চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব পর্ব ২

0
525

চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০২]

গোধুলির আবিরে রাঙ্গানো আকাশ। সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো পরিবেশ। রাস্তার পাশে সোডিয়ামের আলো জ্বলে আলোকিত করলো পথ ঘাট। উচ্চ হাসিতে মুখরিত গলির মোড়ের একটি চা’য়ের দোকান। মাগরিবের নামাজের শেষে এলাকার উচ্চমানের কিছু মুরুব্বী, অর্ধবয়সের লোক বসে চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে আর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে। আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো মসজিদের ইমাম কে নিয়ে। মসজিদে নতুন অজু-খানা করার জন্য এলাকার প্রত্যেকে টাকা দিয়েছিল। দূর্ভাগ্যবশত ইমাম সেই টাকা নিয়ে লাপাত্তা আজ দুই দিন যাবত। এই এলাকার একজন হাফেজ যুবক নতুন ইমাম আসার আগ পর্যন্ত মসজিদে জামায়াতে সালাত পড়াচ্ছে এবং সকালে বাচ্চা দের আরবি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে। মুরব্বীরা মূলত এখন বিশ্বস্ত এবং পূর্ণ সঠিক আকিকার ইমাম রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যথাসম্ভব খোঁজে বের করার চেষ্টা করছে। অর্ষার বাবা মোহাম্মদ আসিফ আলির চায়ের কাপ টেবিলে রাখলো। পরনে তার সাদা পাঞ্জাবি, সাদা টুপি। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘আপাতত ব্যাপারটা অসি সোহেল দেখবে। ইমাম হোসাইনের পরিচয় পত্র তাকে দেওয়া হয়েছে।’

একজন মুরুব্বী কিছুটা ক্রোধ নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘হোসাইনকে কঠিক শাস্তি দেওয়া উচিত। মসজিদের দান করা টাকা চুরি করে অন্যায় করেছে। বিশ্বাস করেছিলাম তাকে আমরা।’

আরেক জন অর্ধ বয়স্ক লোক তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললেন, ‘পালিয়ে আর যাবে কোথায়? কুমিল্লা শহরে অন্যায় করে পালাবে সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব না। শাস্তি পেতেই হবে।’

আরো কিছুসময় মুরুব্বীদের আলোচনা সভা চললো। একসময় হাতের ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো প্রায় এশার আজান দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাই বাড়ি না ফিরে একবারে নামাজ শেষ করে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো সবাই। আজকে দোকানের বিল মিটালো মোহাম্মদ আসিফ আলির। এভাবেই এলাকার সবাই একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব শুভল আচরন করে। শান্তি কমিনিটির সভাপতি এহসান হোসেন এলাকার শান্তি বজায় রাখার আপ্রান চেষ্টা করে। আর এলাকাবাসীও মিলেমিশে সবাইকে নিজ পরিবার ভেবে একত্রে বসবাস করে। চায়ের দোকান থেকে উঠে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাঁড়ালো সবাই। অর্ষার বাবা মোহাম্মদ আসিফ এবং মোহাম্মদ এহসান এক সাথে কথা বলতে বলতে এগুচ্ছিল। সেই রাস্তার পাশ দিয়ে অর্পন কে যেতে দেখে ডাক দিলো আসিফ। অর্পন এগিয়ে এসে খুব সাবলীল ভাবে সালাম দিলো তাদের, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

এহসান ও আসিফ দুজনে সালামের উত্তর নিলো। আসিফ অর্পনের সাথে এহসানের পরিচয় করিয়ে দিতে বললেন, ‘ওর নাম অর্পন মুফতাহির। আমার বোনের ছোট ছেলে। গতকাল এসেছে বেড়াতে।’

অর্পন হাসিমুখে এহসানের উদ্দেশ্যে বলল, ‘কেমন আছেন আঙ্কেল?’

এহসান উত্তরে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ ভালো রেখেছে। তোমার কি খবর?’

– ‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

– ‘তা আমাদের এলাকায় এসে কেমন লাগলো? কোনো বিপদে পরলে সবার আগে আমাকে জানাবে। আর এলাকার মানুষ তো আছেই। ভয় পেও না সবাই তোমাকে সাহায্য করবে।’

অর্পন বিনয়ীর হাসি দিল। এহসান আবারো প্রশ্ন করলো, ‘এতো রাতে বাহিরে কি করছো?’

