হীরার নেকলেস পর্ব ১

0
833

আমাদের বিল্ডিংয়ের ছাদে অনুষ্ঠান চলছে। ঈদের পরের রাত। ছাদে বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে আসা প্রতিবেশীরা । মৃদু লয়ে গান বাজছে, সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো। এরমধ্যে কেউ তীক্ষ্ণ কন্ঠে চিৎকার করল,
আরে আমার নেকলেস কই? আমার হীরার নেকলেস।
আমি ছাদের কোনার দিকে একটু অন্ধকার জায়গায় বসে ছিলাম । হৈচৈ শুনে উঠে গিয়ে দেখি চার তলার শাহনাজ ভাবি চিৎকার করছেন। চোখে মুখে আতংক। শুনলাম তার হীরার নেকলেস চুরি হয়েছে। আজ অনুষ্ঠানে ভাবি একটা চমৎকার নেকলেস গলায় পরে এসেছিলেন। অনেক দামী। তাহলে কি সেটাই চুরি হলো? ভাবি নাকি নেকলেসটা গলা থেকে খুলে হাত ব্যাগে রেখেছিলেন সেখান থেকে কেউ চুরি করেছে, হাত ব্যাগে নেই ওটা। মারাত্মক ব্যাপার । যতদূর শুনেছি হীরার নেকলেসটার দাম কয়েক কোটি টাকা। কিন্তু কে চুরি করবে এখানে, সবাই তো আমাদের প্রতিবেশী, একই বিল্ডিঙয়ের লোকজন।

ঘটনাটা একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। আজ আমাদের ছাদে ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বিল্ডিং কমিটি ঈদের পরদিন গেট টুগেদার করতে সবাইকে দাওয়াত করেছিল। শর্ত- বাসা থেকে কোরবানীর মাংসের একটা পদ রান্না করে নিয়ে আসতে হবে। আমার স্ত্রী মিলি সকাল থেকেই ব্যস্ত এই নিয়ে । সে করেছে গরুর মাংসের কালাভুনা। বেচারি সারাদিন অনেক খেটে খুটে এখানে কালা ভুনা নিয়ে এসে হতভম্ভ হয়ে গেছে। অন্যান্য ভাবিরা এমন সব নতুন নতুন আইটেম করেছে যে চমকে যেতে হয়। শাহনাজ ভাবি করেছেন দই মাংস। ঝোলের বদলে দইয়ের ভিতর খাসির মাংস রান্না। এতো দই দিয়েছেন যে তার মধ্যে মাংসগুলো ডুবে আছে, খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। আমি একবার মুখে দিয়ে দেখেছি, খুব সুবিধার মনে হয় নি। তবুও নতুন ধরনের আইটেম বলে সবাই খুব প্রশংসা করছে। তিনতলার রিনা ভাবি এনেছেন লেবু দিয়ে গরুর মাংস রান্না। সেখানে আস্ত লেবু কেটে দুই টুকরো করে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাদ মোটামুটি। ছয়তলার রেহানা ভাবি এনেছেন মাংসের কিমার সাথে রসুন রান্না। এইটা বেশ উপদেয় হয়েছে। সবাই প্রশংসা করছে। আমিও খেয়ে দেখলাম বেশ ভালো স্বাদ হয়েছে। অন্যান্য ভাবিরাও নতুন ধরনের সব রান্না নিয়ে এসেছেন, হাসিমুখে নিজের রান্নার প্রচারনা চলছে। শুধু মিলি মন খারাপ করে তার রান্নার কাছে দাড়ানো, গরুর কালাভুনা নতুন কিছু না। এইটার রান্না পদ্ধতি ব্যখ্যা করার কিছু নেই।

বাচ্চারা ছাদের এক দিকে খেলছে। অনেকে নিজেদের খেলনা নিয়ে এসেছে। দোতলার রাজ্জাক আংকেলের ছেলে রিহান একটা ড্রোন উড়াচ্ছে। সব বাচ্চাদের এখন সেদিকে মনোযোগ। ম্যাভারিক ড্রোন। ব্যাটারি অনেক শক্তিশালী নিশ্চয়ই। অনেকক্ষণ ধরে রিহান সেটা উড়াচ্ছে, একবার ড্রোন বিল্ডিঙয়ের বাইরে দিয়ে উড়ে এর চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনও নীচু হচ্ছে বিল্ডিঙয়ের ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে আবার কখনও অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে। ড্রোন চোখের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেই বাচ্চারা হৈ হৈ করে উঠছে। রিহান এবার এইচ এসসি দেবে সেন্ট জোযেফ থেকে। এখানে বাচ্চাদের মধ্যমণি হয়ে আছে সে।

