#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃতানিশা_আহিয়াদ_তিশা
#পর্বঃ21
আহান বুকে দু-হাত গুজে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বিরক্তি মুখ করে দাড়িয়ে আছে। ওর সামনে অভি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই কখন থেকে নিজের নাকের ডগা ঘশে যাচ্ছে। মেঘের ঘুসি খেয়ে বেচারার নাকের ডগা একদম পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে মেঘ আর দিশা গালে হাত দিয়ে রাস্তার উপরে বসে আছে। দুজনের রিয়্যাকশন দেখে মনে হচ্ছে কেউ একটু আগে ওদের কারেন্টের তাড়ের সাথে বেধে ঘন্টা খানের শডক দিয়ে এখানে এনে বসিয়ে দিয়ে গেছে। সেই যখন থেকে ওরা দুজন সমস্ত সত্যিটা জেনেছে তখন থেকে এইভাবে রাস্তার উপরে বসে গালে হাত দিয়ে কি যেনো একটা ভেবে যাচ্ছে। ওদের এই অদ্ভুত কাহিনি দেখতে দেখতে আহানের বিরক্তিতে রীতিমতো মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। ‘ও’ মুখ থেকে একটা বিরক্তি সূচক ‘চ’ শব্দ উচ্চারন করে অভির দিকে তাকিয়ে বললো
“আজকে সারা দিন কি এখানেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাটানোর প্লান করেছিস নাকি? করে থাকলে বল, আমি চলে যাচ্ছি। কারন এভাবে রাস্তায় দাড়িয়ে হওয়া খাওয়ার কোনো শখ বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই।”
আহানের কথা শুনে অভি কপাল কুচকে বললো
“আজব, আমি কি করেছি? আমাকে বলছিস কেনো?”
আহান বিরক্তির স্বরে বললো
“তোহ, কাকে বলবো?”
অভি পাশে তাকিয়ে মেঘ আর দিশাকে দেখিয়ে বললো
“ওদেরকে বল। দেখছিস না, দুজন দিন-দুনিয়া ভুলে গিয়ে রাস্তার মাঝে ধ্যান করতে বসেছে।”
আহান ঘাড় কাৎ করে দিশা আর মেঘের দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক ভঙ্গিতে বললো
“এইযে ম্যাডাম’রা আপনাদের দুজনের ধ্যান করা শেষ হয়েছে? শেষ হলে বলুন, আমাদের ফিরতে হবে। আর না হলে আপনারা এখানে বসে ধ্যান, জ্ঞান যা খুশী করুন, আমি বাড়িতে চলে যাচ্ছি। কারন আমার পক্ষে এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আপনাদের নাটক দেখা একে বারেই সম্ভব হচ্ছে না।”
আহানের কথা শুনে মেঘ নিজের গাল থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। তারপর আহানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে চোখ জোড়া ছোট ছোট করে বলে উঠলো
“আচ্ছা আপনারা সবাই এখানে কিভাবে আসলেন? আপনারা কি আগে থেকেই জানতেন যে আবীর আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? যদি জানতেনই তাহলে আসতে এতো দেড়ি করলেন কেনো?”
মেঘের এমন বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে আহানের বিরক্তির মাএা আরো বেড়ে গেলো। ‘ও’ মেঘের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
“হ্যা, জানবো না কেনো? অবশ্যই জানতাম। আবীর তো আমাদের সাথে প্লান করেই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো। আর আগে আসিনি কারন আবীরকে তোমার সাথে রোমান্স করার জন্যে সময় দিচ্ছিলাম। ভেবে ছিলাম তোমাদের রোমান্স করা শেষ হলে তারপর আমরা আসবো।”
কথাটা বলে আহান হনহন করে হেটে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো । তারপর গাড়ি স্টার্ড দিয়ে উচু স্বরে অভিকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“অভি আমি চলে যাচ্ছি। আমার ইম্পরটেন্ট কিছু কাজ আছে। এখন তোরা এখানে বসে বসে যা খুশী করতে পারিস।”
কথাটা বলে আহান আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে ওখান থেকে চলে গেলো। আহান যেতেই মেঘ মুখ বাকিয়ে বললো
“যাহ বাবা, কি এমন বললাম যার জন্যে রেগে একদম বোম হয়ে গেলো? কোনো ডাউট থাকলে ক্লিয়ার করবো না নাকি?”
