#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃতানিশা_আহিয়াদ_তিশা
#পর্বঃ30
“সমস্ত নিউজ চ্যানেলে একটাই নিউজ দেখাচ্ছিলো। বিজনেস ম্যান আজম রহমানের ভাতিজা অভি রহমানকে কেউ শুট করে রাস্তার মাঝখানে ফেলে গেছে। কিছুক্ষন আগেই পুলিশ ওনার রক্তাক্ত দেহটা একটা শূনশান রাস্তা থেকে উদ্ধার করেছে। এটা দেখার পর আহির আর আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের মাথা কেমন খালি খালি লাগছিলো। এটা ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম যে এখন আমরা মেঘের কাছে থাকবো নাকি অভি ভাইয়ার কাছে যাবো! অনেক ভেবে চিন্তে আহির হসপিটাল থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে অভি ভাইয়ার কাছে চলে গেলো। আর আমি মেঘের অপারেশন শেষ হওয়া অবদি ওর জন্যে ওখানেই বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশেরা অভি ভাইয়াকে নিয়ে ওই হসপিটালে চলে আসলো।ওনাদের সাথে আহিরও আসলো। অভি ভাইয়াকে ইমাজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা আবারও অসহায়ের মতো বসে একটু আশার আলোর অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু কথায় আছে না, বিপদ যখন হয়, তখন সব বিপদ এক সাথেই হয়। আমাদের অবস্থাটা সেদিন এই প্রবাদ বাক্যটার সাথে মিলে গিয়েছিলো।”
কথাটা বলে মিহির শুকনো হাসলো। A.k. স্তব্দ হয়ে বসে আছে। A.k. এর চোখের কোনে পানি জমেছে। মিহির মাথা উঠিয়ে A.k. এর দিকে তাকালো। কিন্তু লম্বা চুলগুলো কপালের উপড়ে পড়ে থাকায় A.k. এর চোখের পানিটা মিহির দেখতে পেলো না। পাশ থেকে A.k. এর অ্যাসিটেন্ট কিছুটা ইতস্তত করে মিহিরকে উদ্দ্যেশ্য করে প্রশ্ন করলো
“তারপর কি হয়েছিলো?”
ওনার প্রশ্ন শুনে মিহির আবারও নিজের দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ করলো। তারপর বললো
“টিভিতে অভি ভাইয়ার এমন অবস্থা দেখে দিশা, বাবা, বড় চাচ্চু, মেজ চাচ্চু, কাকি মনি ওনারা সবাই বাসা থেকে দ্রুত হসপিটালে চলে এসেছিলেন। তবে কাকি মনির অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। উনি নিউজে অভি ভাইয়াকে দেখার সাথে সাথে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন। হসপিটালে আসার পর ওনাকেও ওখানে ভর্তি করা হয়। দিশাও অনেকটা ভেঙে পড়েছিলো। তবে বাবা ওকে কোনোরকম বুঝিয়ে সুঝিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বাবা যখন মেঘের ব্যাপারটা জানতে পারেন, তখন অতিরিক্ত প্যানিক করতে করতে ওনারও হার্ট অ্যাটাক হয়। উনি পায়চারি করা অবস্থায় হঠাৎ করে বুক চেপে ধরে হসপিটালের কড়িডোরেই পড়ে যান। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মাও ওখানে এসে পৌছান। ফ্লোরে পড়ে বাবাকে ছটফট করতে দেখে পুরনো সবকিছু ভুলে গিয়ে মা সেদিন বাবার কাছে ছুটে এসেছিলেন। যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রেখে নিজের হাতে বাবার অপারেশন করেছিলেন। আমি আর আহির একদম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। চারপাশ থেকে আমাদের কানে শুধুমাত্র আপন জনদের কান্নার ধ্বনি ভেষে আসছিলো। চোখ মেলে যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম সেদিকে শুধু বিধ্বস্ত কিছু মানুষদের দেখতে পাচ্ছিলাম। যারা আল্লাহর কাছে নিজেদের কাছের মানুষ গুলোর প্রান ভিক্ষা চাইছিলেন। তবে হ্যা, এতোগুলো খারাপের মধ্যে একটা জিনিস ভালো হয়েছে।সেটা হলো, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের ভাঙা পরিবারটা আবার আগের মতো জোড়া লেগেছে।”
শেষ কথাটুকু বলে একটা প্রশান্তির হাসি দিলো মিহির। A.k. এর অ্যাসিটেন্ট কৌতূহল নিয়ে আবারও মিহিরকে উদ্দ্যেশ্য করে প্রশ্ন করলো
“আচ্ছা মিঃ অভিকে কারা শুট করেছিলো সেটা জানতে পেরেছিলেন?”
