গল্প : লারিসা | পর্ব : ষোলো
গভীর রাতে জ্ঞান ফিরে লারিসার। সে নিজেকে বিশাল একটা ঘরের ভেতরে হাত-পা বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখা অবস্থায় আবিষ্কার করে। চোখদু’টো ভালো করে খুলে যাওয়ার পর যে দৃশ্য দেখতে পায়, তাতে একরকম চমকে উঠে সে। কারণ, তার থেকে প্রায় বিশ হাত দূরে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচুতে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে একটি মানুষকে। সেই মানুষটিকে চিনতে ভুল হয় না লারিসার। ওর মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। তবুও তাকে চিনতে ভুল করল না লারিসা। মানুষটি যে খোদ লি রি তা বুঝতে এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি তার। সে চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই দু’জন ছুটে আসে। দু’জনে শক্ত হাতে লারিসাকে হেঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করায়। “চল” বলে ধাক্কা দেয়। কিন্তু লারিসা নড়ে না৷ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের একজন আবারো লারিসার পিঠে ধাক্কা দিয়ে বলে, “চল!”
কিন্তু লারিসা যায় না। সটান দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবাদ জানায়। চেঁচিয়ে বলে, “যার না। যাব না আমি।”
“যাবি না! তবে রে!” বলে ভীষণ রাগে দাঁতে দাঁত পিষে লারিসার চুল হাতের মুঠোয় ভরে জোরে টান দিতেই লারিসা আর্তনাদ করে মেঝেতে পড়ে যায়। সাধুদের একজন জোরে লারিসার পিঠে লাথি মেরে ফের টান দিয়ে দাঁড় করায়। লারিসা কুঁকিয়ে ছটফটিয়ে উঠে। এবং সঙ্গে সঙ্গে একজনের হাত টেনে কামড় বসিয়ে দেয়। লোকটা এত জোরে চিৎকার দেয় যে, লি রি’র ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেলে সামনের দৃশ্যটা যখন পরিষ্কার হয়ে আসে তখন দেখতে পায়, দু’টো লোক লারিসাকে নির্যাতন করছে। লি রি চেঁচিয়ে উঠে, “লারিসা!”
যারা লারিসাকে নির্যাতন করছিল ওরা দু’জনেই অবাক হয়ে তাকায়। তারা ভেবে পায় না, লি রি এই মেয়েটির নাম জানলো কীভাবে? শুধু একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তবে লি রি’র দিকে তাকায়ও না। কারণ ওদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন লারিসাকে ধরে নিয়ে যায়। রাত শেষ হবার আগেই রোবানের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হবে। এবং রোবানকে হত্যার দায়ে লারিসাকেও ওই একই আগুনে পোড়ানো হবে।
লোকদু’টো দেরি না করে লারিসাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। লারিসা যেতে না চাইলে তার গায়ে হাত তুলে৷ তারপর হেঁচকা টান দেয়। ওদিকে লি রি জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। লারিসাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য মিনতি করছে। কিন্তু ওরা লি রি’র কথায় কান দিলো না। লারিসাকে টেনে টেনে নিয়ে গেল বাইরে।
একটা খোলা জায়গায় শুকনো বড়ো গাছের টুকরো জড়ো করা হয়েছে। শুকনো তক্তাগুলোর উপরে লম্বা করে রাখা হয়েছে রোবানের নিশ্চল দেহ। তার ঠিক পাশেই লারিসাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শোয়ানো হয়েছে। তারপর তাদের উপর আরো কিছু কাঠ দেওয়া হয়েছে। এবার একজন মশালটা এগিয়ে দিলো সবচে’ বৃদ্ধ লোকটার হাতে। লারিসাকে এত বাজেভাবে বাঁধা হয়েছে যে, সে কোনোভাবেই নড়তে পারছিল না। তবে তার মুখ বাঁধা হয়নি। তাই সে খুব জোরে জোরে কান্না করছে। বৃদ্ধ লোকটা নিচু আওয়াজে বলল, “এই মেয়ে, লি রি তোমার নাম ধরে ডেকেছে নাকি? সে তোমার নাম জানলো কীভাবে?”
লোকটার আগ্রহ দেখে কান্না থামায় লারিসা। সে স্পষ্ট দেখেছে, লি রি’র নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে ভয়ে লোকটার চোখ বিক্ষিপ্তভাবে নড়ছিল। গলাও কেঁপেছে। এমনকি তার কপালে ঘাম জমে গেছে। লারিসা চুপ মেরে আছে দেখে বৃদ্ধ ফের জিজ্ঞেস করে, “লি রি তোমার নাম জানল কী করে?”