অভি ফোশ করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো
“ডাউট ক্লিয়ার করার জন্যে এমন উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করলে রেগে তো যাওয়ারই কথা।”
“এখানে উল্টাপাল্টা প্রশ্নের কি আছে? আমাকে জানতে হবে না যে তোরা এখানে কিভাবে আসলি? আর আসলিই যখন এতো দেড়ি করে কেনো আসলি?”
মেঘের কথা শেষ হতেই অভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলো
“তুই আবীরের সাথে চলে আসার পর আহান দিশাকে নিয়ে তোদের গাড়ির পিছু করা শুরু করে। ড্রাইভিং করতে করতে ‘ও’ আমাকে কল করে সবটা জানায়। আমি তখন অফিসে ছিলাম। আহানের কাছ থেকে সবটা শুনে তখনই আমি অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাই। ভেবেছিলাম দিশাকে অপমান করার শাস্তি হিসেবে আবীরকে হালকা করে একটু টাইট দিবো। তাই গাড়ি নিয়ে আহানের বলা লোকেশনে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মাঝ রাস্তায় আসতেই আহান আমাকে আবার কল দেয়। আমি ফোন রিসিভ করতেই ‘ও’ জানায়, তোদের গাড়িটা নাকি ‘ও’ হারিয়ে ফেলেছে।”
অভি এইটুকু বলতেই মেঘ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
“পিছু যখন করছিলো তাহলে হারালো কিভাবে?”
মেঘের প্রশ্নের উওরে অভি কিছু বলতে যাবে। তার আগেই দিশা বলে উঠলো
“আসলে তখন আবীরের কথা গুলো শুনে আমার এতোটা খারাপ লেগেছিলো যে আমি গাড়িতে বসে বসে কান্না করছিলাম। আহান ভাইয়া বারবার আমাকে কান্না থামানোর জন্যে বলছিলো। কিন্তু আমি চেয়েও নিজের কান্না আটকাতে পারছিলাম না। তাই ভাইয়া আমার মন ভালো করার জন্যে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দোকান থেকে আমার জন্যে এক বক্স আইসক্রিম কিনে এনেছিলেন। কিন্তু ততোক্ষনে আবীর আমাদের সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। আমরা ভেবেছিলাম ‘ও’ হয়তো তোকে নিয়ে বাসার দিকেই আসছে। তাই আমরাও সেই রাস্তা দিয়েই আসছিলাম। কিন্তু বাংলোর একদম কাছাকাছি আসার পরেও যখন আমরা আবীরের গাড়িটা দেখতে পেলাম না। তখন আহান ভাইয়ার সন্দেহ হলো। উনি আগে থেকেই ওনার কিছু লোকদের মাঝ রাস্তায় দাড় করিয়ে রেখেছিলেন যাতে আবীর বাড়িতে পৌছানোর আগেই তারা ওকে আটকাতে পারে সেইজন্যে। ভাইয়া দ্রুত নিজের গাড়ি ঘুড়িয়ে সেই লোক গুলোর কাছে এসে ছিলেন। কিন্তু ওদের কাছে এসে আবীরের কথা জিজ্ঞেস করতেই ওরা জানালো যে ”আহান ভাইয়া যখন থেকে ওদের ফোন করেছিলো, তখন থেকে নাকি ওরা ওই রাস্তাতেই দাড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই থেকে এই পযর্ন্ত ওই রাস্তা দিয়ে আবীরের গাড়িটা নাকি ওরা যেতে দেখে নি।” ওদের কাছ থেকে এই কথা শোনার পর আহান ভাইয়া ভিষন ঘাবড়ে গিয়ে ছিলেন। কারন উনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরে ছিলেন যে আবীর তোকে নিয়ে অন্য কোথাও একটা চলে গেছে।”
মেঘ বেশ মনোযোগ দিয়ে দিশা কথা শুনছে। দিশা এইটুকু বলতেই ‘ও’ চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
“তারপর কি হলো?”
