#হীরার_নেকলেস (তৃতীয় ও শেষপর্ব)
আমরা বিস্মিত হয়ে গোয়েন্দা গুলজার হোসেনের কথা শুনছি ।
গুলজার আংকেল বললেন, সবার চোখের সামনেই চুরি হওয়া জিনিসগুলো আছে। একে একে আমি সেগুলো বের করে দেব। আর আস্তে ধীরে ব্যাখ্যা করব ঘটনা। প্রথমে মিলির গলার চেইনটা বের করে দাও মেহেদী।
রাহাত ভাই বিস্মিত হয়ে বললেন, মানে কি , মিলি ভাবীর চেইন চুরি হয়নি?
নাহ! মিলির চেইন চুরি হয় নি। ওটা মেহেদীর পকেটেই আছে।
সবার বিস্মিত চোখের সামনে আমি পকেট থেকে মিলির চেইনটা বের করে আবার তার গলায় পরিয়ে দিলাম। মিলি কি অদ্ভুত চোখেই না আমাকে দেখতে লাগল! তখন মিলিকে ডেকে গলায় হাত দিয়ে চেইনটা খুলে নিয়েছিলাম চট করে, মিলি টের পায় নি।
মিলি বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ডাকাত! কেন এটা করলা?
আমি কিছু বলার আগে গুলজার আংকেল বললেন, আমি বলেছি এটা করতে মিলি। সরি, তোমাকে কিছুক্ষণ মানসিক যন্ত্রনা দিয়ে আমরা একটা ফাঁদ পেতেছিলাম। আসলে অনেক কিছু চিন্তা করে মনে হচ্ছিল নেকলেসটা এখানকার কেউই সরিয়েছে। যখন বুঝলাম নেকলেস সরানোর একটা ভালো মাধ্যম হচ্ছে এই ড্রোনটা তখন ড্রোন নিয়ে খোঁজ খবর করে দেখি এই ড্রোনে এক্সট্রা একটা চেম্বার লাগানো হয়েছে। বুঝলাম এখানেই আছে কিছু। কিন্তু কে করল এটা? রেহান, তার বাবা নাকি রাহাত? ভাবলাম একটা ফাঁদ পাতি। যদি আরোও কিছু চুরি গেছে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করা যায় তাহলে চোর নিশ্চিন্ত হবে। সে ভাববে এখান নেকলেস থেকে আলাদাভাবে সবার চোখ অন্যদিকে সরে যাবে। ওই জন্য মেহেদীকে দিয়ে মিলির গলার চেইন খুলিয়েছি। আমি যখন বললাম একটা ক্লিপ্টোম্যানিয়াক আছে আমাদের মধ্যে তারপর মিলি যখন বলেছে তার গলার চেইন চুরি হয়েছে তখন চোর ভেবেছে নেকলেসের উপর থেকে চোখ অন্যদিকে সরানোর এটা একটা ভালো সুযোগ। সেও তখন চিন্তা করে বলেছে তারও একটা জিনিস চুরি হয়েছে। আসলে রাহাতের কোন ঘড়ি চুরি হয় নি। সে বলেছে যাতে সবাই মনে করে এখানে সত্যিই একটা ক্লিপ্টোম্যানিয়াক বা ওই ধরনের চোর ঢুকেছে।
রাহাত ভাই বললেন, ফাজলামি করতেছে গুলজার ভাই । আমার হাতে ঘড়ি কই?
গুলজার আংকেল বললেন, ওইটা তোমার প্যান্টের কোমড়ের দিকের কোনো পকেটে রেখেছ বলে আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে সরানোর সময় পাওনি।
রাহাত ভাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বোঝে গেল সত্যিই তার প্যান্টের কোন গোপন পকেটে ওটা আছে।
জজ রাজ্জাক আংকেল জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু গুলজার নিজেদের নেকলেস নিজেরাই চুরি করবে কেন রাহাত? তাও এতো কিছু করে?
ওইটাই মিলছিল না রাজ্জাক ভাই। পরে বড় কয়েকটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে আছে এমন আমার দু একটা বন্ধুকে ফোন করে জানলাম ওই হীরার নেকলেসে ইন্সুরেন্স করা হয়েছে প্রায় মাস আটেক আগে। ইনস্যুরেন্স ভ্যালুও অনেক বেশি দেড় কোটি টাকা। অর্থাৎ এই নেকলেস চুরি হলে দেড় কোটি পাবে রাহাত। তখন বোঝা গেল রাহাতের এই কাজের পেছনের কারন। আর বার বার পুলিশে খবর দেয়ার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল একই কারনে, ইনস্যুরেন্স ক্লেইম পেতে হলে পুলিশে চুরির জিডি করতেই হবে। আমার ধারনা রাহাত এই ইন্স্যুরেন্স করার সময়ই প্ল্যান করে রেখেছিল এই চুরির প্লট। ড্রোনও সুচিন্তিত ভাবে মডিফাই করে কেনা হয়েছে। আজ রেহানকে ছাদে ড্রোন আনার বুদ্ধি সে দিয়েছে সন্দেহ নাই।
রেহানের মাথা ঝাঁকানো দেখে বোঝা গেল গুলজার আংকেলের অনুমান সত্যি। ওইদিকে রাহাত ভাইয়ের মাথা ঝুঁকে পড়েছে সামনে, বোঝা যাচ্ছে গুলজার আংকেলের পর্যবেক্ষন ক্ষমতার কাছে সে পরাস্ত। কিন্তু যখন শাহনাজ ভাবী এসে বললেন, রাহাত এইগুলো সত্যি?
