দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ২+৩

0
617

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২+৩
পর্ব-২
রাজীব সারারাত চয়নিকার মুখের দিকে তাঁকিয়ে রাত পার করে দিলো। চয়নিকা বেঘোরে ঘুমিয়েছে। সারাদিন না খেয়ে রাতে খাওয়ার পর চোখ এমনিতেই বন্ধ হয়ে আসছিল। রাজীবের সঙ্গে আপাতত কথা বলা বন্ধ।ও নির্বাচনের একগাদা কাজকর্ম ফেলে বউয়ের মান ভাঙাতে বাড়িতে ফিরে এসেছে। বিয়ে বিষয়টা চয়নিকার কাছে জঘন্য লেগেছে।ওকে এভাবে অপমান করার কোনো মানে নেই। রাজীব হাজার বার কানে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে চয়নিকা পাত্তা দিচ্ছে না। দিবে কেনো? নিজের বোনের সঙ্গে এমন হলে ঠিকই কোমর বেঁধে চলে যেতো ঝগড়া করতে। চয়নিকা ঠিক করেছে রাজীবকে একটা শিক্ষা দিবে। ভোরের আলো ফুটতেই মির্জা বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেলো। আমেনা বেগম লতাকে রান্না শেখানো জন্য ঘরে গিয়ে খুঁজে পাননি। অনেক খোঁজাখুঁজি চলল কিন্তু তাঁকে পাওয়া গেলো না। হৈমন্তী হাপাতে হাপাতে আরাফাতের রুমের দরজায় গিয়ে কয়েকবার ধাক্কা দিতেই দরজা খুঁলে গেলো। হৈমন্তী উত্তেজনাই কাঁপছে। আরাফাত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

>বোন কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছি এখুনি তোর ডাকতে হলো? সমস্যা কি হৈমী?

> তুমি জানো লতা আপা নিখোঁজ। আম্মা কাঁদছেন। তুমি কি জানতে কোথাও প্রেম ট্রেম আছে কিনা?

আরাফাত হৈমন্তীর কথায় পাত্তা না শুয়ে পড়ে হামি ছেড়ে বলল,

> জানি। শুধু আমি না বড় ভাইয়াও জানে। গতকাল রাতে লতার বিয়ে হয়েছে। লতার সঙ্গে এক ছেলের বহুদিনের প্রেম ছিল ভয়ে বাড়িতে বলতে পারছিল না। আমি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় দূর করে গতকাল রাতে বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। যা আম্মাকে বল বাড়িতে কোনো লতাপাতা নেই। একটু শান্তি চাই।

হৈমন্তী কথাটা শুনে থতমত খেয়ে গেলো। আম্মা জানলে কি বলবে কে জানে। হৈমন্তী কিছু একটা ভেবে মায়ের রুমে ফিরে গেলো। আমেনা বেগম মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। হৈমন্তী সাহস জুগিয়ে বলল,

> আম্মা লতা আপার সঙ্গে একটা ছেলেকে দেখা যেতো। আমার মনে হয় ওই ছেলেটার সঙ্গেই…

হৈমন্তী কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই আমেনা বেগম ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

> বড়দের বিষয়ে কথা বলতে কে বলেছে? তুমি যাও এখন।

হৈমন্তী চুপচাপ চলে আসলো। সকাল দশটা নাগাদ লতা নতুন বরকে সঙ্গে নিয়ে আমেনা বেগম কে সালাম করতে আসলো। উনি রাগ করে মুখ ভার করে থাকলেন।যার জন্য নিজের বাড়ির বউকে কষ্ট দিলেন সেই মেয়েটাই এই বাড়ির সম্মান নষ্ট করেছে এটা উনি মানতে পারছেন না। তবে লতা বারবার চয়নিকার কাছে ক্ষমা ছেয়েছে। আমেনা বেগমের মন রক্ষার জন্য এসব করতেই হতো। আমনা বেগম জানেন না লতার বিয়ের পেছনে তাঁর ছেলেদের পুরোটা হাত আছে। উনি ভাবলেন লতা উনার সঙ্গে ছলনা করেছে। লতার উপরে গিয়ে সব রাগ জমা হলো। চয়নিকা আবারও বাড়ির কাজকর্মে হাত লাগিয়েছে তবে সে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলছে না। আমেনা বেগম বড় বউয়ের পেছনে পেছনে ঘুরছেন মিলমিশ করানোর জন্য। কিন্তু পাত্তা পাচ্ছেন না। রাজীব সকালবেলায় না খেয়ে বেরিয়েছে। দুপুর নাগাদ আমেনা বেগম কাজের মেয়েকে নিয়ে কোথায় একটা গেলেন ফিরলেন সন্ধ্যা নাগাদ। একা ফিরলেন না সঙ্গে নিয়ে আসলেন ছোট্ট একটা বাচ্চা। চয়নিকার চোখেমুখে বিস্ময়। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে শেষমেশ শাশুড়ির পাশে গিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললেন,

