গল্প – হারিয়ে খুঁজবে আমায়
পর্ব – ১৭ (শেষ)
লেখিকা – সানজিদা ইসলাম
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর থেকেই অনুর আর কোন কাজে মন বসাতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে চলাফেরা করছে। এক কাজ দুইবার করে করছে এমনকি ডিনারের সময়ও অন্যমনস্ক হওয়ার কারণে অনু সবজি মাংস মাছ বাদ দিয়ে শুধু ডাল দিয়ে খেয়েছে।খেয়েছে বললে ভুল হবে শুধু প্লেটের দিকে তাকিয়ে নাড়াচাড়া করেছে।
অনুর বাবা-মা ও কিছু জিজ্ঞেস করেনি হয়তো সময় হলে সে নিজেই বলবে। কিন্তু সে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত তা বেশ ভালই বুঝতে পারছে। কিন্তু মেয়েকে আর ঘাটায়নি তারা।
শাফিনের কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছে তার।তাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া উচিত নাকি উচিত না। মন দোটানায় ভুগছে। চার বছর দূরে থেকেও একদিনের জন্য মনের আড়াল করেনি সে। শাফিনকে অনু আগেও ভালবাসত এখনো ভালোবাসে আর ভবিষ্যতেও ভালো বাসবে। শাফিন ই তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। কিন্তু তার করা অপমানের কথাগুলো এখনো অনুর কানে স্পষ্ট বাজে। চাইলেও সে কোনদিন তা ভুলতে পারবেনা এখনো ভুলতে পারিনি। আর যতবারই শাফিনের কথা মনে পড়ে সাথে সাথেই শাফিন আর ইরার নগ্ন শরীর চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলনা সে।
রাতে অনন্য কে ঘুম পাড়িয়ে ।নিজে আর ঘুমুতে পাড়ানি। সারারাত নির্ঘুম কাটনোর পর সে সিদ্ধান্ত নিল তার বাবা মা আর সাদাত ভায়ের সাথে কথা বলে জানবে তার কি করা উচিত? তারা হয়তো ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। ভাবতে ভাবতেই ফজরের আজান শোনা যায় তারপর অনু শোয়া থেকে উঠে অজু করে নামাজ পড়ে নেয়। তার মাথাটা বড্ড যন্ত্রণা করছে একটা ঘুমের প্রয়োজন ঘুম আসছেনা দেখে একটা হাল্কা পাওয়ারের স্লিপিং পিল খেয়ে নেয়। আর দশ মিনিট পরেই ঘুমের দেশে চলে যায় অনু।
রাতে দেরি করা করে ঘুমানোর সুবাদে সকালে উঠতে বেশ দেরি হলো। অনন্য সকাল থেকে কয়েকবার ডেকে গেছে মাকে কিন্তু অনু ঘুম থেকে উঠো নি। ঘুমের ওষুধ টা কাজে দিয়েছে। অনুর ঘুম ভাঙলো বেলা 11 টায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে গোসল করে একেবারে নিচে গেল অনন্য খোঁজে সে খেয়েছে কিনা জানার জন্য।
সারা ঘর খুঁজেও অনু অনন্যকে পেল না ।তারপর তার মাকে রান্নাঘরে পাওয়া গেল সে তাকে অনন্যর কথা জিজ্ঞেস করল।
অনু: মা অনন্য কই বাসায় দেখতে পাচ্ছি না যে।
রাবেয়া: অনন্য তো সাদাত আর সাদের সাথে বাইরে গেছে আইসক্রিম খাবে বলে বায়না ধরছিল মেয়েটা।
অনু: আহা তুমি ওকে যেতে দিলে কেন তুমি জানো না আইসক্রিম খেলে ওর গলায় সমস্যা হয়।আর সকালের নাস্তা খেয়েছে মেয়েটা?
রাবেয়া: হ্যাঁ তুই ঘুম থেকে উঠে ছিলে না বলে আমি খাইয়ে দিয়েছি।আর এখনতো তুইও উঠে গিয়েছিস আয় টেবিলে বস খাবার খেয়ে নে।
অনু: না মা এখন খেতে ইচ্ছে করছে না একেবারে দুপুরে খাব। আর তোমাদের সবার সাথে আমার জরুরী কথা ছিল সাদাত ভাই কখন আসবে?