দিশা বললো
“আমরা যখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবছিলাম যে তোকে কিভাবে খুজে বের করবো, তখনই অভি আমাদের কাছে চলে আসে। আর ওর ফোনের Number locator অ্যাপে তোর নম্বর দিয়ে সার্স দেয়।তারপর তোর লোকেশন খুজে বের করে।কিন্তু তোর লোকেশন দেখে আমরা সবাই বেশ ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম আবীর হয়তো তোকে কিডন্যাপ করে জজ্ঞলের দিকে নিয়ে গিয়ে তোর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু একটা করতে চাইছে। তাই আমরা তখন আর বেশি দেড়ি না করে দ্রুত সবাই ফোনে দেখানো লোকেশনের দিকে রওনা দিয়েছিলাম । কিন্তু আমরা পুরোপুরি রাস্তা পৌছানোর আগেই তুই নিজেই আমাদের গাড়ির সামনে চলে এসেছিস।”
এইটুকু বলে দিশা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। তারপর ম্লানো হেসে বললো
“জানিস, ওই লোকেশনটা দেখার পড়ে আহান ভাইয়া যখন ড্রাইভ করে এখানে আসছিলেন, তখন উনি অদ্ভুত ভাবে ছটফট করছিলেন। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ ওনার গলা টিপে ধরেছে। ড্রাইভিং করতে করতে বারবার উনি ওনার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের কোনে জমে থাকা পানিটা মুচ্ছিলেন। ওনার চোখে, মুখে কেমন একটা আতঙ্কের ছাপ ছিলো। আমি এই প্রথমবার ওনাকে এতোটা ভয় পেতে দেখেছি। এর আগে ভাইয়াকে কখনো এতোটা অগোছালো রূপে দেখিনি।”
দিশার মুখে কথা গুলো শুনতে শুনতে অজান্তেই মেঘের ঠোটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। মুহূর্তেই ওর মনের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগার একটা শিহরন বয়ে গেলো। ‘ও’ কোনো কথা না বলে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। তারপর এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে সিটের সাথে হেলান দিড়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। চোখ বন্ধ করতেই ওর চোখের সামনে ভেষে উঠলো আহানের সাথে কাটানো কিছু পুরনো স্মৃতি।স্মৃতি গুলো মনে পড়তেই হঠাৎ করে মেঘের হৃদ স্পন্ধনের গতি দ্রুত বেড়ে গেলো। ‘ও’ এক হাত বুকের বা পাশে রেগে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে স্নিগ্ধময় একটা হাসি দিলো।
এদিকে মেঘের এমন অদ্ভুত কান্ড দেখে দিশা আর অভি দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ‘হা’ করে দাড়িয়ে রইলো।
_________________________
রাত 11:30
মেঘ ঠোট ফুলিয়ে বারান্দার রকিং চেয়ারের উপর বসে আছে। কাদতে কাদতে ওর চোখ আর নাকের ডগা একদম ফুলে গেছে। কিছুক্ষন আগেই অভি, দিশা এসে ওকে ডিনার করার জন্যে অনেক বার ডেকে গেছে। কিন্তু ‘ও’ কারোর ডাকেরই কোনো সারা শব্দ দেয়নি। এমনটা নয় যে ওর খিদে পায়নি। সারাদিন না খেয়ে থাকার কারনে খিদেতে ওর পেট জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে আসার পর যা হলো তাতে ওর খাবার খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে।
আসলে অভি, দিশা আর মেঘ বাড়িতে ফিরেই দেখতে পায় আবীর আজম রহমানের সাথে ড্রইং বসে আছে। ওর হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। এটা দেখে মেঘের রাগ উঠে যায়। তাই ‘ও’ রাগে ফুশতে ফুশতে আবীরের কাছে গিয়ে বলে
“আহান নাকি আপনার হাতে গুলি করেছে? কতোটা আঘাত লেগেছে দেখি?”
