চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব অন্তীত পর্ব

0
775

চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]

[অন্তিম পর্ব]

সময় মানেই নগণ্য। মানবজীবন থমকে গেলেও সময় সর্বদা চলমান। প্রতি মুহূর্তে সেকেন্ডের কাটা, মিনিটের কাটা ঘুড়ে বারোর ঘরে আসে। ঘন্টার কাটা চলতে চলতে পুরো ঘড়ির দ্বারপ্রান্ত পরিভ্রমণ করে। থেমে নেই তারা। সময় ঘনিয়ে বিয়ের দিন এলো। আজ অর্ষার গায়ের হলুদ। ঘটা করে কোনো আয়োজন করা হয়নি। তবে এই নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে। নিলয়ই এ ব্যাপারে বারণ করেছে সবাইকে। সে কিছুতেই তার বিয়ের খবর জানাতে চায় না। তার প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অনেক শত্রু রয়েছে। যারা গোপনে থেকে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে এবং ভবিষ্যতেও যে করবে তা নিশ্চিত। তাই সে চায়না তার নিজের জন্য অর্ষার কোনো ক্ষতি হোক। অর্ষা তার স্ত্রী সেটা পাবলিক হলে বিরোধী দল অর্ষার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। তাই ঘরোয়া ভাবেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে চাইছে নিরব। বাধ সাধেন মোঃ এহসান। তার একমাত্র ছেলের বিয়ে তিনি বড় অনুষ্ঠান করে দিতে চেয়েছিলেন। এই নিয়ে নিরব আর এহসানের মাঝে কিছুটা মতবিরোধ হয়। পরোক্ষনে অর্ষার কথা ভেবে নিরবের প্রস্তাব মেনে নেয় সবাই। বর্তমানে দুই পরিবারের কাছের মানুষদের নিয়েই বিয়ের ঝামেলা শেষ করবে তারা।

অর্ষাদের বাসার ড্রয়িংরুমেই তাকে হলুদ লাগানোর ব্যস্ততা করা হলো। সবাই তুমুল রূপে ব্যস্ত এখন। নিরবের মা নিরবকে হলুদ লাগিয়ে সেই হলুদ অর্ষাকে লাগাবে বলে আয়োজন নিয়ে এসেছে। অর্ষা সবুজ পাড়ের কাচা হলুদ রঙ্গের শাড়ি পরেছে। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে সে। এক এক করে সবাই আলতোভাবে তার গালে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। এরই ফাকে অর্ষা বারবার মোবাইল দেখছে। অর্পনের নাম্বারে কল দিলো রিসিভ হলো না। ক্ষুন্ন হলো অর্ষার মন। কি এমন আহামরি কাজ আছে যার জন্য হলুদে আসেনি অর্পন? রাগ হলো তার। অভিমান জমলো অর্পনের উপর। আর কথা বলবে না সে। কলও দিবে না।

যখন হলুদ লাগানো শেষে প্রায় তখন কলিংবেল বেজে উঠলো। এই সময় আবার কে এলো? অর্জন পা চালিয়ে দরজা খুললো। দরজার অপর পাশে ব্যক্তিটিকে দেখে খুশী হলো অর্জন। দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে অর্পন ভিতরে ঢুকে। তাকে দেখেই অবাক হয়। এইসব সময় অর্পন এলো? অবিশ্বাস্য! খুশি হলো অর্ষা। চোখেমুখে তার খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো। অর্পন মৃদু মুচকি হেসে বাটি থেকে কাচা হলুদ তুলে অর্ষার ডান গালে আলতোভাবে লাগিয়ে দিলো। অর্ষাও একটু হলুদ আঙ্গুলে ছুঁইয়ে অর্পনের গালে দিলো। হঠাৎ’ই অর্পন হলুদ থুবড়ে দিলো অর্ষার পুরো মুখে। আকস্মিক ঘটনায় সবাই হেসে উঠলেও হাসলো না অর্ষা। বরং রেগে গেলো খুব। চেঁচিয়ে উঠলো সে, ‘এটা কি করলি? পুরো মুখে হলুদ কেন লাগালি?’

