বেসামাল প্রেম পর্ব ১৫

0
2505

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৫
আপনাদের জীবনে কি মন ভালো করার মতোন মেডিসিন আছে? যার জীবনে মন ভালো করার মেডিসিন আছে তার জীবনটা কিন্তু সত্যি ভীষণ সুন্দর এবং রঙিন হয়৷ হৈমীর জীবনে মন ভালো করার মতো মেডিসিন আছে, তার নাম টিশা৷ এই টিশা কিন্তু শুধু হৈমীর জীবনেরই মেডিসিন নয় এই টিশা আরো অনেকের জীবনেরই মন ভালো করার মেডিসিন। তবে এই মেডিসিনটাকে একান্তই নিজের করে পেয়েছে শুধুমাত্র রউফ। টিশার স্বামী, হৈমীর দুলাভাই। সে যাইহোক আজ যে হৈমীর ভীষণ মন খারাপের দিন। এই মন খারাপটা অবশ্য গত দু’দিন থেকেই হচ্ছে। যার ফলে সে পড়াতে মন বসাতে পারছে না, কলেজে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। আর না সূচনার সঙ্গে মন থেকে হাসিখুশি হয়ে মিশতে পারছে৷ তার এই মন খারাপের রহস্যটা কি জানেন? মি. রুদ্র শেখ। তার ভাবির ভাই, তার বেয়াইসাহেব। আজ দিয়ে শেখ বাড়িতে তিন দিন হলো তার। সেই যে প্রথম দিন আছাড় খাওয়ার পর রুদ্রসাহেব তার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল, এরপর আর সামনে আসেনি। মূলত সমস্যাটা শুরু হলো এখান থেকেই। মেয়েরা ছেলেদের এটিটিউড দেখাতে যতটা পছন্দ করে। ঠিক ততটাই অপছন্দ করে ছেলেদের এটিটিউড দেখতে। আর হৈমী সে তো বরাবরই অ্যাটেশন সিকার। যে লোকটা ক’দিন এত পাগলামি করল তার জন্য কী সব বিশ্রী আচরণ সে কিনা হুট করে এত এভয়েড করছে তাকে! লোকটা একটু বেশিই অহংকারী হয়ে গেল না? তার মতো মেয়েকে পাত্তা টাত্তা দিতে একেবারেই যে ভুলে গেল। এটা কী ঠিক? সেই যে প্রথম দেখার পর থেকে কী সব ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল! এরপর তুলে নিয়ে বিয়ে করার মতলবও আঁটলো। কত কাণ্ডই তো ঘটালো। একটা এক্সিডেন্ট, এরপর বিয়ের প্রপোজাল থেকে রিজেক্ট, সবে মিলে লোকটা মারাত্মক এটিটিউডের ভাণ্ডার খুলে বসল। সহ্য হয় এসব? একেবারেই হয় না। মনটা আজ ভীষণ খারাপ, ভয়াবহ রকমের খারাপ। সেই মন খারাপ নিয়েই কানে ইয়ারফোন গুঁজে স্যাড সং শুনতে শুনতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সূচনা তখন রুমের ঝুলবারান্দায় মাহেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। তাই হৈমী রুম ছেড়ে বেরিয়ে দোতলার বারান্দার একপাশে যে বেতের চেয়ার টেবিল রয়েছে সেখানে গিয়ে আরাম করে বসল৷ গান শুনায় এতই বিভোর ছিল যে নিচে তাকাতে সময় নিল ঘন্টাখানেক। ঘন্টাখানেক পর যখন আকস্মাৎ নিচের দিকে নজর পড়ল। বুকের অতি গোপন কুটিরে কেমন করে যেন ধক করে ওঠল! একি রুদ্র যে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কফি খাচ্ছে! কাঁপা হাতে দ্রুত গান অফ করে বারকয়েক ঢোক গিলল হৈমী। নিজেকে কিছুটা আড়াল করে পিটপিট চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল রুদ্রর ভাবগতিক । এরপর লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। ওঠে দাঁড়য়ে মোবাইলটা পরিহিত লেডিস শার্টের পকেটে রেখে ধীরপায়ে বারান্দায় পায়চারি করল কতক্ষণ। বিরবির করে বলল,
-” একটু বেশিই ঢং দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে, তিনি কি হোম মিনিস্টার! বয়সে বড়ো বলে সহ্য করছি নয়তো এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিতাম, বেয়াদব। বাড়িতে আত্মীয় এলে যে মিলেমিশে থাকতে হয় সই শিক্ষাই নেই! ”