রাবেয়া: কি এমন জরুরী কথা বলবি রে অনু কাল থেকে তোকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে কিছু কি হয়েছে।
অনু:কি জরুরী কথা তা তো কিছুক্ষণ পরে জানতে পারবে আগে সাদাত ভাই আর বাবা আসুক পরে না হয় বলবো আমি উপড়ে যাচ্ছি আরো কিছুক্ষণ ঘুমাবো। ঘুম পুরোপুরি হয়নি আমার।
জোহরের নামাজ শেষে সবাই একসাথে খেতে বসলো খাওয়া শেষ করেই অনু সবার উদ্দেশ্যে বলল,
আসলে বাবা মা সাদাত ভাই আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা ছিল শাফিনকে নিয়ে,
শাফিনের নাম শুনেই সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকালো,
অনু: আসলে কালকে পার্কে সামিন ওর সাথে আমার দেখা হয়। তারপর অনু তাদের বিস্তারিত সবকিছু খুলে বলে। সবকিছু শোনার পর অনুর বাবা জিজ্ঞেস করে
আলম: এখন তুই কি চাইছিস? আবার ওই ছেলেটার সাথে সংসার করতে।
অনু: না বাবা আসলে তা না আমি আসলে দোটানায় ভুগছি আমার মাথা কাজ করছে না। আমার কি করা উচিত আমি বুঝতে পারছি না তাই তোমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে চাইলাম। এখন তোমরা যা ভালো বুঝবে আমি তাই মেনে নেব। এতক্ষণে সাদাত মুখ খোলে,
সাদাত: দেখ অনু যেহেতু তোদের মধ্যে ডিভোর্স হয়নি তাই এখনো তোরা স্বামী স্ত্রী ।তুই যদি শাফিনকে মাফ করে দিয়ে আবার তার কাছে ফিরে যেতে চাস তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তুই ভাব আরো সময় নে তোর যেটা ভালো মনে হয় তুই তাই কর। তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে তোর যে কোন ডিসিশনে আমার সাপোর্ট পাবি।
আর শাফিন হয়তো সত্যিই অনুতপ্ত। ওর সাথে আর প্রায়ই দেখা হত আর প্রত্যেকবারই তোর কথা জিজ্ঞেস করত আর ঐদিনের ব্যবহারের জন্য হাজার বার সরি বলেছে আমার মনে হয় সে অনুতপ্ত। বাকিটা তোর উপর।
সাদাত এর কথাগুলো সাথে অনুর বাবাও সায় দিল।তার মেয়ে যথেষ্ট এডাল্ট এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে যে ডিসিশন নিবে সেটাই তিনি গ্রহণ করবেন বলে জানান।
বিকেলে বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠে অনু নিচে ড্রইং রুমে ছিল তাই দরজা খুলে দেখে বাইরে শাফিন দাঁড়িয়ে আছে মুখে র মধ্যে হাসি হাসি ভাব। অনু তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল,
শাফিন: আমি আসলে অনন্যর সাথে কিছু সময় কাটাতে চাই প্লিজ মানা করো না। তুমি যে কোন ডিসিশন নাও আমি রাজি আছি কিন্তু শর্ত একটাই আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে রাখতে পারবে না।
অনু আর কিছু বলল না দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো আর শাফিন প্রায় দৌড়ে গিয়ে অনন্য কে কোলে তুলে নিল অনন্যও শাফিনকে পেয়ে বেশ খুশি।
অনুও চায়না অনন্য তার বাবার আদর ছাড়া বড় হোক তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় অন্যকে সত্যি কথা বলার একসময় না একসময় ঠিক জানতে পারবে তার বাবাকে।তাহলে শুধু শুধু লুকোচুরি করে কি লাভ।
অনু: অনন্য মা তুমি সব সময় বাবাকে খুঁজতে না। মায়ের কথায় অনন্য মন খারাপ করে মাথা নাড়ায়, তারপর অনুর শাফিনকে উদ্দেশ্য করে বলে ইনি তোমার বাবা। অনুর কথা শুনে শাকিল অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় তাহলে কি অনু তাকে মেনে নিয়েছে। আর অন্যদিকে অনন্য শাফিনকে জিজ্ঞেস করে