রাহাত ভাই তখন আবার মাথা নেড়ে বললেন, মিথ্যা কথা! গুলজার ভাই বানিয়ে বলছে এসব
। তবে এবার তার কথায় জোর নেই একদম।
গুলজার আংকেল রিহানকে ডাক দিয়ে বললেন, রিহান বাবা তোমার ড্রোনটা একটু দেখি।
রিহানের ড্রোনটা গুলজার আংকেলের হাতে দিল।
রিহানের বাবা জজ সাহেব তেড়ে এলেন।
–রিহান ! তুই এর সঙ্গে জড়িয়েছিস? ছি ছি…… আমাদের মেরে ফেললি না কেনো এর থেকে?
রিহান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গুলজার আংকেল বললেন, উহু রিহানের কোন দোষ নাই রাজ্জাক ভাই। সে আসলে এর কিছুই জানত না।
রিটায়ার্ড জজ রাজ্জাক সাহেব একটু থমকে গেলেন। গলার স্বর অনেক নীচু, কি বলছ এইসব গুলজার?
আমি ঠিকিই বলছ রাজ্জাক ভাই। এই ড্রোনটা দেখেন, এটা Maveric 2 DJI টাইপ ড্রোন। এই দেখেন এর ছবি।
গুলজার আংকেল তার হাতে থাকা মোবাইলে একটা ড্রোনের ছবি দেখালেন, অনলাইন থেকে নেয়া। বললেন, এটার সাথে এই ড্রোনটা মিলিয়ে দেখেন , মূল ড্রোনে ক্যামেরার উপরে এই রকম কোন কেসিং লাগানো নাই, অথচ দেখেন এই ড্রোনটাতে কেসিং লাগানো। এটা যখন কেনা হয়েছে তখন চীন থেকেই স্পেশালি এই কেসিং টা লাগিয়ে আনা হয়েছে। এবং এই রকম একটা উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয়েছে সন্দেহ নাই।
আংকেল ড্রোনটা হাতে নিয়ে এর ক্যামেরার উপরে থাকা একটা কেসিং খুলে ফেললেন। বললেন, এই চেম্বার বানানোই হয়েছে হীরার নেকলেসটার কথা মাথায় রেখে ।
আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। গুলজার আংকেল কেসিং এর ভিতর থেকে আংগুল বের করে আনলেন। কিছু নেই। ড্রোন কাত করে কেসিং ঝাঁকি দিলেন, ফাঁকা।
ওই কেসিং য়ের ভিতর হীরের নেকলেসটা নেই।
আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই এখন উনি গুলজার আংকেলকে গালাগাল করবেন মিথ্যা অপবাদ দেয়ার জন্য। কিন্তু ঘটনা উলটো ঘটলো।
রাহাত ভাই হতভম্ব হয়ে দৌড়ে এসে ড্রোন উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন। গুলজার আংকেলের দিকে তাকিয়ে ক্রদ্ধ গলায় বললেন, কোথায়? কোথায় রেখেছেন আপনি নেকলেসটা? আপনিই সরিয়েছেন এখান থেকে না?
গুলজার আংকেল হাসলেন। শান্ত হোন রাহাত।
কিসের শান্ত হব? আপনি বিরাট চালাক মানুষ। এইখানে নেকলেস আছে জানার পর নিশ্চয়ই সরিয়ে ফেলেছেন, এখন নতুন গল্প ফাঁদবেন।
গুলজার আংকেল হাসলেন, আমি নেকলেস সরিয়ে কি করব রাহাত? আমার এতো লোভ নেই আপনাদের মতো। এইখানে আপনার মতো আর একজন আছে যে দেখে ফেলেছিল আপনার কান্ড । তারপর সে ড্রোন থেকে চেইন সরিয়ে ফেলে অন্য কোথাও রেখেছে। চোরের উপর বাটপারি। আমি অবশ্য আন্দাজ করতে পারি কোথায় রেখেছে।
কোথায়? কোথায় আমার নেকলেস? এবার শাহনাজ ভাবি চিৎকার করে উঠলেন।
শাহনাজ নেকলেস আপনার সামনেই আছে।
গুলজার আংকেলের কথায় সবাই বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম।
গুলজার আংকেল হেসে শাহনাজ ভাবীর দই মাংসে হাত ডুবালেন। কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটির পর তার মুখে হাসি ফুটল। তিনি হাত উঠালেন।
তাকিয়ে দেখি গুলজার আংকেলের হাতে লেগে থাকা দইয়ের ভিতরে ঝকঝক করছে শাহনাজ ভাবীর হীরার নেকলেসটা। জিনিসটা দেখতে আসলেই সুন্দর।
নেকলেসটা বের হতেই একটা বিস্মিত গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল। রাজ্জাক আংকেল বললেন, এখানে এটা কে রেখেছে গুলজার?
