#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃতানিশা_আহিয়াদ_তিশা
#পর্বঃ20
মেঘ সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রাগে ওর শরীর থরথর করে কাপছে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে আবীরকে জোড়ে একটা লাথি মেরে গাড়ি থেকে বের করে দিতে। নাহলে ওকে রাস্তায় শুইয়ে ওর উপর দিয়ে রোলার চালিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস মেঘ চাইলেও এখন এইগুলো করতে পারবে না। তাই ‘ও’ চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেস্টা করছে। চোখ বন্ধ করে রাখতে রাখতে কখন যে মেঘ ঘুমিয়ে দেশে হারিয়ে গেলো নিজেই টেড় পেলো না।
ঘুমের মধ্যেই মেঘ হঠাৎ অনুভব করলো কারো গরম নিঃশ্বাস ওর চোখে,মুখে আচড়ে পড়ছে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কারো শীতল হাতের স্পর্শ ওর গালে গভীর ভাবে বিচরন করছে। এরকম হওয়ায় অস্বস্তিতে মেঘের ঘুম ভেঙে গেলো। ‘ও’ পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো আবীর ওর অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। আবীর এক হাত মেঘের কোমড়ে রেখে আরেক হাত দিয়ে মেঘের গালে স্লাইড করছে। আবীরকে এতোটা কাছাকাছি দেখে মেঘের বুকের মধ্যে ধুক করে উঠলো। ‘ও’ এক ধাক্কা দিয়ে আবীরকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আবীর হাত দিয়ে গাড়ির ডেস্কের সাথে একটা পাঞ্চ করে বিরবির করে বললো
“শিট! ‘ও’ তো জেগে গেছে। এবার আমার কি হবে? চাচ্চুকে এসব বলে দিলে তো চাচ্চু আমাকে জ্যান্ত মাটি চাপা দিবে।”
কথাটা বলে আবীরও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। মেঘ বাইরে এসে দেখলো ওদের গাড়িটা একদম শূনশান একটা রাস্তায় দাড় করানো আছে। যতোদূর মেঘের চোখ যাচ্ছে ততোদূরে গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেঘ তাড়াহুড়ো করে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে নিজের সাইড ব্যাগটা বের করতে নিবে ঠিক তখনই আবীর এসে মেঘের হাত চেপে ধরলো। তারপর কাপা কাপা কন্ঠে বললো
“দেখো মেঘ তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই হয়নি। আসলে তোমার ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। তাই ভুল বশতো…….”
আবীর পুরো কথাটা শেষ করার আগেই মেঘ এক ঝটকায় আবীরের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর চিল্লিয়ে বললো
“তাই ভুল বশতো কি? ভুল বশতো গাড়িটা একটা শুনশান জায়গায় নিয়ে এসে আমার সাথে অসভ্যতা করার চেস্টা করছিলেন তাইনা?”
আবীর একটু কাচুমাচু করে বললো
“আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি মেঘ। আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ তুমি এই ব্যাপারে চাচ্চুকে কিছু বলো না।”
মেঘ ঠোট বাকিয়ে হেসে বললো
“ভুল যখন করেছেন শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে মিঃ রহমান। আপনার এই জঘন্য ভুলের জন্যে আপনি কোনো ক্ষমা পাবেন না। আমি এক্ষুনি ফোন করে বাবাইকে সবটা বলে দিবো।”
কথাটা বলে মেঘ সিটের উপর থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। কিন্তু ফোন অন করার আগেই আবীর ‘ছো’ মেরে ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। তারপর সেটাকে গায়ের জোড়ে রাস্তার উপরে ছুড়ে মারলো। এতো জোড়ে ছুড়ে মারায় মুহূর্তের মধ্যে ফোনটা খন্ড-বিখন্ড হয়ে রাস্তার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। আবীর মেঘের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে অনুরোধের স্বরে বললো
“মেঘ প্লিজ তুমি চাচ্চুকে এসব ব্যাপারে কিছু বলতে যেও না। তাহলে চাচ্চু আমাকে মেরেই ফেলবে।”
মেঘ রাগি কন্ঠে বললো
“তোকে মারুক, কাটুক যা খুশী করুক তাতে আমার কি? আমি তো বাবাইকে সব বলবোই। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।”
মেঘ কথাটা বলতেই হঠাৎ করে আবীরের অসহায় চেহারাটা হিংস্র রূপ ধারন করলো। ‘ও’ খপ করে মেঘের এক হাত চেপে ধরে হাতটা মেঘের পিছনে নিয়ে মুচড়ে ধরলো। তারপর মেঘের পিঠটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দাতে দাত চেপে বললো
“বাবার কাছে ফিরতে দিলে তো তাকে সব বলবি! আমি তোকে তোর বাবার কাছে ফিরতেই দিবো না। আজকে থেকে তুই আমার কাছে বন্দী হয়ে থাকবি।”
