#কৃষ্ণপক্ষের_চাঁদ
#পর্ব :০৯
#JannatTaslima(writer)
‘
‘
‘
সূর্য ডুবেছে বহুৎ ক্ষণ আগে।আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা।ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে বৃহৎ আকাশ আর কতখানি দেখা যায়। মনে হচ্ছে ব্যাঙের মতো ছোট্ট গর্তে বসে বিশাল পৃথিবী দেখছি।মাগরিবের নামায পড়ে অল্প তেলওয়াত করছিলাম,ক্ষীণ মাথা ব্যথা অনুভূত হতে ওঠে আসলাম।পেছনে হাত রেখে তাসবীহ জপছি আর জানালা দিয়ে প্রকৃতি বিলাস করছি।প্রদোষ কালীন গগণপাণের লালা আভা যেন লজ্জাবতী নতুন বৌয়ের রক্তিম মুখ মন্ডল।মাথা ব্যথা যেন সময়ের সাথে প্রগাঢ়তা পাচ্ছে। আমার তার একটা ঔষধ জানা আছে।তা হলো এক পেয়ালা চা।চাদঁনি বোধহয় সানজুর সাথে ফোনালাপ করছে।ধীরপায়ে রসুইঘর অব্দি চলে এলাম।চুলায় চায়ের পানি চড়িয়ে দিচ্ছি হঠাৎ হালকা বাতাস অনুভূত হলো।রসুই ঘরে কেউ এসেছে, ভাবলাম চাদঁনি হতে পারে। পেছন ফিরতে দৃষ্টিগোচর হলো চন্দ্র। তিনি যেন এই মুহূর্তে আমায় এখানে আশা করেন নি।তিনি আমতা আমতা করে বললেন,
–আপনি! আমি ভেবেছিলাম চাদঁনি।
–কিছু লাগবে আপনার?
–ইয়ে মানে চা!
–চা খাবেন,আচ্ছা আমি চায়ের পানি চড়িয়েছি আপনাকে এক কাপ দেবো।
–আপনি দিবেন,(বলে ইতস্তত হতে লাগলেন)
আমি বুঝতে পেরে বললাম,
–কেনো আপনার কোনো সমস্যা।
–না সমস্যা নেই।ওকে আমার রুমে নিয়ে দিয়েন তাইলে।
–আচ্ছা।
যাক বাবা এই বাসায় প্রথম কারো চায়ের প্রতি আগ্রহ দেখলাম।আমি মনে করে ছিলাম তারা কেউ হয়তো চা পচ্ছন্দ করে না।এই বাসায় সবকিছু ভালো লাগলেও একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগে। সেটা হলো,এখানের সবাইকে খুব যান্ত্রিক মনে হয় আমার।একই বাসায় থাকে তবুও কী দূরত্ব সবার মাঝে।সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।এই দুই আড়াই মাসে তাদের কখনো একসঙ্গে আড্ডা দিতে দেখি নি।আমাদের বাড়িতে সব সময় গুমোট পরিবেশ থাকলেও সন্ধ্যাবেলা একটা চায়ের আড্ডা পরিবেশটাকে মুখরিত করে তুলতো।পুরুষেরা বসার ঘরে বসতেন আর মহিলারা রসুই ঘরে।চায়ের পাশাপাশি হালকা নাস্তারও ব্যবস্হা থাকতো।চাচাদের আলোচনা শুরু হতো পারিবারিক বিষয় নিয়ে আর রাজনৈতিক বিষয়ে গিয়ে ঠেকতো।আর এক ঘরে দুই দলের লোক হলে তো কথাই নেই,সংসদে বাজেট অধিবেশন বসে গেছে।আমার আড়াল থেকে সেগুলো শুনতে মজাই লাগতো।কোনরকম বড় চাচার চক্ষুগোচর হতেই, তিনি কালবিলম্ব না করেই হুংকার ছেড়ে দিতেন।আমি, আদনান,আরিয়ান আর মারওয়ান ওড়ে এসে টেবিলে বসতাম।তাতে মুন্নী আর মনিরা আপুর বই দিয়ে মুখ গোজে ঘুমানোতে ব্যাঘাত ঘটতো।রাগে তাদের চোখ গুলো রক্তবর্ণ ধারণ করতো এতোক্ষণের লোক দেখানো পড়ার অবসান ঘটলো বলে।সেই দিনগুলো কী রঙিনই না ছিল। চা হয়ে গেছে দুধ চিনি মিলিয়ে এক পেয়ালা চা নিয়ে চন্দ্রের কক্ষের দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে আছি।গতমাসের শেষ তারিখে ঠিক এইভাবে কলম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম, আর আজ চা নিয়ে।সেদিনের মতো আজও করাঘাত কীভাবে করবো তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছি।অতো শতো না ভেবে বেশ কয়েক বার দড়জায় করাঘাত করলাম।দরজাটা বন্ধই ছিলো। তিনি এসে দড়জা খুলে দিলেন।কানে হেডফোন গুজে দরজা খুলে দাড়িয়ে আছেন।
–আপনার চা।
এই কথা বলে তার হাতে চা দিয়ে চলে আসলাম। পেছন ফেরার বেশ কয়েকক্ষণ পর দড়জা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলাম। এসে আরো এক পেয়ালা চা আন্কেলেকে দিয়ে আসলাম।আন্কেলের রুম থেকে আবার রসুইঘের অবস্থান করতেই মিষ্টি একটা স্বর কর্ণগোচর হলো,
–তুমি এখানে, আমি আরো তোমাকে সব জায়গায় খুঁজছি!
