#এক_কাপ_চা
#পর্ব-৪৩+৪৪
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(২০৮)
রাতে খাবার টেবিলে সাগরিকা বেশ চুপচাপ বসে আছে।তার মাথার রেলগাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে।রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়ির কথা মনে হচ্ছে বার বার। পুরো ট্যাংক খালি হয়ে ফুয়েল গড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশে। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। কয়েক দিন আগেই তাশদীদ তার গাড়ি চেক করিয়েছে। তাছাড়া তারটা এমন ভাবে কাটা মনে হচ্ছে কেউ ব্লেড দিয়ে খুব যত্ন সহকারে কেটেছে।
অথচ গাড়ি বাসার গ্যারেজে ছিল রাত থেকে।
ভ্রু-কুঁচকে সাগরিকা তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মাছের বাটির দিকে।নিজের ঠোঁট কামড়ে সে মনে মনে ভাবলো,
“তাশদীদের ক্ষতি কে করতে চাইবে?”
ফ্রেশ হয়ে তাশদীদ সাগরিকার পাশে বসতেই দেখতে পেলো সাগরিকা বেমালুম ভুলে বসে আছে তাকে। তার বাম হাত নিচে নামিয়ে সাগরিকার ওড়নার কোনা ধরে টান দিলো।মেয়েটা তাকাতেই ভ্রু-বিলাস করলো সে।
প্রতি উত্তরে তার স্ত্রী দু চোখের ভাষায় আস্বস্ত করলো সে ঠিক আছে।লোকচক্ষুর আড়ালে হাত বাড়িয়ে শক্ত হাতে ধরব নিলো তার হাত।
সাগরিকার ডান পাশে তাশদীদ বসেছিল, হুট করেই বাম পাশে এসে বসে পড়লো শুভ্র।তাদের দিকে তাকিয়ে প্রানখোলা হাসি দিয়ে বলল,
“বৌ কি আর কারোর নেই?খাবার সময় অন্তত হাত ছাড়ো।”
প্রসঙ্গে তাশদীদ সাগরিকার হাত টেবিলের উপর রেখে বলল,
“বৌ আমার আমি যা ইচ্ছা করবো।”
“নাউজুবিল্লাহ্!”
সাগরিকা আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিলো তাশদীদের হাত থেকে। বোকা বোকা হাসি দিয়ে শুভ্রর উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাত খেয়েছো?না কী সালাদ খাবে?”
“তোর যা ইচ্ছে হয় দে। আমার আপত্তি নেই।”
খাবার বেড়ে শুভ্রর সামনে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসলো সে। তাশদীদের হাত ততক্ষণে প্লেটে থেমে গেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরিকার দিকে। এক সাথে বসে খাবার সময় কখনো তো সাগরিকা তাকে এক টুকরো মাছ তুলে দেয়নি তার প্লেটে কিংবা এক টুকরো লেবু?অথচ শুভ্রর সাথে ওর কি মিল!
নিজের রাগ কে দমিয়ে রাখতে চেয়েও পারলো না সে। এই মেয়েটার ক্ষেত্রে এসেই তার পুরো মস্তিষ্ক বন্ধ হয়ে যায়। রোবট রোবট লাগে তার। অথচ সে অবশ্যই একজন গোছানো স্বত্বার অধিকারী।প্লেটে পানি ঢেলে দিতে দিতে তাশদীদ বলল,
“তুই হঠাৎ এখানে? তোর চলে যাওয়ার কথা ছিল।”
“বোনের বিয়েতে ভাই থাকা স্বাভাবিক নয় কী?”
