দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ৯

0
412

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:৯

ঢাকা ইউনিভার্সিটির সামনে এক বন্ধু সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল আরাফাত সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার পরে বাধলো আরেক বিপত্তি। হঠাৎ গেটের ভেতর থেকে অরিন দৌড়ে এসে আরাফাতের সামনে হাজির। মেয়েটাকে দেখে আরাফাত ভড়কে গেছে। প্রথমে ভেবেছিল দৌড়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু শেষমেশ পারেনি।তারপর ভাবলো একটা বোঝাপড়া করা দরকার। অরিন হাঁপাতে হাঁপাতে ওর সামনে কোমরে হাত রেখে বলল,

> কেমন আছেন? আমাকে দেখলে আপনি এমন পালিয়ে যান নয়তো পালাই পালাই করেন কেনো? ভয় পান বুঝি?

অরিনের ওষ্ঠে হাসি দেখে আরাফাত জ্বলে উঠলো।। ভ্রু কুচকে উত্তর দিল,

> সত্যিই খুব ভয় পাচ্ছি। ভয়ে আমি লেপ গায়ে জড়িয়ে চলাফেরা করছি। শুনো মেয়ে, আমি কোনো পাবনা ফেরত রুগীর সঙ্গে কথা বলি না। একদম আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে না। ফাজিল মেয়ে।

আরাফাতের ধমক শুনে অরিনের চোখ ছলছল করে উঠলো। ছেলেটাকে ওর ভালোলাগে। কি এক অদৃশ্য অদম্য টানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এটাকে ভালোবাসা বলে নাকি ভালোলাগা বলে ওর ছোট্ট মস্তিষ্কে সেগুলো ধরে না। লোকটার সঙ্গ ওকে খুব করে টানে। অরিন ঢোক গিলে মুখটা করুন করে বলল,

> এভাবে কথা বলছেন কেনো?হৈমী আপনার কথা বারবার করে বলে তাই তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসি। এক সঙ্গে থাকি তো।

অরিন অকপটে মিথ্যা কথাটা বলে বসলো। না বললে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অরিনের বুদ্ধি কাজে দিলো। আরাফাত চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে নরম সুরে বলল,

> সরি আমার ভুল হয়েছে। আচ্ছা আসুন সামনে একটা রেস্টুরেন্টে আছে কফি খেতে খেতে কথা হবে।

অরিন মাথা নাড়িয়ে সাড়া দিলো। মনের মধ্যে রীতিমতো লাড্ডু ফুটছে। উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না। তবুও চুপচাপ আছে। পাছে লোকটার যদি আবার মতিগতি পরিবর্তন হয়ে যায়। আরাফাত ওক অবাক করে দিয়ে ওকে নিয়ে নিকটবর্তী একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসে কফির অর্ডার দিলো। সামনাসামনি দুজনে বসে আছে। অরিন লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হচ্ছে। আরাফাত মাঝেমধ্যে ওর মুখটা দেখছে আর ভাবছে, এই ড্রামা কুইন কি ওকে বোকা বানিয়ে নিয়ে আসলো? ও আর ভাবতে পারলো না ভ্রু কুচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> হৈমী কেমন আছে? ওকে কান্নাকাটি করতে মানা করবে। আমি খুব দ্রুত ওই জাহান্নাম থেকে ওকে মুক্ত করে আনবো।

অরিন অবাক হয়ে বলল,

>আমার ভাইয়ার বাড়ি জাহান্নাম কেনো হবে? হৈমী ভালো আছে একদম সুস্থ। তাছাড়া ছোট আম্মা ওকে কত আদর করে।

আরাফাত বিস্মিত হয়ে বলল,

> মিথ্যা বলছো তাইনা? কাজীরা মানুষের সঙ্গে স্বার্থ ছাড়া ভালো ব‍্যবহার করে কখনও? ওরাতো ডাকাতের বংশধর। সুস্থ মানুষকে কিভাবে অসুস্থ করতে হয় ভালো জানে।

আরাফাতের চোখেমুখে আগুন।অরিন কিছুটা নিভে গেলো নিজের বংশের উপরে আনা এতবড় অপবাদ শুনে। বাপ চাচা চৌদ্দ গোষ্ঠীর কাউকে আজ অবধি ডাকাতি করতে দেখেনি তবুও কিভাবে ডাকাত হলো কে জানে। অরিনকে এভাবে চুপচাপ দেখে আরাফাত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> হৈমীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারবে, ফোন আছে তোমার?