> আম্মা বাচ্চাটা কোথা থেকে পেলেন?
আমেনা বেগম বাচ্চাটাকে চয়নিকার কোলের উপরে দিয়ে বললেন,

> রমেলার গ্রাম থেকে এনেছি। সকালবেলায় মেয়েটার মা মারা গেছে। বাবা থেকেও নেই। বিয়ে হয়েছিল জামাই কোথায় চলে গেছে খোঁজ রাখেনা। বাচ্চাটার দেখাশোনার জন্য ভালো একটা পরিবেশ দরকার। তুমি ওকে লালন পালন করবে। নিজের বাচ্চার মতো। এতিমকে ভালবাসলে আল্লাহ তাঁকে ভালোবাসে বুঝলে?

চয়নিকার এক মূহুর্ত্তের মধ্যেই শাশুড়ির উপরে থাকা রাগ কমে গেলো। মনে মনে ভাবল শাশুড়ির উপরে আর রাগ করা চলবে না। কত সহজেই না মা হওয়ার একটা সুযোগ করে দিলো। চোখে পানি এসে গেলো। তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল,

> আম্মা আপনার ছেলেকে একটা ফোন দিয়ে বলেন না ফিরে আসতে। বাচ্চাটা খুব সুন্দর। উনি দেখলে খুশী হবেন।

আমেনা বেগম চয়নিকার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি অনুভব করলেন। লতা না চলে গেলে কখনও বুঝতেন না কি ভুল কাজটাই না করতে চলেছিলেন। লতার উপরে থাকা রাগের জন‍্যই হয়তো উনি চয়নিকার প্রতি এতোটা স্নেহশীল হচ্ছেন। আজ যখন এই বাচ্চাটার খবর পেলেন অপেক্ষা করেননি দ্রুত চলে গিয়েছেন। শুধু রক্তের সম্পর্ক হলেই কি আপন হয়? মাঝেমাঝে পরও আপন হয়ে যায়। চয়নিকা পুরোদস্তুর মা বনে গেলো। রাজীব যত কাজই থাকুক নিয়মিত বাড়িতে ফিরছে। না ফিরে উপাই নেই এখনো চয়নিকা ওর সঙ্গে কথা বলছে না। রাজীব বুঝে উঠতে পারছে না যেখানে ওর মা অন‍্যায় করে ক্ষমা পেয়ে গেলো সেখানে ও কি দোষ করলো যে ক্ষমা পাবে না? মোটামুটি বাড়িতে শান্তি ফিরেছে। রাজীব অত‍্যান্ত ভালো মনের একজন মানুষ। রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু জনগণের জন্য নির্বাচনে নামতে হলো। মির্জ বাড়ির বিপরীত প্রতিপক্ষ ছিল কাজী বাড়ি। কাজী বাড়ির প্রধান দেলোয়ার কাজী মনে মনে একটা ছক তৈরী করে ফেললেন। মির্জ বাড়ির সঙ্গে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরী করা যায় তবে মির্জা বাড়িকে হারানো যাবে। এই দুই পরিবারের ঝগড়া চলছে বহুদিন ধরে। দেলোয়ার কাজী হুট করে একদিন ঘটক পাঠালেন হৈমন্তী সঙ্গে উনার ছেলের বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে। উনার ছেলে মাধ্যমিক ফেল। তবে প্রচুর টাকা পয়সা আছে। কখনও মেয়ের অসুবিধা হবে না। প্রথমে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও হৈমন্তীর বাবা সবাইকে বুঝিয়ে বললেন যদি এই সম্পর্কের জন্য হলেও এতো দিনের ঝগড়া ঝামেলা মিটে যায় তাহলে দোষের কি?তাই মানা করা যাবে না।আরাফাত রাগে ক্ষোভে বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলো। বোনের বিয়ে ও কিছুতেই কাজী বাড়িতে দিবে না। রাজীব পড়েছে দোটানায়। কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে হৈমন্তী বেশ খুশী বিয়ে পড়াশোনা করতে হবে না প‍্যারা নেই। এর চেয়ে ভালো কি বা আছে। ফেল করা চিঠি লুকানোর জন্য ভাইয়ার হাতে পায়ে ধরা লাগবে না। হৈমন্তী বিয়ের জন্য প্রস্তুত। চয়নিকা ওর এমন মতিগতি দেখে বিরক্ত হলো। আমেনা বেগম আগে থেকেই ভেবেছিলেন মেয়ের দ্রুত বিয়ে দিতে হবে কিন্তু কাজী বাড়ির বখাটে ছেলেটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে নিয়ে উনিও বেশ চিন্তিত। বারবার কাজীরা লোক পাঠাতে শুরু করলো। দুই পক্ষের মধ্যে একটা তৃতীয় পক্ষের সৃষ্টি হলো যারা দিনরাত পরিশ্রম করে খবরাখবর আদান প্রদান করতে থাকলো। বিষয়টা রাজনৈতিক পর্যায়ে চলে গেলো। বিয়েটাতে মানা করার উপাই থাকলো না। শেষমেশ দিন ধার্য করা হলো। লোকজন উঠেপড়ে লাগলো বিয়ের আয়োজন করতে। রাজীব দুহাতে টাকা উড়ালো বোনের বিয়েতে। বড় বোনের বিয়েটা হঠাৎ হয়েছিল তাই তেমন কোনো অনুষ্ঠান করা হয়নি এবার কোন খায়েশ অপূর্ণ রাখবে না। পুরো বিয়েতে আরাফাত একবারের জন্যও বাড়িতে আসেনি। দেখতে দেখতে বিয়ে দিন ঘনিয়ে আসলো। কাজী বাড়ি থেকে প্রচুর উপহারসামগ্রী আসলো। মির্জা বাড়ি থেকেও গেলো। কিন্তু বিয়ের দিন ভোরবেলা ঘটলো আরেক অঘটন। দেলোয়ার কাজীর বড় ছেলে রফিককে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। সারা শহর জুড়ে খোঁজা হলো। ফলাফল শূন্য। কাজীদের মাথায় হাত। কিভাবে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। উনার একমাত্র ছেলে ছিল রফিক। ছেলেটা বিয়ে করবেনা বলে পালিয়ে গেছে। দুই পরিবারের মান সম্মান জড়িয়ে আছে এই বিয়ের মধ্যে। এতো আয়োজন এখন যদি বিয়ে না হয়? তাছাড়া কাজীরা এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা। দেলোয়ার কাজীর ভাই আনোয়ার কাজী বুদ্ধি দিলেন। রফিক পালিয়েছে তাতে কি উনার ছেলে তো আছে। যদিও ছেলে ডাক্তার হঠাৎ বিয়ে মানবে কিনা সন্দেহ আছে তবুও পরিবারের কথা ভেবে নিশ্চয়ই মানবে। দুভাই মিলে ঠিক করলেন ছেলেকে রাজি করাবেন।
☆☆☆☆
ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আবির। ভাইয়ের বিয়েতে এসে নিজেকে বিয়ে করতে হবে বুঝতে পারলে কখনও আসতোন। সামনে ওর বাবা চাচা অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বিয়ে গতকাল ধুমধাম করে গায়ে হলুদ হয়েছে। রফিক পালিয়ে যাওয়ার হলে আগেই যেতে পারতো বিয়ের দিন গভীর রাতে কেনো পালিয়ে গেলো মাথায় আসছে না। আবিরের মুখে বিরক্তি। দেলোয়ার কাজী মুখটা আরও করুন করে বলল,
> বাপ বিয়েটা না করলে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। বাপ চাচাকে এবারের যাত্রাই বাঁচা। কথা দিচ্ছি জীবনে তোর কাছে কিছু চাইবো না।