আবীর কথাটা বলার সাথে সাথে মেঘ হাটু পিছনের দিকে ভাজ করে আবীরের মেইন পয়েন্টে জোড়ে একটা লাথি মারলো। মেঘের পায়ে পেন্সিল হিল পড়া ছিলো তাই এতো জোড়ে লাথি খাওয়ায় পড় আবীর আর এক সেকেন্ডও সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না। “মাগো” বলে জোড়ে একটা চিৎকার দিয়ে নিজের মেইন পয়েন্ট চেপে ধরে ধপাস করে রাস্তায় শুয়ে পড়লো। মেঘ আবীরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো
“ওরে বলদ আগে নিজেকে তো সেইফ করতে শিখ তারপর নাহয় আমাকে বন্দী করার কথা ভাববি। আমি ব্লাক বেল্ট ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন। সেলফ ডিফেন্স কিভাবে করতে হয় সেটা আমার ভালো করে জানা আছে।”
কথাটা বলে মেঘ জিব বের করে আবীরকে একটা ভেংচি কেটে দিলো এক ভো দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে কিছুদূর আসতেই হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ওর সামনে দাড়ালো। মেঘ দেখলো গাড়ির মধ্যে আহান আর দিশা বসে আছে। ওদের গাড়ির পিছনে আরেকটা গাড়ি এসে থামলো। সেই গাড়িটা থেকে অভি আর কয়েকজন গার্ড বের হয়ে আসলো। ওদের দেখে মেঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আহান আর দিশা গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত মেঘের দিকে এগিয়ে আসলো। তারপর আহান এসে হুট করে মেঘকে জড়িয়ে ধরে আতঙ্কীত স্বরে বললো
“আর ইউ ওকে? তোমার কিছু হয়নি তো মেঘ?”
আহানের প্রশ্ন শুনে মেঘের কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আর ‘ও’ সব কিছু ভুলে গিয়ে হা হা করে হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে ‘ও’ এটাও ভুলে গেলো যে আহান ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। মেঘের এমন কান্ডে আহান সহ বাকীরা সবাই রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কিন্তু সেদিনে মেঘের বিন্দুমাত্রও খেয়াল নেই ‘ও’ আহানের বুকের সাথে মাথা ঠেকিয়ে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আহান মেঘকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাড় করিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো
“এভাবে পাগলের মতো হাসছো কেনো? কি হয়েছে?”
মেঘ কোনো রকম ওর হাসি থামিয়ে এতোক্ষন যা যা হয়েছে শুরু থেকে সবটা আহানদেরকে বললো। সবটা শুনে দিশাও ফিক করে হেসে দিলো। কিন্তু আহানের চোখ, মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। ‘ও’ চোয়াল শক্ত করে দু-হাত মুঠো বন্ধি করে ফেললো। অভি রেগে গাড়ির সাথে নিজের হাতটাকে একটা পাঞ্চ করলো। তারপর দিশা আর মেঘের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে জোড়ে একটা ধমক দিয়ে বললো
“আহমোকের মতো হাসছিস কেনো? এসব কি তোদের কাছে মজা মনে হচ্ছে? আজকে এদিক ওদিক কিছু একটা হলে মেঘের যা খুশী তাই হয়ে যেতে পারতো। ”
অভির ধমক শুনে দিশা আর মেঘ দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। আহান হিংস্র দৃস্টিতে অভির দিকে তাকিয়ে বললো
“বিলিভ মি অভি, আজকে ওই স্কাউন্ডেল টাকে হাতের কাছে পেলে ওকে আমার হাত থেকে কেউ বাচাতে পারবে না। ওর বডির আমি এতোগুলো টুকরো করবো যে ওর মা-বাবাও ওকে দেখে চিনতে পারবে না।”
কথাটা বলে আহান হনহন করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে ওঠার আগেই আচৎমকা অভির ফোনটা বেজে উঠলো। অভি প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো আজম রহমান কল করেছে। ‘ও’ ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আহানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“আহান ওয়েট, চাচ্চু ফোন করেছে।”
আজম রহমান কল দিয়েছে শুনে আহান গাড়ির ভিতরে না ঢুকে গাড়ির দরজা ধরে দাড়িয়ে পড়লো। অভি ফোন রিসিভ করে ফোনটা স্পিকারে দিতেই ওপাশ থেকে আজম রহমান আতঙ্কির কন্ঠে বলে উঠলো
“অভি বাবা মেঘকে বাচাও। আহান নাকি আবীরকে গুলি করে মেঘকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।”
আজম রহমানের কথা শুনে দিশা আর মেঘ হতবম্ভ হয়ে গেলো। অভি অবাক কন্ঠে বললো
“কি বলছো চাচ্চু? কখন হলো এসব? আর কিভাবে হলো?”