অনন্য: তুমি আমার বাবা হও? অনন্য কথা শুনে শাফিনের চোখে পানি এসে পড়ে সে মাথা নাড়য়। তাহলে এতদিন কোথায় ছিলে আমাদের ছেড়ে? ডু ইউ নো হাউ মাচ আই ফাইন্ড ইউ? আমার সব ফ্রেন্ডের বাবা আছে শুধু আমার বাবাই ছিলনা। বাট নাও আই অলসো হ্যাভ এ ফাদার।ইয়ে ইয়ে কি মজা আমার বাবা আছে আমার বাবা আছে।
অনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে আর বাবার হাসিমুখ দেখছিল। সাথে অনুর মাও যখনই সে শাফিনকে কিছু বলতে যাবে অনু তাকে থামিয়ে দেয় নিষেধ করে কিছু বলা জন্য।
রাবেয়া: অনন্য সাথে শাফিনকে কেন কি মিসতে দিলি তুই। ও তোর সাথে কি কি করেছে সব ভুলে গেলি। এমনকি বাচ্চাটা কেউ অস্বীকার করেছে। আর এখন বাচ্চার জন্য ভালোবাসা উতলে উঠছে।
অনু: না মা কিছু ভুলিনি সবই মনে আছে। কিন্তু তার বাচ্চার কাছ থেকে আমি তাকে আলাদা করতে পারিনা অনন্যর উপর আমার যতটুক অধিকার আছে শাফিনের অধিকার আছে। সে অনন্যর বাবা আমি বা তুমি চাইলেই এটা মিথ্যে হবে না। আর আমিও চাইছি না অনন্যকে ওর বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হোক। আমার মেয়েটা কেন বাবা থাকতে বাবার আদর ছাড়া বড় হবে।
মিসেস রাবেয়া আর কথা বাড়ালোনা মেয়ের কথায় যুক্তি আছে তাই সে স্থান ত্যাগ করল।
সারা বিকেল তারা ভালোই খেলাধুলো করেছে। অনন্যার সাথে সাথে শাফিন ও যেন বাচ্চা হয়ে গেছে। দুজন খেলছে আর প্রাণ খুলে হাসছে। অনু একবার তাদের নাস্তা দিয়ে গেছে। সেগুলো গল্প বলে বলে অনন্য কে কোলে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে আবার অনন্য মাঝেমাঝে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যায় শাফিন চলে যাওয়ার কথা থাকলেও অনন্যর কারণে যেতে পারেনি সে যে ধরে বসেছে বাবার সাথে আরও খেলবে অজ্ঞত শাফিনের বেরোতে বেরোতে রাত হয়ে গেল অনু তাকে সৌজন্যতার খাতিরে একবার খেতে বলল কিন্তু সে খেলে না। ওই বাড়িতে যতক্ষণ ছিল সে যেন অদৃশ্য মানব কেউ যেন তাকে দেখেও না দেখার ভান করেছিল যেন তার এখানে হওয়াতে কারো কিছু যায় আসে না। এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে কারো কথা সম্মুখীন হতে হয়নি তার। নইলে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো কিন্তু অনু তাকে এত তাড়াতাড়ি অনন্য সাথে থাকার অনুমতি দিবে তা সে ভাবতে পারিনি। সে তার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারছে এই অনেক।শাফিন চলে আসার সময় অনুর কাছে তার ডিসিশন এর কথা জিজ্ঞেস করেছিল সে ভেবেছিল হয়তো সেসিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে অনু আরো কিছুদিন সময় চাইল। আর শাফিন ও অনন্য সাথে প্রতিদিন অফিস ছুটির পর খেলার অনুমতি চাইল। আর অনুও নির্ধিদ্ধায় অনুমতি দিয়ে দিল।
পরের দিন যথারীতি অফিস ছুটির পর শাফিন ওদের বাড়িতে এলো। অনন্য সাথে খেলা করলো গল্প করল তাকে খাইয়ে দিল। তারপর যাওয়ার সময় অনু তাকে ডাক দেয়।
অনু: শাফিন কথা ছিল আপনার সাথে।আপনি সেদিন বলেছিলেন আমার সিদ্ধান্ত পজেটিভ নেগেটিভ যাই হোক না কেন আপনি মেনে নেবেন।
