#এক_কাপ_চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ ৪৭+৪৮ অন্তিম পর্ব
(২১৭)
লাশ বাহী ফ্রিজিং গাড়ির সাথেই বেরিয়ে পড়লো বাড়ির সবাই। তাশদীদের বাবাকে নিয়ে যেতে না চাইলেও নিতে হলো কারণ পরিবারের প্রতিটি মানুষ ভীষণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আছে।
স্নেহাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে সাগরিকার মা। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।শুভ্র ড্রাইভিং করছিল। সাগরিকা তার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করেছে।
তাদের সাথে তাশদীদ আসেনি, সে তার বাবা-মায়ের সাথে অন্য গাড়িতে। আরো একটা গাড়িতে মৌসুমির মা সমেত রাশেদ ইখুমরা।
সাগরিকার বাবা পিছন ফিরে বার বার তার মেয়েকে দেখছে। মেয়েটার মুখ একদম শুকিয়ে গেছে। সামিনার লাশ দেখে অসহায়ের মতোন চিৎকার করে কাঁদছিল সে। তার জানা মনে সাগরিকা এতটাও ঘনিষ্ঠ ছিল না সামিনার সাথে তবুও মেয়েটার কান্নায় তার দুচোখ বুজে এসেছিল।
আজ তাদের পরিবারের অনেক কিছুই সবার সামনে এসেছে। তার থেকে কায়সার বয়সে খুব একটা বড় ছিল না।বছর খানেকের ব্যবধান ছিল।কায়সার বড় হওয়া স্বত্বেও তাকে ভাই বলে ডাকেনি সে। অথচ সামিনার প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছে। বিদেশ তো তার যাওয়ার কথা ছিল।দুই ভাই এক সাথেই পাসপোর্ট করলো। অথচ তার যাওয়া হয়নি।বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় তখন লসের হিসেবটাই বেশি।বড় ভাই একা এসব সামাল দিতে পারবে না বলেই তাকে থেকে যেতে হলো।সাগরিকার মা কে যে মাসে বিয়ে করে ঘরে তুলল,সে মাস ছিল আষাঢ় মাস। বৃষ্টির এক বিকেলে পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেল তার হাতে। সেই চিঠিতে ছিল শুধু তামাশার কথা।
সাগরিকার বয়স যখন বারো তখন কায়সার বিয়ে করছিল।কায়সার এরপর তার স্ত্রী, মেয়েটাকে কার কাছে আমানত রেখে গেল সে?
নিশ্চুপে কেঁদেই চলল সে।
দীর্ঘ উনিশ বছর পর আজ তার সিগারেট এর তেষ্টা পাচ্ছে। সাগরিকা জন্মানোর পর থেকে সে একটা সিগারেটও খায়নি, মেয়ের মুখ দেখলেই তার সব কষ্ট দূর হয়ে যায় তবুও আজ তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
পেট্রোল পাম্পের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শুভ্র ছুটলো পানির উদ্দেশ্যে। তাকে দৌঁড়ে যেতে দেখে গাড়ি থামালো তাশদীদ। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল সাগরিকা বমি করছে আর তার বাবা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার চুল গুলো খুলে পুরো পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। তাশদীদ এগিয়ে এসে এক হাতে সাগরিকাকে শক্ত হাতে আবদ্ধ করলো। অন্য হাতে শুভ্রর থেকে পানির বোতল নিয়ে সাগরিকাকে বলল,
” কুলকুচা করে ফেলে দাও।”
কিন্তু তাশদীদকে অগ্রাহ্য করে সেই পানি খেয়ে ফেলল সাগরিকা।এমনটা হবে আগে থেকেই জানতো সে। মুখে চোখে পানি দিয়ে এনে সাগরিকাকে বসালো গাড়িতে। নিজ হাতে চুল বেধে দিয়ে বলল,
“দুপুরে কিছু খাওনি তো। কিছু খাবে?”
দু পাশে মাথা নাড়িয়ে সাগরিকা না বলল।পুনরায় তাশদীদ জিজ্ঞেস করলো,
“আমার সাথে যাবে?”
