#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৭
সন্ধ্যার পর কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পর পাড়ার মোড়ে একটা জম্পেশ আড্ডা জমে। ওয়াহেদ, মাহমুদ, এহমাদ তিন ভাই সেখানে উপস্থিত ছিল। হাতে চা আর সবার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা। পরিস্থিতি ততক্ষণ অবধিই স্বাভাবিক ছিল যতক্ষন অবধি মাহমুদের মুখ বন্ধ ছিল। মাহমুদের একটু টিটকারি জনক কথায় ওয়াহেদের বেশ গায়ে লাগলো। ওয়াহেদ চা খেতে খেতে কথা বলছিল। মাহমুদ কোনো কারণ ছাড়াই ওয়াহেদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— তোরই তো দিন ভাই। বউতে না পোষালে শাশুড়ী। প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে আমার। কেন যে তোর মতো হলো না আমার কপালটা। একেবারে এক ঢিলে দুই পাখি। মা মেয়ে দুজনেই তোর।”
এটা বলেই মাহমুদের দাঁত কেলিয়ে হাসি। ওয়াহেদ কথার মানে বুঝতে পেরেও চুপ থাকলো। আশেপাশে লোকজন আছে। সে মুখ খুললেই বিরাট একটা ঝামেলা হয়ে যাবে। মাহমুদের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাশের দাদা তো বলেই ফেললো,
— মানে কী! কী বলছো গো!”
মাহমুদ দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে হেসে বললো,
— হুম ঠিকই শুনেছো। আমাদের ওয়াহেদের খাসকপাল। শাশুড়ী তাঁর নষ্টা কিনা। দিনে বউ রাতে শাশুড়ী। আহা!”
ওয়াহেদ চুপচাপ সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ভাইয়ের কথাগুলো একেবারে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। বাড়িতে ফিরে চুপচাপ উঠোনে বসে রইলো ওয়াহেদ। ভাই আজ বাড়ি ফিরলে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। এভাবে সবার সামনে ওসব বলার কী দরকার ছিল?লোকের নিন্দে শুনতে কার ভালো লাগে?
মাহমুদ বাড়ি ফিরতেই ওয়াহেদ রেগে ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— তুমি পেয়েছো কী ভাই? তুমি তো নেমকহারাম! ভাই হয়ে ভাইয়ের ক্ষতি করো। লজ্জা করে না তোমার!”
মাহমুদ হেসে বললো,
— এতে লজ্জার কী আছে? আমি তো ভুল কিছু বলিনি। কিছুদিন পর এমনটাই হবে দেখেনিস। আমার কথা কখনো বিফলে যায় না।”
ওয়াহেদ সবচেয়ে ভুল কাজটাই করে ফেললো। একটা চেয়ার তুলে নিয়ে মাহমুদের হাতে আঘাত করলো। মাহমুদ আর্তনাদ করতেই তীব্র শব্দে সুগন্ধা মির্জা নিচে নেমে এলেন। পারিজা,উমাসহ, পারিজার মেজো জা বিমলা নেমে এলো। সুগন্ধা ওপর থেকে নিচে নামতেই দেখলেন ওয়াহেদের হাতে বড় লোহার চেয়ার। মাহমুদ নিচে পরে আছে। সুগন্ধা নিজের ছোট ছেলে ওয়াহেদের গালে একটা চড় মেরে বললেন,
–এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে! শেষমেশ বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলবি! আগে তো তুই এমন ছিলি না। বড় ভাইদের সঙ্গে কখনো কথার অমতও করতি না। কে এগুলো শিখিয়েছে? বউ শিখিয়ে দিয়েছে এসব। তাই না? ভাইকে মে/রে ফেললে সম্পত্তি যদি দুআনা বেশি পাওয়া যায়। তাই তো বলেছে,তাই না!”