শাহনাজ ভাবি নেকলেস চুরি হয়েছে বলে চিৎকার করে ওঠার পর পরই পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। মিউজিক থেমে গেল। একজন গিয়ে ছাদের সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলো। যাতে ছাদ থেকে কেউ নীচে নেমে যেতে না পারে। এতোক্ষণ পিবিআইয়ের রিটায়ার্ড ডি আইজি গুলজার হোসেন ছাদের একপাশে তিনতলার রাশেদ ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলেন। সম্ভবত তার নির্দেশেই কেউ ছাদের গেট বন্ধ করে দিয়েছে। গুলজার আংকেল আজ ছাদে আসতে চান নি। তার স্ত্রী বাসায় নেই, বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। ছাদের এই ওয়ান ডিশ পার্টিতে গুলজার আংকেল কিছু আনতে পারেন নি। কিন্তু বিল্ডিং কমিটির সম্পাদক রাশেদ ভাইয়ের অনেক রিকোয়েস্টে এসেছেন। মিলির জন্য অবশ্য ভালোই হয়েছে। গুলজার আংকেল মিলিকে খুবই পছন্দ করেন। এখানে এসে মনোযোগ দিয়ে মিলির কালাভুনা বানানোর রেসিপি শুনেছেন এরপর খেয়ে প্রশংসা করেছেন। মিলির মুখে হাসি ফুটিয়েছেন বলা যায়। তবে তার কালাভুনা রান্নার কদর হচ্ছে না তেমন। রান্নার অর্ধেকের বেশী এখনো রয়ে গেছে, মনে হচ্ছে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এই অর্ধেকটা।

এই মুহুর্তে ছাদের সবাই খাবার রাখার টেবিল ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু শাহনাজ ভাবি একটা চেয়ারের উপর বসা। তাকে খুব অস্থির লাগছে। রাজ্জাক আংকেলের বউ শিল্পী আন্টি তাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শাহনাজ ভাবির হাজবেন্ড রাহাত ভাই গম্ভীর মুখে দাঁড়ানো। ভদ্রলোক ছোটখাট শিল্পপতি। নিজের দুইটা বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে। তার কাছ থেকে হীরার নেকলেস নিয়ে ডিটেইলস জানা গেল।

নেকলেসটা ভদ্রলোক কিনেছেন ইটালি থেকে। তাদের বিয়ের এক যুগ পুর্তিতে উপহার দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। অপূর্ব কারুকাজ করা নেকলেসে মোট তিনটা হীরা বসানো। মাঝখানের হীরাটা বেশ বড়। বাংলাদেশি টাকায় ট্যাক্স দিয়ে প্রায় সোয়া কোটি টাকা দাম পড়েছে নেকলেসের। এতো দামী একটা নেকলেস হারিয়ে শাহনাজ ভাবি মুষড়ে পড়বেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কি হলো নেকলেসটার? চুরি? কে চুরি করবে এই বাসার ছাদ থেকে। এই পার্টি একদম ঘরোয়া। এখানে কোন কাজের লোক পর্যন্ত নেই। শুধুই বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারা। তাহলে এখান থেকে নেকলেস চুরি হবে কেন?

গুলজার আংকেলকে দেখলাম কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সবাইকে বলছেন একটু ধৈর্য ধরতে আর ছাদ ছেড়ে কোথাও না যেতে। মিলি তার কালা ভুনা ফেলে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে মুখে এখন অস্থিরতা। গুলজার আংকেল শাহনাজ ভাবিকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন,
শাহনাজ আপনি তো গলায় পরেছিলেন নেকলেসটা, কখন খুলে ব্যাগে রাখলেন?
–ঘন্টা খানেক আগে , নেকলেসটার জন্য গলা চুলকাচ্ছিলো অনেক। আমার এলার্জির সমস্যা আছে। সহ্য করতে না পেরে খুলে ব্যাগে রেখেছিলাম। ভেবেছি এখানে কি আর হবে?
–কখন দেখলেন নাই ব্যাগে?
–এইতো একটু আগে। ভাই আপনি অনেক বড় গোয়েন্দা ছিলেন শুনেছি, আমার নেকলেসটা বের করে দেন প্লিজ। আমি না হলে মরে যাবো।
গুলজার আংকেল বললেন, শান্ত হোন শাহনাজ। আমি চেস্টা করছি। আপনি এর মধ্যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন?

