#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১২
খাদিজা আক্তার (Diza)
দিন যেন হাওয়াই মিঠাই। ছুঁয়ে দেখতে গেলেই মিইয়ে যায়। সেদিন সবে চৈত্র মাস ছিল। দেখতে না দেখতে বর্ষাকাল চলে এলো। আগে বৃষ্টিতে ভিজতে রাত্রির বড়ো ভালো লাগত, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ভালো লাগায় যেন ভাঁটা পড়ে গেছে। এতদিন হয়ে গেছে অথচ স্বর্ণালির মৃত্যুর রহস্য যেন রহস্যই রয়ে গেল। রাত্রি নিজের মাথায় হাজার চিন্তা নিয়ে বেঁচে থাকলেও স্বর্ণালির এমন অপমৃত্যু সে মানতে পারছে না। অথচ স্বর্ণালির সাথে ভালো করে তার কখনো কথাই হয়নি।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে হয়তো আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি ভালো লাগার পাশাপাশি মনে ভয়ও সৃষ্টি করে। কিন্তু সিএনজিতে বসে এসব ভাবার অবকাশ রাত্রির নেই। গতকাল রাতে ইব্রাহিমের ওপর রাত্রির ভীষণ রাগ হয়েছিল। তাই ঠিকবেঠিক চিন্তা না করেই সে আদীকে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছে। কিন্তু এ ‘হ্যাঁ’ বলার পরিণতি কেমন হতে পারে তা ভাবতে গিয়ে রাত্রি বারবার ভয়ে কেঁপে ওঠছে।
বছর দুয়েক আগেকার কথা। ইংরেজি পরীক্ষা শেষে রাত্রি বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি এসে দেখে আদী বসে আছে আর আম্মার সাথে গল্প করছে। রাত্রি পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে যেতে নিলে আদী তার পিছু নেয়। পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে,
—রাত্রি, কী হয়েছে তোমার? আমাকে লক্ষ্যই করলে না আবার মুখখানাও কেমন ভার করে রেখেছ।
রাত্রি ঘুরে দাঁড়াল আর পরক্ষণেই মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। রাত্রির এহেন অবস্থা দেখে আদী ঘাবড়ে গেল। দূরত্ব কমিয়ে এনে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল,
—এই, এমন করে কাঁদছ কেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে আমাকে বলো।
রাত্রি কেঁদেই চলেছে। কান্নার ঢেউে ভাসতে গিয়ে সে কিছুই বলতে পারছে না। তবে তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কিছু বলার চেষ্টা করছে। আদীও রাত্রি মুখপানে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে কিছু শুনবে বলে।
—আ… আদী আ… আমার পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছে। আ… আমি এ… এবার ফেল করব।
এ বলে রাত্রি আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। আদী বিষয়টি বুঝতে পেরে রাত্রিকে নানাভাবে বোঝাতে শুরু করে দিলো।
—বোকা মেয়ে, ফেল কেন করবে? তুমি কি ফেল করার মতো ছাত্রী। আল্লাহর রহমতে সবসময়ই তুমি ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে এসেছ। তাহলে এসব ফেলের কথা আসছে কেন?
রাত্রি কান্না জড়ানো কণ্ঠে প্রতিবাদ করল,
—আমি পাশ নম্বর পর্যন্তও লিখতে পারিনি। তাহলে তুমি কীভাবে বলছ আমি ফেল করব না?
—অ্যা…
আদী হতভম্ব হয়ে গেল আর সেদিকে তাকিয়ে রাত্রির আরও কান্না পেল। হঠাৎ করেই রাত্রির বয়েস যেন কমে শিশুসুলভ আচরণ প্রকাশ পেল। সে আদীকে ফেলে এক ছুটে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। তবে দরজা বন্ধ করার আগে শুনতে পেল তার আম্মা আদীকে জিজ্ঞাসা করছে,
—রাত্রির কী হয়েছে? কান্নাকাটি করছে কেন?
আদীর জবাব রাত্রি শুনতে পায়নি কারণ সে অশ্রু ঝরাতে অতি ব্যস্ত।
প্রায় আধঘণ্টা পর রাত্রি নিজের রুমের দরজায় কীসব শব্দ শুনতে পেল। কান্না এখন কমে এলেও পুরোপুরি থামেনি, কিন্তু হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া শব্দে তার কান্না আচমকাই থেমে গেল। রাত্রি বালিশের ওপর উপুড় হয়েছিল। এখন শব্দের সন্ধানে সোজা হয়ে বসলো আর পরক্ষণেই খোলা দরজায় আদীকে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। কান্নায় ভারী হওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
—এভাবে কারো ঘরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। তুমি এমন করে কেন আমার ঘরে ঢুকে পড়ো?
আদী দ্রুত রাত্রির পাশে বসে বলল,
—অন্য কারো ঘরে তো ঢুকি না। তাছাড়া ভেতর থেকে লক করে রেখেছ। ডুপ্লিকেট চাবির সুবাদে ঢুকতে পেরেছি। এখন তো তুমি জীবনেও দরজা খুলতে না।
—তুমি এখন যাও আদী। আমার কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না।
—রাত্রি, তুমি এমন করে থাকলে আমার কি ভালো লাগবে? উফ, কী যে কষ্ট হয়। মনে হয় যেন প্রেমিকা আমায় ছেড়ে পালিয়ে।
—আদী…
কিঞ্চিৎ রাগী কণ্ঠে রাত্রি আদীর নাম নিতেই আদী স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
—মজা নয়, সত্যি হৃদয় পোড়ে। একটু শান্ত হও। শান্ত হয়ে একটু ভেবে দেখো। আমার মনে হচ্ছে তুমি পাশ করবে। একটু নম্বর হিসাব করে দেখো না।
রাত্রি নিচু স্বরে জবাব দিলো,
—দেখেছি।
—দেখছ? কত নম্বর পর্যন্ত উত্তর করলে?
