#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৪
সঙ্গী হারিয়ে সুগন্ধা বড্ড একা হয়ে গেছেন। আলী আকবরের মৃত্যুর প্রায় দুটো বছর পেরিয়ে গেছে। একদিকে একাকিত্বের জ্বালা। আরেকদিকে উমার কটু কথা। পারিজাকে যেভাবে তিনি উঠতে বসতে কথা শুনিয়েছেন। উমাও সেভাবেই নিজ শাশুড়ীকে কথা শোনায়। খাওয়ার খোঁটা, কাজের খোঁটা। সবকিছুতেই সুগন্ধার দোষ ধরে উমা। উমার বেলায়ও যে সুগন্ধা কম করেছেন তা কিন্তু নয়। উমা ভালো ঘরের মেয়ে। কিন্তু, শশুর বাড়িতে সংসার করতে হলে কথা তো শুনতেই হবে। তাই হয়তো এই বেলায় যে সবকিছুর কড়ায় গন্ডায় শোধ তুলছে উমা। সুগন্ধা আজকাল একা একা কী যেন বিরবির করে। কোনো মানুষ দেখলেই রেগে যায়;চিৎকার চেচামেচি করে। সবাই একটু দূরে দূরেই থাকে সুগন্ধার থেকে।
ভর দুপুরে টপা ছাঁদে বসে বসে কুলের আচার খাচ্ছে। পারিজা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে তারপর ওপরে এলো।টপা পারিজাকে দেখে কুলের আচার খেতে সাধলো। পারিজা একটু মুখে দিয়ে বললো,
–কী ব্যাপার? এত উদাস হয়ে বসে আছো?”
টপা কুলের আচার খেতে খেতে বললো,
— কী আর বলবো! বড় আম্মাও কখনো এত কথা আমায় বলেনি। উঠতে বসতে বড় ভাবী এটা সেটা বলে খোঁটা দেয়! আমি তাঁর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? কাজ করতে করতে গায়ে গতরে আর কিছু নেই। তবুও রোজ শুনি আমি নাকি কাজ করি না। তাহলে, রোজ রোজ এত থালাবাসন,জামাকাপড় কী আমার ভূত এসে কেঁচে দিয়ে যায়?”
পারিজা টপার কথা শুনে মুচকি হাসলো। হেসে বললো,
— সেতো কত কিছুই বলে। এত কথা ধরো না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এসব শুরু হয়েছে। বড় দাদা, উমা দিদি আগে এরকম ছিলেন না। কে জানে এখন কী হয়েছে! ”
টপা পারিজার কথার উত্তরে বললো,
— শাশুড়ির ভূত এখন বউয়ের ঘাড়ে চেপেছে। এতদিন বড় আম্মা আর এখন বড় ভাবী। বউ শাশুড়ী বলে কথা!”
পারিজা আর টপা দুজনেই হেসে উঠলো। টপা পারিজাকে আবার প্রশ্ন করলো,
— তোমার মা কেমন আছেন ছোট ভাবী?”
পারিজা টপার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এই তো আছেন ভালো।”
টপা পারিজাকে বললো,
— আর ছোট ভাই? তোমার সঙ্গে এখনও খারাপ ব্যবহার করে? নাকি ঠিকঠাক?”
পারিজা টপার কথার জবাবে বললো,
— না সেরকম কিছু না। আছি আমরা ভালো”
টপার কথার বহর যেন ফুরাচ্ছে না। পারিজাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে নিজেই পারিজাকে বললো,
— তোমাকে দেখে বেশ কিছুদিন যাবত সন্দেহ হচ্ছে ছোট ভাবী। তোমার কিছু হবে টবে নাকি?”
পারিজা লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়লো। টপা হেসে বললো,
— ছোট ভাই জানে? বলেছো ওনাকে?”
