#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি
-“বাবা, তোমার লজ্জা করলো না সবাইকে লুকিয়ে একটা মেয়ে ঘরে এনে রাখতে? বিয়ে করেছো? জানালেই পারতে আমায়। এক বছরেই এত পর হয়ে গেছি আমি? তাছাড়া দুদিন আগেও তো আমি এসেছিলাম। তখন ওনি কই ছিলেন?”
-“বাবার বাড়িতে। সেসব তোমার দেখার বিষয় না। তুমি বিয়ে করে ফেলেছো। সুতরাং এ বাড়ির ব্যক্তিগত বিষয়ে তোমার না গলালেও চলবে।”
সায়ন সাহেবের কথায় আকাশ থেকে পড়ল সিদ্ধি। নিজের বাবার মুখেও এমন কথা শুনতে হবে কখনো কল্পনাতেও আসেনি তার। যেই বাবা কিনা তাকে আজীবন মাথায় তুলে রেখেছে, সেই বাবাই আজ তাকে পর করে দিল? চোখটা ঝাপসা হয়ে এসেছে সিদ্ধির। আয়াশ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সিদ্ধি থামিয়ে দিল। চোখের জলটুকু মুছে স্পষ্ট গলায় বললো,”আপনাকে নানা হওয়ার সুসংবাদ দিতে এসেছিলাম কিন্তু আপনি তার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন সায়ন সাহেব।” কথাটুকু শেষ করেই সিদ্ধি বেরিয়ে যেতে নেয় কিন্তু পারে না। কেউ একজন পেছন থেকে তার হাত ধরে রেখেছে। সিদ্ধি ভেবেছিল হয়তো তার বাবা কিন্তু পেছনে ফিরে খেয়াল করলো শোভা তার হাত ধরে রেখেছে। সিদ্ধি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। শোভা বেশ মায়াবী গলায় বলে উঠলো,”এসেছো যখন, ক’টা দিন থেকে যাও। তোমার মায়ের মতো সেবা হয়তো করতে পারবোনা কিন্তু নিজের মেয়ে ভাবতে এক বিন্দুও কার্পণ্য দেখাবো না।” সিদ্ধি আয়াশের দিকে তাকালো। আয়াশ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। পোশাক-আশাক বলতে কিছুই আনেনি সিদ্ধি তবে এ বাড়িতে তার বেশ কিছু কাপড় ছিলই আগে থেকে।
সায়ন সাহেব হড়হড় করে ঘরে চলে গেলেন। শোভা আয়াশ আর সিদ্ধিকে বসালো। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে এনে দুজনকে দিল। সিদ্ধি মিষ্টি হাতে নিতেই শোভা বলতে শুরু করলো,”ওনার একটু রাগটাই বেশি আর চিন্তায় থাকলে তো কথাই নেই। ওনার ব্যবসা আবার নতুন করে শুরু করছেন তো তাই সেসব নিয়েই একটু ঝামেলা। এমনিতে ওনি মন থেকে খুব ভালো। তোমায় যা বলেছেন, রাগ করে বলেছেন। তুমি মনে নিও না ওসব।” তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে সিদ্ধি। দুদিন হলো তার বাবার জীবনে আসা মহিলা তাকেই তার বাবার রূপ চেনাচ্ছে? বাহ! এমন দিনও কি দেখার বাকি ছিল সিদ্ধির?
শোভা সিদ্ধির ঘরটা গুছিয়ে রেখেছে। দুদিন পর আজ এ বাড়িতে প্রবেশ করেই সিদ্ধির যেন মনে হচ্ছে এ বাড়িটা সম্পূর্ণ অপরিচিত তার জন্য। আয়াশ আর সিদ্ধিকে বসিয়ে ঘর ছেড়ে গেলেন শোভা। আয়াশ সিদ্ধির কোলের উপর মাথা রাখলো।
-“তুমি ক’দিন থাকবে এখানে?”