মিহির বললো
“না, ওসব জানার সময়ই হয়ে উঠেনি। বাবা, মেঘ, অভি ব্রো, ওদের অপারেশন সাকসেস ফুল হলেও ওরা বেশ অনেক দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলো। তাই ওদের পুরোপুরি সুস্থ করার চেষ্টা করতে করতে ওসব আমাদের মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া পুরনো কাসুন্দি ঘেটে আর নিজেদের লাইফে কোনো প্রভলেম ক্রিয়েট করতে চাইনি। তাই ওসব নিয়ে আর মাথাও ঘামাই নি।”
মিহিরের কথা শুনে লোকটা ছোট করে বললো
“ওহ আচ্ছা!”
কথাটা বলে লোকটা কিছুক্ষন চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর ভ্রু কুচকে বললো
“আচ্ছা আহান খানের কি হয়েছিলো? উনি কি তারপর আর ফিরে আসেন নি? কোথায় আছেন এখন উনি?”
“জানি না! সেদিনের পর থেকে আহান খান নামটা আমাদের লাইফ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। কতো খুজেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। এখন সে কোথায় আছে, কিভাবে আছে, কেমন আছে সে বিষয়ে আমরা কিচ্ছু জানিনা।”
A.k. এতোক্ষন চুপচাপ বসে মিহিরের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। এইবার উনি বসা থেকে দাড়িয়ে ব্যাস্ত কন্ঠে মিহিরকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন
“ওকে মিঃ মিহির, আমরা তাহলে এখন আসি। অনেকটা রাত হয়ে গেছে, এখন আমাকে বাড়িতে ফিরে একটু রেষ্ট নিতে হবে। কালকে সকাল, সকাল আমার আবার ইম্পরটেন্ট কিছু মিটিং আছে। সকালে উঠেই সেগুলো আমাকে এ্যাটেন্ড করতে হবে।”
A.k. এর কথা শুনে মিহির বসা থেকে দাড়িয়ে ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বললো
“থ্যাংক্স মিঃ A.k.। আজকে আপনার জন্যেই মেঘ এতো বড় একটা বিপদের হাত থেকে বেচে গেলো। এরজন্যে আমরা সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।”
A.k. মিহিরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো
“আমাকে থ্যাংক্স না দিয়ে আপনারা আপনাদের বোনের ভালোভাবে একটু খেয়াল রাখুন। কারন ওনাকে হেল্প করার জন্যে তো আর সব সময় আমি ওনার কাছাকাছি থাকবো না, তাইনা? এইবার নাহয় আমি বাচিয়ে নিলাম। এর পরের বার এমন কোনো বিপদে পড়লে তখন কে বাচাবে ওনাকে?”