–তোমার ফোনালাপ শেষ।
–হুম।
–কী কথা হলো সানজুর সাথে?
–তেমন কিছুই না।এই ভালো মন্দ জানতে চাইলাম আর কী।এ কদিন ধরে ওর সাথে বেশি কথা বলি না।কখন না মুখ ফসকে তোমার কথা বলে ফেলি তাই।
–ওহ,তা এতোক্ষণ কী করছিলে?
–ঔ ভার্সিটির নিউ ফ্রেন্ডদের সাথে গ্রুপে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
–বাহ এ কয়দিনে অনেক বন্ধু বানিয়ে ফেলছো দেখছি।
–আমারতো সব জায়গায় গেলে অনেক বন্ধু হয়ে যায়। তবে এতোদিনে ভার্সিটিতে তোমার কোনো নতুন বন্ধু দেখলাম না।
–কেনো তুমিই তো আমার বন্ধু।
–বন্ধুকে কী কেউ কখনো তুমি করে বলে?
–বন্ধুত্ব মানে তুই বলা না।বন্ধুত্ব মানে সব সময় পাশে থাকা।এসব বাদ দাও সানজুর সাথে কী কথা হলো? ও ভালো আছে তো?
–আছে, তবে একটু প্যারার মধ্যে আছে।
–প্যারা!কিসের প্যারা?
–মামা ওকে ইংলিশ কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। ওদের আমেরিকা যাওয়ার ডেটতো খুব কাছাকাছি।
–ওতো সেই ছোটো বেলা থেকেই আমেরিকা যাচ্ছে, আর আমায় ও সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।
–কিহ! ঔ বান্দরনী তোমাকেও এই আশা দিছে।
–তার মানে তোমাকেও এই আশা দিছে?
চাঁদনি আমায় কিছু বলার আগে ওর দৃষ্টি রসুইঘরের দরজায় গিয়ে ঠেকলো।তাই ও দরজাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো?আমাদের কথা শুনছিলে বুঝি?
দরজা এবার প্রতিউত্তর করলো,
–আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, মহিলাদের দুনিয়াদারি গল্প শুনবো।আমি তো শুধু চায়ের কাপটা দিতে এসেছিলাম। (আমি একটু তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম )
–চা,কে বানিয়েছে তুমি?
চাঁদনিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তার মুখের ওপর এক পেয়ালা চা তুলে ধরলাম।
–ওমা তুমি চা বানিয়েছো!আমি তো এতোক্ষণ খেয়ালই করে নি।আর ভাইয়া তুমি আঁধারের বানানো চা খেয়েছো!তুমি না নিজের বানানো চা ছাড়া অন্য কারো হাতে খাও না?
–আমি কী করবো?কেউ যদি আমি আসার আগে আমার জায়গা দখল করে নেয়? (আমার নিম্ন দৃষ্টি এখন ওপরে ওঠে গেলো,অবাকতার সহিত তার দিকে না তাকিয়ে পারলাম না)
–সে যাই বলো,এই প্রথম অন্য কারো হাতে বানানো চা খেলে কেমন লাগলো?
