আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ১৬

0
295

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৬
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)

শেষ প্রশ্নটি বেশ জোর দিয়েই করল আদী আর এমন প্রশ্ন শুনে রাত্রির মাথায় হুট করেই ইব্রাহিমের নামটি চলে এলো। এমন বাজে পরিস্থিতিতেও তার মন নিজের অজান্তেই হেসে ওঠল। বলল,

—সব পুরুষ এক না হলেও কি অভিন্ন? ইব্রাহিমকে দেখলে যেমন ঘৃণা আসে, তেমন তোমাকে দেখলেও আসে যখন তুমি নেশা করে আমার সাথে জঘন্য কথাগুলো বলো। কিন্তু এসব বললেও নিজেকে কেমন লাগে কারণ আমি তো কোনো পুরুষের সন্তানও।

—এই রাত্রি, কথা কও না ক্যান?

রাত্রি নত দৃষ্টিতে নানান চিন্তায় বিভোর ছিল, কিন্তু এখন আদীর প্রশ্ন শুনে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,

—কী বলব?

আদীর দুই হাতের বাঁধনে বন্দী রাত্রি। সে বান্ধন আরও শক্ত করে করুণ গলায় আদী বলল,

—কেন বিষ নিয়ে এলে? মাত্র চব্বিশ ঘণ্টাও আমায় বিশ্বাস করতে পারোনি?

প্রশ্ন শুনে রাত্রি নিজের কান্না সংবরণ করে শক্ত গলায় বলল,

—দু’দিন বাদে যে মেয়ের বিয়ে হতে চলেছে, সে এখন অন্য পুরুষের মুখোমুখি এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তাদেরই বিয়ে হবে। মানুষের অন্যায় আবদার মানতে যে মেয়ে ২৪ ঘণ্টা তার সংস্পর্শে থাকবে, সে মেয়েকে তুমি এ কথা জিজ্ঞেস করছ?

রাত্রির মুখে এমন কথা শুনে আদী নির্জীব হয়ে গেল। হাতের বাঁধন ক্রমশ আলগা হয়ে গেল। আদী দূরত্ব বাড়িয়ে পিছনে যেতে লাগল চোখ নামিয়ে। আদীর চেহারায় এখন এমন প্রতিক্রিয়া ভাসছে যা দেখে রাত্রির মনে হচ্ছে হয়তো আদী এখন কেঁদেই দিবে। কিন্তু না। আদী নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে আর তার চলে যাওয়া দেখে রাত্রি ছুটে এসে ডান টেনে ধরে জিজ্ঞাসা করল,

—আমার কথার জবাব না দিয়ে তুমি পালাচ্ছ কোথায়?

আদী উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে। রাত্রি বলল,

—হ্যাঁ, বিষ এনেছি। কিন্তু তোমাকে নরপিশাচ ভেবে আনিনি। আমি জানি মানুষের নেশা করলে হুঁশ থাকে না, তোমারও থাকেনি। তুমি যা পেরেছ সে রাতে আমাকে তাই বলেছ। এমন সব কথা বলেছ যা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বলতে পারে। আমাদের মাঝে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না। তাহলে কেন বললে আমায়? তুমি জানো? তোমার প্রতিটি কথা আমার হৃদয়ে বিষ হয়ে ঢুকেছে। যখনই এসব আমার মনে পড়ত আমি পাগলের মতো কান্না করতাম তবুও তোমায় কিচ্ছু বলতাম না কারণ আমি জানি এসব তুমি ইচ্ছে করে বলোনি। এসব কথা শোনার পর তুমি কীভাবে আশা করো তোমাকে আমি নিরাপদ মনে করব?

—তু… তুমি আমার কাছের অনিরাপদ?

এ প্রশ্ন করে অবিশ্বাসের চোখে তাকাল আদী আর নিজের হাত একটু একটু করে রাত্রির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। রাত্রি আহত হলো আদীর প্রশ্ন শুনে আর আহত হৃদয় নিয়েই কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বিধাতা সে সুযোগ রাত্রিকে দিলো না। আদীর ফোন বেজে উঠতেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোনে কথা বলতে শুরু করল,

—হ্যালো।

আদী ফোনে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু রাত্রির চোখে চোখ রেখে কেমন যেন থমকে আছে।

—কখন হয়েছে এসব? জহিরকে কি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে?

আদী প্রশ্ন করল, কিন্তু উত্তর কী এলো রাত্রি শুনতে পেল না। আদী বলে চলেছে,

—আরে ওই মেয়ে তো আমার বাসার সামনেই থাকে… খালি বিয়ে ভেঙে যায়… তুই কি শিওর যে ওই মেয়ে জহিরের জন্য সুই””সাইড করেছে?… ওকে। আমি এখনই আসব, কিন্তু আধঘণ্টা সময় লাগবে।

শেষ বাক্য আদী বলল একদম গাঢ় গলায় তাও রাত্রির পানে তাকিয়ে। যেন তার গলার স্বর বলে দিচ্ছে, আমাকে আধঘণ্টা দে আমি রাত্রিকে সময় দিতে চাই।

আরও দুই মিনিট কথা বলে আদী ফোন রেখে দিলো। এরপর রাত্রিকে বলল,

—ভালোই হয়েছে এখন আমাকে চলে যেতে হবে কারণ যে আমার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। তার সাথে অন্তত ২৪ ঘণ্টা প্রেমিকের মতো আচরণ করা যায় না।