আজম রহমান ভাংগা গলায় বললেন
“কখন হলো,কিভাবে হলো, সেসব আমি কিচ্ছু জানিনা বাবা। আবীর এইমাএ ফোন করে আমাকে সবটা জানালো। ছেলেটা খুব বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছে। ঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছে না। আমি কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তাই তোমাকে ফোন করলাম। তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি গিয়ে আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসো বাবা।”
আজম রহমানের কথা শুনে মেঘ এগিয়ে ফোনের কাছে এসে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু কিছু বলে উঠার আগেই আহান দ্রুত এসে মেঘের মুখ চেপে ধরলো। অভি আজম রহমানকে আশ্বস্ত করে বললো
“তুমি কোনো চিন্তা করো না চাচ্চু। আমি কিছু ক্ষনের মধ্যেই মেঘকে সেইফলি তোমার সামনে এনে হাজির করবো।”
কথাটা বলে অভি ফোন কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকালো। আহান মেঘের মুখ থেকে হাত সরিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিলো। তারপর বললো
“অভি ওকে মারার প্লানটা চেইঞ্জ করলাম। এতো সহজে ওকে মেরে ফেললে আমাদের লিস্ট থেকে একটা জোকার কমে যাবে। আর জোকার কমে গেলে আমাদের এন্টেটেইন করবে কে? তার থেকে ভালো প্রথমে ওকে ওরই পাতা ফাদে ফেলবো। তারপর ওর দলের সবগুলোকে ধরে মেরে উপরে যাওয়ার টিকিট কেটে দিবো।”
অভি আহানের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ দিয়ে বললো
“গুড আইডিয়া!দেখিস, এখন থেকে ওদের বোনা জালে ওদেরকে এমন ভাবে প্যাচাবো যে সবগুলো চোখের সামনে শুধু শড়িষা ফুল দেখতে পাবে।”
আহান আর অভির কথা শুনে দিশা আর মেঘ অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন এর আগে অভি আর আহানের যখনই দেখা হয়েছে তখনই ওরা একে অপরকে তুমি অথবা আপনি বলে সম্মোধন করেছে। অথচ এখন ওরা দুজন এমন ভাবে তুই তোকারি করছে যেনো মনে হচ্ছে ওরা একে অপরকে অনেক আগে থেকেই চিনে। দিশা অভির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
“তোমরা দুজন সেদিন তো হসপিটালে মেঘকে নিয়ে কি ঝামেলাটাই না করছিলে। একে অপরের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছিলে! তাহলে হঠাৎ করে তোমাদের মধ্যে এতো ভাব হলো কবে থেকে?”
দিশার প্রশ্ন শুনে অভি হালকা হাসলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো
“আমাদের মধ্যে হঠাৎ ভাব হতে যাবে কোন দুঃখে ? আমরা দুজন তো অনেক আগে থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড।”
অভির কথা শুনে মেঘ আর দিশার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ওরা দুজন একসাথে চিল্লিয়ে বলে উঠলো
“হোয়াট?”