শাফিন: হ্যাঁ তোমার সিদ্ধান্ত পজিটিভ হলে তো কোন কথাই নেই আমি একজন দায়িত্বশীল স্বামী আর পিতা হয়ে দেখাবো আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো তোমাদের সুখে রাখার। আর যদি নেগেটিভ হয় তাহলে আমি মেনে নেব হয়তো তুমি আমার ভাগ্যে নেই। কিন্তু যদি নেগেটিভ হয় তাহলে আমারও শর্ত আছে,
আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।
অনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু কর,
অনু:শাফিন আমি দুইদিন অনেক ভেবেছি আমার পরিবারের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছি। তারা আমার মনোভাবকে আমার ইচ্ছা কে প্রাধান্য দিয়েছে। আমি এ কদিন অনেক দোটানায় ভুগছিলাম। কিন্তু এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আমার কি করতে হবে।
শাফিন আমি চাইনা আমার মেয়েটা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হোক। বাবা থাকতেও এতিমের মতো বড় হোক। একজন সন্তানের জন্য বাবা এবং মা উভয়েই প্রয়োজন তাই আমি চাই তুমি অনন্য বেস্ট বাবা হয়ে দেখাও কিন্তু তোমার সাথে থাকা সম্ভব না।সেদিন তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে আমি ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু তোমার সাথে সংসার করার মত মন মানসিকতা আমার হারিয়ে গেছে।
যতবারই মনে হয়েছে তোমার সাথে থাকা উচিত ততোবারই সেদিনের ঘটনা মনে পড়ে যায়। আমি তা সহ্য করতে পারিনা। আর আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে খুব ভয় পাই আমি আর ঠকতে চাই না।একটা সংসারের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভালোবাসা আর ভালোবাসা টিকে বিশ্বাসের উপর আমি তোমাকে কখনো বিশ্বাস করতে পারবোনা। দূর থেকেও একে অপরকে ভালোবাসা যায় শাফিন। আমি দূর থেকে তোমাকে ভালোবাসতে চাই। তোমার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাকে মাফ করে দিও আর পারলে ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও ডিভোর্স দেওয়া না দেওয়া সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার আমি কখনোই তোমাদের মাঝে যাব না।তুমি চাইলে আমরা বন্ধুর মতো থাকতে পারি আমার কোন আপত্তি নেই।
আর রইল অনন্যর ব্যাপার তো তুমি ওর বাবা ওর উপর আমার যতটুকু অধিকার আছে তোমারও আছে। তুমি চাইলে যে কোন সময় এখানে আসতে পারো ওকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারো কিন্তু রাতে বাইরে থাকা হবে না। আর তোমার কাছে একটাই রিকুয়েস্ট অনন্য কে কখনো বাবার কমতি অনুভব করতে দিওনা। এ কয়দিনে সে তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে।
এতক্ষণ শাফিন চুপ করে অনুর কথাগুলো শুনছিল।মনে হচ্ছে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে উনি অনু তার সাথে থাকতে চায় না কথাটা শোনার পর থেকেই চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি বের হচ্ছে সে চেষ্টা করছে সেটা থামানোর কিন্তু চোখটা যেন তার কথা মানছে না।তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো অনু তার কাছে ফিরবে। আজ সেটাও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু অনন্য কে পেয়েছে অনুকে বন্ধুরূপে পেয়েছে তাই খারাপ কি জীবনে হয়তো আর অনু কাউকে বিয়ে করা হবে না। সে তার মেয়ের মুখ দেখেই কাটিয়ে দেবে সারা জীবন আর অনু তো আছেই।