–কেমন আর লাগবে? ওনার চা ওনার মতোই চিনি কম। (ভীতু একটা সামনে দাড়িয়ে বলার সাহস নাই,তা-ই পেছন ফিরে চলতে চলতে বলে গেলেন)।
————————
মধ্যাহ্নের তপ্ত রোদ পড়লো বলে,ব্যস্ত ভঙ্গিমায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যাগ ভর্তি করছি।কিয়ৎকাল পরই বর্তমান ঠিকানাটা অতীত হতে চললো।কারণ আমি আজই মেসে স্থানান্তরিত হচ্ছি।চাঁদনি বিছানায় বসে আমার পানে নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে। আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই তাই খুব দ্রুত সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো।এখন শুধু আন্কেল আর চন্দ্রের অপেক্ষা।দুজনেই আমার যাওয়ার ব্যপারে অবগত।সময়ের আগে চলে আসার কথা।অথচ কারো কোনো পাত্তাই নেই।দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি কাঙ্খিত বিকাল চার ঘটিকা বেজে গেছে।যার ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাদঁনিকে তাড়া দেখিয়ে বলতে হলো,
–কী ব্যাপার চাঁদনি?আন্কেল আর চন্দ্র ভাইয়ার তো কোনো খোজ নেই।চারটাতো বেজে গেছে।আমিতো তাদের আগেই জানিয়ে ছিলাম যে আমি চারটার দিকে বের হবো।অথচ তাদের কোনো পাত্তাই নেই।এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা।
–কী জানি তাঁরা কোথায়? তাদের কাজের কোনো শেষ আছে নাকি। আমি যে বাসায় একা থাকি সে খেয়াল তাদের থাকে। (অভিমানী গলায় চাঁদনি)
–চাঁদনি এরকম করে কেনো বলছো?তাঁরা তোমাকে কত ভালোবাসে।
–ভালোবাসে না ছাই।আমার কোনো চিন্তা আছে তাদের। দুজনেই একবার বেরুতে পাড়লেই আর বাসায় ফেরার নাম নেয় না। আমার যে একা একা বাসায় তাকতে ভালো লাগে না। (নাকেমুখে জলে ডুবানো অভিমানী নতুন এক চাদঁনিকে আবিষ্কার করলাম আমি)
–একা একা কই আমিতো আছি।
–তুমিতো আছো!কিন্তু কিছুক্ষণ পরতো তুমি চলে যাবে।তখনতো আবার আমি আগের মতো একা হয়ে যাবো।
–সমস্যা নেই সুযোগ পেলে আমি এখানে চলে আসবো।নইলে তুমি চলে যাবে। আমার মেসতো বেশ দূরে না।
–তাও তুমি যাবে।
–যেতে তো হবে। আর কতোদিন তোমাদের বাসায় ফ্রী থাকবো।
–ফ্রী কিসের ফ্রী থাকা? বন্ধুর বাসায় কী বন্ধু থাকতে পারে না।প্লিজ আধাঁর তুমি যেয়ো না।থেকে যাও আমাদের বাসায় কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।
আমি এবার চাঁদনির পাশে বসে ওর হাত ধরে কৃতজ্ঞস্বরে বললাম,
–আমি জানি চাঁদনি তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার।আল্লাহ আমার ভাগ্যে আপনজনদের ভালোবাসা না রাখলেও।প্রিয়জনদেের অফুরন্ত ভালোবাসা রেখেছেন।আমার জীবনে প্রিয়জনের সংখ্যা খুব কম।কিন্তু যারা আছে তাদের একজনের তুলনাও শত প্রিয়জনের সাথে হয় না।তেমনি একজন তুমি। সানজুর পর তুমিই আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি যখন সব থেকে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।তখন আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি আমার পাশে দাড়িয়েছো।তোমার করা উপকারগুলো কখনো আমি ভুলতে পারবো না।আর আমি তোমাদের উপর কৃতজ্ঞ হতে পারবো না।এবার আমায় নিজের রাস্তা নিজে খুজে নিতে দাও চাঁদনি। প্লিজ,,,,,