—পাশ নম্বর থেকে ১০ বেশি।
—দেখলে তো। আমি বলেছিলাম। শোনো, আল্লাহর রহমতে দেখবে পাশ করে গেছ। এখন বাধ্য মেয়ের মতো এগুলো খেয়ে নাও। মামী বলল তুমি না কি সকালেও খেয়ে যাওনি। এই নাও।
এ বলে আদী একটি প্যাকেট এগিয়ে দিলো। রাত্রি প্যাকেট দেখে বুঝতে পারল এতে কেক রয়েছে। রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—কেক কেন? আজ তো কারো জন্মদিন নয়।
—জন্মদিন হলেই কি লোকে কেক কাটে? তোমার মন খারাপ তাই কথা কম বলে এখন কেক কাটো শীগগির। আমার ক্ষিধা লেগেছে।
রাত্রি নাক টেনে হালকা হেসে বলল,
—তুমি বড়ো অদ্ভুত।
—তা জানি, কিন্তু তোমার মন খারাপ সত্যি নিতে পারি না।
এ বলেই আদী প্যাকেট থেকে কেক বের করে রাত্রির হাতে দিলো। কেকের ওপর কিছু লেখা আছে যা দেখে রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—এসব কী লেখা?
—কী করব বলো? তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা করে। তাই কেকের ওপর লিখে দিলাম যেন আমাকে একটি বিয়ে করিয়ে দাও।
রাত্রি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
—এ আবার কেমন ইচ্ছা। তাছাড়া তুমি এখন বললে আমার মন খারাপ নিতে পারো না। আর এখন বলছ বিয়ে করতে ইচ্ছা করে? আমার কান্নার সাথে বিয়ে করার সম্পর্ক কী?
—I don’t know. But trust me. আমার না তোমার মতো একটি মেয়ে লাগবে; সত্যিই লাগবে।
রাত্রি চোখ নামিয়ে হাসছে নীরবে আর কেক কাটছে মনের সুখে। একটুখানি কেক হাতে নিয়ে আদীর দিকে বাড়িয়ে রাত্রি বলল,
—পরীক্ষা নিয়ে এখনো চিন্তা হচ্ছে। তবে কষ্ট কমে এসেছে। তোমার এসব বিটলামি আমাকে বড়ো হাসায়।
—আমার বিয়ে করতে চাওয়া তোমার বিটলামি মনে হচ্ছে? অদ্ভুত!
—আদী, আমি আজকে অনেক খুশি। আমার মন খারাপে কারো চিন্তা হয় দেখে বড়ো ভালো লাগছে। তাই আজকে যদি তোমার কিছু চাওয়ার থাকে আমার কাছে তবে তুমি চাইতে পারো আদী।
—তাই? এমন জম্পেশ অফার দিচ্ছ?
—হুঁ।
—পরে চাওয়া শুনে পালিয়ে যাবে না তো?
রাত্রি মৃদু হেসে গাঢ় গলায় বলল,
—আমার জীবন নিশ্চয়ই চাইবে না। অবশ্য চাইলেও আপত্তি নেই।
—সর্বনাশ! কী বলছ এসব? আজকে এত বড়ো অফার দেওয়া হচ্ছে আমাকে? আঃ! নিজেকে কেমন ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তাহলে চেয়ে ফেলি?
রাত্রি কেক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আদী রাত্রির মুখপানে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বলল,
—তোমার জীবন থেকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আমাকে দিবে? এ চব্বিশ ঘণ্টা আমি তোমাকে নিজের গার্লফ্রেন্ডের মতো খুব বেশি আগলে রাখতে চাই।
আদীর কথা শুনে রাত্রি অবাক হয়ে বলল,
—এ কেমন অদ্ভুত চাওয়া?
—রাত্রি, তোমাকে বললে তো তুমি বিশ্বাস করো না। কিন্তু তোমার মতো একটি মেয়ে পেলে আমি ধন্য হতাম। তা এখন যেহেতু তোমার ডুপ্লিকেট নেই। তাই একটি দিনের জন্য তোমাকেই গার্লফ্রেন্ড হিসাবে চাইছি। আমার এ সামান্য চাওয়াটি কি তুমি রাখবে না রাত্রি?
—আমার সব এলোমেলো লাগছে।
—এত ভেবো না। তোমাকে অসম্মান করব না। শুধু মন উজাড় করে একটি দিন গার্লফ্রেন্ড ভেবে নিজের সবটুকু তুলে দিতে চাই।
—ঠিক আছে। কোনো একসময় তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা দিয়ে দিবো।
হঠাৎ সিএনজি থেমে গেল আর রাত্রির ভাবনায় ছেদ পড়ল। কালকে রাতেই আদী মেসেজ করে সব জানিয়ে দিয়েছিল আর সে অনুযায়ী রাত্রি এসে হাজির হয়েছে।
(চলবে)