A.k. এর কথা শুনে মিহিরের মুখটা চুপসে গেলো। মিহির বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে মেঘের প্রতি ওদের এতোটা কেয়ারলেস হলে চলবে না। কারন এই দুই বছরে বিজনেসে ওদের অনেক শএু হয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে ওদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। তাই এখন থেকে মেঘের প্রতি ওদের বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে। নাহলে আজকের মতো আবার একটা অঘটন ঘটে যাবে। মিহিরকে চুপ করে কিছু একটা ভাবতে দেখে A.k. আর কথা না বাড়িয়ে ওনার অ্যাসিটেন্ট নিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো।
A.k. চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর মিহির বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলো যে আজকে ওরা কেউই বাড়িতে ফিরবে না। একটা ইম্পরটেন্ট কাজের জন্যে ওরা শহরের বাইরে এসেছে। এটা বলে মিহির ফোন রেখে দিলো। মিহির কাউকে টেনশনে ফেলতে চায় না বলে মেঘের সাথে হওয়া অ্যাক্সিডেন্টটার ব্যাপারে বাড়ির কাউকে কিছুই জানালো না।
তখন রাস্তা থেকে A.k. মেঘকে এখানে নিয়ে এসে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েছে। তারপর আহির আর মিহিরকে ফোন করে সবটা বলে এখানে আসতে বলেছে। A.k. এর সাথে কথা বলে ওরা গাড়ি নিয়ে দ্রুত হসপিটালে চলে এসেছে। এখানে আসার পর জানতে পেরেছে, অতিরিক্ত ভয়ে মেঘের প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে, আর দৌড়ানোর ফলে পায়ে সামান্য একটু আঘাত লেগেছে। এছাড়া আর তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি।
_________________________
একটা গোডাউনের মধ্যে হাত- পা বাধা অবস্থায় চেয়ারের উপরে বসে আছে 29/30 বছরের একটা ছেলে। ছেলেটার সামনের টেবিলের উপর নীল রঙের একটা ব্যাগ রাখা। যেই ব্যাগটার মধ্যে কতোগুলো টাকার বান্ডিল রাখা। আর সেই টাকার বান্ডিল গুলোর দিকে ছেলেটা লোভি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার মুখোমুখি বিপরীত পাশে বসে আছে হুডি পড়া একটা লোক। লোকটার দুই পাশে দাড়িয়ে আছে দুজন গার্ড। হুডি পড়া লোকটা সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে স্বাভাবিক কন্ঠে সামনে থাকা ছেলেটাকে উদ্দ্যেশ্য করে প্রশ্ন করলো
“তোমার নামটা যেনো কি?”
ছেলেটা টাকার দিক থেকে চোখ সরিয়ে হুডি পড়া লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো
“হামিদ!”
“নাইস নেইম! আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলো তো, তোমরা মেয়েটাকে তাড়া কেনো করছিলে? কি উদ্দ্যেশ্য ছিলো তোমাদের?”
হুডি পড়া লোকটার কথা শুনে হামিদ ভ্রু কুটি করে বললো
“সেটা আপনাকে কেনো বলবো? কে আপনি? আর আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে এসেছেনই বা কেনো?”
হুডি পড়া লোকটা বসা থেকে দাড়িয়ে ধীর পায়ে হামিদের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতের বাধন খুলতে খুলতে বললো
“আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি শুধু আমাকে এটা বলো যে ওই মেয়েটাকে তাড়া করার জন্যে তোমাদের কে হায়ার করেছিলো?”
হামিদ ত্যাড়ামো করে বললো
“সেটা আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই।”
হুডি পড়া ছেলেটা হামিদের এক হাতের বাধন খুলে অন্য হাতের বাধন খুলতে খুলতে বললো
“হ্যা তুমি আমাকে এই কথাটা বলতে বাধ্য নও ঠিকই। কিন্তু তুমি যদি সত্যিই আমাকে এই ইনফরমেশন টা দেও, তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো। সাথে এই ব্যাগ ভর্তি টাকা গুলোও তোমাকে দিয়ে দিবো। এখানে পুরো দশ লাখ টাকা আছে। যদি তুমি আমাকে সমস্ত সত্যি কথা বলে দেও তাহলে এই সব টাকা তোমার।”
কথাটা বলতে বলতে হুডি পড়া লোকটা হামিদের অন্য হাতের বাধনও খুলে দিলো। লোকটার কথা শুনে হামিদের চোখ মুখ মুহূর্তের মধ্যে চকচক করে উঠলো। সে ঝট করে বসা থেকে দাড়িয়ে টেবিলের উপর থাকা ব্যাগটা হাতে তুলে নিলো। তারপর টাকা গুলো হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বললো
“আপনাকে সত্যিটা বলে দিলে আপনি যে এই টাকা গুলো আমাকে দিয়ে দিবেন, তার গ্যারান্টি কি? এমনও তো হতে পারে সত্যিটা বলার পরেও আপনি আমাকে এখানে আটকে রাখলেন। তারপর আমাকে এখানেই মেরে ফেললেন।”
হামিদের কথা শুনে হুডি পড়া লোকটা হো হো করে হেসে দিলো। তারপর এগিয়ে এসে হামিদের কাধে এক হাত রেখে হাসতে হাসতে বললো
“কামঅন ডুড, তোমাকে মেরে আমার লাভ কি? আমি তো তোমাদের বসকে খুজছি। তাকে পেলেই আমার কাজ হয়ে যাবে। তোমাকে আটকে রেখে আমি কি করবো?”