এ বলে আদী একদম রাত্রি কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বেদনা নিয়ে নরম কণ্ঠে বলল,

—তোমার সাথে আমার যা সম্পর্ক ছিল রাত্রি। আজ তা নিজের অজান্তেই শেষ হয়ে গেল। আমার জীবনে মেয়ে এসেছে যেমন, চলেও গেছে কোনোরূপ ছায়া না ফেলে। কিন্তু তুমি চলে যাচ্ছ আমার সমস্ত মনকে ছাই করে দিয়ে। আমি তোমাকে কখনো প্রেমিকার নজরে দেখিনি, কিন্তু আমার সবসময়ই একটি চাওয়া ছিল যেন তোমার মতো একটি মেয়ে আমার প্রেমিকা হয়; বউ হয়। কিন্তু আজকে থেকে এ চাওয়াকে আমি নিজ হাতে খু””ন করলাম। তোমার সাথে দেড় কি দুই বছরে আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। তাই আমার মনে হয়েছিল তুমি হয়তো কষ্ট পেয়ে সুই””সাইড করতে পারো কারণ আমি জানি তুমি ইব্রাহিমকে পছন্দ করো না। কিন্তু এ বিষয়েও তুমি নির্জীব রইলে। অবশ্য এখন বললেও আমার কিছু যায় আসে না। যেখানে সম্পর্ক নেই, সেখানে নির্লজ্জের মতো আমি তোমার ওপর অধিকার ফলাতে চাই না। তবে কি জানো? মাঝেমধ্যে বুকের ভেতরে তোমার নামে যে ছন্দপাত হয় তা হয়তো আমি কোনোদিনও থামাতে পারব না।

*

রাত শেষ প্রায়। আলো ফুটছে আকাশে। কিন্তু মনের আলো কাল রাতেই নিভে গেছে। আদী কখনো ভাবতে পারেনি রাত্রি তাকে নিয়ে এমন চিন্তা করতে পারে। তবে আদীর আচরণ যে আহামরি ভালো ছিল তা সে নিজেই স্বীকার করতে অপারগ। তবে একটি বিষয় কাল সকাল থেকেই অনুভব করছে আদী। গৌর বর্ণের ওই মেয়ে তাকে অন্যভাবে টানে। খয়েরি রঙের শাড়ি আর কাজল চোখের দৃষ্টি বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু এসব চিন্তা এখন করে তো কোনো লাভ নেই।

কালকে রাত দশটা নাগাদ আদী রাত্রিকে তার সেই বান্ধবীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল, যার কথা বাসায় বলে রাত্রি এসেছিল আদীর কাছে। বান্ধবীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পরও রাত্রি কোনো কথা বলেনি। পুরো সময় জুড়ে মেয়েটি কেমন তব্দা লেগেছিল। কিন্তু পৌঁছে দিয়ে আদী শেষবারের মতো বলেছিল,

—আমি তো নিকৃষ্টতম মানুষ। তাই তোমার জীবনের মূল্যবান ঘণ্টা আর ব্যয় করলাম না। ভালো থেকো। আজকের পর আর কখনো তোমার সামনে এসে দাঁড়াব না। স্বর্ণালি আমাকে বদলে দিয়ে গিয়েছে অনেকটাই, বাকিটুকু আজ তুমি বদলে দিলে।

এ কথা শেষে আদী বিষাদের হাসি হেসেছিল। তার হাসি রাত্রি দেখেছিল মনোযোগ দিয়ে, কিন্তু জবাব দেওয়ার মতো আগ্রহ তার ছিল না। ফলে শেষ বিদায়েও রাত্রি ছিল একদমই চুপচাপ।

—আদী?

পুলিশ স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল আদী। এ মাত্র সাজ্জাদ এসে পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল। আদী ভাবনায় বিভোর ছিল বলে সামান্য নড়েচড়ে ওঠল। তবে কিছু না বলে কেবল সাজ্জাদের দিকে এগিয়ে গেল,

—আমি স্বর্ণালির কেস নিয়ে ঢাকা ছিলাম। এ মাত্র এলাম। জহিরকে শুনলাম অ্যারেস্ট করেছে। কিন্তু তুই সারা রাত ধরে এখানে কেন?

সাজ্জাদের প্রশ্ন আদী বুঝতে পারল তবুও অবুঝের মতো জিজ্ঞাসা করল,

—তাহলে কই থাকব?

—কই থাকবি মানে? তোর না রাত্রির সাথে থাকার কথা?

—ছিল, কিন্তু জহিরের বিপদ তাই…

—কী হয়েছে দোস্ত?

প্রশ্ন করেই সাজ্জাদ আদীর কাঁধে হাত রাখল। আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করে আদীর খবর নিতে চাইল। কিন্তু আদী রাত্রিকে নিয়ে কিছু বলতে চায় না। তাই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল,

—আরে আমার আবার কী হবে?

—হয়েছে বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি। জহির তো পেয়ারের দোস্ত না যে তুই রাত্রিকে ফেলে চলে আসবি। I know man. আমি জানি তুই রাত্রিকে কতটুকু…

আদী বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—ছাড় এসব। ওই মেয়ের লা””শ পেলি?

সাজ্জাদ ঠোঁট টিপে মাথা নেড়ে বলল,

—হ্যাঁ, ঢাকা মেডিক্যালে পাওয়া গেছে। স্বর্ণালির মতোই ওর অবস্থা।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here