বসতির একজন বলে উঠে, “এত প্রশ্ন করছেন কেন? পুড়িয়ে ফেলুন পাপিটাকে। পুড়িয়ে ফেলুন।” বাকি সবাই সমস্বরে সম্মতি জানায়। তখন বৃদ্ধ লোকটা জ্বলন্ত মশাল এগিয়ে দেয় লারিসার দিকে। আগুন ধরেই যাবে এমন সময় একটা বিস্মিক কণ্ঠ শোনা যায়, “এটা কী!”
সঙ্গে সঙ্গে সকলে একসঙ্গে চোখ তুলে তাকায়। বৃদ্ধ লোকটাও। তারা সবাই দেখতে পায় প্রায় ছয় ফুট লম্বা একটা প্রাণী, তার সমস্ত শরীরে কালো লোমে ভরতি, তার পিঠে তিনটি হাতির দাঁতের মতো শিং, লম্বা নখওয়ালা হাত-পা… এমন প্রাণী কেউ জীবনে দেখেনি। প্রাণীটা মাত্র বারো কিংবা তেরো হাত দূরে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে সকলের গলা শুকিয়ে যায়। তখন অন্ধকার থেকে, দূর দূর থেকে কয়েক শত নেকড়ে ধীর পা ফেলে এগিয়ে এসে ওই অদ্ভুত প্রাণীটার পেছনে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই শত শত প্রাণীর হামলার শিকার হয় সকলে৷ ধাওয়া খেয়ে সকলে এলোপাথাড়ি ছুট দেয়। কেউ উলটে পড়ে যায় ওই সাজানো কাঠগুলোর উপর। কিছু কাঠ পড়ে যায়। লারিসার উপর থেকে কয়েকটি বড়ো কাঠ পড়ে গেলে সে একটু একটু করে হাতের বাঁধন খুলে নেয়। কারণ একটু আগে লোহার শিকল খুলে নিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে তাকে।
হাত-পায়ের বাঁধন খুলে ছুটে পালায় লারিসা। কারণ একসঙ্গে এত নেকড়ে দেখে সে নিজেও তীব্র ভয় পেয়েছে। ছুটতে ছুটতে একটা ঘরের আড়ালে গা ঢাকা দেয় লারিসা। তখন দেখে, সেখানে আগে থেকে একজন বৃদ্ধ মহিলা লুকিয়ে আছেন। তিনি লারিসাকে দেখে মুচকি হেসে বলেন, “লি রি তোমার নাম জানে কীভাবে?”
লারিসা বলে, “আমি ওর বউ।”
বৃদ্ধ মহিলার হাসি আরো বেড়ে যায়। তিনি কোমল গলায় বলেন, “তোমার সঙ্গে দেখা হবার জন্যই হয়তো এত বছর ধরে বেঁচে আছি।”
“আমার সঙ্গে?” কৌতূহল প্রকাশ করে লারিসা।
“হ্যাঁ। কাউকে না কাউকে তো আসল সত্যিটা বলতেই হবে। সেই কেউ একজন বোধহয় তুমি। যাকে সব সত্যি বলে দেওয়া উচিত।”
“কীরকম সত্যি?”