“আপনি যান। ওই গাড়িতে বাবা আর দাদু রয়েছে। দুই জন অসুস্থ মানুষ নিয়ে যাচ্ছেন।”
তাশদীদ কোনো জবাব দিলো না। সাগরিকার মাথায় হাত রেখে শুভ্রের উদ্দেশ্যে বলল,
“এসি চালানোর দরকার নেই। গ্লাস খুলে দিস। আর হ্যাঁ একটু সাবধানে আসিস। গ্রামের পথ তো।ঝাঁকুনি যেন কম লাগে।”
পাশ ফিরেই সাগরিকার বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“কাকা আপনি কিছু টক ফল কিংবা খাবার কিনে নিয়ে আসুন।স্নেহাও কিছু খায়নি।আমরা এগিয়ে যাচ্ছ আপনারা ধীরে ধীরে আসুন।”
সামিনার লাশের সাথে এসেছিল মুনির এবং তাজবীদ। তারা পৌঁছে অপেক্ষা করতে লাগলো।বাকী সবাই পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে। সেদিন দাফন করা সম্ভব নয়, কারণ সামিনার এখনো কাফন হয়নি। বিস্তৃত খোলা উঠানের মাঝে রাখা হয়েছে গাড়িটা। গাড়ির ভিতরেই এক রাত রাখা যাবে এমন ব্যবস্থা করে নিয়ে এসেছে।পুরো উঠানে আলোর খেলা চলছে।গ্রামের মানুষ আসছে, কথা বলছে। কেউ বা নিজ থেকেই কোর-আন শরীফ পাঠ করছে।
লাশ পাহাড়া দেওয়াটা গ্রামের মানুষের কাছে নতুন নয়। বাড়ির বান্ধা কাজের লোকগুলো লেগে আছে খেদমতে। রাত গড়িয়ে ভোর হতে চলল ঠিক সেই সময় নিজ রুমে ফিরলো তাশদীদ।সাগরিকা নিজ বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে এসে তার পাশে আস্তে-ধীরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে।
দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।
মুনির, শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারায় বিরক্ত ফুটে উঠেছে।
মুনির কিছু বলার পূর্বেই তাশদীদ ইশারা করে বলল বাইরে যাবে তারা। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। তাদের অপেক্ষা করতে বলে ফিরে এলো বিছানার কাছে। ঘুমন্ত মেয়েটার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
(২১৮)
এত রাতে কোনো আসামীর সাথে দেখা করার অনুমতি কারা কর্তৃপক্ষ কাউকে দিতে চান না।কিন্তু এই অনুমতি এসেছে উপর মহল থেকে।আজ বিকেলে গ্রেফতার কৃত মহিলা আসামীর সাথে দেখা করতে এসেছে কেউ।
চোখ মুখে ঘুম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুলি।সামনে রয়েছে তার ছোটো বোন।আজ দীর্ঘ পনেরো বছর পর তাদের দেখা।
বোনের দুই হাত ধরে জুলি বলল,
“এখানে কেন এসেছো? জানো না, কোনো আসামীকে অপরাধে সাহায্য করাটাও অপরাধ। তুমি কেন এসেছো?”
“তুমি আর বাবা ছাড়া আমার আর কে আছে?”
” তোমার নিজের সন্তান আছে, স্বামী আছে।”
“আমি তাদের ছাড়তে চাচ্ছি এটাও তুমি জানো।”
“না তুমি তাদের ছাড়বে না।তুমি কী ভুলে গেছো?একটা পরিবার মানে একটা রহমত।পরিবার ভাঙ্গা মানে অনেক কিছু।সামান্য ভুল বুঝাবুঝি জন্য এসব করো না।পরিবার মানেই আপনজন।”
“তাহলে তুমি কী করেছো আপু?তুমি একটা পরিবারকে ভেঙ্গে চূর্ণ করে দাওনি?স্নেহার কী হবে?”
বোনের কথায় জুলির চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।সে কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলো,
“আমি যা করেছি আমার নিজের জন্য করেছি।নিজ শান্তির জন্য।”
“যেদিন কায়সার ভাই বিয়ে করলো সেদিন তোমার ফিরে আসা উচিৎ ছিল।অথবা তাকে তোমার উপস্থিতি জানান দেওয়া।”
“সে বলেছিল হাজার মাইল দূরে থেকেও আমাকে বুঝতে পারে সে। তাই আমি কখনো তার সামনে যাইনি। তাকে পরিচয় দেইনি।”
“প্রেমে পড়ে আবেগের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিজের সব শেষ করে দিলে?”