আবির রাগ সামলাতে পারলো না ঝাঝালোভাবে বলল,

> পাববো না। জানা নেই চেনা নেই হুট করে কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। এসবের আগে কিছু জিঞ্জাসা করেছো? পেটে শুধু কূটচাল। বিয়ে নিয়ে কিছু একটা প‍্যাচ ছিল তোমাদের তাইনা?। আমি ওসব পারবো না। আমি আজকেই ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। বাচ্চা একটা মেয়ে আমার সঙ্গে কিভাবে কি?
আনোয়ার কাজী ভাইকে পরাজিত দেকে নিজে হাত জোর করে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উনি জানেন ছেলে যখন বলেছে করবে না তখন করবেই না। কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। বিয়ে না হলে কতদিনের পরিকল্পনা সব ব‍্যর্থ। উনি ছলছল চোখে ছেলেকে বললেন,
> বিয়ে না করলে বাপ চাচার কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। বিষয়টা আর পরিবারিক পর্যায়ে নেই। লোকজন হাসাহাসি করবে তার চাইতে মৃত্যু ভালো। ওরা কতটা আশা করে আছে। দুই পরিবার এবার এক হবে। কি আর করা হলো না।
আবির বুঝতে পারলো ওর বাবা ওকে কৌশলে ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সত্যিই বিয়েটা খুব জরুরি। বহুদিনের শত্রুতার অবসান হওয়ার দরকার। বিয়েটা ও করবে। আবির মুখ কঠিন করে বলল,
> বিয়ে করবো আমি তবে শর্ত আছে।
দুভাই যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
> সব শর্তে রাজি তুই শুধু বল কি করতে হবে।
আবির ভেবে চিন্তে উত্তর দিলো,
> দুদিন পরে আমার ফ্লাইট বউ নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করবে না। আপাতত বউকে এখানেই থাকতে হবে। আর আমার সব সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে যখন যা বলবো সবাইকে তাই শুনতে হবে।