কথাটা বলে মেঘ আবীরের হাত চেপে ধরে ওর হাত থেকে টেনে ব্যান্ডেজ খোলার চেস্টা করে। এটা দেখে আবীর ভিষন ঘাবড়ে যায়। তাই ‘ও’ আর কোনো উপায় না পেয়ে হাত চেপে ধরে ফ্লোরের উপর বসে পড়ে। তারপর ব্যাথায় কুকিয়ে উঠার নাটক করে বলে
“মেঘ কি করলে এটা? আমার হাতে প্রচন্ড পেইন হচ্ছে তো।”
আবীরের কথা শুনে মেঘ হাটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ে। তারপর আবার ওর হাত ধরে ব্যান্ডেজ খুলতে খুলতে বলে
“তাই নাকি? কতোটা পেইন হচ্ছে একটু দেখি?”
আবীর ব্যান্ডেজের উপর থেকে নিজের হাত চেপে ধরে চিল্লাচ্ছে আর ব্যাথার নাটক করছে। আর মেঘ ওর হাত সরিয়ে ব্যান্ডেজটা টেনে খোলার চেস্টা করছে। ওদের দুজনের মধ্যে এক প্রকার ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেছে। ওদেরকে এমন ধস্তাধস্তি করতে দেখে আজম রহমান এগিয়ে এসে মেঘের হাত ধরে টেনে এক ঝটকায় ওকে উঠিয়ে দাড় করালেন। তারপর মেঘকে উদ্দ্যেশ্য করে ধমকের স্বরে বলেন
“এটা কোন ধরনের অসভ্যতা মেঘ? তুমি দেখতে পাচ্ছো না যে ছেলেটার হাতে আঘাত লেগেছে তারপরেও তুমি ওর ব্যান্ডেজটা ধরে এভাবে টানাটানি করছো কেনো?”
আজম রহমানের ধমক শুনে মেঘ কেপে উঠে। ‘ও’ আমতা আমতা করে বলে
“বাবাই, আসলে আমি দেখতে চাইছিলাম যে আহান সত্যিই কি ওনার হাতে গুলি করেছে, নাকি উনি মিথ্যা কথা বলছে।”
আজম রহমান চোয়াল শক্ত করে বলেন
“এতো কিছু কে দেখতে বলেছে তোমাকে? আহান গুলি না করলে ‘ও’ কি মিথ্যা কথা বলেছে আমার কাছে?”
“বলতেও তো পারে। আজ কাল কারো উপরেই পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না বাবাই।”
মেঘ কথাটা শেষ করতেই আজম রহমান বাজখাই কন্ঠে ওকে আরো জোড়ে একটা ধমক দিয়ে বলেন
“শাটআপ! একদম মুখে মুখে কথা বলবে না। যাও নিজের রুমে যাও। আমি কাকে বিশ্বাস করবো আর কাকে বিশ্বাস করবো না। সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। এটা নিয়ে আমি তোমার কাছ থেকে কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি যাও এখান থেকে।”
আজম রহমানের কথা শুনে সাথে সাথে মেঘের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। ‘ও’ অভিমানি দৃষ্টিতে এক পলক আজম রহমানের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে উপরে চলে আসলো। উপরে এসে রুমে ঢুকে সেই যে দরজা লক করেছে তারপর আর ‘ও’ দরজা খুলেনি। দুপুরের পর থেকে এখন পযর্ন্ত আজম রহমান, দিশা, অভি কতোবার এসে যে ওর দরজায় নক করে গেছে তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু মেঘ কারো ডাকেরই কোনো রেসপন্স করেনি।
মেঘ রকিং চেয়ারে দুলছে আর আজম রহমানের বলা কথা গুলো ভাবছে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেঘের মনে আজকে ওর বাবাইয়ের প্রতি এক আকাশ সমান অভিমান জমেছে। ‘ও’ কখনো ভাবতেও পারেনি যে আবীরের জন্যে ওর বাবাই ওকে এইভাবে বকা দিবে। মেঘ অভিমানি কন্ঠে বিরবির করে বললো
“তুমিও আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না বাবাই। ভালোবাসলে ওই ছেলেটার জন্যে আমাকে এইভাবে কস্ট দিতে পারতে না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। এই পৃথিবীতে কেউ নেই আমার।”
