হারিয়ে খুঁজবে আমায় পর্ব ১৫

0
622

গল্প – হারিয়ে খুঁজবে আমায়
পর্ব – ১৫
লেখিকা – সানজিদা ইসলাম

অনু একটা এনজিওতে কাজ করছে প্রায় তিন বছর যাবত। সেখানেই তার ট্রান্সফারের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়ে আসলো। ভিনদেশে আর থাকতে চায় না সে। আর তাছাড়া দিন শেষে পাখি যেমন নীড়ে ফিরে তেমনি একটা সময় পর সবারই যার যার মাতৃভূমিতে ফিরতে হয়। তার এনজিওর বাংলাদেশ একটি শাখা রয়েছে সেখানেই তার ট্রান্সফারের আবেদন করেছে। এবং কর্তৃপক্ষ তার আবেদন মঞ্জুর করে নেয়।

15 দিন পর জয়নিং আর ৭ দিন পর এই দেশে ফিরবে। তাই তার কলিগরা তার জন্য ফেয়ারওয়েল পার্টি রাখল এবং অনু সেখানে সাখাওয়াত চাচা , মনি মা (সাদাতের চাচা চাচি)ও নেহা কেও ইনভাইট করলো। সাদাতের চাচি মালিহা অনুকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করেছে একজন মায়ের মত ভালোবেসেছে প্রেগনেন্সির সময় খেয়াল রেখেছে শাসন করেছে আর অনুও তাকে মায়ের মত দেখে। আর তাকে মনি মা বলে ডাকে।

ফেয়ারওয়েল পার্টি অনুর বাড়ির গার্ডেনে করা হচ্ছে। সে একটা মিষ্টি কালারের জামদানি শাড়ি পরেছে চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া কপালে ছোট্ট টিপ আর হালকা রঙের একটি লিপস্টিক ও হাতে কাচের চুড়ি। আর অনন্য পড়েছে বেবি পিংক কালারের একটি ফ্রক। তাকে একদম রাজকন্যার মত লাগছে। টুকটুক করে মায়ের সাথে হেটে আসছে সে।

আনন্য দেখতে একদম মায়ের মতোই হয়েছে কিন্তু গায়ের রংটা পেয়েছে শাফিনের ধবধবে সাদা আর চেহারায় প্রচন্ড মায়া। আর সাথে দুষ্টু অনেক। সারা ঘর মাতিয়ে রাখে তার দুষ্টুমি আর পাকা পাকা কথায় মায়ের খুব ভক্ত সে। সন্ধ্যায় মা বাসায় ফিরলেই তাকে জাপটে ধরবে এটা ওটা জিজ্ঞেস করবে আর মায়ের আঁচল ধরে ঘুরবে। বাইরের আবহাওয়া থাকার কারণে অনন্য কে একদম ফরেনার মনে হয় সে কিছুটা ইংলিশও বলতে পারে ফ্রেন্ডেদের সাথে ইংলিশে কথা বলে সে।

এখনো অনন্য তার মায়ের পিছু পিছু ঘুরছে হঠাৎ তার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায় আর সে তার দিকে দৌড় দেয়।

অনু:অন আস্তে দৌড়াও বাবা পড়ে যাবে তো। কে শোনে কার কথা সে দৌড়ে তার ফ্রেন্ডের কাছে চলে যায়।(অনু তার মেয়েকে সংক্ষেপে অন বলে ডাকে)

আন: হ্যালো রেইন হাউ আর ইউ?

রেইন: আ’ম ফাইন। বাট আই উইল মিস ইউ আফটার ইউর লিভ। বাই দ্যা ওয়ে ইউ লুকিং সো প্রেটি।

অন: থ্যাঙ্ক ইউ। আই উইল মিস ইউ টু রেইন। (মন খারাপ করে)

এরমধ্যে হঠাৎই রেইন এর বাবা তাকে ডাক দিল সে দৌড়ে তার বাবার কোলে উঠে গেল। তার বাবা হাসিমুখে তাকে কোলে নিল আদর করতে থাকল। এইসবের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকলো অনন্য। বিষয়টা লক্ষ্য করলো অনু।

সে মেয়ের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল আর অনন্য অনুকে জড়িয়ে ধরল। অনন্যার বয়স সাড়ে তিন বছর বেশ কিছু না বুঝলেও বাবা কি তা বোঝে মাঝে মাঝেই বাবার কথা বলে জিজ্ঞেস করে কিন্তু অনু কিছু বলতে পারেনা।

রাতে সবাই খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় তারপর যাওয়ার সময় একেকজনকে একেক টা গিফট দিয়ে যায় অনুকে। অনন্যর ফ্রেন্ডরাও তাকে বিভিন্ন গিফট দেয় তারপর সবাই বিদায় নিয়ে চলে যায়।