অর্পন সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অতঃপর দাঁত কেলিয়ে হেসে প্রতিত্তুর করলো, ‘আরে ধুরু! এভাবে একটু হলুদ লাগালে বউ হয় নাকি? এখন একদম ঠিক আছে। তোকে দেখে এখন গায়ের হলুদের বউয়ের মতোই লাগছে।’

দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ করে তাকালো অর্ষা। তারপরই ফিক করে হেসে ফেললো। অর্পনও হাসলো। গায়ে হলুদ লাগানো শেষ। এবার গোসল করার পালা। অর্ষার হাতে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি দিয়ে গোসল করতে পাঠালো হেনা। অর্পন অনেক দূর থেকে জার্নি করে এসেছে বিধায় তার খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।

অর্ষার গায়ে লাল পাড়ের গোলাপি শাড়ি। চুল গুল উঁচু করে খোঁপা বাধা। দুই হাতে তার মেহেদী। অর্ষার চাচাতো বোন অর্নী তার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ এক ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুই হাতের দুই পিঠে মেহেদী দেওয়া কম্পলিট হয়েছে। ঘার ধরে এলো অর্নীর। ঘার একাত থেকে ওকাত করে আড়মোড় ভেঙ্গে বলল, ‘জিজুকে বলে পুষিয়ে দিও আপু। আমার হাত ঘাড় দুইটাই কোমায় চলে গেছে।’

মুচকি হাসলো অর্ষা। মেহেদী দেওয়া শেষ করে অর্নী উঠে চলে গেলো। অর্ষা বিছানায় একাধারে এতোক্ষন বসে থেকে বিরক্ত হলো। তাই বিছানা ছেঁড়ে বারান্দার দিকে পা বাঁড়ালো। রেলিংএ হেলান দিয়ে দেখতে লাগলো রাতের মোহনীয় নগরী। আজকের আকাশটা জ্যোৎস্না দিতে ব্যস্ত। চাঁদের আলো এসে আঁচড়ে পরেছে বারান্দার কার্নিশে। গাছের পাতার উপর জ্যোৎস্না পরে আবছা আলোকিত করেছে। অর্ষা মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো এই অপরুপ দৃশ্য। বেশকিছু সময় পর অর্পন নিশব্দে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। টের পেয়েছে অর্ষা তাও নড়লো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

‘আকাশ টা সুন্দর না?’

দূরের আকাশের সাদা-কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো অর্ষা। অর্পন অর্ষার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। নিচু আওয়াজে শুধাল, ‘হ্যাঁ, একদম তোর মতো।’

অর্ষা নিশব্দে হাসি দিলো একটা। তারপর বললো, ‘জানিস? নিরব ভাই কে কেবল দূর থেকেই দেখেছিলাম। কখনো ভাবি নি উনি আমার জীবনসঙ্গী হবেন। তেমন করে অনুভব করিও নি কখনো। কিন্তু এখন দেখ। উনার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে এক প্রকার অদ্ভুত টান অনুভব করি আমি।’

মলিম চোখে তাকালো অর্পন। অর্ষার বলা প্রতিটা কথা তার বুকে তীরের ন্যায় ধারালো সুঁচের মতো বিঁধছে। বুক ভার হয়ে এলো। নিরবে তা সয্য করতে লাগলো। এমন লাগছে কেন তার? সে তো অর্ষাকে ভালোবাসে না। তাহলে?

‘তুই নিরব ভাইকে পছন্দ করিস? বিয়েতে তুই রাজি?’

বিরক্তির চোখে তাকালো অর্ষা। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? রাজি যদি না হতো তাহলে এতো আয়োজন হতো? বললো, ‘পাগল তুই? রাজি না হলে বিয়ে ঠিক হতো? রিফাতের সাথে ব্রেক’আপ হওয়ার পর ভেবে নিয়েছিলাম আব্বুর পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো। আর নিরব ভাইকে তো আমি আগে থেকেই চিনি। তাই অসুবিধে হয়নি। ভালোই হয়েছে। বাড়ি পাশাপাশি। রাগ হলেই বাপের বাড়ি চলে আসতে পারবো।’

শেষের কথা গুলো মজার ছলে বললো অর্ষা। চোখেমুখে তার খুশি। কিন্তু এই খুশি অর্পন নিতে পারলো না। আহত হলো সে। কেন জানে না সে। কষ্ট লাগলো তার। থাকলো না আর এখানে। চুপচাপ অর্ষাকে কিছু না বলে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। অর্ষা আপন মনে নিরবকে নিয়ে ভাবছিলো তাই খেয়াল করেনি একদম।