“তুমি চলে যাও। এখন থেকে আমার কাছে আর আসবে না।বাবাকে দেখে রেখো।”
জুলির সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে এটা জেল সুপার কল দিয়ে জানিয়েছে শুভ্রকে। আর জুলির জামিনের চেষ্টা করা হচ্ছে এটা মুনিরের বন্ধু জানালো।সবটা শোনার পর তাশদীদ বলল,
“আগে কাকীর দাফন হোক তারপর বাকীটা দেখা যাবে।অন্তত এটুক নিশ্চিত করবো যেন ফাঁসি ব্যতীত অন্য কোনো শাস্তি না হয়।”
(২১৯)
সামিনাকে শেষ গোসল করানোর জন্য নেওয়া হয়েছে। কবর স্থানে কবর খোড়া সম্পন্ন করেছে। কেউ বা বাঁশ কাটছে কেউ বা খাটিয়া আনতে যাচ্ছে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিল সাগরিকা।বড়ই,নিম পাতা দিয়ে গরম পানি করা হচ্ছে। তার মা করছে সেসব।মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“মা আমি কাকী কে গোসল করাবো।”
মেয়ের এহেন কথায় চমকে উঠেছে সাগরিকার মা।ধমক দিয়ে বললেন
“এসব পাগলামো করো না।যাও ঘরে যাও। বিশ্রাম নাও।”
“আমি করাবো মা।”
“অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয় মা।এসব তুমি পারবে না।”
“যারা থাকবে তারা দেখিয়ে দিবে না হয়।”
মেয়ের এমন জেদ শুনে সাগরিকার বাবা, তাশদীদ এগিয়ে এলো।শুভ্র কড়া চোখে নিষেধ করলো।সবার কড়া আদেশ সাগরিকা পাত্তা দিলো না। সে নিজের মতামত জানিয়ে দিয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে তাশদীদ সাগরিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি জানো এমন পাগলামো করাটা বোকামী হচ্ছে।কাকীর ময়নাতদন্ত হয়েছে। তার শরীরে অনেক কাটা দাগ।”
“আপনি কী ভাবছেন আমি ভয় পাবো?”
“তুমি অনেক দিন এসব ভুলতে পারবে না।”
“আমাদের নারী জীবনটাই এমন।আজ মৃত তার শরীরের কাটা দাগ আছে এটা সবাই জানেন অথচ জীবিত থাকতে যে তার দেহে অসংখ্য অদৃশ্য কাটা দাগ ছিল?সে সব আপনাদের চোখে লাগেনি কেন?”
চলবে,,,
#এক_কাপ_চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৪৮
(২২০)
সামিনার লাশ দেখার পর আঁতকে উঠেছেন দুজন মহিলা।সাগরিকা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল লাশের দিকে। নিয়ম মাফিক লাশ কাফন পড়িয়ে বেরিয়ে এলো। তাশদীদ ভেবেছিল সাগরিকা হয়তো ভয় পাবে কিন্তু কেন যেন মেয়েটা একদম চুপ হয়ে আছে। অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে।পরদিন
সামিনার তিন দিনের কূলখানির বিকেল বেলা বাড়িতে বেশ ঝামেলা হলো।তাশদীদের মা দুই দিন পর বুঝতে পারলো যে সাগরিকা,স্নেহার জন্য সেদিন তার স্বামী রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন।রাস্তায় তার সাথে এমন দূর্ঘটনা হয়।দুপুরে খাবার খেতে আসা গ্রামের কিছু মহিলা তাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলো।তারা একে অপরে কথায় কথায় অনেক কথা বলে। যার মানে এটাই দাঁড়ায় যে সাগরিকার জন্যই তাশদীদের বাবার এমন অবস্থা হয়েছে।
