#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২১
মির্জা বাড়ির একটা কক্ষে তুমুল ধস্তাধস্তি চলছে। আরাফাত তমালের কলার ধরে উত্তম মাধ্যম ধোলাই দিচ্ছে। এককোনে অরিন জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। বাইরে থেকে বাড়ির লোকজন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। আবির ভ্রু কুচকে আছে। রাজীব বারবার আরাফাতকে ডাকছে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ করছে না। বরং মৃদু শব্দে তমালের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভেতরে যে মারামারি চলছে সেটা বুঝতে কারো বাকী নেই। মাসুদ নির্বাক চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। ও জানে আরাফাত বিনা কারণে কারো গায়ে হাত তুলবে না। অন্যায় যে করবে শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। মান সম্মান এতো ঠুনকো না যে সামান্য আঘাতে তা চুরমার হয়ে যাবে। লোকজন কি বলবে সেই ভয়ে প্রতিবাদ না করে চুপ থেকে খারাপ কাজকে প্রমোট করার দিন শেষ। লোকে কি বলবে লোকে বিষয়টাকে কোন চোখে দেখবে এসব ভাবলে তো আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হতে টাইম লাগবে না। নিজেকে ভালো রাখতে হলে মাঝেমাঝে প্রতিবাদ করতে হয়। সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালো থাকার কারণ খুঁজে নিতে হয়। তাছাড়া ভালোর সঙ্গে সব সময় ভালো কিছু হয়না। মানুষ দুর্বলের পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে থাকে। মাসুদের ধ্যান ভাঙলো দরজা খোঁলার আওয়াজ শুনে। ভেতরে ভয়াবহ অবস্থা। আরাফাত তমলের ঘাড় ধরে বাইরে ছুরে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো। হৈমন্তী আর চয়নিকা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলো। চয়নিকা গিয়ে অরিনকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। আবির তমলাকে নিয়ে মেঝেতে বসিয়ে দিয়ে রফিককে দ্রুত পানি আনতে হুকুম দিলো। ছেলেটার ঠোঁট কেঁটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কপাল ফুলে আলু হয়ে গেছে। শার্টের বোতাম একটাও আর অবশিষ্ট নেই সব ছিড়ে গেছে। চুলগুলো খড়ের স্তুপের সমান। আরাফাত হয়তো বেচারার চুল ধরে টানাটানি করেছে। কিন্তু সকলের প্রশ্ন, এসব হচ্ছে কেনো? আরাফাত শান্তশিষ্ঠ ভদ্রলোক হঠাৎ এমন রাঘববোয়াল হয়ে উঠলো কেনো? রফিক পানির পাত্রটা সমনে বাড়িয়ে দিতেই তমলা দ্রুত সেটা কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে গলাই ঢেলে নিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,
> প্লিজ ক্ষমা করে দিন। জীবনে আর এমন ভূল করবো না। সব মেয়েকে সম্মান করবো।
আবির যা বোঝার বুঝে গেলো। ওর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। একটা বোনকে নিজেদের বেখেয়ালে হারিয়ে ফেলেছে আরেকজনকে হারাতে পারবে না। ও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল,
> তোর সাহসের প্রশংসা করতে হচ্ছে। বাঘের খাঁচাতে এসেছিস শিকার করতে? এখন শিকার করার মতো হাতদুটোকে বাঁচাতে পারবি তো? খুঁন করবো তোকে আমি।
কথাটা বলে ও আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রাজীব দ্রুত তমালকে ওর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে ইশারা করলো তমালকে সরিয়ে নিতে। ছেলেটা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। রাজীবের ইশারা পেয়ে ছেলেটা এসে টানতে টানতে তমালকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মির্জা বাড়ির চৌকাঠ তমালের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। বাইরের বাগানে আরাফাত পাইচারি করছে। মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে অরিনের উপরে। এই কাজের জন্য শুধুমাত্র তমাল ছেলেটা দোষী না। অরিন ইন্ধোন জুগিয়েছে। ছেলেটার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে মেলামেশা করেছে যার জন্য তমাল ভেবেছে হয়তো অরিনের ইচ্ছে আছে। তাই তো আরাফাতের অবর্তমানে চুপিচুপি ওর রুমে গেছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,