অভি বললো
“জ্বী ম্যাডাম! আপনারা দুজন প্লান করে ছদ্মবেশে বাংলাদেশে এসে নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ভাবছিলেন তাইনা? ভেবেছিলেন সবাইকে বোকা বানাতে পেরেছেন। কিন্তু এটা আপনাদের ভুল ধারনা। এই পুরো প্লানটা আমার আর আহানের ছিলো। আপনারা শুধুমাত্র আমাদের প্লানের ছোট্ট একটা অংশ ছিলেন।”
মেঘ ভ্রু কুচকে বললো
“মানে?”
আহান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে মেঘকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“মানেটা আমি বলছি।”
মেঘ আর দিশা অভির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আহানের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালো। আহান ভরাট কন্ঠে বলা শুরু করলো
“ইন্টার মিডিয়েট শেষ করেই আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি আব্বুর বিজনেসে জয়েন করি। তার আগে নানা ভাই আর মামনী মিলেই সবকিছু সামলাতো। আমি বিজনেসের কাজে জয়েন হতেই ওনারা কম্পানির ভাড় আমার কাধে দিয়ে নিজেরা অবোশরে চলে যান। আমি একা একাই নিজের মতো করে পুরো কম্পানির হাল ধরি। এবং মাএ দুই বছরের মধ্যেই সব কিছু নিজের আয়ওে নিয়ে আসি। তারপর নেমে পড়ি আমার মামনীর ভাঙা সংসার জোড়া লাগানোর মিশনে। কিন্তু সেটা করতে হলে আমাকে আগে পাপা আর মেঘ কোথায় আছে সেটা জানতে হতো। তাই আমি সিলেটে গিয়ে সবার আগে অভির সাথে যোগাযোগ করি। কারন ছোট বেলায় অভির সাথে আমার বেশ ভালো বন্ডিং ছিলো। মামনী আমাদের নিয়ে চলে আসার পর ওখানে মেঘের সাথে কী কী হয়েছিলো সবটা আমি অভির থেকে জানতে পারি। আর এটাও জানতে পারি যে মেঘ আর পাপা এখন ইউরোপে থাকে। তাই অভির থেকে পাপার অফিসের ঠিকানা নিয়ে আমি ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় এসে বিজনেস ট্যুরের নাম করে আমি ইউরোপে চলে যাই। সেখানে গিয়ে অভির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী আমি পাপার সাথে দেখা করতে সোজা পাপার অফিসে যাই। সাথে কোনো রকম গার্ড বা পুলিশ প্রটেকশন ছাড়া আমি সেদিন পাপার ছেলে হয়ে ওনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার নাম শুনেই উনি এতোটাই রেগে গিয়েছিলেন যে সবার সামনে আমাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছিলেন। শুধু এইটুকুই না, গার্ড ডেকে উনি আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিয়েছিলেন সেদিন। ওইদিন ওনার উপরে আমার যেমন রাগ হয়েছিলো, তেমন ওনার আচরণে ভিষন কস্টও হয়েছিলো। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি আমার পাপা আমার সাথে এতোটা খারাপ ব্যাবহার করবে। আমি ওনাকে আমার বাবার স্থানে বসিয়ে ছিলাম,অথচ উনি আমাকে কখনো উনার ছেলের স্থানটা দিতে পারেনি।”
কথা গুলো বলতে বলতে আহানের গলাটা ধরে এলো। আর মেঘ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না যে ওর বাবাই আহানের সাথে এমনটা করেছে! আহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলা শুরু করলো