মনে ভিতর রাগটা ক্রমাগতই বাড়তে লাগল। ইচ্ছে করল নিচে গিয়ে লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু এসব তো করা যাবে না৷ পাছে কেস টেস ঠুকে দেয়? নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত সলিউশন খুঁজতে ফোন করল টিশাকে। টিশা ফোন রিসিভ করেই বলল,
-” কিরে এখন ফোন দিলি ঘুমাসনি? আমি মিষ্টি খাচ্ছি দুটো খেয়েছি, আর একটা খাব। এর বেশি খাব না। ওজন বেড়ে গেছেরে বিয়ের সময় ছিলাম পয়তাল্লিশ এখন ঊনষাট। বাবুর ওজন আড়াই কেজি৷ এই জানিস আজকাল পেটটা নিচের দিকে কেমন ভারি ভারি লাগে। বাবু এত নড়াচড়া করে। আমার কি মনে হয় জানিস দীর্ঘদিন এক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকতে ওর ভীষণ বিরক্ত লাগছে।”

-” তা তো লাগবেই তুই এক সেকেণ্ড কোথাও বসে থাকতে পারিস না আর তো ছানাটা কত মাস এক জায়গায় পড়ে আছে ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক! এবার আসল কথা শোন, আজ আমার খুব মন খারাপ। ”

-” সেকি! মন খারাপ কেন রে? তোর বেয়াই তো আর এখন তোকে চুম্মা টুম্মা দেয় না৷ তাহলে মন খারাপ কেন? ”

-” আর বলিস না দুঃখের কথা বেয়াই যে গিরগিটির মত রঙ বদলাইছে তা তো বলিইনি। ”

হৈমী টিশাকে পুরো কাহিনী খুলে বলার পর টিশা খুব সিরিয়াস হয়ে বলল,
-” সবই বুঝলাম, তোর সমস্যাটাও বুঝলাম। ”

-” আমার সমস্যা, আমার আবার কী সমস্যা। আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু রাগ লাগছে যে এই লোকটা এসব করে আমাকে অপমানও করছে। ”

-” শোন তুই যে প্রেমে টেমে পড়ে গেছিস টের পেয়েছিস। অবশ্য না পাওয়ারই কথা তোর তো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এই টিশার আছে। শোন, চারটা প্রেম করে একটা বিয়ে করেছি। পেটে বাচ্চা নিয়ে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াই, পকপক করে কথা বলি, ক’দিন পর আম্মা ডাক শুনব, তোকে খালা ডাক শুনাবো, জামাইকে আব্বা ডাকের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই টিশার বয়স যাইহোক অভিজ্ঞতা কিন্তু কম নেই। ”

-” তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস দেশে, বিদেশে শতশত হিরো টাইপ ছেলে রেখে আমি বাংলাদেশের ডিপজল, মিশা, ইন্ডিয়ান ভিলেন, চুল ঝুঁটি করা পাগলা বাবা টাইপ ছেলের প্রেমে পড়ব! যে কিনা আবেগের তাড়নায় একা পেয়ে অর্ধেক বাসর সেরে ফেলে ছিঃ ছিঃ বইন। আমার রুচি সম্পর্কে তোর এমন ধারণা। লজ্জিত হলাম ভীষণ লজ্জিত। ”

-” তোর লজ্জা ধুয়ে তুই পানি খা। আমার মুখ থেকে সত্যি ছাড়া মিথ্যা বের হয় না। তা তুই খুব ভালো করেই জানিস। আর প্রেম টেমের ব্যাপারে আমি যে পিএইচডি করা এতেও সন্দেহ নেই। আমার রগচটা জামাই যে কিনা দু-চোখে আমাকে সহ্য করতে পারতো না, বিয়ে করল মায়ের চাপে পড়ে, সে জামাইকে বশে এনেছি শুধু প্রেম, ভালোবাসা দিয়ে। এমন বশ করেছি যে এখন দিন রাত প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে অস্থির সে। ”

একদমে কথাগুলো বলে ঢোক গিলল টিশা। এরপর হৈমীকে কিছু বলতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” রুদ্র বেয়াই এখন কী করছে রে? তখন বললি ঢং ধরে কফি খাচ্ছে, শেষ হয়নি? ”

দম ছাড়ল হৈমী। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আহত সুরে বলল,
-” এখন কী করছে জানিস? ”

-” কী? ”

-” উনার ডান পা টি টেবিলের ওপর রাখা, সে ডান পায়ের ওপর আবার বাম পা তুলে রাখছে। ঘাড়টা সোফার মাথায় এলিয়ে চরম শান্তিতে সিগারেট খাচ্ছে। ভাবটা এমন যে সিগারেট না অমৃত খাচ্ছে। ”

-” আহা কতদিন সিগারেটের গন্ধ নেয়া হয় না। তোর দুলাভাই বাবু আসার পর থেকে সিগারেট বাদ দিছেরে। সিগারেট টা আমার জোশ লাগতো। ও যখন সিগারেট খেতো আমি কত তৃপ্তি নিয়ে শুঁকতাম। যাক সে কথা তোর এখন কেমন ফিলিংস হচ্ছে রে? একটা গান ভাইরাল হয়েছে শুনেছিস?
ছেলে তোর গোলাপ গোলাপ ঠোঁটে
যখন বিড়ির ধোয়া উঠে
সেই ধোয়া দেখিতে বড়ই ভাল্লাগে। ”