অরিন ঢোক গিলল ভয়ে। আবির আগেই ওর ফোনটা জব্দ করেছে। বাড়িতে একটামাত্র ফোন, তাও আবার হাতি বাহিনীর প্রধান সেটা আগলে নিয়ে বসে থাকে। আবিরের আছে ফোন আছে কিন্তু সেটা ওর নিজস্ব। বাড়ির লোকজন কেমন শেয়ালের মতো চালাক। অরিন জোর করে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,

> আসলে আমার কাছে কোনো ফোন নেই। ভাইয়া বলেছে সব মিটে গেলে ফোন পেয়ে যাবো। খুব সরি।

আরাফাত ক্ষুব্ধ হলো অরিনের উত্তর শুনে। এই মেয়েটা ওকে কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারবে না এটা ওর আগেই মনে হয়েছিল তবুও একটা আশা ছিল। সেটাও গুড়ে বালি। এলাকায় রফিকের লোকজন দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছে। রাজীব ফোন করে বলেছে। হৈমীকে নিয়ে যত চিন্তা ওদের। মেয়েটাকে হাতে রেখে কোনো অন‍্যায় আবদার না করে বসে। আরাফাতের ধ‍্যান ভাঙলো অরিনের কথা শুনে। মেয়েটা বোকাবোকা মুখ নিয়ে বলল,

> শুনেন,যদি আপনি আমাকে বিয়ে করেন তাহলে কিন্তু আপনার লাভ হবে। এই ধরুন..

অরিন আর বলতে পারলো না।আরাফাত ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো। এত বড় একটা মেয়ের এমন গোলমেলে বুদ্ধি কেনো আরাফাতের মাথায় ধরে না। কাজীদের মাথায় যে গোবর আছে সন্দেহ নেই। আরাফাতের ধমক খেয়ে অরিনের কিছুই অনুভব হলো না। বরং সে চনচল হয়ে বলল,

> আরে বাবা শুনবেন তো আমার বুদ্ধি। তারপর না হয় বকাবকি করবেন। যদি আপনার কাছে আমি চলে যায় তাহলে আমাদের বাড়ির লোকজন বাধ্য হয়ে হৈমীকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে চাইবে। তখন আপনার লাভে লাভ। বুদ্ধিটা কেমন?

আরাফাত কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো,

> তাই বলে বিয়ে? তোমার মতো বুদ্ধিটাও একেবারে পচা।

> ভেবে দেখুন একবার। আমি তো শুধু আপনাকে সাহায্য করতে চেয়েছি যদি পছন্দ না হয় তবে যাচ্ছি। যেচে লোকের ভালো করতে নেই।

অরিন উঠতে গেলো কিন্তু আরাফাত ওকে আটকে দিয়ে বলল,

> আমি রাজি। দ্রুত আমরা বিয়ে করছি। পরের বার দরকারি কাগজপত্র সঙ্গে রাখবে। বাড়িতে ফিরবো।

অরিনের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। শেষমেশ লোকটাকে নিজের করে পাওয়ার একটা সুযোগ পেলো। পরের কথা পরে ভাবা যাবে। তাছাড়া কাজীরা কখনও চাইবে না ওদের মেয়ের সংসার ভাঙুক। বরং সব ঠিকঠাক হওয়ার একটা সুযোগ পাবে। সেদিন কথা শেষ করে আরাফাত বাড়িতে ফিরে আসল। ওদের টেবিল থেকে দূরে একজন বসে ফুলছিল আরাফাত সেটা বুঝতেই পারলো না।
______________________
আবির রাগরাগি করে হাসপাতালে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। তবে হৈমন্তীর মনটা বেশ ফুরফুরে। শাশুড়ির সঙ্গে মিলে আবিরকে টাইট দেওয়ার ভিন্ন ভিন্ন টিপস আবিস্কার করেছে। কান্নার পরেই সুখ আসে কথাটা হাড়ে হাড়ে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধি গুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে সোনার সোহাগা। লোকটা এতোদিন খুব জ্বালাতন করেছে হৈমন্তী এবার প্রতিশোধ নিবে। বিষয়টা ভাবতেই ওর পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সারাদিন বেশ ভালো কেটেছে।হৈমন্তির কলেজে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি। আবির একগাদা বই পাঠিয়েছে। পরীক্ষা পযর্ন্ত বাড়িতেই পড়তে হবে। আনোয়ার কাজী খুব হম্বিতম্বি করেছে সেই ভয়ে এই ব‍্যবস্থা নেওয়া। আপাতত হৈমন্তীর এসবে কোনো ভাবনা নেই। পড়তে ওর তেমন ভালোলাগেও না। আমেনা বেগমের চক্করে পড়াশোনা করা। সারাদিনের কর্মব্যস্তা শেষে বাড়িতে ফিরলো আবির। হৈমন্তী ডাইনিং রুমে সোফায় পা তুলে টিভি দেখছিল। আবির ওর দিকে একবার তাঁকিয়েও দেখলো না। হৈমন্তী কয়েকবার উঁকিঝুকি কেটে চুপচাপ টিভিতে মনোযোগ দিলো। মহিত ঝগড়ার পর থেকে হৈমন্তীর থেকে দূরে দূরে আছে। আসমা বেগম ওকে হৈমন্তীর কাছে আসার সুযোগ দিচ্ছেন না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে উনি মেয়েটাকে শান্ত করেছেন। বয়সের স্বল্পতা সেক্ষেত্রে ভুল করা অস্বাভাবিক কিছু না। মানুষের প্ররোচনায় কখন কি করবে তখন সংসারে অশান্তি হবে। আসমা বেগম দক্ষ হাতে সামলে নিয়েছেন। আবির ফ্রেস হয়ে টেবিলে গিয়ে বসে পড়লো খাওয়ার জন্য। আসমা বেগম হৈমন্তী আর অরিনকে ডেকে নিলেন। বাকীরা খেয়ে নিয়েছে। আবিরের আজ বেশ মন খারাপ। কারো সঙ্গেই দরকার ছাড়া কথা বলছে না। হৈমন্তী উশখুশ করে আমেনা বেগমের দিকে তাকালো। আমেনা বেগম চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। হৈমন্তী চুপচাপ খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে ঢুকলো। আবির এখনো রুমে আসেনি। হৈমন্তী অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেশ বুকশেলফ থেকে বই ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। এক পাশে হুমায়ূন স‍্যারের বেশ কিছু বই রাখা। হৈমন্তী বইগুলো নামাতেই একটা ফাইল উপর থেকে পড়ে গেলো। হৈমন্তী মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় ফাইলটা চোখের সামনে তুলে ধরলো। ফাইলের উপরে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা “অরুনি “। হৈমন্তী ভ্রু কুচকে ফেলল। অরুনির কিসের ফাইল দেখার জন্য পরের পৃষ্ঠা খুলতেই বুঝে গেলো এটা ওর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। চাপা উত্তেজনাই ওর শরীর কাপছে। দ্রুত বিস্তারিত পড়তে গেল তার আগেই ফাইল টা কেউ টেনে কেড়ে নিলো। হৈমন্তী বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে দেখলো আবির চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইলটা ওই কেড়ে নিয়েছে কিন্তু কেনো? হৈমন্তী ফিসফিস করে বলল,

