#মন_প্রাঙ্গনে_এলে_যখন
#লেখনীতেঃ #আলফি_শাহরিন_অর্পা
#পর্ব_২৫
আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে জয়। দৃষ্টি তার অস্তমান সূর্যের দিকে। নীল আকাশে চারদিকে ধূসর রঙের মেঘের ছড়াছড়ি সাথে আকাশে লালিমা দেখা যাচ্ছে, যা দৃশ্যটিকে মনোরম করে তুলছে। কোলাহলপূর্ণ শহরে হয়ত এই সময়ে পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়, সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে নিজ নীড়ে ফিরে যাবে হয়ত এই জন্য আনন্দ প্রকাশ করছে, কে জানে? আজ অনেকদিন পর এমন শান্তি অনুভব করছে। মাঝে মাঝে নিজেকেও একান্তে সময় দেওয়া প্রয়োজন। মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করে নিজের সাথে কেননা সে নিজের সাথে নিজের মনের কথাগুলো অনায়াসে বলতে পারে কিন্তু অন্য কোনো ব্যক্তি থাকলে তার মনে সৃষ্টি হয় অস্বস্তি ও লোকসমাজের ভীতি।
এইসবই ভাবছিলো তখনি তার চোখ একজোড়া দম্পতির দিকে যায়। মেয়েটি হয়ত ছেলেটার কাছে কিছুর জন্য বায়না ধরেছে আর ছেলেটি বরাবরই তার উপর বিরক্ত। কিন্তু যখনই মেয়েটির চেহারার মধ্যে হালকা মলিনতার ছাপ দেখা দিল তখনি ছেলেটা মেয়েটির হাত ধরে ফুচকার দোকানের সামনে নিয়ে গেল। তখন মেয়েটির মুখমণ্ডল থেকে মলিনতা চলে গেল আর দেখা দিলো এক বিস্তৃত হাসি, যা প্রকাশ করছে সে কত খুশি হয়েছে। মেয়েটির মুখে হাসি দেখে ছেলেটাও একটা বড় হাসি দিলো। কী মনোরম সে দশ্য?
~অতীত~
সেই ঘটনার অনেকদিন পেরিয়ে যায়। রুদ্ধ যখন সব জানতে পারলো সে পরশিকে বুঝালো এটা কখনো সম্ভব না কেননা জয় তাকে ভালোবাসে না। প্রথম প্রথম পরশির কষ্ট হলেও সেও নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা করে জয় কখনো তার ছিলো না। যদি হত সে তাকে পেতো। পরশি এখন আগের মত হয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে মজা করা, পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলা ইত্যাদি আও নানা কাজের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখে কিন্তু দিনশেষে মনের মধ্যে একটা খালিত্য কাজ করে। কিন্তু রুদ্ধের কথা চিন্তায় আসতে সেসবের দিকে আর যায় না।
এর কিছুদিন পর~
পরশি আনমনে স্কুল থেকে বের হচ্ছিল তখন সামনে জয়কে দেখে ভূত দেখার মত চমকে যায়। কালো রঙের শার্ট সাথে কালো রঙের প্যান্ট আর চোখে ছিলো কালো রঙের চশমা। নিজের সাদা রঙের গাড়িটির সাথে হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। তাকে সেই সময় একদম ডার্ক প্রিন্স লাগছিলো। সে কিছুক্ষণের জন্য হা করে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু পরক্ষণে জয়ের বলা সেসব কথা মনে আসতেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। আর নিজেকে জয়ের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগলো কেননা জয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই।
–জয়া! এই জয়া! আকস্মিক পিছন থেকে ভারি পুরুষালি কণ্ঠ শুনে জয়া কেঁপে উঠলো। সে জানে আওয়াজটি কার। তার ইচ্ছে করছে দৌড়ে কোথাও চলে যেতে কিন্তু সে তা করলো না। কারণ সে জানে একদিন না একদিন তাকে জয়ের সামনে আসতেই হবে তাহলে তা আজ কেনো নয়। নিজের হাত দুটো মুঠো করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। অতঃপর পিছনে ফিরে তাকালো।
–আমার তোমার সাথে কথা আছে। এই বলে জয় পরশির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল।
জয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে পরশি বললো-
–কী হয়েছে আর আপনি আমাকে এই জায়গায় কেনো নিয়ে এসেছেন?
–কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য।
–কিন্তু আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।
–কথাটা খুবই জরুরি আর তুমি সেটা শুনতে বাধ্য।
–আপনার সাথে আমার কোনো ধরনের কথা থাকতেই পারে না কেননা সেই রাস্তা আপনি নিজে বন্ধ করছেন। আর যদি বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চান তাহলে বলবো আমি আপনার সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চাই না। কেননা আমি এত স্ট্রং নই যে প্রতিনিয়ত আপনাকে নিজের সামনে দেখে নিজের অনুভূতির গলা টি’পে হ’ত্যা করতে পারব। এসব কথা বলতে বলতে পরশির চোখ ছলছল করে উঠলো। অশ্রু গুলিও আজ বাঁধ মানছে না। অশ্রুগুলোকে এত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করার পরও এর দু-এক ফোঁটা জল পড়েই গেল।
পরশির এমন রূঢ় বাণী শুনেও জয়ের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ হলো বলে মনে হলো না। সে চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।
–তোমার কথা শেষ নাকি আরও বাকি আছে? যদি বাকি থাকে বলে ফেলো কেননা এরপর আমি বলবো তুমি শুনবে? জয়ের এইটুকু কথা শুনে পরশি আর কোনো কথা বললো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। পরশির কোনো হেলদোল না দেখে জয় এবার বলতে শুরু করলো।
–জানো বয়স তখন আমার ২৫ এর কৌঠায়। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও রাজনীতি করে দিন কা’ট’তো। ছিলাম অনেকটা বাউন্ডুলে স্বভাবের। নিজের মন যা চাইতো তাই করতাম। একদিন এক পিচ্চি পরীর সাথে দেখা হলো। পরীটা ছিলো ভিষণ চঞ্চল। এক জায়গায় কখনো স্থির থাকতেই পারতো না। তার এই চঞ্চলতা বারবার মুগ্ধ করেছে আমায়। একসময় পরীটার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মেয়েটা সারাদিন আমার সাথে কথা বলতে চাইতো,আমারও ভালো লাগতো। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিলো সেই পরীটার প্রতি আমি দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম। একদিন পরীটা এসে আমাকে নিজের মনের কথা বলে ফেললো। আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম সে কী আমাকে সত্যি ভালোবাসে নাকি শুধু আবেগ মাত্র। কিন্তু পরীটা আমাকে ভুল প্রমাণ করলো কেননা বিরহ যন্ত্রণা সেই সহ্য করার ক্ষমতা রাখে যে কখনো ভালোবেসে ছিল। আর যে কখনোই ভালোবাসে নেই তার মনে এরকম কোনো অনুভূতি থাকা না থাকা এক সমান। আর একটা কথা মেঘা আমার খুব কাছের বন্ধু তাই তার সাথে মিলে তোমার সামনে মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করেছি যাতে তোমার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হতে পারি। এই বলে জয় থামলো। নিজের সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিলো পরশির দিকে। পরশির দিকে তাকাতেই ওর বুকটা ছ্যা’ত করে উঠলো। কেঁদে কে’টে নিজের চেহারার কী অবস্থা করে ফেলেছে। সে পরশিকে থামাতে যাবে এর আগেই পরশি দৌড়ে এসে তাকে জরিয়ে ধরলো।
এভাবলই হেঁসে খেলে দিন যাচ্ছিলো পরশির। নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে খুশি মেয়ে মনে করতো পরশি। নিজের কথাঝুলি খুলে বসতো জয়ের সামনে জয়ও মন দিয়ে শুনত। এর কিছুদিন পর ওদের সম্পর্ক সম্পর্কে জানা জানি হয়ে যায়। তখন জয় জি’দ ধরে বসে তার আর পরশির এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখতে। সবাই যখন তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো যে পরশি আরেকটু বড় হলে এনগেজমেন্ট করিয়ে দিবে তখন সে কিছুই বুঝতে চাইছে না। অবশেষে সবাই বাধ্য হয়ে আয়োজনে লেগে পড়লো।
আজ পরশি আর জয়ের এনগেজমেন্ট । সবাই পরিবারের মধ্যে ছোট করে করতে চাইলেও জয়ের জি’দ ছিলো এটা বড় করে করতে হবে। অগত্যা সবাইকে রাজি হতে হলো।
ধুমধাম করে আয়োজন করা হলো সবকিছুর। এখন সময় হয়ে গিয়েছে জয় আর পরশি আংটি বদলের। জয় আংটির বক্স থেকে আংটিটা উঠালো এবং পরশিও নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু জয় পরশির হাতে আংটিটা না পড়িয়ে তা দূরে ছুঁ’ড়ে
মাড়লো। সকলে হতভম্ব হয়ে গেল জয়ের এমন কাণ্ডে।
মিসেস চৌধুরীর প্রচণ্ড রাগ লাগছে তাই তিনি তেড়ে গেলেন জয়ের নিকট আর জিজ্ঞেস করল-
–জয় এটা কোন ধরনের মজা।
–মা আমি একদম মজা করছি না। গম্ভীরতার সাথে জবাব দিলো জয়।
–দেখ এইবার অনেক হয়েছে লোকজন আছে এখানে। তাড়াতাড়ি আংটিটা তুলে এনে পরশিকে পড়াও। মিসেস চৌধুরীর এমন কথা শুনে জয় কিছুক্ষণ নিজের মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো অতঃপর হোস্টের হাত থেকে মাইকটা ছিনিয়ে নিয়ে পরশির সামনে দাঁড়াল। অতঃপর একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো –
–এখানে কোনো এনগেজমেন্ট হবে না।
চলবে…
বিঃদ্রঃ নেক্সট পর্বে জয় ও পরশির অতীত শেষ করে দিব। আজকেই চেয়েছিলাম কিন্তু সময় পাইনি।