পারিজা টপার দিকে তাকিয়ে বললো,
— না বলবো ভেবেছি। বলবো বলবো করে বলা হচ্ছে না। কাজের জন্য তোমার ভাইয়ের অবস্থা দফা রফা। তাই আর বলা হচ্ছে না।”
টপা মুচকি হেসে বললো,
— জানিয়ে দেখো। ছোট ভাই খুশি হবে অনেক।”
পারিজা মুচকি হাসলো।
ওয়াহেদ মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পারিজাকে এখনও সেভাবে জানানো হয়নি কথাটা। এই ভাইয়ে ভাইয়ে দন্ড ওয়াহেদের আর ভালো লাগে না। ওয়াহেদের বাবা আলী আকবর মৃত্যুর পূর্বে সবার নামেই জমিজমা লিখে রেখে গেছেন। সেই সূত্রে ওয়াহেদের নামেও কিছু জমি বরাদ্দ আছে। ওয়াহেদের ইচ্ছে সেই জমিতে একটা বাড়ি তুলবে। এই বাড়িতে আগের মতো আর ভালো লাগে না। এহমাদ আর এহমাদের বউয়ের কান্ড দেখলে, ওয়াহেদের নিজের মাথায় বারি মারতে ইচ্ছে করে। সবসময় মহা রাজাদের মতো হুকুম জারি করে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বন্দি খাঁচা হয়ে গেছে ওয়াহেদের জীবনটা!
— পারিজা!”
পারিজা ওয়াহেদের গলার স্বর শুনে পেছন ফিরলো। ওয়াহেদ আমতা আমতা করে পারিজাকে বললো,
— বাবা আমার নামে জমি রেখে গেছেন পারিজা। তুমি তো বাড়ির অবস্থা জানোই। চলো আমরা আলাদা হয়ে যাই। আমাদের জমিতে আমরা বাড়ি করবো। ওখানেই থাকবো আমরা। রোজ রোজ এত অশান্তি আর ভালো লাগে না। ”
পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
— নিজের চিন্তা ছাড়া তুমি কী কিছু ভাবতে পারো না ওয়াহেদ? তোমার আম্মার অবস্থা একবার দেখেছো তুমি? প্রান তাঁর যায় যায় অবস্থা। উমা দিদির ব্যবহার তো তুমি নিজেই দেখেছো। এই অবস্থায় আমরাও যদি সব ছেড়ে চলে যাই। তাহলে, আম্মার কী হবে ভেবেছো? বাবা নেই তো কী হয়েছে? আম্মা কী মরে গেছেন?”
ওয়াহেদ মাথা নিচু করে বললো,
— এত কিছু ভেবে বলিনি আমি। ওই এমনি মনে এসেছিল; তাই বলেছি।”
পারিজা মাথায় চিরুনি কাটতে কাটতে বললো,
— সেই তো! এমনি মনে যা আসে তাই বলে ফেলো! এক বাচ্চার বাপ হবে। তাঁর মুখের এই অবস্থা।কোনো লাগাম নেই মুখের! ”
ওয়াহেদ চমকে পারিজার দিকে তাকালো। পারিজা কিছু না দেখার ভঙ্গি করে চুলে চিরুনি কাটতে লাগলো।
পারিজা তৃণলতাকে চিঠির জবাব হিসেবে আরেকটা চিঠি লিখলো।
” আম্মা, তোমার মতো আমিও খুব শীঘ্রই স্বর্গ সুখ লাভ করতে চলেছি। তোমার মতো আমাকেও কেউ আম্মা বলে ডাকবে। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আম্মা। আমার তোমাকে খুব মনে পরছে আম্মা।”
পারিজা চিঠিটা টপার কাছে দিয়ে দিলো। পারিজা মনে মনে ঠিক করলো সে ওয়াহেদকে একটা কথা বলবে। দীর্ঘদিন পারিজা নিজের আম্মা তৃণলতার মুখটা একবারের জন্যও দেখেনি। পারিজা ওয়াহেদকে বলতে চায় ওয়াহেদ যেন তাঁকে তৃণলতার কাছে রেখে আসে।
পারিজা ওয়াহেদের কাছে নিজের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতেই ওয়াহেদ সাফ সাফ না করে দিলো। পারিজা যখন রাগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। তখনই ওয়াহেদ বলে উঠলো,
— এত রাগ করে না লক্ষীটি! তোমাকে রেখে আসবো তোমার আম্মার কাছে। কিন্তু, এখন না;আরো কিছু দিন পরে। শুরুতেই এত লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি করলে কখন না কী হয়ে যায়।”
পারিজা ওয়াহেদের কথা শুনে চুপ করে গেল। আরো কিছুদিন যাক। ওয়াহেদ অনুমতি দিক বা না দিক। পারিজা একাই যাবে আম্মার কাছে। কারো বাঁধা শুনবে না সে।
চলবে…