-“কেন? যতদিন ইচ্ছে থাকি। তোমার কী সমস্যা? ও বাড়িতে আরেক বউ তো পড়েই আছে তোমার। সেজন্যই তো আমায় এ বাড়িতে রেখে যাওয়ার এত তাড়া তোমার।”
সিদ্ধির কথা শেষ না হতেই আয়াশ উঠে দাঁড়ালো। সিদ্ধির কপালে চুমু দিয়ে বললো,”যেদিন ফিরতে ইচ্ছে হয়, কল দিও আমায়।” বলেই ঘর ছেড়ে প্রস্থান করলো আয়াশ। সিদ্ধি উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। আয়াশও রাগ করলো ওর উপর? সবাই কেন তাকে একা করে দিচ্ছে এমন করে? আনমনে গুনগুন করতে থাকে সিদ্ধি,” ওরা মনের গোপন চেনে না, ওরা হৃদয়ের রঙ জানে না।”
______________________
আনিসের লাশ নামানো হচ্ছে। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, মৃত্যু আধঘণ্টা আগেই হয়ে গেছে। হৈচৈ পড়ার পর দরজা ভাঙতে ভাঙতেই লাশ ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে। তূর্য একমনে তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। সহস্র পাপ-নোংরা কাজ করতেও যার হাত কাঁপেনি, অথচ সব ভুলে ভালো হতে চেয়েও আর পৃথিবীতে থাকতে পারলো না লোকটা। আসলে মানুষের সাইকোলজিটাই এমন। খারাপ কাজ করে খারাপ মানুষ হয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকা যায় কিন্তু ভালো মানুষ হয়ে খারাপ কাজের কথা স্মরণ অবধি করলে অনুশোচনা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ভেতরটাকে, একটা মুহূর্ত বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যায়।
আসর পরে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে আনিসের। সবাইকে জানানো হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। আত্মহত্যার খবর জানাজানি হলে ইমাম সাহেব জানাযা তো পড়াবেনই না, তার উপর পুলিশি তদন্তের ঝক্কি তো আছেই। আয়াশের কাছে কল করেছিল তূর্য কিন্তু এত অল্প সময়ে আয়াশের গ্রামে আসা সম্ভব না। তূর্যও চায় না আয়াশ গ্রামে আসুক। আয়াশের মুখ দেখলেই তার কষ্ট হয় এই ভেবে যে নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর থেকে কত কী লুকোতে হচ্ছে তার।
জানাযা শেষে আনিসকে কবর দিয়ে তায়েফউদ্দিন তূর্যকে নিজের ঘরে ডাকেন। তূর্য জানে এখন তাকে অজস্র প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করেই ঘরে ঢুকলো সে কিন্তু ঘরে ঢুকতেই হতভম্ব হয়ে গেল। তায়েফউদ্দিন সিগারেট ফুঁকছেন। এত বছরে তূর্য কোনদিন নিজের বাবাকে সিগারেট স্পর্শ করতেও দেখেনি অথচ সেই মানুষটা কিনা সিগারেট খাচ্ছেন? তূর্য পাশে বসতেই তায়েফউদ্দিন তূর্যর দিকেও একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন। আকাশ থেকে পড়লো তূর্য। সিগারেট না নিয়েই বলতে শুরু করলো,
-“বাবা, আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা একেবারেই ভালো নেই কিন্তু তুমি অসুস্থ। এ অবস্থায় সিগারেট খাওয়া তোমার জন্য একদম উচিত না।”
-“উচিত-অনুচিতের দোহাই দিস না তূর্য। এতই যখন উচিত-অনুচিত ম্যাটার করে তোর কাছে, তাহলে কেন আনিসের পাপকর্মের সবটুকু জেনেও আমাকে বললিনা। অন্তত ওর অবৈধ সন্তানটার কথা বলতে পারতি।”
-“বা..বাবা..”