এখন বিয়েটাই আসল আবিরের শর্ত কোনো ব‍্যাপার না। তাছাড়া বিয়ের পরে দেখা যাবে কি হয়। সেই হিসেবে দুজন রাজি হয়ে গেলো। আবিরের সঙ্গে হৈমন্তী বিয়েটা সেদিন হয়ে গেলো। মির্জা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলেও কাজী বাড়িতে বেশ আনন্দঘন পরিবেশ। আমেনা বেগম বেশ খুশী রফিককে জামাই হিসেবে উনার পছন্দ ছিল না কিন্তু না বলতে পারেননি। যখন পাত্র বদলে গেল তখন উনি একটু বেশিই খুশী ছিলেন। রাজীব বোনকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চোখের পানি মুছতে পারলো না তার আগেই শুনলো দেলোয়ার কাজী ওর প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচনে নামছে। কাজীরা দুভাই যৌথ পরিবারে বসবাস করে। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের গলাই গলাই ভাব। রাজীবের চোখেমুখে বিস্ময়। বিষয়টা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। ওকে ঠকানো হয়েছে। ওর জানা আছে আগামীকাল সকালবেলা ও বাড়ি থেকে কি নির্দেশ আসবে। বোনকে ভালো রাখতে হলে ওকে নির্বাচন থেকে সরে আসতে হবে। কাজীদের পরিকল্পনা সফল। রাজীব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। কাজী বাড়িতেও আনন্দটা স্থায়ী হলো না। কারণ বউ নিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়ে দেখলো রফিক ফিরে এসেছে। ওর হাত পায়ে জখম। কেউ ইচ্ছা করে ওকে বেঁধে রেখেছি। কিন্তু কাউকে সন্দেহ করা যাচ্ছে না। কে ওকে বাঁধতে পারে আর তাঁর উদ্দেশ্য কি হতে পারে বোঝা গেলো না। কাজী বাড়িতে এটা নিয়ে বৈঠক বসলো।

চলবে

পর্ব:৩
রফিক হৈমন্তীর সঙ্গে আবিরের বিয়েটা মানতে নারাজ। অকথ্য ভাষায় সবাইকে গালি গালাজ করছে। বাড়ির লোকজন যে ওকে ভালোবাসে না এটা নাকি তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ। ওকে খোঁজার জন্য বিয়েটা একদিন পিছিয়ে দিতে পারতো কিন্তু না দিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলো। নিজের পছন্দের মেয়েকে নিজের ভাইয়ের বউ হিসেবে মানতে ওর অসুবিধা হচ্ছে। কাজী বাড়িতে বউদের বেশ সম্মান আছে। রফিককে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে পাঠানো হলো। এখনো হৈমন্তীকে বরণ করা হয়নি। আবির বিরক্ত হচ্ছে বসে থাকতে থাকতে। ওদের দুজন কে ডাইনিং রুমের সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে হৈমন্তীর দৃষ্টি আশেপাশে ঘুরছে। এখনো বরের মুখ দেখা হয়নি। ওর ভয়ের চাইতে কৌতূহল বেশি। আসার সময় ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হননি। আরাফাত ওর সঙ্গে রাগ করেছে বিষয়টা নিয়ে ও চিন্তিত। কিভাবে ভাইয়ের রাগ ভাঙানো যায় সেই চিন্তা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। বিপদের দিনের বন্ধু হচ্ছে ভাইয়া।হৈমী যখনই কোনো ঝামেলা পাকিয়ে উদ্ধার হতে পারে না তখনই আরাফাত এসে ঝড়ের গতিতে ওকে উদ্ধার করে। হৈমন্তীর ধ‍্যান ভাঙলো পাশ থেকে আসা আওয়াজ শুনে।