সবকিছু গোছগাছ করতেই এক সপ্তাহ চলে যায় তারপর তারা শাফিনের চাচা চাচি থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

সাদাত আর সদ এয়ারপোর্ট এসেছে অনুদের রিসিভ করতে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই অনু সাদাতকে দেখতে পায় তাকে ডাক দেওয়ার আগেই অনন্য কোল থেকে নেমে দৌড়ে যায় সাদাত এর কাছে। সে তার সাদাত মামাই কে ভালো করে চেনে। সাদাত মামাই তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। প্রতিদিন কথা হয় তার সাথে। অনন্য কে অনু বকে দিলে সাদাত অনুকে বকে দেয়। তাইতো সে সবচেয়ে বেশি প্রিয়।

এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে সিদাত কোত্থেকে যেন এক জোড়া ছোট ছোট হাত তার পা জাপটে ধরে পেছন ফিরে দেখে তার ছোট্ট পরী।

সাদাত: কেমন আছে আমার লিটল প্রিন্সেসটা। তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো।

অনন্য: খুব ভালো। তুমি কেমন আছো মামাই।

সাদাত: আমিতো বিন্দাস আছি। তো বলতো আসার সময় মা তোমাকে বিরক্ত করে নিত।

অনন্য: একদম না শুধু একবার বকুনি দিয়েছিল। মুখ গোমরা করে।

সাদাত: কি! এত বড় সাহস আমার প্রিন্সেসকে বকুনি দেয় আজ ওর একদিন কি আমার একদিন। বলেই
সে মুচকি হেসে অনন্যকে কোলে তুলে সামনে তাকায় অনু এবং বাকি সবাইকে আসতে দেখে সেদিকে আগায়।

আগের থেকে কিছুটা মোটা ও সুন্দর হয়ে গেছে অনু। চেহারায় আগের মত আর দুষ্টুমি ছাপ নেই আছে গম্ভীরতা। এই কয়েক বছরে যেন বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। সে অনন্য কে অনুর কোলে দিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরে

সাদাত: আসার সময় কোনো সমস্যা হয়নি তো।

অনুর বাবা: না বাবা কোন সমস্যাই হয়নি।

সাদাত: আপনার হয়তো বেশ ক্লান্ত চলুন যাওয়া যাক এখান থেকে লাভ নেই। কিরে অনু তুই এত মোটা আর বিচ্ছিরি দেখতে হয়েছিস কেন। খাবার মজা পেয়ে কি সারাদিন খেতি নাকি কাজকর্ম কিছু করতি? কি হাল করেছিস নিজের দেখলে মোটা মানুষও লজ্জা পাবে।

এবার অনুর রাগ উঠে গেল কি সমস্যা লোকটার সবসময় খোঁচা দিয়ে কথা বলতে হবে কি মোটা হয়েছে সে মাত্র ৬০ কেজি তার ওজন বয়সের তুলনায় ঠিকই আছে। লোকটার কোনদিন ভালো হলো না। তাই সে আর কথা না বলে মুচকি হাসলো। হঠাৎ তার পেছন থেকে একটা 7-8 বছরের ছেলে বেরিয়ে এলো।অনুর তাকে চিনতে বেশি বেগ পেতে হলো না এত সাদ সে তাকে হাতের ইশারা করলো সামনে আসার জন্য।

সাদৎতার পিমনির ইশারা পেয়ে দৌড়ে তার সামনে গেল অনু তাকে জড়িয়ে ধরে বলল কেমন আছে আমার বাবাটা?

সাদ: খুব ভালো তুমি কেমন আছো পিমনি। আমি তোমাকে খুব মিস করতাম।

অনু: আমিও তোমাকে খুব মিস করছি সোনা।

এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল অনন্য তার মাকে অন্য কেউ জড়িয়ে ধরতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো সে সাদকে তার মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে দিল।

অনন্য: কে তুমি আমার মাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে ছিলে কেন তুমি জানো না আমার মা শুধু আমাকে ভালবাসে।

সাদ: আমি তোমার পিমনিকে চুপ জড়িয়ে ধরেছি তুমি কে ছোট পিচ্চি।

অনন্য: আমি পিচ্চি নই ওকে আমি মামাস বিগ গার্ল।হুহ।

সাদ: পিমনি এই মেয়েটাকে সে কখন থেকে আমার সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছে।

এতক্ষণ সবাই তাদের ঝগড়ার শুনে মিটমিট হাসছিল। তারপর অনু বলল

অনু: সাদ বাবা ও হচ্ছে তোমার বোন অনন্য। আর অনন্য সাদ তোমার বড় ভাই হয়।তার সাথে ভালো ভাবে কথা বল।ভাইয়াকে হাই বল।