“আমি আবার ভাবলাম তুই বুঝি কারোর মায়ার টানে রয়ে গেলি।”
“আমি তো পড়েছিই মায়ায়। কারোর মায়ায় পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছি আমার এই নষ্ট, ব্যর্থ জনম।”
তাশদীদ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে নিজ কক্ষে ফিরে এলো।পিছন থেকে সে শুনতে পারছিল শুভ্র এবং সাগরিকার মৃদুস্বরে ঠাট্টার স্বর। হাতের কাজ শেষ করে রুমে ফিরে সাগরিকা দেখলো তাশদীদ ঘুমিয়ে পড়েছে। পা টিপে টিপে হেটে এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। তাশদীদের দু হাতের বন্ধনে নিজেকে বন্দী করে ফিসফিস করে বলল,
“এত হিংসুক কেন আপনি?আপনারো কি আমার মতো ভয় হয়? যখন অন্য কারোর সাথে থাকলে?ইচ্ছে করে লুকিয়ে রাখতে?”
তাশদীদ কিছু বলল না। একটা ক্লান্তিকর দিন শেষ হলো প্রশান্তির মাধ্যমে।তুলতুলে অনুভূতি হচ্ছে তার বুকের মধ্যে।বিনিময়ে শুধু তার হাতের বন্ধন শক্ত হলো।আর সাগরিকার মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি তাকে নিজের বুকের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলে তাশদীদ!
(২০৯)
স্নেহার মামাতো ভাই আজ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তার মামী কল দিয়ে যা তা শুনিয়ে দিলো সামিনাকে। দোষটা স্নেহাকে দিয়ে সে বলল স্নেহার পোশাক খারাপ। ছোটো ছোটো জামা পড়ে। খালি গায়ে থাকে তবে কোনো ছেলে হাত বাড়ালেই তার দোষ হবে কেন?আগে নিজের মেয়েকে সামলানোর উপায় জানতে হবে তার। একজন মা যেমন চাইলে সন্তানকে ভালো করতে পারে তেমনি খারাপ ও করতে পারে। বাকী জীবনে যেন সামিনা তাদের বাড়িতে না যায়।
তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে।
পুরোটা সময় সামিনা চুপ ছিল।গত কয়েক দিন যাবত তার শরীর ভালো না।হয়তো কোনো বড় রোগ ব্যধিতে ধরেছে তাকে। নিজের ক্লান্ত শরীর বইতে বইতে আজ আর পারছে না।এদিকে আজ শাশুড়ি বাড়ি ফিরেছে। সে এসে এক বারের জন্যএ তাকে ডাকেনি।জানে না সে আগামীকাল কি হবে? তাকে আবার কেউ জোর করবে কি না? এবার আর কারোর কথায়, অন্যের যুক্তিতে নিজের ভবিষ্যৎ ভাববে না সে। কিন্তু পর মুহুর্তেই থমকে গিয়েছিল সে৷
এক সময় তার এবং রাশেদের বিয়ের কথাতে সম্মত জানাতো, আজ তারা সবাই চাইছে রাশেদ আইনী ভাবে স্নেহার বাবার দায়িত্ব নিক।
ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তার। পাশে শুয়ে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ঝরতে লাগলো তার।
এই মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই।তার করা পাপ গুলোর শাস্তি তার মেয়ে পাচ্ছে। অথচ তার কিছুই করার নেই। এমন সময় দরজায় নক করে প্রবেশ করলো জুলি।এই কয়দিন হাসপাতালে থেকে তার চেহারা,স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি ঘটেছে। এক গ্লাস দুধ হাতে সামিনার পায়ের কাছে বসলো সে। দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মেলা শুকাই গেছ বৌ। এত শুকাইছো কেন?”
“কোনো দরকার আছে আপনার? না থাকলে আসতে পারেন।”
“আমি কি তোমার ক্ষতি চাই?”
সামিনা যথেষ্ট চেষ্টা করছে জুলিকে এড়িয়ে চলতে।এই মহিলাকে নিয়ে তার ইদানীং বেশ সন্দেহ হয়। অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। সে খুব সহজেই তার যুক্তিতে অন্যদের সামিল করতে পারে। সামিনাকে মানতে বাধ্য করে তার সকল কথা৷
“কোনো প্রয়োজন?”