“ঘাড় ধাক্কা খাওয়ার পর আমি যখন চোখ ভর্তি পানি নিয়ে গেট থেকে ফিরে আসতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আমার আশাহত মনে এক চিলতে সূর্যের রশ্মির মতো হাজারো স্বপ্ন নিয়ে একটা কিউট হিজাব পড়া বারবি ডল এসে আমার সামনে দাড়িয়েছিলো সেদিন। সে এসে কোনো কথা না বলে আমার কেটে যাওয়া হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেট দিয়ে অফিসের ভিতরে চলে গিয়েছিলো। আর আমি মন্তমূগ্ধ হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থম মেরে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলাম। পরে যখন আমার হুশ এসেছিলো তখনই আমি দ্রুত গিয়ে গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকা গার্ডদের কাছে মেয়েটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর ওরা যেটা বললো সেটা শুনে আমি কিছুক্ষনের জন্যে কোমাতে চলে গিয়েছিলাম। ওরা আমাকে বলেছিলো, মেয়েটা নাকি ওই কম্পানির Owner আজম রহমানের একমাএ মেয়ে তাসনুবা সায়াজ মেঘনা। সবেমাএ ক্লাস টেনে পড়ে। কিন্তু এইটুকু বয়সেই সে সমস্ত রকম সোস্যাল ওয়ার্কিংয়ের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখে। বিপদে পড়া যেকোনো মানুষকে হেল্প করাটা নাকি ওর প্যাশন। আর এই পৃথিবীতে আজম রহমানের একমাএ দূর্বলতা নাকি ওই মেয়েটা।ওদের কথা শুনে আমি তখনই মনে মনে ডিসাইড করে নিয়েছিলাম যে আজম রহমানের এই দূর্বলতাকেই আমি আমার ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যাবহার করবো। কিন্তু প্রভলেম ছিলো একটাই। সেটা হলো আজম রহমান সব সময় মেঘের আশেপাশে কড়া সিকিউরিটি দিয়ে রাখতো। আর সেই সিকিউরিটির চোখ ফাকি দিয়ে মেঘের কাছে কারো পৌছানোটা এক প্রকার অসম্ভব কাজ ছিলো। তাই আমি আমার নেক্সট গেমের প্লান করার জন্যে বাংলাদেশে চলে আসি।”
এইটুকু বলে আহান থামতেই দিশা বেশ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে
“তারপর?”
আহান কিছু বলার আগেই অভি বলে উঠে
“তারপর আহান বাংলাদেশে এসে আবার আমার সাথে যোগাযোগ করে। আর আমরা দুজন মিলে “মিশন আজম রহমান আর মিড়া রহমানের সংসার জোড়া লাগানোর” প্লান শুরু করে দেই। আমাদের প্লান অনুযায়ী আমি চাচ্চুর সাথে কথা বলে লেখাপড়ার নাম করে ইউরোপের একটা মেডিকেলে গিয়ে ভর্তি হই। তারপর সেখানে গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাচ্চুর সাথে ওনার বিজনেসেও হাত লাগাই। চাচ্চুর বিজনেসে জয়েন করার অবশ্য অন্য একটা কারন ছিলো। তবে আস্তে আস্তে চাচ্চু আমাকে ওনার সব কম্পানি দেখা শোনা করার দ্বায়ীত্ব দেন। আর আমিও খুব ওনেস্টলি আমার দ্বায়িত্ব গুলো পালন করতে থাকি। এভাবেই সময়টা চলে যাচ্ছিলো। এরমধ্যে আমি প্রত্যেকদিন মেঘের সব খবরা খবর আহানকে জানাতাম। কারন আহান সব সময় শুধু মেঘের ব্যাপারেই জানতে চাইতো। অন্য কোনো ব্যাপারে ওর কোনো রকম ইন্টারেস্ট ছিলো না। থাকবে কি করে? সে তো তখন দিন দূনিয়ার সব প্লান ভুলে গিয়ে মেঘের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ায় ব্যাস্ত ছিলো। আর হাবুডুবু খেতে খেতে সে এতোটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলো যে সে উড়ে উড়ে আবার ইউরোপে চলে আসে। ইউরোপে এসে আবার চাচ্চুর সাথে দেখা করে। তবে এইবার উনি চাচ্চুর সংসার জোড়া লাগাতে নয়, নিজের সংসার গড়তে গিয়েছিলো।”
এইটুকু বলে অভি ফিক করে হেসে দেয়। মেঘ ভ্রু নাচিয়ে সন্দীহান কন্ঠে বলে
“মানে?”