কথাটা বলে মেঘ ফুপিয়ে কেদে উঠলো। কান্নার মাঝখানেই হঠাৎ ওর কানে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসলো। ‘ও’ মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো ওর থেকে কিছুটা দূরে অন্ধকারের মধ্যে একটা অভয়ব দাড়িয়ে আছে। অভয়বটাকে দেখে মেঘ ভয় পেয়ে চিল্লিয়ে উঠলো। কিন্তু ওর গলা থেকে কোনো সাউন্ড বের হওয়ার আগেই অভয়বটা দ্রুত এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরলো। তারপর ‘ও’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে টানতে টানতে রুমের মধ্যে নিয়ে আসলো। রুমের মধ্যে নিয়ে এসে ব্যালকনির দরজাটা লক করে দিয়ে ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে ওকে ছেড়ে দিলো।
লোকটার থেকে ছাড়া পেয়ে মেঘ বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। আরেকটু হলেই ওর দমটা বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। ‘ও’ নিজেকে কোনো রকম সামলে নিয়ে সামনের ব্যাক্তিটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওর চোখ জোড়া ছানা বড়া হয়ে গেলো। কারন ওর সামনে আহান দাড়িয়ে আছে। আহানের হাতে মিডিয়াম সাইজের একটা শপিং ব্যাগ। মেঘ বিস্ফোরিত চোখে আহানের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কন্ঠে বললো
“আপনি এখানে কিভাবে আসলেন? কেনোই বা আসলেন? কেউ যদি আপনাকে দেখে ফেলতো? তখন কি হতো?”
আহান ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে ওর হাতে থাকা ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো। তারপর গায়ে পড়ে থাকা হুডি জ্যাকেটের চেইন টা খুলতে খুলতে বললো
“বাংলোর পিছনের গেট দিয়ে ঢুকে তারপর পাইপ দিয়ে বেয়ে বেয়ে তোমার ব্যালকনিতে এসেছি। তাই কারো দেখার কোনো চান্স নেই বললেই চলে। কারন তোমার বাবার মাথা মোটা, গবেট গার্ডেরা সবাই সামনের গেটে দাড়িয়ে আছে। কেউ এসে যদি তোমাকে এখান থেকে তুলেও নিয়ে যায়, তাও ওরা কিছু টেড় পাবে না। সবগুলা এক নম্বরের অপদার্থ।”
কথাটা বলতে বলতে আহান ওর গায়ে থাকা জ্যাকেট টা খুলে রিডিং টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটার উপরে রাখলো। মেঘ তাকিয়ে দেখলো আহান একদম খালি গায়ে ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। আহানকে এমন খালি গায়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেঘ চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো। তারপর অবাক কন্ঠে বললো
“হোয়াট ইজ দিস? আপনি জ্যাকেট টা কেনো খুললেন? আপনি কি ভুলে গেছেন যে এই মুহূর্তে আপনি একটা মেয়ের রুমে দাড়িয়ে আছেন?”
আহান স্বাভাবিক ভাবেই বললো
“এই গরমে যদি এতোক্ষন যাবৎ হুডিওয়ালা জ্যাকেট পড়ে থাকি, তাহলে একটু পর আমার পুরো বডি তৈলে ভাজা মুরগির মতো বাদামি কালারের হয়ে যাবে। আর ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এই রুমটাতে যেই মেয়েটা থাকে সেই মেয়েটা হচ্ছে আমার বউ। তাই আমি এখানে শুধু জামা ছাড়া নয়, প্যান্ট ছাড়াও থাকতে পারি। দেখতে চাও?”
আহানের কথা শুনে মেঘ টাস্কি খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর ভাবতেই কস্ট হচ্ছে যে আহানের মতো ব্যাক্তিত্ব্য সম্পন্ন একজন মানুষ এমন লাগাম হীন কথা বার্তা বলছে। তাও আবার একটা মেয়ের সামনে। মেঘের এসব ভাবনার মধ্যেই আহান এসে পিছন থেকে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ওর ঘাড়ে আলতো করে ঠোট ছুইয়ে দিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদ্যু স্বরে বললো
“কেদে কেটে চোখ মুখের এমন নাজেহাল অবস্থা করে রেখেছো কেনো? সামান্য একটু ধমক’ই তো দিয়েছে তাতে এতোটা কান্নাকাটি করার কি আছে?”