-“চুপ! কথা শেষ হতে দে আমার। ততক্ষণ চুপ থাকবি।”
-“জ্বী বাবা।”
-“আনিসের স্বভাব-চরিত্র ছোট থেকেই শয়তানিতে ভরা। ভাবতাম দুষ্টুমিরই সময়, বড় হয়ে শুধরাবে। শুধরালো না। বিয়ে-শাদী দিয়ে শুধরাতে চাইলাম। বুঝতে পেরে সব পাকাপোক্ত হওয়ার পর বিয়ের একদিন আগে বিয়ে ভেঙে দিল। মেয়ের পরিবার তখন সেই ক্ষ্যাপা। সেসবকে অবশ্য আমি পরোয়া করিনি তবে মেয়েটার অশ্রুমাখা নয়ন উপেক্ষা করতে পারিনি। বিয়ে করে নিলাম মেয়েটাকে। সেই মেয়েটাই তোমার মা। ভেবেছিলাম বেণু আমার সংসারে এসে সব গুছিয়ে নিবে। পারলো না, তোমার ঐ দুশ্চরিত্র চাচার সামনে যেতেও ভয় পেত বেণু। ছন্নছাড়াই রয়ে গেল আনিস। তবে ও যে এতটা নিচে নেমে গেছে তা তখন তোমার আর ওর কথা আড়ালে না শুনলে বুঝতে পারতাম না।”
-“দুঃখিত বাবা।”
-“তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই। যার মৃত্যু যখন নির্ধারিত আছে, তার মৃত্যু তখনই হয়। এতে আমাদের তো কোন হাত থাকে না। যাই হোক, তুমি এসো এখন। আমি একটু একা থাকতে চাই।”
তূর্য ঘর ছেড়ে বেরোলো। তায়েফউদ্দিন তখন একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা হাতে নিয়েছে।
________________________
শোভা সিদ্ধির ঘরে একগ্লাস গরম দুধ দিয়ে গেলেন। এখনো রাতের খাবারটাই খায়নি সিদ্ধি। প্লেটটা ঢাকা পড়ে আছে পাশে। শোভা বেশ জোরাজুরি করে গেছে কিন্তু খাওয়াতে পারেনি। শোভা অবশ্য অধিকার খাটাতেও ভয় পাচ্ছে কিছুটা, পরের মেয়ে বলে কথা। সিদ্ধি অপেক্ষায় আছে আয়াশের কলের। সেই কখন গেছে ছেলেটা, এতক্ষণে একটাবারও কি কল করা যেত না? রাগ ভুলে সিদ্ধিই কল করলো আয়াশকে। প্রথম দুইবার কল কেটে দিল আয়াশ। তৃতীয়বার কল করার পর ধরলো।
-“কী হয়েছে? কল ধরছিলে না কেন?”
-“চোখ লেগে গেছিল। আনিস চাচা মারা গেলেন। খবর শুনে মন খারাপ ছিল। কখন যে চোখ লেগে গেছিল বুঝিইনি।”
-“খেয়েছো রাতে?”
-“না, খাবো এখন।”
সিদ্ধি কিছু বলতে যাবে তার আগেই অপর পাশ থেকে শুনতে পায় রুফুর গলা,” খেতে আসেন আয়াশবাবু।” আয়াশ “আসছি” বলেই সিদ্ধিকে বিদায় জানায়। কল কেটে যাওয়ার পরও ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে সিদ্ধি। আয়াশ একবারও খোঁজটুকু নিল না যে সিদ্ধি খেয়েছে কিনা? একদিনেই এত পর হলো সে? এত রাগ? এত অভিমান? রাগ-অভিমানই মুখ্য হলো আয়াশের কাছে? সিদ্ধির ভালোবাসা কিছুই না? আচমকা দরজায় ঢকঢক শব্দ শুনে কেঁপে উঠলো সিদ্ধি।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং গল্প কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন।]