ওয়াহেদ উত্তেজিত গলায় উত্তর দিলো,
— আম্মা! তোমার মেজো ছেলে আজ সবার সামনে আমার সম্মান উড়িয়ে দিয়েছে। সবার সামনে ইচ্ছে করে বলেছে। আমি না কি নষ্টার মেয়ে বিয়ে করেছি। দিনে বউ আর রাতে শাশুড়ী নিয়ে শুই আমি। বড় ভাইয়ের থেকে এসব শুনতে হলো? আম্মা তুমি আমার মাথায় লোহা দিয়ে দুটো বারি দাও। আমি ম/রে যাই। তবুও এসব শুনতে ভালো লাগে না আমার।”
সুগন্ধা নিজের ছেলেকে বিন্দুমাত্র শাসন করলেন না। পারিজার সামনে গিয়ে বললেন,
— যেদিন থেকে এই মেয়েকে ঘরে তুলেছি। সেদিন থেকে আমার ঘরে বিপদ আপদ লেগেই আছে। যেমন মা তেমন তাঁর মেয়ে। নিজে হয়েছে নষ্টা। মেয়েটাকেও বানিয়েছে তেমন।দুটোর চরিত্র একইরকম। শুধু পরপুরুষের দিকে নজর। দেহব্যবসায়ী! এত সম্পত্তির লোনা কীসের তোমার? নিজের বরকে শিখিয়ে দিচ্ছো সবকিছু তাই তো! তোমার মাই তো বলে দিয়েছে এসব করতে তাই না! নষ্ট পাড়ার মেয়েদের কখনো ঘরে তুলতে নেই। অন্তত জমিদার অভিজাত পরিবারে তো একেবারেই নয়। ধ্বংস করে দেবে সবকিছু! ”
পারিজার প্রচন্ড আত্মসম্মানে লাগলো কথাগুলো। এখন এখানে তাঁর দোষ কী? তবুও এতগুলো কথা শুধু শুধু শুনতে হলো? নাহ! এর জবাব সে দেবেই! পারিজা উঁচু গলায় বললো,
— মা, আপনি বলেছেন আমার মা নষ্টা। আমার মা দেহব্যবসায়ী। আমি মেনে নিয়েছি। আপনি ভুল কিছু বলেননি। যা সত্যি তাই বলেছেন। কিন্তু, মা কথায় কথায় আপনাদের জমিদারি পরিবারের কথা তুলবেন না। আপনারা পতিতাবৃত্তিকে ঘৃনা করেন। আপনারা পতিতা-দের ঘৃনা করেন।কিন্তু, আপনাদের এই ঘৃনা এই নীতিবাক্য কোথায় যায়। যখন সপ্তাহে দুটো নির্দিষ্ট দিনে আপনাদের বাড়িতে বাইজিদের আসর বসে। নাকি সেটাও আপনাদের জমিদারি পরিবারের আভিজাত্য? আপনার মেজো ছেলে যখন প্রায়ই নষ্ট পাড়ায় গিয়ে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। তখন কোথায় থাকে আপনার এই নীতিবাক্য? আপনি সব বুঝে শুনেও চুপচাপ বসে থাকেন। তখন কী নিজের জমিদারি পরিবারের সম্মানের কথা মাথায় আসে না?”
সুগন্ধা রেগে গিয়ে বললেন,
— যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! কোথা থেকে শিখেছো এত নষ্টামি? মায়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে লজ্জা লাগে না তোমার?”
পারিজা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
— আমি তো ভুল কিছু বলিনি মা। মায়ের বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে আমি এভাবে কথা বলেছি। তাই আমি নষ্টা। আপনি যখন নিজের বয়সী একজন নারীর সম্পর্কে এত বাজে বাজে কথা বলেন। তখন? ”
সুগন্ধা জোর গলায় বললেন,
— আমাকে এতকিছু বলার পরেও তোমাকে ছাড় দেবো ভেবেছো? খুব শীঘ্রই তোমাকে বাড়ি থেকে বিদায় করবো। নাহলে আমার নামও সুগন্ধা না। রোজ রোজ তোমার জন্য এসব অশান্তি সইতে পারবো না আমি।”
পারিজা কিছুটা চমকে উঠলো। সুগন্ধা ওয়াহেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— তুই যদি আমার ছেলে হয়ে থাকিস বাবা। তাহলে, তুই এই মেয়েকে তালাক দিবি! এরচেয়ে অনেক ভালো মেয়ের সঙ্গে আমি তোর বিয়ে দেবো। যে তোর কানে অন্তত বিষ ঢালবে না।”
সুগন্ধা ওপরে চলে যেতেই পারিজা ঘরে গিয়ে বসলো। বিয়ের আগের জীবনটা কত ভালো ছিল পারিজার! সেখানে অন্তত একটু শান্তি ছিল। এখানে শান্তির শ টুকুও নেই। রোজই একই জিনিস নিয়ে অশান্তি। নোংরা নোংরা কথা হজম। আর কত সহ্য করতে হবে এসব?
ওয়াহেদ ঘরে ঢুকে পারিজার সামনে গিয়ে বললো,
— মা এক কথার মানুষ পারিজা। আমি যেখানে এত ঝামেলা করে ফেলেছি। সেখানে তোমার এত তর্ক করার কী প্রয়োজন ছিল? চুপ থাকলেই পারতে। এখন যদি মা সত্যি সত্যিই আমার জন্য মেয়ে দেখে? তুমি আজকে একেবারেই ঠিক করোনি। তোমার মায়ের কথার জবাবে কিছুই বলার দরকার ছিল না। তুমি কী একটু চুপ থাকতে পারো না?”