আজ সকালে রিপোর্ট এসেছে সে আর কোনো দিন হাঁটতে পারবে না। স্বামীর চিন্তা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ভদ্রমহিলা নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারলেন না। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে সাগরিকাকে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করলেন।উপরি লাভ হিসেবে সাগরিকাকে আঘাত করে বসলেন।
কথাটা এ অবধি থাকলেই ভালো হতো।কিন্তু সাগরিকাকে আঘাত করার কারণে তার মা বেশ ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করলেন।ফলস্বরূপ বাড়িতে মুহুর্তের মাঝেই বেশ বড়সড় ঝগড়ার সৃষ্টি হলো।
সাগরিকা দুদিক থেকেই সামাল দিতে ব্যর্থ হলো।বাড়ির ছেলেরা যতক্ষণে এসেছে তখন জল গড়িয়ে অনেক দূর।
মেয়েটার কান কেটে রক্ত ঝরছিল, পরণের ওড়নায় রক্ত দাগ ফেলেছে অতি দ্রুতই। তার দিকে এগিয়ে এসে তাশদীদ বলল,
“কি হয়েছে? এতটা রক্ত কেন?চলো এখনি।”
কিন্তু বাধ সাধলেন সাগরিকার মা। সে তাশদীদের হাত থেকে নিজের মেয়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“তোমার মা বলেছেন, খুব দ্রুতই তোমাদের ডিভোর্স এর ব্যবস্থা সে করবে।আমরাও তাই চাই। তুমি আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকো।”
তাশদীদের কোনো কথা না শুনে মেয়েকে টানতে টানতে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন তিনি।সাগরিকার বাবার সাথেও কথা বলে লাভ হলো না।পারিপার্শ্বিক সকল পরিস্থিতি তাদের হাতের বাইরে চলে গেছে।
পুরো বিকেল তাশদীদ পুকুর ঘাটে বসে কাটালো।বাইরে থেকে তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ভিতর কিছু একটা চলছে। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।তার মা তাকে সাফ সাফ জানিয়েছে হয় সাগরিকা না হয় তার বাবা।এক দিকে বাবা তো অন্য দিকে স্ত্রী।কিন্তু পুরো বিষয়টা বেশ গোলাটে।
মাগরিবের আজানের পূর্বেই মুনির এসে তার পাশে বসলো।তাশদীদের মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে। তবুও কিছু কথা তাকে বলা প্রয়োজন। ভণিতা না করেই সে বলল,
“জেল খানার ভিতরে জুলি আত্মহত্যা করেছে।”
এমন একটা খবরের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না তাশদীদ।অস্তমিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুনিরের দিকে।
“মৃত্যুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।কারণ সে এমন একটা ড্রাগ নিয়েছে যেটা সচরাচর এ দেশে পাওয়া যায় না। এই ড্রাগ টা বাইরের দেশ থেকে আনতে হয়। চিন্তার বিষয় হচ্ছে ওকে এই ড্রাগ সাপ্লাই দিলো কে।”
“ওর সাথে গতকাল কে দেখা করতে এসেছিল?”
“ওর জন্য ঠিক করা একটা উকিল এসেছিল।আর!”
“আর?”
“আরো একজন এসেছিল কিন্তু তার কোনো পরিচয় জানা যায়নি।”
“ওর লাশের দাফনের ব্যবস্থা করিস। আর হ্যাঁ শরীয়ত মোতাবেক যেন হয়।”
(২২১)
ইখুমের বিছানায় বসে আছে সাগরিকা। কথায় কথায় মনে হলো স্নেহার অসুখের কথাটা।ডাক্তার বলেছিল স্নেহার অভিভাবক এ বিষয়ে জানেন।তাকে সামিনা এবং রাশেদ নিয়ে গিয়েছিল। রাশেদ অস্বীকার করেছে এই বিষয়ে কিন্তু ইখুম কী কিছু জানতো?
“রাঙ্গামা! স্নেহার অসুস্থতা সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?”
“কোনটা?”