> তোমরা উঠে আসো।

হৈমন্ত মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় দাঁড়িয়ে পড়লো। ভদ্রমহিলা ওদের নিয়ে গিয়ে বরণ করে হৈমন্তীকে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। হৈমন্তী একটা বিষয় লক্ষ্য করলো এই বাড়ির মেয়ে বউদের কারো মুখেই হাসি নেই। সকলেই গম্ভীর। তবে ছেলেদের সবাই স্বাভাবিক বেশ কথাবার্তা বলছে। মেয়েদের দিকে তাঁকালে মনে হচ্ছে মানুষের মতো দেখতে কোনো রোবট। দরকার ছাড়া একটা কথাও উচ্চারণ করছে না। হৈমন্তীর এবার ভয় করছে। ও তো বেশ কথা বলে। এই পরিবেশের সঙ্গে কিভাবে মানিয়ে চলবে মাথায় আসছে না। আবির বরণের সঙ্গে সঙ্গেই কোথায় একটা চলে গেছে। হৈমন্তীকে বাইরে বসিয়ে রাখা হলো। হৈমন্তীর শাশুড়ির মুখটা স্বাভাবিক কিন্তু চাচি শাশুড়ির মুখে বিরক্ত। ভ্রু জোড়া কুচকে রেখেছে। হৈমন্তী অবাক চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে সেসব খেয়াল করলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো। রুমটাবেশ পরিপাটি করে সাজানো তবে কোনো ফুলের বাসর নেই। কয়েকটা ফুলদানিতে রজনী গন্ধা ফুলের সঙ্গে গোলাপ রাখা আছে। বিয়ে বাড়ির সঙ্গে এই বাড়ির কোনো মিল নেই। হৈমন্তী ভয়টা দ্বিগুন হচ্ছে। কিছু একটা ভেবে বিছানা থেকে নামার জন্য পা বাড়াতেই দরজা খুঁলে গেলো। হৈমন্তী পা গুছিয়ে নিয়ে পূর্বের মতোই জড়সড় হয়ে বসলো। আবির এক ঝলক মেয়েটার দিকে তাঁকিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো। হৈমন্তী সেদিনের তাঁকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা বেরিয়ে আসলো। আবির সোফায় বসতে বসতে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> কি নাম তোমার?
হৈমন্তী ভয়ে কেঁপে উঠলো। ঢোক গিলে বলল,
> হৈমন্তী।
আবির ভ্রু কুচকে বলল,
> আগেপিছে কিছু নেই?
> জ্বী আছে মির্জা, হৈমন্তী মির্জা।
> কোন ক্লাসে পড়ো? দেখে তো মনে হচ্ছে ক্লাস নাইন।

হৈমন্তীর বেশ রাগ হলো লোকটার কথা শুনে।তবে ভয়ও পাচ্ছে। পড়াশোনার কথা জিঞ্জাসা করতেই ওর মনে হলো ওতো প্রথম সাময়িক পরীক্ষাতে দুটো সাবজেক্টে ফেল করেছে। এখন যদি লোকটা জেনে যায় কি হবে? না না বলা যাবে না। তাছাড়া ওতো প্রথমেই ভেবেছিল মাধ্যমিক ফেল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে পড়াশোনার কথা আর জিঞ্জাসা করবে না। ঝামেলা হবে না। কে জানতো পাত্র পাল্টে যাবে। আগে জানলে বিয়েটা ও করতোই না। আবির ওকে চুপচাপ দেখে বলল,

> যাওয়া ফ্রেস হয়ে এসে ঘুমাও। বাচ্চাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আমার বিরক্ত লাগে।

হৈমন্তী ঘোমটার উচু করে একবার লোকটার মুখটা দেখে নিলো। লোকটা দেখতে সুদর্শন তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু মুখের হাসির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এরা হাসে না ক‍্যান এই প্রশ্নই ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। হৈমন্তী চুপচাপ ফ্রেস হয়ে আসলো। শাড়ি চেঞ্জ করে থ্রি পিচ পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। আবির একবার দরজা খোলার শব্দ শুনে মাথা তুলতেই দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেলো। আবিরের কাছে মেয়েটা নেহায়েত বাচ্চা ছাড়া কিছুই না। এইটুকু একট মেয়ের বিয়ে কিভাবে দিতে পারে ওর ভাবনার বাইরে। বাপ চাচাকে মনে মনে ইচ্ছা মতো ধুয়ে দিলো। হৈমন্তী চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বিছানা জড়সড় হয়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিনব্যাপী যে ধকল গিয়েছে তার ফলাফল হিসেবে শুতেই ঘুমিয়ে পড়লো। ফোন হাতে বসে আছে আবির। কিছুক্ষণ আগে একটা টেক্সট এসেছে। এটা নিয়ে বেশ চিন্তিত কিছু না ভেবে বাইরে বেরিয়ে পড়লো।
☆☆☆☆
সকালবেলায় কারো স্পর্শ পেয়ে হৈমন্তীর ঘুম ভাঙলো। চোখ খুঁলে দেখলো পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। মেয়েটার চোখেমুখে হাসির আভা। হৈমন্তী ধড়ফড় করে উঠে বসতেই মেয়েটা বলে উঠলো,

> ভয় পাচ্ছো কেনো? ভয়ের কিছু নেই। তোমার ভাইয়া এসেছে তোমাকে নিতে। যাবে না?