গুলজার আংকেল শাহনাজ ভাবীকে জিজ্ঞেস করলেন, শাহনাজ আপনার এই দই মাংসের ভক্ত জানি কে? কে যেন বলেছে সে পুরাটা বাসায় নিয়ে যেতে চায়?
শাহনাজ ভাবী বড় বড় চোখ করে বললেন, সদরুল ভাই!! তাই তো বলি, কারো পছন্দ হয় নাই তেমন, কিন্তু সদরুল ভাইয়ের এই জিনিস এতো পছন্দ হলো যে আমাকে অনেক রিকোয়েস্ট করে রাজি করিয়েছেন পুরোটা বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সদরুল ভাই এতোক্ষণ চুপ করে ঘামছিলেন, এবার বললেন, পুরা ফালতু বানানো গল্প। কিসের মধ্যে কি! আমি কেনো নেকলেস নিতে যাবো? আমি কি ফকির? দই মাংস ভালো লেগেছে তাই নিতে চেয়েছি , সেটার অর্থ এই না যে আমি নেকলেস ওর মধ্যে রেখেছি। ফালতু যত্তসব।
গুলজার আংকেল আবার হাসলেন, সদরুল হাত সাফাই কাজে আপনি যত দক্ষ তাকে এই কাজ আপনার ছাড়া কারো না। রাহাত যখন শাহনাজের ব্যাগ থেকে নেকলেস নিয়ে ড্রোনের মধ্যে লুকিয়েছে সেটা আপনি নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছিলেন কোন ভাবে। তারপর নেকলেসটা এক ফাঁকে সরিয়ে দইয়ের মধ্যে ডুবিয়েছেন। জানতেন এই নেকলেস নিয়ে একটা হৈ চৈ হতে পারে এখানে। মুষ্কিল হচ্ছে আপনি টেকনলজির ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন না। আমার অনুমান রাহাত যখন নেকলেস ড্রোনে রেখেছে সে ড্রোনের ক্যামেরা অফ করে নিয়েছিল। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই সেটা করেন নি, কারন কন্ট্রোল রিহানের হাতে ছিল, হয়ত কোন এক ফাঁকে ড্রোন দেখার নাম করে সরিয়েছেন , ক্যামেরায় সব রেকর্ডিং হচ্ছে টের পান নি। এই ড্রোনের রেকর্ডিং দেখলেই দেখা যাবে আপনি সরাচ্ছেন নেকলেসটা।
সদরুল ভাই নিশ্চুপ হয়ে মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ওসি রাকিব এগিয়ে এসে মাথা চুলকে বলল, এখন আমার করণীয় কি স্যার? সদরুল সাহেবের বিরুদ্ধে কি কেউ অভিযোগ করবেন?
আমি ভাবলাম , কে অভিযোগ করবে? রাহাত ভাই নিজেই কেলেংকারির সাথে জড়িত। অভিযোগ করলে সেও ঝামেলায় পড়বে।
গুলজার আংকেল কিছু বলার আগেই আমাদের বিল্ডিং কমিটির সম্পাদক রাশেদ ভাই বললেন, যেহেতু নেকলেসটা পাওয়া গেছে সেখানেতো আর পুলিশের কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। রাহাত শাহনাজ আপনারা অভিযোগ করতে চান?
দুইজনই মাথা নীচু করে না করে দিলেন।
ওসি বললেন, স্যার তাহলে আমরা যাই। আপনার আরোও একটা ম্যাজিক দেখলাম আজ। আপনি আমাদের গর্ব।
গুলজার আংকেল মাথা নাড়লেন। ওসি তার দলবল নিয়ে চলে গেল।
রাতে মিলি এসে ঠাট্টা করে বলল, তুমি তো খুবই ডেঞ্জারাস ধরনের লোক ময়না পাখি, অন্য লোকের কথায় বউয়ের গলার চেইন চুরি কর! তোমাকে তো আর বিশ্বাস করা যায় না।
আমি বললাম, যেখানে তোমার মন চুরি করেছি সেখানে সামান্য চেইন বাকি থাকবে কেন!!
মিলি হেসে ফেলল।
(শেষ, গোয়েন্দা গুলজার হোসেনের বই বের হয়েছে। নাম, গেস্ট হাউজের খুনি, রকমারি থেকে সংগ্রহ করতে পারেন, ধন্যবাদ।)
লেখক খোন্দকার মেহেদী হাসান
©Khondokar Mahedi Hasan