তানি লজ্জা পেল। আমতা আমতা করে বলল, না মানে….
“ওহ। আমি ভেবেছি তুমি হয়তো ঘুমাও নি। তা কখন উঠলে? ”
“এই তো”।
“আচ্ছা শোনো আমাদের কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে তৈরী হয়ে নাও”।
“আচ্ছা”।
তানি চলে যেতেই শুভ্র হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভাগ্যিস মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে। কাল প্রথম দেখায় যেভাবে রক্তশূন্য মুখ দেখেছে! একে তো বিয়ের আগে ওর সাথে দেখা করে নি, তার উপর দেরি করে আসা! সবটা মিলিয়ে তানি হয়তো খুব আপসেট হয়ে পড়েছিল। হবার ই কথা। এটা তানির দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথমবার বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়েরা সাধারণত ভয় বেশী পায়। ঘর পোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় হয়। দ্বিতীয় বার যে আবারও তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবে না সেটার গ্যারান্টি কী! এসব নিয়ে মেন্টাল স্ট্রেস ও বেশী থাকে। সারাপথে যে বিপদ ঘটেছে তাতে নিজেদের নিয়ে ভাবার চেয়ে তানিকে নিয়ে বেশী ভেবেছে শুভ্র। তানি আবার আত্মহত্যা করে ফেলবে না তো! এই ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। যাক ঠিক সময় পৌছে অনেক বড় অপমান থেকে বেঁচেছে। শুভ্র’র মামা চেয়েছিল ফিরে যেতে কিন্তু শুভ্র রাজী হয় নি। যে করেই হোক বিয়ে আজ ই করবে। অচেনা, অজানা একটা মেয়ে অপেক্ষা করে আছে। সেটা বিফলে যেতে দেয়া যায় না।
******
অভ্র শুভ্র কে দেখে চোখ টিপে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া ঘুম কেমন হয়েছে?
শুভ্র কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আমি তোর পাঁচ বছরের বড়। সম্মান দিয়ে কথা বল। বড় ভাইয়ের গোপন ব্যাপার জানতে চাওয়ার জন্য তোর অবশ্যই শাস্তি হবে। কঠিন শাস্তি।
“যাহ বাবা! আমি এতোকিছু জিজ্ঞেস করলাম কখন? তুমিই তো আগ বাড়িয়ে সব বললে। ”
“হু। তানির সাথে তোর দেখা হয়েছে? ঘুম থেকে ওঠার পর আর দেখলাম না?”
অভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, এক রাত যেতে না যেতেই ভাবীকে চোখে হারাচ্ছ! এক রাতেই সিংকিং ড্রিংকিং ওয়াটার। ”
“এই কথা গুলো পারলে আপনার ভাবীর সামনে বলুন। দেখি কতো পারেন!
অভ্র হেসে ফেলল। বয়সের ব্যবধান থাকলেও দুই ভাইয়ের সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো। শুভ্র সবার সাথেই সহজে মিশে যায়। অভ্র সিরিয়াস গলায় বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া একটা সত্যি কথা বলোতো?”
“আমি অকারণে মিথ্যে বলিনা অভ্র”।
“ভাবীকে প্রথম দেখায় তোমার কেমন লেগেছে? ”
শুভ্র মৃদু হেসে বলল, সত্যি বলব?
“হ্যাঁ “।
“লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয় নি। তবে চমৎকার লেগেছে উল্টো জামা পরা অবস্থায় দেখে। ”
দুজনেই ফিক করে হেসে ফেলল। অভ্র বলল, সত্যি! তোমাদের নাতি নাতনিরা এই গল্প শুনে খুব মজা পাবে?
শুভ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। তাল মিলিয়ে অভ্রও হাসলো।
*****
বিদায়ের সময় তানি একটুও কাঁদলো না। হাসিমুখে বিদায় নিলো। এই বাড়িতে যে খুব শান্তিতে ছিলো তেমন না। বরং উঠতে, বসতে অনেক খোটা শুনতে হয়েছে তানিকে। কেন সংসার করতে পারলো না! কেন স্বামী, শাশুড়ীর মন জুগিয়ে চলতে শিখলো না। তানি সেসব কথার জবাব দেয় নি। বরং নীরব থেকেছে। এগারো মাসের সংসারে তানিও কম চেষ্টা করে নি মানিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আর পারে নি। ফিরে এসেছিলো। সে অধ্যায় টা তানির জীবনের ভয়াবহ একটা অধ্যায়। মনে পড়লে তানি শিউরে ওঠে এখনো। বাড়ির প্রতিটি মানুষ সেই আঘাতে খোচা দিয়ে গেছে এতো দিন। কিন্তু আজ থেকে তানির শুরু হলো নতুন জীবন। এই জীবন কেমন হবে তানি জানে না। কিন্তু মনে মনে স্বস্তি পায় এটা ভেবে যে অন্তত পুরোনো ক্ষতটা তো ভুলতে পারবে।
তাসলিমা মেয়ের জন্য কাঁদছে। শুভ্র কী বলবে বুঝতে পারছে না। তাসলিমা শুভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, বাবা আমার মেয়েটারে দেইখ্যা রাইখো।
শুভ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। হঠাৎ ই মন টা খারাপ হয়ে গেল। অবন্তীর মা’ও ঠিক এইভাবে হাত ধরে বলেছিল, অবন্তীকে দেখে রেখো শুভ্র৷ এখন থেকে তুমিই ওর সব। শুভ্র কথা দিয়েছিল। কিন্তু রাখতে পারে নি। অবন্তী মারা গিয়েছিল ওর চোখের সামনে। ভয়াবহ এক্সিডেন্টে মাথা থেতলে গিয়েছিল। চুয়াত্তর ঘন্টা আইসিওতে ছিলো। আইসিওতে নেয়ার আগে শুভ্রই বন্ডে সই করেছিল। কী ভয়ংকর সেই দিনগুলো! শুভ্র আর ভাবতে পারে না। মাথার মধ্যে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা শুরু হয়। অবন্তী ওর প্রথম ভালোবাসা ছিলো। সেই কলেজ থেকে দুজন দুজন কে ভালোবাসতো। আজ ও নেই। ওর জায়গায় এখন থেকে তানি থাকবে। কিন্তু তানিকে কী কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে! ভালোবাসা বলে আদৌ কিছু হয় কী! যদি হতো ই তবে অবন্তীকে এতো ভালোবাসার পরও কেন ওকে ঠকিয়েছিল!
চলবে……
(পান্ডুলিপি নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ছে। আর মাত্র একটা সপ্তাহ লাগবে সব গোছাতে। এরপর নিয়মিত বড় পর্ব দেব। পরবর্তী পর্ব পরশু দিন ইনশাআল্লাহ)