খুশীতে হৈমন্তীর চোখ চকচক করে উঠলো। বাড়িতে ফিরবে এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। হৈমন্তী তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। হঠাৎ ঘুম ভাঙার জন্য শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। মেয়েটা মলিন মুখ নিয়ে ওর সামনে বসে পড়লো। হৈমন্তীকে চুপচাপ দেখে বলল,

> ভাইয়া চলে গিয়েছে তোমার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছে। ভাইয়াকে ভূল বুঝো না। আজকের মধ্যেই ওকে যেতে হলো নয়তো ফ্লাইট মিস করতো। তুমি চিন্তা করো না ভাইয়া ফিরে আসবে।

মেয়েটা কথা শেষ করে ওর হাতের মুঠোয় একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেলো।হৈমন্তীর চোখ বড়বড় করে তাঁকালো। মেয়েটা যেমন এসেছিল তেমনিভাবে চলে যেতেই ঝড়ের গতিতে রাজীব ভেতরে ঢুকে হৈমন্তীর হাত ধরে বলল,

> বাড়ি চল হৈমী। এখানে তোকে আর থাকতে হবে না। খুব ভূল করে ফেলেছি তোকে এদের বাড়িতে বিয়ে দিয়ে।

হৈমন্তী বিস্মিত হয়ে জিঞ্জাসা করলো,

> কেনো ভাইয়া?

> এরা ভালো মানুষ না। তুই লাগেজ গুছিয়ে নে। এখুনি বের হবো।

হৈমন্তী চেঞ্জ করলো না। লাগেজ নিয়ে ভাইয়ের পেছনে পেছনে বের হলো। ডাইনিং রুমে বড়সড় একটা ঝামেলা হচ্ছে। এ বাড়ি থেকে মির্জ বাড়ির নামে অভিযোগ করা হয়েছে। বোনের বিয়ে ওরা কৌশলে কাজী বাড়ির ডাক্তার ছেলের সঙ্গে দিতে রফিককে আটকে রেখেছিল। রাজীব প্রতিবাদ করেছে। এমন হলে আগেই ও বিয়ে ভেঙে দিতে পারতো। রাজীবকে থ্রেট করা হয়েছে নির্বাচন থেকে সরে আসতে। তাছাড়া জামাই বিয়ের রাতেই বিদেশ পাড়ি দিয়েছে সেখানে বোন কিভাবে সুখে থাকবে এটা নিয়ে চিন্তিত রাজীব। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করেছে এই বাড়িতে বোনকে রাখবে না। দরকার নেই দু পক্ষের মিলমিশের। এরা মানুষ না।কাজী বাড়ির ছেলেদের ডিভোর্স হয়না তবে স্ত্রী মারা গেলে বিয়ে করার নিয়ম আছে। রাজীব জানেনা এই ভুলভাল নিয়ম কে সৃষ্টি করেছে। আনোয়ার কাজী ভাইয়ের জন্য বউমাকে খুন করে গুম করে দিতেও পিছপা হবে না। ভরসা করার মতো এখানে কেউ নেই। রাজীব ওকে নিয়ে দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কোথায় থেকে হৈমন্তীর শাশুড়ি আসমা বেগম এসে হাজির হলেন। উনি ছলছল চোখে হৈমন্তীর হাতে বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন,

> তোমার সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলতে পারিনি। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রথমে রাগ হয়েছিল ভেবেছিলাম ডাক্তার ছেলের সঙ্গে ডাক্তার বউ নিয়ে আসবো। তোমার মুখটা দেখেই কেমন মায়া হলো। পথ চেয়ে থাকবো তুমি আবার ফিরবে আসবে আমার বাড়িতে।

হৈমন্তীর বেশ মায়া হলো। কিন্তু ওর তো কিছু করার নেই। রাজীব গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> আন্টি বোনকে রেখে যাওয়ার মতো ভরসা পাচ্ছি না।বিয়ের রাতে বউ ফেলে জামাই চলে যেতে দেখেছেন কখনও? তাছাড়া আমাদের নামে জঘণ্য রকম অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার ছেলে যদি আসে তখন দেখা যাবে।