অর্পন হাত ঘড়িতে সময় প্রখর করে একবার। তারপর উত্তর দিলো, ‘নামাজে যাচ্ছিলাম। আজান দিবে এখন।’

অর্পনের কথায় খুশি হলো এহসান। আজকালকার দিনে এমন নম্র ভদ্র ছেলে হাতে গুনা কয়েকটা পাওয়া যায়। চোখ তুলে অর্পনের চুলের দিকে তাকালো এহসান। চুল গুলো ছোট করেই কাটা।।অন্যান্য ছেলেদের মতো মাঝের চুল বড় না, কালার করা নেই। অর্পনের এমন নম্র ব্যবহারে এহসান মন থেকে খুশি হলেন। আসিফ বলে উঠলো, ‘আমরাও যাচ্ছি। আসো এক সাথে যাই।’

‘জি আসেন।’ বলে তাদের সাথে হাটতে লাগলো অর্পন। পথের মাঝে এহসানের সাথে বেশ ভালো কথা হলো তার। ব্যবহারের অনেক নম্র। এলাকায় এমন কয়েকজন ব্যক্তি থাকলে শান্তি এমনি এমনি আসবে।

কলিং বেল বাজার আওয়াজে দরজা খুললো অর্জন। দরজা খুলে অর্পন কে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো সে। অর্পন বিনিময়ে মুচকি হাসি দিয়ে চুপচাপ ভিতরে ঢুকে গেলো। অর্পনকে দেখে হাসি দিলেও সেই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মোঃ আসিফ অর্জনের উপর রাগান্বিত হলেন। বাসায় ঢুকেই প্রথমে ছেলেকে শাসন করতে লাগলেন।

– ‘দিন দিন তুমি বেয়াদব হচ্ছো অর্জন। এশারের নামাজ পরতে মসজিদে এলে না কেন?’

অর্জন উত্তর দিলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাস নাইনে পরে সে। মাঝে মাঝে বেয়াদবি একটু বেশি করে ফেলে। নামাজ পরা নিয়ে তার যতো আলসেমি। আর এই আলসেমির জন্য বহু কথা শুনতে হয় তাকে। তারপরেও এক দুই ওয়াক্তের নামাজ মিস করে ফেলে। অর্ষা বাবার কণ্ঠস্বর শুনে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। হেনা টেবিলে খাবার বাড়তে বাড়তে শুধাল, ‘বলেছিলাম শুনে নাই আমার কথা। আপনি বাসায় না থাকলে দুইজনের সাহস ভেড়ে যায়। সামলাতে পারি না আমি। সারাদিন কাজ কর্ম করে এদের এইসব কান্ডে আমি আসলেই আর নিতে পারি না।’

মায়ের কথায় ভ্যাবাচেকা খেলো অর্ষা। মানে কি? দুষ করেছে তার ভাই অথচ কথা শুনাচ্ছে তাকে সহ। এটা কোনো কথা? মায়েরা কখনো একজনকে একা বকবে না। সাথে বড়জনকে নিয়ে বকবেই। দুষ থাকুক আর না থাকুক। এটা তাদের জাতীয় গুন।

মোঃ আসিফ অর্ষাকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি নামাজ পরেছো?’

অর্ষা ঠোঁটে হাল্কা মিষ্টি হাসি রেখে উত্তর দিলো, ‘জি আব্বু পড়েছি।’

মোঃ আসিফ অর্জন কে শাসন করতে লাগলো। এক পর্যায়ে বলল, ‘এখন নামাজ পরে ভাত খেতে আসবে। আর কাল থেকে যেন জামায়াতে তোমাকে দেখি। লাষ্ট বার বলছি অর্জন। কথার খেলাপ করলে তুমি আমার খারাপ রূপ টা দেখবে। যাও নামাজ পড়তে যাও।’

অর্জন কিছু বললো না। চুপচাপ রুমে চলে গেল নামাজ পরতে। অর্পন ডাইনিং টেবিলে বসে শুনছিল সব কথা। তপ্ত শ্বাস ফেললো। নামাজ পরতে যাবার সময় সে নিজেও অর্জন কে ডেকেছিল অনেক বার। কিন্তু অর্জন পাবজি খেলতে ব্যস্ত ছিল বিধায় তাকে সাথে নিয়ে যেতে পারেনি। তখনি বুঝতেছিল অর্জন বকা খাবে মামার কাছ থেকে। তার মামা খুব কড়া আর রাগী একজন মানুষ। যেমন তার আদর ঠিক তেমনি তার শাসন। অর্পনের মতে তার আসিফ মামাই পৃথিবীর সব চেয়ে সেরা মামা। অর্ষা এগিয়ে অর্পনের অপর পাশের চেয়ার টেনে বসলো। অর্পন চোখ তুলে একবার অর্ষাকে দেখে নেয়। আসিফ টেবিলে বসতেই খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল সবাই।

রাত্রী প্রায় সাড়ে এগারোটা!
বাহিরে গোমট বাধানো পরিবেশ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গাছপালা নিস্থব্ধ। আকাশে বিশাল থালা ন্যায় শুভ্র চাঁদ আলো ছড়িয়ে জ্যোৎস্নাময় করেছে পরিবেশ। বিছানায় শুয়ে মোবাইলে টাইম দেখলো অর্পন। সামনে তাকিয়ে দেখে অর্জন টেবিলে বসে ঝিমুচ্ছে। কিছুক্ষন পর পর মাথা ধুলে পরে যেতে নিলে আবারো মাথা ঝামটি মে’রে বসছে। সামনে তার জীববিজ্ঞান বই খুলা।

‘শিখা হয়েছে?