আহানের কথা শুনে মেঘ ওর উপরে ভিষন রেগে গেলো। সাথে ওর প্রতি মেঘের বেশ অভিমানও হলো এটা ভেবে যে আহানও ওর কস্টটা বুঝতে পারলো না। ‘ও’ আহানের প্রশ্নের কোনো উওর না দিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে ওর কোমড় থেকে আহানের হাত দুটো সরানোর চেস্টা করতে লাগলো। কিন্তু ‘ও’ যতো আহানের হাত সরানোর চেস্টা করছে আহান ততো আরো শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে। আহানের এমন কান্ডে রাগে, ক্ষোপে, অভিমানে মেঘের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ‘ও’ দাতে দাত চেপে আহানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“ছাড়ুন আমাকে। একদম আমাকে ছোবেন না। কেনো এসেছেন আপনি এখানে? আমি আপনাকে আসতে বলেছি?”
মেঘের কান্না ভেজা কন্ঠে এমন অভিমান মিশ্রিত কথা শুনে আহান আলতো হাসলো। তারপর ফিশফিশ করে আদুরে স্বরে বললো
“আমার পরীটা সারাদিন ধরে না খেয়ে রুম বন্ধ করে রেখে কান্নাকাটি করেছে। এসব শোনার পর আমি কি এখানে না এসে থাকতে পারি? আমি জানি তুমি তোমার বাবাইয়ের উপর অভিমান করে সারাদিনে কিচ্ছু খাওনি। কিন্তু কারো উপর অভিমান করে খাবারের উপরে রাগ দেখানোটা কি ঠিক মেঘ পরী? ”
আহানের এমন আদুরে কন্ঠের কথা শুনে মেঘের আবার আজম রহমানের বলা কথা গুলো মনে পড়ে গেলো। তাই ‘ও’ আর নিজেকে সামলাতে না পেরে আহানের দিকে ঘুড়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুজে শব্দ করে কেদে দিলো। মেঘের এমন কান্ডে আহান একদম হতোবাক হয়ে গেলো। মেঘ কান্না করে হেচকি দিতে দিতে বাচ্চাদের মতো করে বললো
“বাবাই আমাকে আজকে অনেক বকেছে। শুধুমাত্র ওই খারাপ ছেলেটার জন্যে। আমি বুঝতে পারছি বাবাইও আর আমাকে ভালোবাসে না। এই পৃথিবীর কেউ আমাকে একটুও ভালোবাসে না। আমি এখানে আর থাকতে চাই না। আমি আপনার সাথে যাবো। আমাকে এখনি আপনি এখান থেকে নিয়ে চলুন।”
কথাগুলো বলতে বলতে মেঘের কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। আহান দু-হাতে শক্ত করে মেঘকে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। কিন্তু ওর ঠোটের কোনে ফুটে আছে বাকা হাসি। আহান বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে যে আজকে মেঘ সমস্ত সত্যিটা জানার পর ওর প্রতি মেঘ ভিষন দূর্বল হয়ে পড়েছে। এই জন্যেই ওর সাথে মেঘ এমন বাচ্চাদের মতো আচরন করছে। নাহলে আগের মতো রুড হয়ে এতোক্ষনে ওকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতো। আহান মেঘের ঘাড়ে মুখ গুজে মনে মনে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো
—-এইবার আপনি কি করবেন মিঃ আজম রহমান? আপনার ট্রাম্প কার্ড তো এখন আমার কাছে। এখন তো হাজার চেস্টা করলেও আপনি ওকে নিজের কাছে আটকে রাখতে পারবেন না। ওকে তো এখন আমি নিজের করেই ছাড়বো। এবার এটাকে আপনি ভালোয় ভালোয় সবটা মেনে নিবেন নাকি ঘাড় ত্যাড়ামো করবেন, সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার।
চলবে