সেদিন শাফিন প্রতিউত্তরে অনুকে আর কিছুই বলতে পারেনি তার গলায় কথা কান্না কারণে আটকে গিয়েছিল ।অনুরো মনে হচ্ছিল তার কলিজাটা কেউ কেটে ফেলছে।কিন্তু তার কিছু করার ছিল না সেও নিরুপায়।
সেদিনের পর শাফিন আর অন্যকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেনি ।অনুর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে কিন্তু বিয়ে আর করা হয়নি প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনন্য সাথে সময় কাটানো অনুর আর সাদাতের সাথে আড্ডা দেওয়া আর ছুটির দিন তিনজন ঘুরতে যাওয়া তাদের রুটিন হয়ে গেল বেশ ভালই চলছিল দিনগুলো । দেখতে দেখতে আরো 5 বছর কেটে যায়।এরমধ্যে সাফিনা সাদাতের মধ্যেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল ।বেশ ছিল তারা কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় আবার সব শেষ করে দিল।
শাফিনের মা আর অনুর জোরাজুরিতে শাফিন বিয়ে করতে রাজি হলো। খুবই সাধারণ একটা মেয়েকে অনু নিজে পছন্দ করছে। তাই শাফিন ও আর আপত্তি করেনি। শাফিনের বিয়ের সব আয়োজন করা শেষ পড়শু বিয়ে । তাই বিয়ের আগেরদিন শাফিন অনুর কাছে আবদার করে বসে শেষ একটা দিন সে অনুর সাথে কাটাতে চায়। অনু আর কথা বাড়ায়নি হয়তো এটাই তার শাফিনের সাথে শেষ ঘুরা হবে তারপর হয়তো তার স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে তাদের কথা মনে পরবে না তাই সেও সুযোগটাকে মিস করলো না।
সেদিন অনু শাফিনের দেওয়া লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে হাতে লাল চুড়ি চুল খোপা করা তাতে কয়েকটা জবাফুল কোত্থেকে যেন শাফিন এগুলো নিয়ে এসেছে। হালকা সাজ আর শাফিন পড়েছিল সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা। আর অনন্যর জন্য লাল ফ্রক। ঠিক শাফিনের স্বপ্নের মত।তিনজন বেশ ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া করেছে।সারা রাস্তায় একবারের জন্যও শাফিন অনুর হাত ছাড়েনি এমন ভাবে ধরেছে যেন ছাড়লেই দূরে চলে যাবে অনু ও বিরোধিতা করেনি। এরমধ্যে শাফিন আরেকটা আবদার করে অনুর কাছে,
শাফিন:হয়তো আর এভাবে বলা হবেনা একটা শেষ রিকুয়েস্ট করবো রাখবে? একবার জড়িয়ে ধরতে দেবে অনু শেষবারের মতো।
শাফিনের কথা গুলো কেন জানি খুব অদ্ভুত লাগছিল অনুর কাছে। আর এই কথাটা বলার সময় সামনের গলা ধরে আসছিল।তারও খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেছিল ।নিজের চোখে ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে দেখা খুব কষ্টের।তার পরেও সে তার কষ্ট কাউকে বুঝতে না দিয়ে হাসি মুখে শাফিনের বিয়ের সব কাজ করে যাচ্ছে। অনু নিজে গিয়ে শাফিনকে কে জরিয়ে ধরল।হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখল অনন্য রাস্তার মাঝে দৌড় দিয়েছে তার বেলুন আনার জন্য। সামনে একটা গাড়ি। গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে সে অনুকে কোনরকম ধাক্কা দিয়ে অনন্যের কাছে যায় তখন অনেক দেরি হয়ে যায় অন্যকে বাঁচাতে পারলেও শাফিন নিজে গাড়ির নিচে পড়ে যায় আর অনু চিৎকার দিয়ে উঠে।