রাজীব কথাটা শেষ করে অপেক্ষা করলো না। হৈমন্তীক টেনে বের হয়ে আসলো। আরাফাত এসেছে বোনকে নিতে। ডাইনিং রুমে রফিকের সঙ্গে ওর তর্কাতর্কি চলছে। আরাফাতকে ও দোষারোপ করছে। বিয়ের রাতে রফিক বন্ধুদের সঙ্গে মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরছিল তখন কেউ ওর মুখ বেধে কিডন‍্যাপ করে। রফিক সোজাসুজি আরাফাতকে দোষী করছে। ছেলেটার রাগ বেশি। অযথা ওকে দোষ দেওয়াই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দুম করে রফিকের মুখের মধ্যে ঘুষি বসিয়ে দিলো। ঝামেলা আরও বাড়লো। হাতাহাতি হলো। বহুকষ্টে আরাফাতকে ওখান থেকে বের করা হলো। মির্জা বাড়িতে ফিরে এলো হৈমন্তী। বিয়েটা নিয়ে ওর অনেক কৌতূহল ছিল সব মিটে গেলো। এক রাতের ব‍্যবধানে আবিরের মুখটা পযর্ন্ত মনে পড়ছে না। আমেনা বেগম ছেলেদের উপরে রুষ্ট হয়েছেন। মেয়েটার সংসার হলো না এই ছেলেদের জন্য। উনি হম্বিতম্বি করছেন। রাজীব রাগ করে বোনকে ঢাকাই খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। আমেনা বেগমের সামনে থাকলেই ঝামেলা হবে
জেলা শহর থেকে রাজধানীতে পৌঁছে গেছে হৈমন্তী। নতুন শহর নতুন পরিবেশ। আরাফাত ওকে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেল। মোটামুটি দিনকাল ভালো যাচ্ছে। হৈমন্তীর খালা রাহেলা হকের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে রাকিব ডাক্তারি পাশ করে স্থানীয় হাসপাতালে চাকরি করছে আর মেয়ে ছোঁয়া হৈমন্তীর দুই বছরের সিনিয়র। এদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হৈমন্তী হিমশিম। হৈমন্তীকে এরা তেমন পাত্তা দেয়না। তবে খালার সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক। রাহেলা হক বোনের মেয়েকে পেয়ে বেজায় খুশী।
গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে বর্ষা এলো আবার চলেও গেলো। হৈমন্তী একটা বছর খালার বাড়িতে আছে। আরাফাত মাঝেমাঝে ওকে দেখতে আসে। রাজীব নির্বাচনে পাশ করেছে তবে কাজীদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। কাজীরা ভূলেই গেছে মির্জা বাড়ির সঙ্গে ওদের একটা সম্পর্ক আছে। হৈমন্তীর এক দিনের সংসার। এক বছরে হৈমন্তীর অনেক উন্নতি হয়েছে। পড়াশোনার প্রতি ভালো মনোযোগ এসেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। মন দিয়ে পড়ছে।
_____________
প্রতিদিনকার মতো বই নিয়ে বের হলো হৈমন্তী। খাবার টেবিলে গিয়ে বসতেই ছোঁয়া ফিসফিস করে ওর ভাইকে বলল,
> ভাইয়া জানো হৈমী বিবাহিত। বাসর রাতে বর পালিয়েছে বিষয়টা কেমন না? বেচারা বউয়ের মুখ দেখেই পালিয়ে গেছে আর ফিরে আসেনি।

ছোঁয়ার কথা শেষ হলো না রাহেলা হক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। হৈমী মাথা নিচু করে খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে গেল। রাকিব বিস্মিত হয়ে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী । পরিবারের অবস্থাও খারাপ না বরং বেশ ভালো তাহলে বর কেনো পালিয়ে গেল হজম হচ্ছে না। তারপর ভাবলো ছেলের হয়তো আলাদা পছন্দ আছে। কথাটা ভেবে ও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। এক বছর ধরে মেয়েটাকে দেখছে। তেমন কথাবার্তা না হলেও লুকোচুরি করে দেখা হয়েছে শতাধিক বার। আগে বিরক্ত লাগত তবে এখন আর লাগে না। বেশ ভালো লাগে। হৈমন্তী খাবার রেখে উঠে পড়লো। মলিন হেসে বলল,

> খালামনি সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি বাইরে থেকে খেয়ে নিব।

রাহেলা হক ওকে আটকনোর চেষ্টা করলেন কিন্তু হলো না। হৈমন্তী চলে গেছে। রাকিব বিরক্ত হয়ে ছোঁয়াকে বলল,

> হিংসা ভালো তবে মাত্রাতিরিক্ত নয়। আমার মাথাতেই আসছে না ওকে দেখে তোর হিংসা কেনো হয়। আরাফাত জানলে জান্ত দাফন করবে।

রাকিব উঠে আসলো। ছোঁয়া রাগে ফুলছে। আরাফাতকে ও পছন্দ করে না, একদম করে না। ছেলেটা ওকে বেশ কয়েকবার অপমান করেছে সেই রাগ গিয়ে পড়েছে হৈমন্তীর উপরে। ওরা বোনকে এতো ভালোবাসে তাহলে এতদিন পরের বাড়িতে রেখে গেছে কেনো এটাই ওর মাথায় আসে না। রাকিব দ্রুতগতিতে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় হৈমন্তী রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রাকিব ওর সামনে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুঁলে দিয়ে বলল,

> চলে এসো আমি কলেজের সামনে নামিয়ে দিব।
হৈমন্তী কিছু একটা ভেবে গাড়িতে উঠে আসলো। রাকিব সামনের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

> ফিরবে কখন?