> নিলেন কেনো? দিন আমি দেখবো।

আবির দ্রুত ফাইলটা আলমারিতে লক করতে করতে বলল,

> বুঝবে না শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে। এসব তোমার কর্ম নয়।

হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> আমি দেখতে চাই। লুকিয়ে কেনো রাখছেন?

হৈমন্তী দ্রুত আলমারির কাছে গিয়ে খুলতে গেলো কিন্তু পারলো না। আবির ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে বলল,

> জিদ করোনা। যা হয়ে গেছে তা ঘাটাঘাটি করা ঠিক হবে না। তাছাড়া তুমি দেখে কি করবে? বর রেগে আছে তার রাগ না ভাঙিয়ে ফালতু কাজকর্ম করছো?

কিছু একটা ভেবে হৈমন্তী এবার জোরাজুরি করলো না। চুপচাপ আবিরের দিকে ঘুরে পড়লো। আবিরের দুহাত হৈমন্তীর কোমরে আবদ্ধ ছিল। হৈমন্তী নিজের হাত দুটো দিয়ে আবিরে গলা জড়িয়ে ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বলল,

> তাহলে আগে বরের রাগ ভাঙাই কি বলেন?

আবির বুঝতে পারলো না হৈমন্তীর মাথায় কি চলছে। ওর চোখেমুখে বিস্ময়। যে মেয়েটা ওর ধারেকাছে আসতে চাইতো না সেই মেয়েটা আজ নিজে থেকে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে হজম হলো না। ও ভ্রু কুচকে বলল,

>তুমি ঠিক আছো? জ্বর টর আসেনি তো?

হৈমন্তী পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল,

> কিছু ঠিক নেই ডাক্তার আমি অসুস্থ। আমার ভীষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে।

কথাটা বলে হৈমন্তী ক্রমশ আবিরের ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যেতেই আবির ঝট করে নিজের থেকে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

> এসব কি হৈমী? তুমি তো ভাবি দুষ্ট হয়ে গেছো। শুনো এসব ভালো লক্ষণ না। পড়াশোনা ফেলে তুমি এসব শিখছো? আজ থেকে আর টেলিভিশন দেখবে না।

হৈমন্তী হাসিটা আরও কিছুটা প্রশস্ত করে বলল,

> আমার কি দোষ বলুন?প্রেম রোগে ধরেছে আপনি তো ডাক্তার ঠিক করে দিন না। প্লিজ।

কথাটা বলে হৈমন্তী আবিরের দিকে এগিয়ে গেলো। ছেলেটা বারবার ঢোক গিলছে। শেষমেশ রুমে টিকতে না পেরে দ্রুতগতিতে পাশের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। হৈমন্তী ওকে এভাবে ভয় পেতে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। লোকটা ভীষণ চালাক। সব সময় ওকে মানিয়ে নিয়েছে ভাব ধরে থাকে। এই হচ্ছে ওর মানিয়ে নেওয়ার ধরণ। বুদ্ধিটা আসমা বেগমের ছিল। উনি ছেলের মতিগতি বুঝেন। মনের মধ্যে একজনকে রেখে হঠাৎ অন‍্য একজনকে হুটকরে মানিয়ে নেওয়া খুব একটা সহজ না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here