পারিজা স্পষ্ট ভাবে বললো,
— অন্যের বেলায় হয়তো চুপ থাকতে পারতাম। তবে, আমার মায়ের বেলায় আমি একচুলও ছাড় দেবো না। আর তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? শুনে রাখো, তোমার মা তোমার জন্য মেয়ে দেখুক কিংবা তোমার বিয়ে দিক। তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। তুমি ভেবেছো তুমি আরেকটা বিয়ে করবে। আমি অভাগীর মতো এই বাড়িতে পরে থাকবো। কিন্তু, আসলে এমন কিছুই না। বিয়ে তো দূরের কথা। আম্মা তোমার জন্য যেদিনই মেয়ে দেখা শুরু করবে। সেদিনই এই বাড়িতে আমার শেষ দিন। তোমাদের এই সংসারের প্রতি অনেক আগে থেকেই আমার মন উঠে গেছে। বিয়ের কয়েকদিন পরই যখন এত অপমান অপদস্ত হতে হয়েছিল। তখনই আমার মনে হয়েছিল। এই সংসার আমার জন্য না। যেখানে আমার মূল্য নেই। সেখানে আমার স্থায়িত্ব একেবারেই কম।”
ওয়াহেদ উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
— পারিজা! আম্মার উচিত ছিল আরো আগেই আমার জন্য মেয়ে দেখা। তোমার মতো একটা মেয়ের সঙ্গে এতদিন থাকা আমার উচিত হয়নি। আসলেই! সত্য বলেছিল আম্মা। তোমার মতো মেয়েরা এমনই। একূল অকূল সর্বকূলেই তোমাদের থাকতে ইচ্ছে করে! এমন মেয়েদের সঙ্গে থাকাও উচিত না!”
পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— থেকো না! তুমি পুরুষ মানুষ। তোমার মুখের তিনটা শব্দই যথেষ্ট! ”
ওয়াহেদ বিষ্মিত হলো। পারিজার স্পষ্টভাষ্যতা দেখে। আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। শোকেসের সামনের দামী ধাতুর তৈরী জিনিসটা নিয়ে আছাড় মারলো। দরজা খুলে নিশিরাতে উধাও হলো।পারিজা একবারও পিছু ডাকলো না। ওয়াহেদের আজকের ব্যবহার তাঁকে পারিজার মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পারিজা ভোরের অপেক্ষা করলো। ভোর হতেই স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে। বাড়ি ছেড়ে শুন্য হাতে বেরিয়ে গেল। আসার সময় বাড়ির দিকে তাকিয়ে একবার মনে মনে বললো,
— আমার আল্লাহ , এই দোজখ খানায় যেন আর ফিরতে না হয়।”
ওয়াহেদ সারারাত কানুর দোকানে কাটিয়েছে। কানুর ছোট্ট দোকান। যাওয়ার জায়গা নেই। দোকানেই খাওয়া, দোকানেই ঘুম। ওয়াহেদ মাঝরাতে গিয়ে বেচারাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। সারারাত চা খেয়ে বিস্কুট খেয়ে কানুর সঙ্গে গল্প করেছে। কানু একবার অবশ্য বলেছিল এত রাতে এখানে কেন? ওয়াহেদ উত্তরে বলেছে তোমার ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। কানু শুধু একটু করে হেসে ছিল।
সকালে ওয়াহেদ বাড়ি ফিরে গেল। পারিজার প্রতি এক গাদা অভিমান। ওয়াহেদ বাড়ি ফিরে পারিজাকে কোথাও পেল না। টপাকে জিজ্ঞেস করতেই টপা বললো,
— আমি ভোর বেলা যখন আসছিলাম। ছোট ভাবীকে বাইরে দেখেছি। ভাবীকে দূর থেকে দেখেছি। ভাবী তো কোনো জবাব দিলো না। আমি পরে ভেবেছি অন্য কেউ হয়তো। কেন ভাবী ওপরে নেই?”
ওয়াহেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছিল তখন। পারিজার কথায় কাল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। পারিজা মোটেও এখানে থাকবে না। তবুও কেন ওয়াহেদ এত সহজে ধৈর্য হারালো? কেন পারিজাকে একটা বার কাছে টেনে নিলো না? পারিজা কত লক্ষী মেয়ে। বোঝালেই বুঝতো! ওয়াহেদ নিজের ভুল খুব সহজেই বুঝতে পারলো। কিন্তু, এখন পারিজাকে কোথায় খুঁজবে সে? পারিজা ছাড়া তাঁর থাকা অসম্ভব! পারিজা কী তবে এবার তাঁকে ফাঁকি দিলো?আর ফিরবে না সে?
চলবে…