রাত্রীর আকাশ জ্যোৎস্নায় আলোকিত। চারপাশ রাত্রীর অন্ধকারে অন্ধকারাবৃত। গাছের পাতার ফাঁকে-ফাঁকে ঝিঁঝিঁ পোকারা লুকিয়ে ককর্ষ কন্ঠে ডাকছে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোর নিচে বসে থাকা কুকুর ডাকছে। এই ডাক হাহাকারের। তীব্র থেকে তীব্রতর যন্ত্রনার আহাজারি। সেই ল্যাম্পপোস্টের কৃতিম আলোতে আবছা আলোকিত রাস্তায় হাটছে অর্পন। পা দু-টো একদম চলছে না। অনুভূতি তার শূন্যের কৌটায়। অর্ষার বিয়ে সে মেনে নিতে পারছে না কেন? কি করবে সে? উপায় পেলো না সে। মাথা ব্যাথা তীব্রভাবে বেড়ে গেলো। চোখ লাল হয়ে এলো। নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না আর। বসে গেলো রাস্তার মাঝেই। এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো। এই নামহীন যন্ত্রনা থেকে মুক্তির উপায় চাইলো সে।

সকালের শুরু থেকে বিকেল অব্ধি প্রত্যেক সদস্য ব্যস্ততায় কাটিয়েছে। পুরোটা দিন এই কাজ সেই কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে অর্পন। ভুলে থাকতে চেয়েছে বুকের হাহাকার। কিন্তু পুরোটা দিন কাজে ব্যস্ত থাকলেও বিকেলে বুক ভার হয়ে এলো যখন নিরব আর তার পরিবার আসলো বিয়ের জন্য। একবার অর্ষাকে দেখার জন্য তা রুমে গেলো সে। গিয়ে দেখলো অর্ষা একদম লাল বধূ সেজে বসে আছে। লাল বেনারসি, চুলে লাল গোলাপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, গয়নায় মুখরিত অর্ষা। সুন্দর লাগছে তাকে। কিন্তু এই সাজ তো অর্পনের জন্য না। আজ অর্ষা কবুল বলে সারাজীবনের জন্য অন্যের হবে।

অর্পন কে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অর্ষা বললো, ‘আমাকে কেমন লাগছে রে?’

ঠোঁট টেনে মৃদু হাসলো অর্পন। উত্তর দিলো, ‘অনেক সুন্দর লাগছে। একদম চড়ুইপাখির মতো।’

হাসলো অর্ষা। একহাত উঠিয়ে খোঁপা থেকে একটা গোলাপ ফুল নিলো। এগিয়ে আসলো অর্পনের দিকে। অর্পন গোলাপ ফুলটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। অশান্ত মনে অস্থির হয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাহিরের পরিবেশ অন্ধকারে ঢেকে গেছে একদম। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে অর্পনের। কি করবে সে? বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অর্ষার। হাতের গোলাপ ফুলটার দিকে তাকালো একবার। ভাবলো সে। সে অর্ষাকে ছাড়া থাকবে কিভাবে? অর্ষাকে সে ভালোবাসে? নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো। দাঁড়ালো না আর। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সময় বেশি নেই। দ্রুত পা চালিয়ে দৌড় দিলো বাসার উদ্দেশ্যে। অস্থির মনে এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ি ভেয়ে বাসায় ঢুকলো। তখুনি কানে আসলো তার অর্ষার বলা একটা শব্দ। থেমে গেলো সে।

‘কবুল!’

শব্দ টা তার কর্ণপাত হতেই অনুভূতিহীন হয়ে পরলো অর্পন। ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসলো সবার পরিতৃপ্তির হাসি। আলহামদুলিল্লাহ বলে দোয়া করে নিলো সবাই। অর্পন এখনো সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে। অল্প একটু জন্য সে অর্ষাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললো! নিজের করে রাখতে পারলো না তার চড়ুইপাখিটাকে। হাতের গোলাপ ফুলটা উঠিয়ে দেখলো সে। লাল হয়ে এলো তার চোখ। আজ দশ বছর পরেও এই গোলাপ সে তার ডাইরীতে যত্নে করে রেখে দিয়েছে। এই গোলাপ ফুল তার প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন। এটা যত্নেই রাখতে হয়। ডাইরী থেকে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপটা বের করে হাতে নিলো। মনে পরলো সেই দিনের কথা। যেদিন অর্ষা এই গোলাপ ফুলটা তার হাতে দিয়ে বলেছিলো,

‘বেঁচে থাকুক আজীবন, চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব!’

~ সমাপ্ত ~

নোট : স্যাড ইন্ডিং হওয়ায় কেউ বকা দিয়েন না আমাকে। গল্পটা আমি প্রথম থেকেই এমন ভেবে রেখেছিলাম। নিরবকে হয়তো তেমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আমি ইচ্ছে করেই করিনি। কারন নিরব এবং অর্ষা আবারো নতুন গল্পে নতুন ভাবে আসবে। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং। ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here