“ওর হার্টে ছিদ্র আছে।”
“হ্যাঁ জানি তো।”
“কে বলেছে তোমাকে? ”
“তোমার ছোটো কাকা বলেছিল একদিন। এই তো বাবু হওয়ার আগে। কেন বলো তো।”
“তোমরা এই বিষয়টা জানতে অথচ আমাদের কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করোনি?তুমি জানো সেদিন রাতে স্নেহা মারা যেতে পারতো?কারণ স্নেহার অপারেশন এর আগের ধাপ চলছে। যদি মেডিসিন গুলো ঠিক মতোন কাজে লেগে যায় ওর আর অপারেশন লাগবে না।ওর মা মারা যাওয়ার পর ওর সব কিছু এলোমেলো, এই অল্প বয়সে এতটা আঘাত নিতে পারেনি।”
“আমি ভেবেছিলাম তোমরা সবাই এই বিষয়ে জানো।”
এই সময় রাশেদ রুমে প্রবেশ করলে সাগরিকা বলল,
“স্নেহার বিষয়টা তুমি জেনেও কিভাবে অস্বীকার করলে?”
“কোন বিষয়?”
“ওর অসুস্থতা সম্পর্কে? ”
রাশেদ গা ছাড়া ভাবে বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“ওই সময় এত কিছুর মাঝে আমার মাথায় ছিল না।তখন আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল তোমাদের নিরাপত্তা এবং মিয়া ভাইকে নিয়ে।”
রাশেদের এমন গা ছাড়া জবাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না মেয়েটা।চুপচাপ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।বের হতেই মুখোমুখি হলো তাশদীদের। বেচারার মুখ শুকিয়ে একটু খানি হয়ে আছে। সাগরিকা স্মিত হেসে তাকে বলল,
“সারা দিন নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি।রুমে যান আমি খাবার গরম করে নিয়ে আসছি।”
তাশদীদ বিনাবাক্য ব্যয়ে রুমে চলে গেল।সাগরিকা ফিরে এসে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
“মায়েদের কথা চিন্তা করবেন না।তারা ঠিক সকাল বেলায় মিলে যাবে।”
“আর কিছুই ঠিক হওয়ার নেই।”
” মানে?”
“আগামীকাল তোরা এখান থেকে ঢাকা চলে যাবি।হোটেল বুকিং করা আছে। দুদিন পর তোদের ফ্লাইট।”
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“আমরা নয় তোরা। তোর সাথে যাবে কাকা কাকী আর স্নেহা।”
“আর আপনি?”
“আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
ভাতের প্লেটে সাগরিকার হাত থেমে গেল।দুই চোখের পানি ছলছল করছিল।সে প্রতিবাদ করে বলল,
“আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”
“ডিভোর্স এর থেকে সাময়িক বিচ্ছেদ কী ভালো নয়?”
“আরে অন্যের ঝগড়ায় আমরা কেন ভুক্তভোগী হবো?”
“আমার কথাটা শোনো, সিংগাপুরে তোমার মেডিক্যাল এডমিশন হয়েছে। এমন পরিস্থিতি না হলে হয়তো আমি নিজেই যেতাম। কাকা-কাকী নয়, কিন্তু এখন পপরিস্থিতি ভিন্ন।আমার এখানে প্রয়োজন।এদিকটা সামলে উঠলে আমি নিজেই যাবো।মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার।”
সাগরিকা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।সে জানে এখানে তার সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য নেই।হয়তো তাশদীদ এখন তাকে ছেলে ভোলানো রূপকথা শুনাচ্ছে।
(২২২)
এরপর?