বেলকনিতে অরিন আনমনে দাঁড়িয়ে আরাফাতের কথা ভাবছে আর মন খারাপ করছে। হঠাৎ তমাল পিছন থেকে ওর কাঠে নিজের হাতটা রাখল। অরিন চমকে উঠে পেছন তাঁকাতেই তমাল দাঁত বের করে হেসে বলল,
> নিঃসঙ্গ তোমাকে সঙ্গ দিতে চলে আসলাম। আমি জানি তুমি আরাফাতের সঙ্গে সুখী না। অরিন এরকম ফালতু সম্পর্কে জড়িয়ে কেনো নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছো? আমার সঙ্গে চলো। সুখের সমুদে নাও ভাসাবো আমরা দুজন।
তমালের কথা শুনে অরিন ভ্রু কুচকে ফেলল। বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো,
> আপনি কি সব আজেবাজে কথা বলছেন তমাল ভাই? আমি নিজের ইচ্ছেতে উনাকে বিয়ে করেছি ছেড়ে দিবো বলে না। সারাজীবন এক সঙ্গে থাকবো বলে। আপনি আমার রুম থেকে এখুনি বেরিয়ে জান।
অরিনের কথা শুনে তমাল পিছিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এগিয়ে আসলো। ওর চোখমুখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। অরিনের অস্তিত্ব হচ্ছে। কিভাবে এই আপদকে বিদায় করবে ভাবতে পারছে না। ওকে ভয় পেতে দেখে তমাল বাঁকা হেঁসে বলল,
> বিশ্বাস করতে পারছো না তাইনা? প্লিজ একবার বিশ্বাস করে দেখো আমি ঠকাবোনা। আরাফাত কিছু জানতে পারবে না। আমরা দূরে পালিয়ে যাবো। আর এখুনি কিছু করতে হবে না। আগে প্রেম ট্রেম করি। কাছাকাছি আসি তারপর নাহয় ওসব ভাবা যাবে। হাতটা ধরো।
তমাল অরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই অরিন মৃদু চিৎকার করে বলল,
> আপনাকে আমি ভালো লোক ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি মোটেও ভালো মানুষ না। এখুনি বেরিয়ে না গেলে কিন্তু আমি সব উনাকে বলে দিব।
> আমি তোমার ভালো চাইছি আর তুমি হুমকি দিচ্ছো? আরাফাত তোমাকে ভালোবাসে না। ও তোমার বোনকে ভালোবাসে। শুনো আমার কথা মেনে নাও তোমার ভালো হবে। প্লিজ একবার বিশ্বাস করো আমাকে। আমি তোমাকে একটুও কষ্ট দিবো না।
তমাল কথাটা বলে অরিনকে ধরতে চাইলো কিন্তু পারলো না। পেছন থেকে একটা হাত ওর হাতটাকে খপ করে ধরে ফেলল। আরাফাত তমালের পিছনে পিছনে এসেছিল প্রথম থেকেই যেটা ও বুঝতে পারেনি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ও সবটা শুনেছে। এতক্ষণ দাঁত চেপে সবটা সহ্য করলেও এখন আর পারলো না। তমালারে শার্টের কলার ধরে ওর নাকেমুখে কয়েকটা ঘুসি বসিয়ে দিলো। আরাফাতের শক্তির কাছে তমাল পেরে উঠতে পারলো না। তাছাড়া দরজা আগেই আরাফাত বুদ্ধি করে বন্ধ করে রেখেছে। পালিয়ে যাওয়ার উপাই একদম বন্ধ। শেষমেশ পড়ে পড়ে আরাফাতের কিল ঘুষি হজম করতে হলো। তমাল বারবার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু আরাফাত ক্ষমা করেনি। কিসের ক্ষমা? বেয়াদবির একটা লিমিট থাকে। একজন বিবাহিত মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে। কতবড় অমানুষ হলে এমন করা যায়। আরাফাত নিজের সব রাগ ভালো করে মিটিয়ে নিয়েছে। বাকী আছে অরিনকে কয়েকটা দেওয়ার। কিন্তু পারবে না। ওর মুখের দিকে তাঁকালে আরাফাতের দিন দুনিয়া সব এলোমেলো হয়ে যায়। পারবে না আঘাত করতে। তার আগেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করবে।
☆☆☆
অরিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে হেঁচকি তুলছে। হৈমন্তী চুপচাপ ওর পাশে বসে আছে। নিজের উপরে নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠেছে। সব বদ বুদ্ধি ওর ছিল। ভেবেছিল অরিন সেজে গুজে তমালের সামনে সামনে ঘুঁরলে আরাফাত জ্বলবে। জেলাস হবে তারপর অরিনকে ভালোবাসবে কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তমালারে মতো লুচু ছেলে ও জীবনে দেখেনি। ভাইয়ের বউকে কুপ্রস্তাব দিতে বিবেকে বাঁধলো না? হৈমন্তীর ইচ্ছে করলো ঠাটিয়ে লোকটার গালে দুটো থাপ্পড় দিতে কিন্তু তার আগে নিজের গালে চারটা দিতে মন চাইছে। কিভাবে অরিনকে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না। চয়নিকা বাইরের গেছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। এই সুযোগে হৈমন্তী ফিসফিস করে বলল,
> ভাবি খুব সরি। সব দোষ আমার। আমার জন্য ভাইয়া এতটা রেগে আছে। তমাল তোমাকে বাজে প্রস্তাব দিতে সাহস পেয়েছে। আমি জীবনে আর তোমাকে খারাপ বুদ্ধি দিতাম না।
অরিন শান্ত হয়ে বলল,
> তোমার বুদ্ধি পুরোপুরি কাজে না লাগলেও আমি তোমার ভাইয়ার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি হৈমী। সব ক্রেডিট তোমার। আমি বুঝতে পারিনি তমাল ছেলেটা এমন কিছু করবে। তাছাড়া মানুষ চেনা বেশ কঠিন। তুমি এসব আমার ভাইয়াকে বলতে যেওনা। তোমাকে বকবে আমার খারাপ লাগবে।
অরিনের কথা শুনে হৈমন্তীর মন আরও খারাপ হলো। ওর জন্য মেয়েটা বকা শুনছে তবুও ওকে বাঁচানোর চেষ্টাও করছে। এমন একটা বউ এই বাড়ির জন্য সত্যি দরকারি। মেয়েটা মির্জা বাড়ির উপযুক্ত বউ। হৈমন্তী অরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
> তুমি খুব ভালো ভাবি। দেখবে ভাইয়া তোমাকে ঠিক বুঝতে পারবে। অনেক অনেক ভালোবাসবে।
> এবার থেকে আর কোনো দুষ্ট বুদ্ধি করলে চলবে না। উনি রেগে যাবেন এমন কাজ আমি জীবনে করবো না। উনার স্ত্রী হিসেবে এই ঘরটাতে জায়গা পেয়েছি এটাই আমার জন্য অনেক।
☆☆☆☆☆
নিস্তব্ধ রুমে পাইচারি করছে আবির। হৈমন্তী চুপচাপ বসে আছে বিছানার এক কোণে। আবিরের চোখেমুখে রাগ তবে সেটা কতটুকু হৈমন্তী তা বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগেই অরিনের রুম থেকে ফিরে এসেছে। রুমে আসতেই আবির ওকে জিঞ্জাসা করেছে অরিনকে এসব কে শিখিয়ে দিয়েছে। হৈমন্তী ভয়ে চুপসে গেছে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় কথাটা একদম ঠিকঠাক। কি দরকার ছিল আবিরকে এই বাড়িতে এসে জামাই আদর খাওয়ার? না থাকলে হৈমন্তী আজকের ঘটনা প্রাণ থাকতে বলতো না। কিভাবে এই লোকটাকে বোঝাবে আল্লাহ্ ভালো জানে। হৈমন্তী হাত দুটো মুখে দিয়ে আছে। আবির হঠাৎ থমকে গিয়ে বিছানায় উঠে বসে বলল,
> আমার কেমন জানি ডাউট হচ্ছে। কোনোক্রমে তুমি এসব আজেবাজে কথাঅরিনকে শিখিয়ে দাওনিতো? চয়নিকা ভাবি বলেছে অরিন আরাফাতকে জেলাস করানোর জন্য তমালের সঙ্গে দু একটা কথাবার্তা বলেছে।
হৈমন্তী ফিসফিস করে উত্তম দিলো,
> আপনি আমাকে দেখতে পারেন না তাই সব সময় আমাকে দোষারোপ করেন। আপন বউ না তো তাই জন্য এমন করছেন। পর কখনও আপন হয়না। বিয়ে একজনের সঙ্গে ঠিক ছিল আপনাকে তো জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিয়েছে।
হৈমন্তীর কথা শূনে আবির ওকে ঝাপটে ধরে বলল,
> বউ আবার আপন পর কি? আমার একটামাত্র বউ যে কিনা রূপে গুণে যেমন লক্ষ্মী,দুষ্ট বুদ্ধিতেও তেমন।
হৈমন্তী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
> দরকার নেই আপনার প্রশংসা করার। আপনি যে আম্মার পান ফেলে দিয়েছেন তাঁর বেলা কিছু না?
অরিনের চথা শুনে আবির ভ্রু কুচকে বলল,
> অতিরিক্ত পান খাওয়া ঠিক না। শাশুড়ি আম্মা ছাগলের মতো পান খান বিষয়টা বিরক্তিকর। আমি এর ঘোর বিরোধীতা করছি। ফেলেছি বেশ করেছি দরকার হয় আরও ফেলবো।
হৈমন্তী গাল ফুলিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আবির হৈমন্তীকে আটকে দিয়ে বলল,
> রাগ করো না বউ। কাজ কারার আগে একবার না দশবার ভাবতে হয়। দুমদাম কাজকর্ম করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমন কিছু করবে না যেটার জন্য সারাজীবন পস্তাতে হয়। আমি চাইনা আমার বউ ভুল কাজ করে সারাজীবন আফসোস করুক। বুঝেছো কিছু?
(চলবে)