হুডি পড়া লোকটার কথাটা হামিদের কেনো যেনো বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। তাই ‘ও’ টাকার ব্যাগের চেইন টা আটকে হুডি পড়া লোকটার মুখোমুখি দাড়িয়ে বলা শুরু করলো
“গতকাল রাতে আমাদের আড্ডায় সুন্দরী একটা মেয়ে এসেছিলো। মেয়েটা আমাদের টাকার একটা ব্যাগ আর মেঘনা ম্যাডামের ফটো দিয়েছিলো। তারসাথে মেঘনা ম্যাডামের সব ডিটেলসও দিয়েছিলো। বলেছিলো, আজকে রাতের মধ্যে মেঘনা ম্যাডামকে গ্যাং রেপ করে খুন করে ফেলতে।তাই আমরা ওনার কথা মতোই প্রথমে মেঘনা ম্যাডামের গাড়ির চাকায় পেরেক ঢুকিয়ে, চাকার হওয়া বের করে দিয়েছিলাম। তারপর উনি যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই বাইক নিয়ে মেঘনা ম্যাডামের উপর অ্যাটাক করে ছিলাম।”
হামিদের কথা শুনে হুডি পড়া লোকটা চোখ জোড়া কিছুক্ষন বন্ধ করে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগলো। তারপর যথা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। তারপর ফোনের গ্যালারি ঘেটে একটা পিক বের করে হামিদের সামনে ধরে বললো
“দেখো তো, এটা সেই মেয়ে কিনা?”
হামিদ পিকটার দিকে তাকিয়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। তারপর অবাক করা কন্ঠে বললো
“হ্যা, ইনিই তো সেই মেয়েটা। কালকে যখন ইনি আমার হাতে টাকার ব্যাগটা দিচ্ছিলেন, তখন আমি স্পষ্ট এনার চেহারা দেখেছি। কিন্তু এর ফটো আপনার কাছে কিভাবে আসলো?”
লোকটা ফোনটা অফ করে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বললো
“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি এখন এখান থেকে আসতে পারো।”
লোকটার কথা শুনে হামিদ আর বেশি কিছু না বলে টাকাগুলো নিয়ে চলে গেলো। হামিদ চলে যেতেই হুডি পড়া লোকটা চেয়ারের উপর একটা লাথি মেরে চিল্লিয়ে বললো
“ইউ ব্লাডি বিচ! তোদের একটাকেও ছাড়বো না আমি। আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস না তোরা? তোদের কলিজা ছিড়ে আমি জংলি কুকুরকে খাওয়াবো।”
কথাটা বলে লোকটা গোডাউন থেকে বের হয়ে যেতে যেতে নিজের গার্ডদের উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“ওই হামিদ নামের ছেলেটাকে চব্বিশ ঘন্টা নজরে, নজরে রাখবে। ওকে এক সেকেন্ডর জন্যেও চোখের আড়াল করবে না। ‘ও’ কোথায় যায়, কার সাথে দেখা করে, কি করে সেই সব ইনফরমেশন আমার চাই।কারন এখন ওই হলো আমার একমাএ ট্রাম্প কার্ড।”
#চলবে