“দেখো, আগেই কইছি। এরা ভাইয়েরা মিলা তোমার হক মারতে চাইবো।তোমার স্বামীর প্রতি তোমার হক এরা নষ্ট করে নাই?যে বছর স্নেহার বাবা বিদেশ গেল তোমারে বাড়িতে রাইখা, সেইবার কি সে যাইতে চাইছিল?চায় নাই কিন্তু। রাশেদরে পাঠাইতে চাইছিল।অথচ সে গেল না।কেন গেল না? কারণ সে তখন প্রেমে মজছে। বাড়ির সবাই কইলো বেতন ভালো, আবার যাও। কয়েক বছর থাইকা আসো। বেচারা গেল আর ফিরলো না।কোম্পানি তার নামে কোটি টাকা পাঠাইলো। কয় টাকা দিছে তোমারে?”
“আমার নামে ব্যাংকেই রাখা আছে।”
“হু আছে। ঘোড়ার ব্যাংকে আছে।সেই টাকা দিয়া ওরা ব্যবসায় লাগাইয়াই আজ এত কিছু করলো।বাইচা থাকতে তো দিছেই বেচারা মরার পরেও ভাইগো দিয়া গেল।”
সামিনা কিছুই বলল না।হাতে থাকা শূন্য দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে সে। জুলির বলা কথা গুলো তার কাছে কোনো সুরের মতোন লাগছে। অনুরনন তুলছে তার মস্তিষ্কে।তার দুই চোখ ভারী লাগছিল।মন্ত্রমুগ্ধের মতোন সে বসে রইল বিছানার উপর।
“শুনো, ওরা তোমারে কিছুই দিব না।কাল সকালে তুমি এই বাড়ির ভাগ চাইবা।বুঝছো?আমি আসি তুমি ঘুমাও।”
জুলি চলে যাওয়ার বেশ কিছু সময় পর সামিনা বসে রইল। স্নেহার জন্য নিয়ে আসা গ্লাসটা হাতে ধরে বসে আছে সে। ভুল বশত স্নেহার গ্লাসটার দুধ খেয়ে ফেলেছে সে। ধীরে ধীরে তার মাথাটা ভার হয়ে এলো।বমির ভাব হতে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো সে। অথচ পৌঁছাতে পারলো না।পড়ে গিয়ে নাক, মুখ দিয়ে রক্ত চলে এসেছে তার।মনে হচ্ছে তার বুক জ্বলে যাচ্ছে দুধটা খাওয়ার পর।
ধীরে ধীরে দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। সাহায্যের জন্য প্রাণপণে কাউকে ডাকতে চাইলেও পারলো না।
তার মনে হচ্ছিলো সে মরে যাচ্ছে। অথচ অবচেতন মনে শুনতে পেল কেউ তাকে বলছিল,
“ব্যর্থ জীবন থেকে মুক্তি পাচ্ছিস। ভেবে দেখেছিস? যদি তোর চোখের সামনে তোর ছোট্ট স্নেহা এভাবে ছটফট করতো?”