এরপর কেটেছে তিনটে বছর। তিনটে বছরে তাশদীদ এর সময় হয়নি সাগরিকার কাছে ফিরে আসার। তাদের গল্পটা যেন থমকে আছে। একটা সময় ফোন কলে দীর্ঘ সময় কথা হতো।এখন এটাও হয় না।দিনের তিনটে বেলা নিয়ম মাফিক দুটো মিনিট করে কথা হয়। খুবই সাধারণ সেসব কথা। কি করছে, কী খেয়েছে এসব।
কেমন আছে অপর পাশের ব্যক্তিটা? এই কথাটা জিজ্ঞেস করার ও সময় হয়নি তাশদীদের। সাগরিকা প্রথম দিকে মানিয়ে না নিতে পারলেও ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে নিয়েছে। তার বাবা এখানে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর কিনেছিলেন।বেশ ভালোই চলছে এটা।যদিও লোক রাখা আছে তবুও সাগরিকা নিয়ম মাফিক দোকানে কাজ করে। বাকী স্টাফদের মতোই। লেখাপড়ার ব্যস্ততা তো রয়েছেই।স্নেহাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল।এখানে তার চিকিৎসা বেশ ভালো ভাবেই হচ্ছে। এখানের সবাই জানে সাগরিকা, স্নেহা আপন বোন।
গতকাল রাতে ইখুমের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়েছিল।বাড়িটা আগের মতোন নেই।অনেক বদলেছে। ইখুমের ছেলেটা ছোটো ছোটো স্বরে কথা বলে। দাদী পুরোপুরি শয্যাশায়ী।এবার সত্যি সীমার বেবি হবে।তাশদীদের বাবা এখন কিছুটা সুস্থ আছেন। তার চিকিৎসা চলছে।তুলির বিয়ে হয়েছে গত বছর।সাগরিকার ইচ্ছে ছিল বিয়েতে যাওয়ার। কিন্তু তাশদীদ একবারও যেতে বলেনি।অভিমানী সাগরিকা নিজেও বলেনি।মৌসুমিদের খবর সাগরিকা জিজ্ঞেস করে না।কারণ সে জানে তাশদীদ এবং মৌসুমি অনেকটাই একান্ত সম্পর্কে আছে। হোক সেটা ব্যবসায়ী কাজের ক্ষেত্রেই।সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্ট গুলো কিংবা ছবি দেখে তার এটাই মনে হয়।
হয়তো এটাই কারণ তাশদীদ ফিরেনি তার কাছে। তাদের সম্পর্কটা ইদানীং মাত্রই নাম মাত্র। তবুও
তার দিন কাল তো থেমে নেই।চলছে বেশ।মাঝেমধ্যে তাশদীদের জন্য কোথাও একটা কমতি অনুভব হয়। এখানে আসার পর বাবার থেকে শুনেছিল সে,
তাশদীদ তার হাতে ধরে বলেছিল সাগরিকাকে নিয়ে চলে যেতে। কারণ সে চায় সাগরিকা নিজের পায়ে দাঁড়াক।মানুষ তাকে নিজের নামে জানুক।সংসার নামক গন্ডিতে আগেই বাধা না পড়ুক।
সাইকেল চালিয়ে সাগরিকা ফিরে এলো নিজেদের
বাবার দোকান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছে তাদের বাড়ির সামনে থাকা পার্কে।এখানে স্নেহা ব্যস্ত কারোর সাথে পড়া নিয়ে কথা বলায়। সাগরিকাকে দেখে হাত ইশারায় সে বলল তার আরো কিছু সময় লাগবে। অগ্যতা সাগরিকা কানে হেড ফোন গুঁজে গান শোনায় ব্যস্ত। গুনগুনিয়ে সে গাইছিল,
Your love, your love,your love I miss that
Your love,your love, your love I want that
ঠিক সে সময় ভূত দেখার মতোন চমকে উঠলো সে। তার পাশে তাশদীদ বসে আছে।মিনিট দুই চুপচাপ বসে থেকে তাকাতেই দেখতে পেল কেউ নেই।সাগরিকার বেশ মন খারাপ হলো।না চাইতেও সে ভেবে বসেছিল তাশদীদ সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসেছে।কারণ কাল তাদের বিবাহ বার্ষিকী।
তাশদীদ কে কল দিতেই ব্যস্ত করে দিলো।ম্যাসেজ এলো তাজবীদের। তারা মিটিংয়ে ব্যস্ত। দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো সাগরিকার চোখ বেয়ে। স্নেহার কাজ শেষ হলে তাকে নিয়ে ফিরে এলো ফ্ল্যাটে।
চুপচাপ নিজের রুমে দরজা চাপিয়ে ঘুম দিলো সে। মনে মনে কিছু ভয়ংকর সিদ্ধান্তও নিয়ে বসলো।