–আমি জানি আমি তোমাকে আটকাতে পারবো না।কিন্তু আমি তোমাকে অনেক মিস করবো।(বলে জড়িয়ে ধরলো,আমার কাধে ভেজা ভেজা স্পর্শ হচ্ছে।আমার আখিদ্বয়ও জলে টইটম্বুর।)এই দুই আড়াই মাস দুজন একসাথে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি।আমার তোমাকে কখনো খুব দূরের কেউ বা শুধু বন্ধু মনে হয় নি।নিজের বোন মনে হয়েছে। যদিও দুজন সমবয়সী।তবুও তুমি আমার থেকে ম্যাচিউর।সব সময় আমার ভুল গুলো ধরিয়ে দিতে।যা আমার খুব ভালো লাগতো। আম্মু মারা যাওয়ার পর সবার আদর পেলেও শাসন খুব কম পেয়েছি।বাবা-ভাইয়া খুব ভালোবাসলেও মায়ের ভালোবাসার অভাব খুব পুড়াতো আমাকে।কিন্তু তোমার ছোঁয়ায় কিছুটা হলে আমি আম্মুকে অনুভব করতাম।আম্মু হলে হয়তো তোমার মতো এভাবে আমার ভুল ধরিয়ে দিতো, নামাজ পড়তে বলতো,কুরআন তেলওয়াত করতে বলতো,গুছিয়ে চলাফেরা কথা বলা শিখাতো।ভাইয়ার সাথে অনেকটা ফ্রী হলেও একটা মেয়ের মনের কথা শেয়ার করার জন্য একটা মেয়েকেই প্রয়োজন। বাইরে আমার অনেক ফ্রেন্ড থাকলেও তাদের কাউকেই আমার মনের কথা শেয়ার করার মতো বিশ্বস্ত মনে হতো না।যতোটা তোমাকে মনে হয়। আমার মনে হয়, তোমাকে যদি বলি তুমি আমার সাথে সায় না দিলেও।অন্ততপক্ষে ভালো পথ দেখাবে। কারণ তুমি যে অনেক ভালো।
এবার আমি চাদঁনিকে ছাড়িয়ে বললাম,
–হয়েছে, আর আমার প্রশংসা করতে হবে না। এখন তোমার ভাইয়াকে একটা কল করো।দেখো এখন কোথায় ওনি।(এরই মাধ্যমে আমাদের ইমশোনাল সংলাপের ইতি ঘটলো।)
চাঁদনি এবার মিটি মিটি হেসে বললো,
–শুধু আমার ভাইয়াকে!
এই যা ইমোশনাল ড্রামার অবসান ঘটাতে গিয়ে পরিস্থিতিতো সম্পূর্ণ বিপরীতে নিয়ে আসলাম।কী থেকে কী বলে ফেলছি।এমনি চাঁদনি ঔদিন তরকারির জুল ফেলার ঘটনার পর থেকেই আমায আর চন্দ্রকে নিয়ে টিজ করে।এখন আবার সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। পরিস্থিতি সামলাতে বললাম,
–হ্যা মানে না!তুমি চন্দ্র ভাইয়াকে কল করো আমি আমার নতুন ফোন দিয়ে আন্কেলকে কল করছি।তার নাম্বারতো আমার কাছে আছে।
–তুমি চাইলে ভাইয়ার নাম্বারে কল করতে পারো।তার নাম্বারও আমি তোমার ফোনে সেইভ করে দিয়েছি।
আমি মনে মনে ভাবলাম চাদঁনি যদি আমার সত্যটা জানতো।তাহলে কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলতো না।আসলে ধর্ষিতাদের রঙিন জীবন হয়তো সেদিন রঙহীন হয়ে যায় যেদিন তাঁরা ধর্ষিত হয়।চাঁদনিকে জবাব দেওয়ার আগেই কুকিল কন্ঠ দ্বারী বেল বেজে উঠলো।আমি আগ বাড়িয়ে বললাম,
–আমি যাচ্ছি, তাঁরা হয়তো এসে গেছে।
চাঁদনিও মৃদু হেসে বললো,
–যাও আমার ভাইয়া এসে গেছে বোধহয়।
আমি চাঁদনিকে চোখ রাঙিয়ে মুচকি হেঁসে হেঁসে দরজা খুলতেই আমার সব হাঁসি উদাও হয়ে গেলো।আমি কী স্বপ্ন দেখছি না সত্যি দেখছি,,,,,,,
#চলবে,,,,
{যদিও উপন্যাসটার অপেক্ষায় তেমন কেউ থাকে না।তবুও বলছি,আমার পরশু জ্বর থাকায় আর গতকাল ইদের কারণে দিতে পারি নি।সবাইকে চলে যাওয়া ইদের মোবারকবাদ???।}