অভি হাসতে হাসতে বললো
“মানে হলো তিনি এইবার চাচ্চুর কাছে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। আর চাচ্চুর সামনে দাড়িয়ে ওনাকে সরাসরি বলে দেন যে “আমি মেঘকে ভিষন ভালোবাসি। আর ওকে আমি আমার বউ করে নিয়ে যেতে চাই।” কথাটা চাচ্চুর কানে যাওয়ার সাথে সাথে উনি আহানের গালে কশিয়ে একটা চড় মেরে ছিলেন। তবে সেই চড়ে পুরো অফিসের মানুষ কেপে উঠলেও আমাদের মজনু বাবাজির কিছুই হয়নি। তিনি সবার সামনে দাড়িয়ে চাচ্চুকে চ্যালেঞ্জ করে বলে এসেছে যে “আমি যদি বিয়ে করি তাহলে আপনার মেয়েকেই বিয়ে করবো। আপনার এতোই যখন ক্ষমতা, পারলে আপনি আপনার মেয়েকে আটকে রেখে দেখান।” কথাটা বলে আহান চলে এসেছিলো ঠিকই। বাট চাচ্চু ভিষন ঘাবড়ে গিয়েছিলো। আর তারপর থেকে উনি মেঘের সিকিউরিটি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো।”
অভির কথা শুনে মেঘের মাথা ভনভন করে ঘুড়তে শুরু করলো। ‘ও’ বিশ্বাসই করতে পারছে না যে আহান ওকে ভালোবাসে! মেঘ এক হাত মাথার উপরে রেখে ড্যাবড্যাব করে আহানের দিকে তাকালো। আর আহান রেগে অভির গায়ে কতোগুলো কিল, ঘুসি বসিয়ে দিলো। তারপর দাতে দাত চেপে বললো
“এসব ফালতু কথা বলতে তোকে কে বলেছে নন্সেন্স? কাজের কথার বাইরে যদি একটাও আজাইরা কথা বলেছিস তাহলে তোর জামা কাপড় খুলে তোকে আমি ডাস্টবিনের মধ্যে দাড় করিয়ে রাখবো বলেছিলাম।”
আহানের কথা শুনে অভি নাক ফুলিয়ে বলে
“আমি তোর উপকার করছিলাম আর তুই আমার বোন আর বউয়ের সামনে আমার মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি করছিস? ছিহ! এইজন্যেই গুনী জনেরা বলে কখনো কারো উপকার করে নেই। উপকারীদের দাম মানুষ কখনো দেয় না।”
অভির কথা শুনে আহান ওর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। অভি একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলা শুরু করলো
“তারপর থেকে আহানের একমাএ লক্ষ্য হয়ে উঠে মেঘকে পাওয়া। ‘ও’ বাকি সব প্লান ভুলে গিয়ে মেঘকে কিডন্যাপ করে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কিডন্যাপ করার আগেই ঘটে আরেক কান্ড। কোথা থেকে হুট করে জেড়িন এসে মেঘ সেজে আহানদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আর কাকি মনি বোকার মতো জেড়িনের সবকথা বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমার প্লানের গরবরটা মূলত এখান থেকেই শুরু হয়। আমরা খোজ নিয়ে জানতে পারি এটা জেড়িনের একার প্লান না। এটার সাথে রহমান পরিবারের আরো অনেকে যুক্ত আছে। তাই আমরা তখনকার মতো মেঘকে কিডন্যাপ করার আইডিয়াটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জেড়িনের সাথে জড়িত থাকা অন্যান্য কার্লপ্রিটদের ধরায় মনোযোগ দেই। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে যায় আরেক দূর্ঘটনা। হঠাৎ করে চাচ্চু একদিন আমাকে এসে জানায় ওনার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। আর ডাক্তার বলেছে খুব দ্রুত এগুলোর ট্রিটমেন্ট না করলে ব্লক গুলো ক্যান্সারের রূপ নিতে পারে। চাচ্চুর মুখে এসব কথা শুনে আমার মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। আমি কিছুক্ষনের জন্যে পুরো বাক শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে দাড়িয়ে আমার ঠিক কি করা উচিৎ আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। তার উপর চাচ্চু আমাকে দিয়ে ওয়াদা করিয়ে ছিলো যাতে আমি এই ব্যাপারে আমি কাউকে কিছু না বলি। তাই আমি এই ব্যাপারে আহানকেও কিছু বলতে পারিনি।”
কথা গুলো বলে অভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আর বাকিদের সবার চোখে মুখে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। অভি মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো
“দিন গুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু এর মধ্যে ঘটলো আরেক কাহিনি। চাচ্চু ওনার ট্রিটমেন্টের জন্যে সিজ্ঞাপুরে চলে গেলো। আর আমাকেও বাবা জরুরী খবর দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসলো। তখনই আমার লোকদের থেকে জানতে পারলাম তুই আর দিশা মিলে নিজেদের পাসপোর্ট ভিসা সব রেডি করে ফেলেছিস বাংলাদেশে আসার জন্যে। আমি সবকিছু জেনেও না জানার ভান ধরে রইলাম। আমার গার্ডদের আগেই বলে দিয়ে ছিলাম তোরা যেখানেই যেতে চাস না কেনো ওরা যাতে তোদের না আটকায়। কারন তখন আমার মাথায় অন্য প্লান ঘুড়ছিলো।”
অভির কথার মধ্যেই দিশা অবাক কন্ঠে বললো
“তারমানে তুমি সেদিন সবাইকে মিথ্যা কথা বলেছিলে? আমাদের বাংলাদেশে আসার খবরটা তুমি আগে থেকেই জানতে?”