হু গিয়েছি, দুইবার। আমার ডায়াবেটিস আছে। এই ছাদের ওয়াশরুমই ব্যবহার করেছি, তখনও ব্যাগ আমার সাথেই ছিল।

গুলজার আংকেল একটু গলা চড়িয়ে সবাইকে বললেন, দেখুন যদি আপনাদের সম্মতি থাকে আমি সবার সাথেই আলাদাভাবে একটু কথা বলতে চাই। নেকলেসটার কি হয়েছে সেটা জানা দরকার, কারণ পুলিশ এসে গেলে সবাই বিব্রত হবেন ।

সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল।

ছাদে আমরা সব মিলিয়ে মানুষ আছি আঠারোজন। শিশু পাঁচ জন, রিহান সহ। গুলজার আংকেল একা এসেছেন আর বাকি আমরা ছয় জোড়া দম্পতি। আমি সবার দিকে একবার তাকালাম। এই আমরাই সাসপেক্ট এখন। কাছাকাছি কিন্তু একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে সবাই। বাড়ির মালিক সমিতির সম্পাদক রাশেদ ভাই তার স্ত্রী রেনু আপার সাথে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় কথা বলছেন। রাশেদ ভাই আসলে গুলজার আংকেলের বয়সী, বায়ান্ন থেকে পঞ্চান্ন। আমি কিছুদিন আংকেল বলাতে তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘এই যে মেহেদি শোনেন, আপনি বিয়ে করেছেন, বয়স কিন্তু কম হয়নি আপনার। আমাকে আংকেল ডেকে বুড়া প্রমাণ করার চেস্টা করে লাভ নাই। আমি এখনও ইয়াং আছি।‘ এরপর থেকে আমি লজ্জায় তাকে ভাই বলি, উনিও খুশি হন খুব। ভাই বলে যদি কাউকে খুশি রাখা যায় অসুবিধা কি? ভদ্রলোকের নানা ধরনের পৈত্রিক ব্যবসা আছে, সেগুলোতে অবশ্য খুব একটা সময় দেন বলে মনে হয় না, কিন্তু তার টাকার অভাব নেই। ব্যবসা অন্যান্য ভাইরা দেখে। এই বিল্ডিংয়ে উনি সম্পাদক হবার পর সবার সঙ্গে খুব খাতির রেখে চলেন, কারও দরকার হলেই হাজির হয়ে যান। প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন থাকায় অনেক কাজ দ্রুত করিয়ে দেন।
রাজ্জাক আংকেল দাঁড়িয়ে আছেন তার ছেলে রিহানের সাথে। রাজ্জাক আংকেল রিটায়ার্ড জজ। চাল চলনে আভিজাত্যের ছাপ। এখন তাকে একটু বিভ্রান্ত লাগছে। রিহানের হাতে তার ম্যাভারিক ড্রোন। শিল্পী আন্টি শাহনাজ ভাবির কাছে দাঁড়ানো। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

তিনতলার রিনা ভাবি তার স্বামী সদরুল ভাইয়ের সাথে দাঁড়ানো। ভাবির কোলে তার পাঁচ বছরের ছেলে রাইয়ান। সদরুল ভাই একটু অদ্ভুত ধরনের মানুষ। ফ্রী ল্যান্সিং কাজ করে বেড়ান। দারুন হাত সাফাইয়ের জাদু দেখাতে পারেন। একবার আমার চোখের সামনেই একটা আস্ত ডিম হাতের ভিতর থেকে উধাও করে দিয়ে আমাকে বেকুব বানিয়ে দিয়েছিলেন। উনাদের ফ্ল্যাটটা রিনা ভাবির নামে তার বাবা কিনে দিয়েছেন।

এরপর একটু দূরে দাড়ানো রেহানা ভাবি আর কামাল ভাই। তাদের চারবছরের দুই জমজ মেয়ে জারা আর নারা বাবা মায়ের কোলে উঠে বসে আছে। ভাই আর ভাবি দুইজনই চাকরি করেন ব্যাংকে। তারা আমার মতোই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে। এই মুহুর্তে দুইজনকেই দেখলাম উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমি মিলির দিকে তাকালাম। সে বেশ নার্ভাস ভঙ্গীতে আমার গাঁ ঘেষে দাঁড়ানো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গুলজার আংকেল কি বলছে?

— আংকেল বলেছে আমাদের মধ্যেই কেউ হীরার নেকলেসটা সরিয়েছে। একটু সময় দিলে উনি বের করে ফেলবেন কে সরিয়েছে আর কিভাবে সরিয়েছে।

মিলিকে একটু নার্ভাস লাগল। সে তার মুখের ঘাম মুছে বলল, কি বলো! আশ্চর্য! গুলজার আংকেল কি শিওর? আমাদের মধ্যে থেকেই একজন হীরার নেকলেস চুরি করেছে ? কে সে ?

#হীরার_নেকলেস প্রথমপর্ব
লেখক খোন্দকার মেহেদী হাসান
©Khondokar Mahedi Hasan

( গুলজার হোসেনের থ্রিলার গল্পের বই বের হয়েছে এই বই মেলায়। গেস্ট হাউজের খুনি বইটা রকমারি থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here