নিজে বলে নিজেই খিলখিল করে হেসে ওঠল। অথচ আজ টিশা মন ভালো করতে পারলো না হৈমীর। নিজের ব্যর্থতা টের পেয়ে টিশার জেদ হলো খুব। কেন হৈমীর মন ভালো হলো না? তার স্বামী যে বলে তার কাছে মন ভালো করার মতো জাদু আছে সেসব কথা কি মিথ্যা? উহুম তার স্বামী মিথ্যা বলতেই পারে না। যদি বলেও থাকে তাহলে সে মিথ্যাকে সত্যি করার ক্ষমতা তার আছে। তাই প্রচণ্ড সিরিয়াস হয়ে হৈমীকে বলল,
-” আমি তোকে একটা কাজ দিব পারবি? ”

-” মন ভালো হওয়ার মতো কাজ? ”

-” ইয়েস সিস্টার। ”

-” তাহলে পারব। ”

-” ভয় পাবি না তো? ”

-” তুই কি আমাকে ভীতু টাইপ মেয়ে ভাবতে শুরু করলি নাকি? ”

ঠোঁট টিপে হেসে টিশা বলল,
-” শোন রুদ্র ভাই সিগারেট খাচ্ছে তুই এখন নিচে যাবি গিয়ে ইউটিউবে ঢুকবি, এরপর ভাইরাল গানটা প্লে করে টি টেবিলের সামনে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি৷ রুদ্র ভাই যে ধরনের মানুষ নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে, রেগে যাবে? চোখ গরম করে গাল দু’টো শক্ত করে তাকাবে? তুই তখন ফুড়ুৎ করে ফোনটা নিয়ে সূচনা ভাবির রুমে চলে আসবি। একেবারে সেভ এন্ড চিল। কী পারবি তো? ”

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মুখে হাত চেপে হেসে ওঠল হৈমী। বলল,
-” পারব না মানে? উনাকে একটু জ্বালাতেই তো মন আনচান করছে। ”

ফোন কেটে দিল টিশা। মনে মনে বলল,
-” তুমি যে মনে মনে তার সামনে যেতে চাচ্ছো , তার কাছাকাছি থাকতে চাচ্ছো তা কী আর আমি বুঝিনা চান্দু? আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খুব শিঘ্রই তোমাদের মাখামাখি প্রেম হবে। যাই বাবা আমার জামাইটার বোধ হয় পড়া শেষ এবার ঘরে যাই। ”
____
টিশার আদেশ মতো হৈমী যখন গানটা প্লে করল।
“ছেলে তোর গোলাপ গোলাপ ঠোঁটে
যখন বিড়ির ধোয়া উঠে
সেই ধোয়া দেখিতে বড়ই ভাল্লাগে। ”

লিরিক শুনে রুদ্র সত্যি সত্যি বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে হৈমীর দিকে তাকাল। হৈমীর কেন জানি সাহস হলো না সামনে থাকতে। তাই চটপটে পায়ে চলে গেল রান্না ঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে পুনরায় ফেরত এলো। রুদ্র সিগারেট শেষ করে হৈমীর ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে হৈমীর দিকে তাকাল। বলল,
-” প্রপোজ করছো? ইউ নো হোয়াট সেধে দেয়া জিনিস আমি নিই না। ”

দু’ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল হৈমীর৷ সহসা তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
-” আমি আপনাকে প্রপোজ করতে আসব আমি? প্রপোজ করার মতো কী আছে আপনার? আমি এসেছিলাম জাস্ট আপনাকে জ্বালিয়ে নিজের মনকে শান্ত করতে। ”

নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। ব্ল্যাক ট্রাউজার, ব্ল্যাক টি-শার্ট পরিহিত পেশিবহুল, সুঠাম দেহটি আজকে ভীষণ অভিলাষ পূর্ণ লাগছে। যেই অভিলাষী দৃশ্য হৈমীর অন্তঃকোণ শুঁকিয়ে চৈত্রের খরা সৃষ্টি করল। সেই খরায় এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায় মাত্র একটিবার ঢোক গিলল সে। কেঁপে ওঠল দু’পায়ের পাতা, উঁচিয়ে রাখা তর্জনী। রুদ্র সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে সে তর্জনী নিজের মুঠোয় করে নিল। দু-চোখ শক্ত করে বুজে ঠোঁট কাঁপিয়ে হৈমী বলল,
-” আমি কিছু বলিনি, আমি কিছু করিনি। ”

প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বক্র হাসিতে ঠোঁটজোড়া চঞ্চল হলো রুদ্রর। মাথা নিচু করে হৈমীর গোলগাল ছোট্ট মুখের সম্মুখে ঠোঁটজোড়া নিয়ে সিগারেটের গন্ধযুক্ত উত্তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। নিমিষেই হৈমীর বক্ষঃস্থলের ওঠানামা বেগতিক ভাবে বেড়ে গেল। শক্ত কাঠের ন্যায় চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল সে। রুদ্র তার বেসামাল চিত্তকে আরো বেশি বেসামাল করে দিতে পুনরায় উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” আমাকে জ্বালাতে এলে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সুইটহার্ট! ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here