অনন্য: আমার এমন পচা ভাইয়া লাগবে না। আমার মাকে নিয়ে যায়।

সাদ: আমারও তোমার মত পচা বোন লাগবেনা।

তারপর বহু কষ্টে তাদের দুজনের ঝগড়া থামিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তারা নিজ বাসায় উঠল আগে থেকেই সাদাত লোক দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে রেখেছে।তারপর তারা কোন রকম ফ্রেশ হয়ে যার যার রুমে বিশ্রামের জন্য চলে গেল আর সাদাত ডিনারের ব্যবস্থা করতে গেল।

রাতে খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমিয়ে গেল। খুব লম্বা জানি পর ক্লান্তি আসাটাই স্বাভাবিক।

শাফিন এই কয়েক বছরে অভ্যাসবশত প্রায়ই রাতে অনুদের বাড়ির সামনে যায়। যদি অনুর‌ সাথে একবার দেখা হয় সেই আশায়।আজ কেন জানি শাফিনের মন বাড়িতে টানছে। বারবার মনে হচ্ছে আজ অনুর দেখা মিলবে। তাই আর দেরি না করে অনুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেল।

সেখানে যাওয়ার পর শাফিনের খুশির সীমা রইল না অনুদের বাড়ি আলো জ্বলছে অনুর ঘরের বারান্দায় আলো জ্বলছে তাহলে কি অনু ফিরে এসেছে। সারারাত শেয়ার দুচোখের পাতা এক করল না এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো অনুর বারান্দার দিকে যদি একবার দেখা হয় সেই আশায়। কিন্তু সকাল 9 টা পার হওয়ার পরেও অনুর দেখা মিলল না। হঠাৎই কোত্থেকে একটা বল এসে শাফিনের পায়ের কাছে থাকল। সেবল টা হাতে তুলতেই একটা তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।

মেয়ে: তুমি আমার বলটাকে হাতে কেন নিয়েছো। ডোন্ট ইউ নো দ্যাট অন্যের জিনিস না বলে নেওয়া ব্যাডম্যানার।(কোমরে হাত দিয়ে)

শাফিন নিচু হয়ে বাচ্চাটি গাল টেনে দিল।

মেয়ে: ওফফো ডোন্ট টাচ মাই চিক। আই ডোন্ট লাইক ইট।

শাফিন: ওরে বাবা আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। সরি আর হবে না। তা কি নাম তোমার?

মেয়ে: আমি তোমাকে আমার নাম কেন বলব। মা বলেছেন ডোন্ট টক উইথ স্ট্রেঞ্জারস।

কেন যেন শাফিনের বাচ্চা মেয়েটিকে খুব আপন লাগছে তার যদি একটা মেয়ে হতো তাহলে নিশ্চয়ই ও সমান বড় হত। হঠাৎই কেউ একজন বাচ্চাটিকে ডাক দিল বাচ্চাটি স্বপ্নের হাত থেকে বল নিয়ে তাকে বাই বাই দিয়ে চলে গেল।

আর শাফিন বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কারণ বাচ্চা মেয়েকে অনুর বাবা নানু ভাই বলে ডাক দিয়েছে। শাফিনের যা বোঝার তা বুঝে গেছে এতক্ষণ সাথে কথা বলছিল অথচ তাকে চিনতে পারল না।

শাফিন ভাবল আপাতত তার বাড়ি যেতে হবে অনেক কাজ পড়ে আছে। বাড়ি গিয়ে তার খুশীর সীমা রইল না সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলছে

শাফিন: মা অনূঢ়া ফিরে এসেছে যেন আমার একটা মেয়েও আছে একদম বাচ্চা পুতুল কি সুন্দর করে কথা বলে আমাকে বলে কি জানো মা নিষেধ করেছেন স্ট্রেঞ্জারদের সাথে কথা বলতে। চেহারা একেবারে অনুমত টুকটুক করে হাটে কথা বলে। মা ও আমার মেয়ে আমার আর অনুর মেয়ে। বলতে বলতেই স্বপ্ন চোখে খুশিতে পানি এসে পড়লো।

আর তার মা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না।

বাড়ি এসে প্রথমেই সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল। অনুর সাথে কথা বলতে হবে তার। একবার হলেও মাফ চাইতে হবে। তার জন্য সুযোগ আর সময় দুটোই প্রয়োজন।
………….
……………….
[বাকিটা পরবর্তী পর্বে…….]

#হারিয়ে_খুঁজবে_আমায় #সানজিদা_ইসলাম #গল্পের_ডায়েরি #Sanjida_Islam #GolperDiaryOfficial

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here