অর্জন চোখ ঢলতে ঢলতে শুধাল, ‘ঘুম পাচ্ছে কিন্তু আরেকটু বাকি। এখনো শেষ হয়নি।

অর্পন বললো, ‘তাড়াতাড়ি শিখে আমাকে দাও। সময় নষ্ট করো না।’

অর্জন মাথা দুলিয়ে পড়া শুরু করলো। এতোক্ষণ অর্পন কোষবিভাজন বুঝিয়েছিল অর্জন কে। প্রায় চার ঘন্টা হয়ে গেল এখনো অর্জনের এই বিভাজন টা মাথায় ধরতে পারছে না। এই ছেলে ডাব্বা মারবে পরিক্ষায়। তার থেকে চোখ ফিরিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করলো অর্পন। বেশ কিছুক্ষণ নিউজ-ফিডে ঘুরাঘুরি করে ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে দেখে অর্ষা এখন এক্টিভ। তাই বাংলা ভাষায় ইংলিশে টাইপ করে ম্যাসেজ দিল।

– ‘কিরে পড়াশোনা বাদ দিয়ে অনলাইন কি করছিস?’

অর্ষা সাথে সাথে রিপ্লাই করলো, ‘তুই পড়াশোনা বাদ দিয়ে কুমিল্লা কি করছিস?’

ভ্রুঁ জোরা আপনা আপনি কুঁচকে গেলো। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পরলো অর্পনের। এই মেয়ে সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর দিবে। অর্পন আর রিপ্লে দিলো না। সিন করে মোবাইল বালিশের পাশে রেখে দিল। ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলো। কিছুসময় পর অর্পনের মোবাইল নোটিফিকেশনের আওয়াজ কানে আসলো। অর্পন মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে যেতেই অবাকের শেষ প্রান্তে। ফ্রেন্ড লিষ্টের বাহির থেকে বেশ কয়েকটা মেয়ে তার প্রত্যেকটা পোষ্টে হাহা রিয়েক্ট দিচ্ছে। সাথে ফানি কমেন্ট করছে। কমেন্ট বক্সে তারা আড্ডা খানা বানিয়ে ফেলেছে অলরেডি। অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল অর্পন। এখানের একটা মেয়েকেও সে চিনে না। অর্পনের আইডি লক না করা ছিল না। অর্পন খেয়াল করলো প্রত্যেকটা আইডিতে অর্ষাকে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখাচ্ছে। যা বুঝার সে বুঝে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে রাগ কন্ট্রোল করলো। অর্ষাকে ম্যাসেজ দিল সে –

– এগুলা কেমন ফাজলামো অর্ষা?
– কেন? খারাপ লাগছে জান? পেট ভরেছে? নাকি আরো লাগবে?
– নিজেকে খুব ইন্টেলিজেন্ট ভাবিস নাকি তুই?
– অবশ্যই তাই ভাবি।
– সুদ টা তুলা থাক। পরে সময় করে বুঝিয়ে দিব।
– ভয় পাই না তোকে। যা ভাগ!

মোবাইল ছুঁড়ে পাশে রাখলো অর্পন। রাগে মাথা গিজগিজ করছে তার। ইচ্ছে করছে অর্ষাকে এখুনি থা’প্রা’তে। এতো গুলো তাকে নিয়ে মজা নিল। আর অর্ষা? সে নিজেও এসবে মজা নিচ্ছে। ইগো তে লাগলো অর্পনের। লম্বা শ্বাস ফেলে রাগ দমানোর চেষ্টা করলো।

অর্ষার মন বেশ ফুরফুরে এখন। মেয়েগুলা সব তার কলেজ ফ্রেন্ড। তাদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে আড্ডা শেষ করে মোবাইল টেবিলে রাখলো। গরমে গলা শুকিয়ে এলো তার। মাথার উপর ফ্যানটা ক্যাটক্যাট আওয়াজে ঘুরছে। এই মুহূর্তে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি চায় তার। তাই গায়ে ওড়না ভালো করে জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে গেল। ফ্রিজ খুলে পানি খেয়ে নিল সে। চলে আবার জন্য পা বাড়াতেই থেমে যায়। ডিপ ফ্রিজ খুলে দেখলো সেখানে কয়েকটা আইসক্রিমের বক্স রাখা। খুশিতে সে নাচতে লাগলো। সেখান থেকে ভ্যানিলা ফ্লেভার আইসক্রিম বক্স হাতে নিয়ে সোফায় বসলো। প্রফুল্লিত মনে বক্স খোলে আহাম্মক হয়ে গেল সে। বক্সটা নাকের কাছে এনে শুকলো। নাক মুখ কুঁচকে রেখে দিল বক্সটা। ফুঁশ করে বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো। কারন আইসক্রিম বক্সে রসুন বাটা রাখা ছিলো। বাকি গুলোতে নিশ্চয় আদা, পেয়াজ বাটা রাখা। হতাশ হয়ে এক হাত গালে রেখে বসলো অর্ষা। বাহ বাহ! বাঙ্গালী মায়েদের আরেক স্বাভাব। কত আশা নিয়ে বক্স খুললো অথচ কি হলো? আইসক্রিমের জায়গায় রসুন বাটা পেলো।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here