অভি স্বাভাবিক ভাবেই বলে
“হ্যা সেদিন সবাইকে আমি মিথ্যা বলেছিলাম। আমি তোমাদের আসার খবরটা আগে থেকেই জানতাম। তবে তোমাদের এখানে আসার কারনটা তখনও আমার কাছে স্পষ্ট ছিলো না। সেটা বাংলাদেশে আসার পর মেঘ যখন আমাকে বলেছিলো ‘ও’ নাকি চাচ্চুর অসুস্থতার ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছে। আর ওনার ডায়েরি পড়ে ওনার কোনো একটা উইশ পূরন করার জন্যে এখানে এসেছে তখনই আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা স্পস্ট হয়।”
মেঘ এতোক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে সবার কথা গুলো শুনছিলো। অভির কথা শেষ হতেই হঠাৎ ‘ও’ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো
“আচ্ছা আমরা যখন বাংলাদেশে এসেছিলাম আহান ভাইয়া কি তখনও বাবাইয়ের অসুস্থতার ব্যাপারে কিছু জানতো না?”
মেঘের প্রশ্ন শুনে আহান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
“নাহ! অভি আমাকে এই ব্যাপারে কখনো কিছুই বলেনি। হঠাৎ করেই ‘ও’ আমাকে একদিন ফোন করে বলেছিলো তুমি আর দিশা নাকি বাংলাদেশে আসছো। কথাটা শুনে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম অভি আমার সাথে মজা করছে। কিন্তু ওর কথার গম্ভীরতা শুনে বুঝতে পারলাম যে ‘ও’ মজা করছে না, সিরিয়াসলি কথা গুলো বলেছে। আমি ওকে অনেকবার তোমার আসার কারনটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু ‘ও’ আমাকে কিছুই বলেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই সবকিছু খুজে বের করতে হলো। তবে সবকিছু খুজে বের করতে করতে ততোক্ষনে অনেকটা দেড়ি হয়ে গিয়েছিলো। ”
আহান আর অভির সব কথা শুনে দিশা,মেঘ ধপ করে রাস্তার উপরেই আসন দিয়ে বসে পড়লো। ওদের এই মুহূর্তে ঠিক কি রিয়্যাকশন দেওয়া উচিৎ সেটা ওরা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। দুজনেই একে অপরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচৎমকা অভি এসে ওদের সামনে হাটু গেড়ে বসে সন্দীহান কন্ঠে বললো
“আচ্ছা তোরা চাচ্চুর কোন উইশটা পূরন করতে বাংলাদেশে এসেছিস সেটা তো আমাকে তোরা এখনো বলিস নি? ওই ডায়রিতে কি এমন লেখা ছিলো যেটা পড়ার পর তোরা এতো রিস্ক নিয়ে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিলি?”
মেঘ রাগি চোখে অভির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ওর নাক বরাবর জোড়ে একটা ঘুসি মারলো। তারপর দাতে দাত চেপে বললো
“বলবো না! তোর মতো বিশ্বাস ঘাতক, ছ্যাচরা, উজবুক, মিথ্যা বাদীর সাথে আমি কোনো কথাই বলতে চাই না। তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। আর যাওয়ার আগে তোর এই শয়তান বন্ধুকেও মাথায় তুলে নিয়ে চলে যাস। তোদের দুটোর চেহারা তো দূরে থাক আমি তোদের ছায়াটাও দেখতে চাই না।”
চলবে……