চলবে,,,
#এক_কাপ_চা
#পর্ব-৪৪
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(২১০)
একটা মৃত্যু, একটি জীবনের শেষ। অথচ মৃত্যুতেই মুক্তি। তবুও মৃত্যু মেনে নিতে আপনজনদের কষ্ট সব থেক্র বেশি হয়।
আপনজনের মৃত্যুতে আমরা কিংবা আমাদের অবচেতন মন বার বার প্রার্থনা করে, আমাদের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দান করার জন্য।
সামিনার মৃত্যুর সাত ঘন্টা পর তার ঘর থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর সামিনার মৃত্যু হয়। সকালে স্নেহা ঘুম থেকে উঠে তার মা কে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভেবেছিল তার মা রাগ করে ফ্লোরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু মায়ের কাছে যেতেই দেখতে পেল ফ্লোর লাল হয়ে আছে।
স্নেহার চিৎকারের শব্দ শুনে সাগরিকার মা দ্রুত দৌড়ে এলেন।ফ্লোরে রক্তের ছাপ দেখে আঁতকে উঠেছেন তিনি।ভদ্রমহিলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।ঘাবড়ে না গিয়ে স্নেহাকে কোলে তুলে নিলেন।হাত বাড়িয়ে নাকের কাছটায় নিতেই বুঝলেন তার সামনে নিথর দেহে পড়ে রয়েছে সামিনার লাশ।
ততক্ষণে বাড়ির বাকী সবাই চলে এসেছে। তাশদীদ কল করে ডাক্তার ডাকলেন।কিন্তু সামিনাকে স্পর্শ করতে দেয়নি শুভ্র। তার সন্দেহ হচ্ছে, সন্দেহ ধীরে ধীরে গাঢ় বর্ণ ধারণ করছে।সামিনার মৃত্যু অবশ্যই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না তার।বিশেষ করে গতকাল রাতে সাগরিকার বলা কথা গুলো শুনে তার সন্দেহ আরো বেড়ে চলেছে।
বাড়ির সবার মুখ থমথমে অবস্থা। স্নেহাকে তুলির সাথে তার বান্ধুবীর বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডাক্তার আসার পূর্বেই শুভ্র তাশদীদ কে বলল,
“পুলিশে খবর দেওয়া উচিৎ। আসলে উচিৎ নয়, বাধ্যতামূলক।”
“এখন পুলিশ মানে ঝামেলা নয়?স্পষ্ট দেখে বুঝা যাচ্ছে যে ওয়াশরুমে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু পারেনি। বমি করেছে, মাথা ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এমন হয়েছে।”
“এজন্যই পুলিশ প্রয়োজন।মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া ডাক্তার আসতে পারলে পুলিশ কেন পারবে না?কল টা কী তুই দিবি? না আমি?”
পুলিশ এসে সামিনার লাশ নিয়ে গেল।পোস্ট মর্টেম
রিপোর্ট আসার পর সামিনার মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। পুরো সময় বাড়ির ভিতরে একজন মানুষও প্রবেশ করতে দেয়নি। কিংবা আশেপাশের বাড়ির কেউ জানতে পারেনি মৃত্যুর ব্যাপারে।
পুলিশ আসার পর সামিনার মৃত্যুর খবর বাতাসের বেগে সব দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশের মানুষের নানান ধরনের মন্তব্য। কেউ বলছে অসুস্থ ছিল আবার কেউ বলছে আত্মহত্যা।
প্রাথমিক সুর হরতালে পুলিশ জানালেন এটা নিছক দূর্ঘটনা মাত্র।
পুরো দিনের ক্লান্তি এবার বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে তাশদীদের। কিছু কারণ বশত মৌসুমির এ বাড়িতে আসাটা বন্ধ ছিল। তবে আজ সে সামিনার মৃত্যুর বাহানায় এ বাড়িতে ফিরেছে।তাদের কারোর মন মেজাজ এতটা ভালো ছিল না যে সে তার মায়ের সাথে কেমন ভাবে কথা বলছে এটা দেখবে। পুরো দিন বাসায় কিছুই রান্না হয়নি।সকালের চা -নাস্তাটাও টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে।