হৈমন্তী অবাক হচ্ছে ভাইয়ের কথা শুনে। হৈমন্তীকে চুপচাপ ভাবতে দেখে রাকিব বিড়বিড় করে বলল,

> কিছু জিঞ্জাসা করেছি উত্তর দাও। সারাদিন বাড়িতে তো খুব বকবক করো শুনেছি।

হৈমন্তী বিস্মিত হয়ে উত্তর দিল,

> ক্লাস শেষে ফিরবো। প্রাইভেট আছে ফিরতে বিকেলে হয়ে যাবে।

> ও আচ্ছা।

সারা রাস্তায় ওদের আর কথা হলো না। হৈমন্তী অবাক হচ্ছে কারণ লোকটার সঙ্গে ওর আজকেই প্রথম কথা হচ্ছে। নিজে যেচে ওকে পৌঁছে দিচ্ছে হজম হচ্ছে না। রাকিব ওকে কলেজের সামনে ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। হৈমন্তী আর পেছনে তাকালো না। মহিলা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষদের নজরে পড়ার কোনো মানে হয়না।

রাকিবের অবচেতন মনে হৈমন্তী জন্য একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে ওর চিন্তা হচ্ছে। আরাফাতের সঙ্গে কথা বলবে। মেয়েটার দায়িত্ব নিতে ওর অসুবিধা নেই কিন্তু ও কি জানে কাজী বাড়ির বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার অপরাধ কতটা ভয়ানক হবে। কাজীরা মির্জা বাড়িতে সারা বছর হুমকি ধামকী দিয়ে আসছে ওদের বাড়ির বউকে ফিরিয়ে দিতে কিন্তু রাজীব কিছুতেই মানছে না। ওর ধারণা বোনকে নিয়ে গিয়েই ওরা মেরে ফেলবে। তাই এই লুকোচুরি।।
☆☆☆☆
সারাদিন না খেয়ে ক্লাস শেষ করে বের হলো হৈমন্তী। বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে ওর ভালো সম্পর্ক হয়েছে। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রিকশার জন্য। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। খাঁখাঁ রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে একটা রিকশা পেয়েও গেলো। কিন্তু রাস্তার পেরিয়ে গিয়ে উঠতে হবে। হৈমন্তী অপেক্ষা করলো না দ্রুত এগিয়ে গেলো। কর্মব্যস্ত শহর হাজারো যানবাহন চলছে। হৈমন্তী দৃষ্টি রিকশার দিকে। এর মধ্যেই একটা গাড়ি এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে দিলো। লোকটা হয়তো গাড়ি থামানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। হৈমন্তী ততক্ষণে পড়ে গেছে। হাত পায়ে বেশ চোট লেগেছে। একজন মেয়ে এগিয়ে এসে ওকে ধরলো। হৈমন্তী যন্ত্রণায় ছটফট করছে। গাড়ির মালিককে লোকজন আচ্ছা করে বকছে। লোকটা কাচুমাচু হয়ে সবাইকে বুঝিয়ে হৈমন্তীকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে নিলেন। ভদ্রলোক হৈমন্তীকে পাশের একটা ভালো ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। গাড়িতে উঠার সময় হৈমন্তী জ্ঞান থাকলে বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারলো না। হাতের তালুতে বেশ লেগেছে রক্ত ঝরছে। পায়ের অবস্থাও ভালো না। জ্ঞান হারালো
☆☆☆☆
গম্ভীর হয়ে বসে আছে আবির। মন মেজাজ ঠিক নেই। বাড়িতে প্রচুর অশান্তি করে এসেছে। বাবা চাচার উপরে ও বিরক্ত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প‍্যাচালো বুদ্ধি বাড়ছে। আবির কিছুদিন আগেই বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে। বাড়ির অবস্থা আগের মতো নেই। বাবা চাচারা মিলে বেশ খিচুড়ি পাকিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বাড়ি গড়ের মঠ হয়ে উঠবে। সবাইকে বুঝিয়েছে কিন্তু কেউ বুঝতে চাইছে না। রফিক রাজনীতিতে নেমেছে। এই ছেলেটাই হচ্ছে যত নষ্টের মূল। বাবা চাচকে ভুলভাল বুঝিয়ে মির্জাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে। আবির বিরক্ত হয়ে বাড়ি ছেড়েছে। হঠাৎ ফোনের শব্দে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। হাসপাতালের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে দ্রুত রিসিভ করলো। রোগী এসেছে ওকে যেতে হবে শুনে আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত বেরিয়ে পড়লো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here