গভীর রাতে তার অনুভব হলো কেউ নয় কয়েকজন হাঁটছে তার ঘরের বাইরে।ফোনের লাইট জ্বালিয়ে সাগরিকা দেখতে পেল কেউ নেই।তন্দ্রাভাব আসতেই কারোর চিৎকারে উঠে বসলো সে। বেড সুইচ চাপ দিতেই পুরো ঘর আলোকিত হলো।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাজবিদ, সীমা, ইখুম,রাশেদ সমেত পরিবারের সবাই। আর তার পাশে বসে আছে তাশদীদ। সাগরিকা সবাইকে দেখে হতভম্ব হয়ে বসে রইল।তার যেন ঘোর কাটতেই চাইছে না। তাদের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে সবাই এসেছে তাকে সারপ্রাইজ দিতে। সবার সাথে কথা বললেও সাগরিকা তাশদীদ কে এড়িয়ে চলছিল।তার কাছে এমন কোনো সারপ্রাইজের মূল্য নেই যে সারপ্রাইজের পূর্বে থাকে অসহনীয় যন্ত্রণা।
রাত দুটোর সময় যার যার রুমে ফিরলো সবাই।সাগরিকা অপেক্ষা করছিল রুমের বাইরে। তাশদীদ রুমে ফিরেছে অনেক আগেই।বার বার দরজার কাছ থেকে ফিরে আসছে সে। দরজার নবে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল।সে হুড়মুড়িয়ে পড়লো তাশদীদের সামনে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“এটা আমার রুম।আমার নিজের বালিশ ছাড়া ঘুম আসে না। তাই নিতে এসেছি।”
বিনাবাক্য ব্যয়ে তাশদীদ পাশ কেটে দাঁড়ালো।সাগরিকা দুই মন দুই দশা করে বালিশ নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় তাশদীদ তার সাথে প্রথম কথা বলল,
“তুই কি নিশ্চিত বাইরে ঘুমাবি?”
সাগরিকা কিছু না বলে বেরিয়ে আসছিল সে সময় তার হাত আকড়ে ধরে বলল,
“আগামীকাল সবাই সমুদ্রসৈকত দেখতে যাবে।”
“আমার ক্লাস আছে।আমি ঘুমাবো।”
“দশ মিনিট সময় দিলাম।তৈরি হয়ে বাইরে আয়।না হলে একদম মেরে পা ভেঙ্গে কাঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে ঢাকার অভার ব্রীজের নিচে থালা হাতে বসিয়ে দিবো।”
“আমি যাবো না। আপনি আমার কে?আমি বিচ্ছেদ চাই।সম্পর্কে তিক্ততার সাথে থাকার থেকে বিচ্ছেদ ভালো।আমি তিক্ততা সইতে পারবো না।”
পরিশিষ্টঃ
সকালবেলা নাস্তার টেবিলে তাশদীদের লেখা চিরকুট পেলো বাকী সবাই।আপাতত দেশ ভ্রমণ শেষে তাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে।
সাগরিকার যখন ঘুম ভাংলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলো পানির মাঝে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে মাঝ সমুদ্রের দিকে।হুট করেই তার মনে হলো,
তাশদীদ একদিন বলেছিল, অধিক ভালোবাসার জিনিস সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে ভালো লাগে তার। তবে কী তাকে?
দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে নিজের মনকে রাজি করাতে ব্যস্ত সে। তার পাশে তাশদীদ বসে বলল,
“এক কাপ চা বানিয়ে আনো তো।”
চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই তাশদীদ টুক করে অধর স্পর্শ করলো মেয়েটার অধরে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তুমি আমার সকাল বেলার এক কাপ চা
যাকে ছাড়া আমার দিনের শুরু কখনোই ভালো হয় না।সারা জীবন এইভাবেই পাগলামো করবে তো আমার সাথে? হ্যাঁ শুধুই আমার সাথে। কারণ এই আমি আমার চায়ের ভাগ কাউকে দিতে পারবো না।”
সমাপ্ত
(অনেক দিন অপেক্ষার পর শেষ হলো #এক_কাপ_চা। আর পাঁচটা গল্পের মতোন করতে চাইনি।শুরুতে ইচ্ছে ছিল একটু কষ্ট দিব।কিন্তু আপনাদের তাশদীদ সাগরিকাকে আলাদা করার ইচ্ছে হলো না।কেমন হয়েছে জানাবেন।আর হ্যাঁ অবশ্যই রেসপন্স করবেন। কারণ শেষ পর্ব সবাই যেন পড়তে পারে।)