সীমার ডাকে সাগরিকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো।সামিনাকে দেখা শেষ চেহারাটা সে ভুলতে পারছে না।স্নেহার কি হবে এটা ভেবেই তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজের মা-বাবা ছাড়া একটা দিন যেখানে কল্পনা করা তার জন্য কষ্টকর সেখানে স্নেহার মা-বাবা কেউ রইল না।বাবা ডাকটা সে ছোটো বেলায় মুখে বুলি ফোটার আগেই হারিয়েছে আজ মা ডাকটাও হারিয়ে গেল তার।
কিন্তু কারোর মৃত্যুতে কিছুই থেমে থাকে না।পরিবারের শোকের সময় দায়িত্ব আরোও বেড়ে যায়। নিজের দুঃখ কে চাপা দিয়ে হলেও এগিয়ে যেতে হয়। এটাই নিয়ম,পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট নিয়ম।
নাস্তার টেবিল পরিষ্কার করে সীমা চুলোয় চা বসিয়ে দিলো।সাগরিকা সকল প্লেট, গ্লাস পরিষ্কার করে অন্য চুলোয় ভাত বসিয়েছে। আগামী তিন দিন তারা মাছ, মাংস খাবে না।এই নিয়ম কেন এটাও তারা জানে না।তবে ছোটো বেলা থেকে দেখে আসছে, কেউ একজন মারা গেলে মৃত বাড়িতে সেদিন ডাল,আলু ভর্তা,করল্লা ভাজি কিংবা শুক্তার পাতা নামক এক ধরনের খাবার দেওয়া হয়।
সীমা রান্না ঘরে ব্যস্ত ঠিক সে সময় সাগরিকা বাইরে সবাইকে চা দিলো।সামিনার জন্য কেউ কাঁদছে না।সবার শুধু একটু মন খারাপ।এই বিষয়টা সাগরিকাকে অল্প বয়সেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিলো।আজ সামিনার মা বেঁচে থাকলে হয়তো মেয়ের জন্য কাঁদতেন।
স্নেহা তাশদীদের কোলে ঘুমিয়ে আছে। তার দিকে চা এগিয়ে দিতেই সে বলল,
“রুমে এসো।স্নেহাকে শুইয়ে দিতে হবে।”
নিজ রুমে ফিরে তাশদীদ দেখতে পেলো তাদের বিছানায় মৌসুমি ঘুমিয়ে আছে।মেজাজ খারাপ হলেও তাশদীদ বিষয়টা এড়িয়ে গেল।স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।সাগরিকার ঘরে, তার বিছানায় শুইয়ে দিলো।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে ইশারা করে বসতে বলল।
” কিছু বলবেন?”
“একবার ভেবে দেখেছিস? যদি সত্যি মেঝ কাকী আত্মহত্যা করে তবে এর দায়ভার কার?পুরোটাই আমাদের।”
“আমাদের কেন?”
“তার প্রতি ইদানীং আমাদের পরিবারের ব্যবহার চিন্তা করেছিস?ডিপ্রেশনটা কী স্বাভাবিক নয়?তার ব্যাংকে টাকা ছিল অথচ টাকা তুলতে হলেও আমাদের লাগতো। নিজের ইচ্ছা, শখ সব ত্যাগ করেছিল কেবল মাত্র স্বামী নেই বলে।”
“হুম।তার করা ভুলগুলো না হয় ভুলে যাই আজ।মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কটু কথা নাই বা বলি।”
“সাগরিকা এবার তোর নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করা উচিৎ।”
“আমার জীবন মানেই তো আপনি।এই কাজে আমি পারদর্শী।”
“আমি চাই না তোকে কেউ তাশদীদের স্ত্রী কিংবা আমাদের সন্তানের মা বলে জানুক।আমি না থাকলেও তোকে চলতে হবে। জীবনের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।”
সাগরিকা ফ্লোরে বসে তাশদীদের দুই হাত আবদ্ধ করে বলল,
“কী ভাবছেন?”