অনু:শাফিনননননন…অনুর পুরো শাড়িতে রক্তের ছিটা পড়ে যায় সে দৌড়ে শাফিনের কাছে যায় গিয়ে দেখে সাদা পাঞ্জাবি রক্তে ভরে গেছে। অনুকে ইশারায় সামনে যেতে বলে শাফিন। অনু তাড়াতাড়ি করে তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে।
কিচ্ছু হবে না তোমার কিছু হতে দেব না আমি। কাল না তোমার বিয়ে এখন এসবের মানে কি। ওঠো ওঠো যেতে হবে।আরে আশ্চর্য তো আপনার এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। কোন এমন অস্থিরতা দেখে কষ্টের মধ্যেও শাফিন মুচকি হাসে তারপর অনুর হাত ধরে বলে
শাফিন: আমার কাছে সময় নেই অনু হসপিটাল নিয়ে গিয়েও কোনো লাভ হবে না ।দেখেছ আল্লাহ কখনই চাইনি আমরা যেন আলাদা হই তাই তো তোমার কাছ থেকে আলাদা হওয়ার আগেই আল্লাহ আমাকে নিয়ে নিচ্ছে। খুব ভালোবাসি তোমায় খুব ভালোবাসি।তারপর খুব কষ্টে বলল অনন্যকে দেখে রেখো নিজের জীবনে এগিয়ে যাও আর তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি তার জন্য ক্ষমা করে দিও। ভালোবাসার টান থাকলে ওই পারে দেখা হবে বিদায়।তারপর হঠাৎ করেই ওকে টান দিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে নিল তারপর তাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় আস্তে আস্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল শাফিন।
অনু কান্না করছে ।চিৎকার দিয়ে ডাকছে শাফিনকে কিন্তু তার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে সেই ও নিস্তেজ হয়ে গেলো। জ্ঞান হারালো অনু। আশেপাশের লোকজন অনুর ফোন নিয়ে প্রথমে সাদাতের নাম্বার দেখতে পেল তারপর তাকে ফোন দিল। এরই মধ্যে এম্বুলেন্স এসে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যায় সাদাতো সেখানে পৌঁছে যায়। হসপিটাল ডাক্তাররা শাফিনকে মৃত ঘোষণা করে। অনন্য তার মায়ের বেডের সামনে কান্না করছে। আর বারবার বাবাকে ডেকে যাচ্ছে।
15 বছর পর,
আজ সাদ আর অনন্যর বিয়ে। সাদ তার কথা রেখেছে সে তার পরী কে নিজের করে নিয়েছে। এখন পরী শুধু তার।
দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অনু আর একা একাই কি যেন বিড়বিড় করছে।
অনু: দেখেছ শাফিন আমি তোমার কথা রেখেছি জীবনে অনেক এগিয়ে এসেছি।আজ আমার নিজের একটা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে অনেক অসহায় মেয়েদের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলি। তাদের উৎসাহ করি।
যান আমাদের মেয়ে খুব বড় হয়ে গেছে আজ তার বিয়ে। জানো কার সাথে।হা হা হা মনে আছে সাদ তোমাকে বারবার বলতো পরীকে সেই বিয়ে করবে। আর তুমি তাকে ধমক দিতে। সে কথা রেখেছে এইমাত্র আমাদের মেয়েকে বিদায় করে দিলাম। আমার আর কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু সবকিছু থেকেও কি যেন একটা নেই বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করে আমি তার কারণটা খুঁজছি।তুমি অপেক্ষা করো খুব জলদি তোমার কাছে ফিরে আসব একা একা আর ভালো লাগেনা এখন আমার সব দায়িত্ব শেষ।এখন শুধু তোমার অপেক্ষায় আছি একদিন সময় করে নিয়ে যেও তোমার কাছে। হারিয়ে খুজি তোমায় শাফিন। হারিয়ে খুঁজছি, হারিয়ে খুঁজেছি তোমায়।
—(সমাপ্ত)—
#হারিয়ে_খুঁজবে_আমায় #সানজিদা_ইসলাম #গল্পের_ডায়েরি #Sanjida_Islam #GolperDiaryOfficial