“আজ যদি কাকী স্বাবলম্বী থাকতো, নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে জানতো তবে তার পরিণতি এমন হতো না।”
সাগরিকা নিশ্চুপ রইল।তাশদীদের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো সে। এই মানুষটা ছাড়া সে যে অচল হয়ে যাবে। তবুও এই মানুষের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিবে।তাশদীদ উবু হয়ে থুতনি ঠেকালো পিঠে।
তপ্ত শ্বাস এসে পড়লো মেয়েটার দেহে।এরপর সে ফিসফিস করে বলল,
“তুই আমার প্রভাতের এক কাপ চা হয়ে যা, আমি প্রতি চুমুকে না হয় তোকেই চাইবো।”
(২১১)
রাতের সকল কাজ শেষ করে সাগরিকা নিজ রুমে ফিরে দেখতে পেল মৌসুমি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাশদীদ বিছানায় বসে আছে তবে তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। সাগরিকা কাছাকাছি আসতেই সে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়, সকালে কথা হবে।”
বিনাবাক্যে স্নেহার পাশে বসে তার গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলো সে।পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তাশদীদকে কিছু বলার পূর্বেই স্নেহা ঘুমের মাঝেই বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিলো। তড়িঘড়ি করে তাশদীদ উঠতেই খাটের সাথে পা লেগে বেশ ব্যথা পেলো সে। তবুও স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।রাত তখন এগারোটা, হুট করেই থানা থেকে কল আসার কারণে বেরিয়ে যেতে হয়েছে রাশেদ এবং তাজবিদ কে। সাগরিকার বাবার হঠাৎ করে প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল সে ঘুমে। বাধ্য হয়েই তাশদীদ এবং সাগরিকাকেই যেতে হবে হাসপাতালে। ব্যথার কারণে তাশদীদের হাটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়েই শুভ্রের সাথে যেতে দিতে হলো সাগরিকাকে।স্নেহার অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল।সবে মাত্র বাড়িতে একটা মৃত্যু হয়েছে। শুভ্ররা বেরিয়ে যেতেই তাশদীদ ফিরে এলো নিজ রুমে।ব্যথা উপশমের জন্য খাওয়া মেডিসিনের কারণে ঘুম নেমে এলো তার দুই চোখে।
(২১২)
“এই শেষ সময়ে এসে আপু তুমি এত বড় ভুল কী করে করলে? এবার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে তো সবাই বুঝে যাবে।”
“আমি সামিনাকে কিছু দেইনি।”
জুলির উত্তরে ফোনের অপর পাশ থেকে তার বোন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
“আমার মনে হচ্ছে না। তুমি নিশ্চয়ই রাগের বশে এমন করেছো।কারণ দুই দিন পরেই…..”
“আমি দেইনি। আর দিলেও বা কী?আমি চেয়েছি এই পরিবারের সর্বোচ্চ ক্ষতি।”
“পেরেছো কী?আজ থানায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে স্নেহার মামাতো ভাইকে কে ছাড়িয়েছে।শুভ্র নামের একটা ছেলে এসেছিল খোঁজ নিতে। তোমার কী মনে হচ্ছে না এরা দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেলবে?খুব দ্রুত তোমার বিপদ আসবে।অনেক হয়েছে
প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অন্যায়কারীর ক্ষতিসাধন।আর নয়, আমি টিকিট কেটে রাখছি।তুমি বাবার কাছে ফিরবে।”
“আমি ফিরতে পারবো না রে। আমার শান্ত জীবনটা এই পরিবার নষ্ট করে দিয়েছে। আমি আমার জীবনের পনেরোটা বছর নষ্ট করেছি।এই বাড়ির থালা বাসন ধুয়েছি, সব করেছি।বাবার স্নেহ, আদর, ভালোবাসা আমার জীবনের সফলতা সব ত্যাগ করেছি।তাই এই মুহুর্তে আমি ফিরতে পারবো না।”
“কিন্তু ওরা?”
“সামিনার মৃত্যুকে ঘুরিয়ে দিতে হবে অন্যের শোক দিয়ে। সামিনার মৃত্যু ওদের ওতটা শোক দেয়নি।যতটা অন্যের মৃত্যু দিবে।সাগরিকা,শুভ্র স্নেহা কে নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে।ওদের কিছু হলেই পুরো পরিবার ভেঙ্গে যাবে। সেই সময় ভদ্রমহিলা বুঝতে পারবে, ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু কতটা যন্ত্রণার হয়।”
রান্নাঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাশদীদের বাবা শেষের কথা গুলো শুনতে পেলো।কোনো শব্দ না করে বেরিয়ে এলো সন্তর্পণে।
আপাতত তার কাউকে কিছু জানানোর সময় নেই। তাকে খুব দ্রুত পৌঁছাতে হবে তার কলিজার টুকরোদের কাছে।
চলবে,,,,