বৃদ্ধ মহিলা উদাস গলায় বলে চলেন, “আজ থেকে বহু বছর আগে একটি সহজ সরল মেয়ে এখানে এসেছিল। তাকে দলে রাখবার নাম করে বেহুঁশ করে দিনেরাতে বহুবার ধর্ষণ করা হয়। মেয়েটির জ্ঞান ফিরলে আবার তাকে অজ্ঞান করা হত। তারপর তার দেহের উপর চলত অমানবিক নির্যাতন।
মেয়েটি যে রাতে পালিয়ে যায়, সেই রাতে কী একটা কারণে বাইরে বেরিয়েছিলাম আমি। দেখি, মেয়েটা দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি তার পিছু নেই। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যাবার পরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ে। আমিও আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করি। দেখতে পাই এক আজব দৃশ্য। মেয়েটির পেটে বাচ্চা ছিল না। অথচ কয়েক মিনিটের মধ্যে তার পেট ফুলে গেল। ধীরে ধীরে ফুলতে ফুলতে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে দশ মাসের গর্ভধারিণী হয়ে গেল সে। আমি তা দেখে অবাক। তখন প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়। মেয়েটা বৃষ্টির মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করে। আশ্চর্যের বিষয় কী জানো? বাচ্চাটাকে কোলে নেয় একটা জংলি নেকড়ে! আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম, নেকড়েটা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে এবং কিছুক্ষণ পর তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। তখনই আমি বুঝেছিলাম, এই বাচ্চা কোনো সাধারণ বাচ্চা নয়। এ-বাচ্চা এই পুরো গোষ্ঠীর পাপের ফসল। এই পুরো সাধু দলের মিলিত পাপের ফসল। এই বাচ্চার জন্মই হয়েছে এই পাপিষ্ঠদের দুনিয়া থেকে মুছে ফেলার জন্য। এবং সেই ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে একটা নেকড়ে! আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই কাউকে কিছু বলিনি। দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পরদিন জানতে পারি সেই মেয়েটি মারা গেছে এবং বাচ্চাটিকে সাধুরা বসতিতে নিয়ে এসেছে। আমি জানতাম বাচ্চাটি বড়ো হয়ে তার মায়ের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের বদলা নেবে। তার মায়ের সাথে যে অন্যায় হয়েছে সেটা সে এই সাধুদেরকে ফিরিয়ে দেবে তা আমি জানতাম। আমি খেয়াল করতাম, প্রতিবার জন্মদিনে গভীর রাতে অসংখ্য নেকড়ে এসে ওই ঘরের কাছে ভীড় করত যে ঘরে লি রি’কে আটকে রাখা হয়েছে। এবং আমি জানলার ফাঁক দিয়ে এ-ও দেখেছি যে, লি রি প্রতি বছর তার জন্মদিনে গভীর রাতে একটা অদ্ভুত প্রাণী হয়ে যায়। সবকিছু জেনে বুঝেও কাউকে কিছু বলিনি। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, লি রি’র মায়ের সঙ্গে যা হয়েছে তা খুবই অন্যায় ছিল।
এখান থেকে সবাই চলে যাবার পর রোবান যখন আবারো লি রি’কে আটকে রেখে সবাইকে এখানে এনেছিল এই বলে যে, লি রি আমাদের হাতে জিম্মি থাকলে কোনো নেকড়ে আমাদের উপর হামলা করবে না কারণ নেকড়েরা লি রি’র বন্ধু। তখনই আমি বুঝেছিলাম, রোবান নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনছে। সেইসাথে বস্তিবাসীর মৃত্যুও।
শুনো, আজ কিন্তু লি রি’র জন্মদিন নয়। তবুও সে অদ্ভুত প্রাণী হয়ে উঠেছে। কেন হয়েছে জানো?”
লারিসা এতক্ষণ হা করে শুনছিল বুড়ির কথা। এবার প্রশ্ন শুনে সে থমথমে গলায় বলে, “কেন?”
“কারণ, আজকের এই দিনেই লি রি’র মা’কে কেউ একজন ভুলভাল বুঝিয়ে দলে যোগদান দিতে আগ্রহী করে তুলেছিল।”
“কিন্তু আপনি এসব জানলেন কীভাবে?”
বুড়ি মাথা নিচু করে ফেলল। বলল, “কারণ সেই পাপী মানুষটাই আমি। আমিই লি রি’র মা’কে এটাসেটা বুঝিয়ে দলে যোগদান করে বলেছিলাম। কারণ একটি মেয়ে যোগ করতে পারলে তখন আমাকে একটি পাকা ঘর দেওয়া হবে বলা হয়েছিল। সেই ঘরের লোভে আমি…”
“আপনি একজন মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়ের এত বড়ো ক্ষতি করতে পারলেন! ছিঃ!”
লারিসা কথাটি বলে শেষ করতে পারেনি তার আগেই একটা নেকড়ে উড়ে এসে বুড়ির গলায় থাবা বসিয়ে দেয়। তার গলায় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। বুড়ি ধপ করে লুটিয়ে পড়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর লি রি এগিয়ে আসে৷ লি রি’র এমন ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে লারিসা ভয় পেয়ে যায়। তবে এবার সে নিশ্চিত হয়, বহুদিন আগে এক রাতে সে ড্রিংক করা অবস্থায় আসলে ভুল দেখেনি। সত্যি সত্যি লি রি এমন প্রাণী হয়ে যায়!
লি রি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়।
ভোরের আলো ফুটে উঠলে জ্ঞান ফিরে তার। সে চোখ খুলে লারিসাকে দেখে বলে, “কে আপনি? আমি এখানে কেন?”
লারিসা বুঝতে পারে, লি রি সব ভুলে গেছে। সে কোমল গলায় জানায়, “আমি আপনার বউ।”
তারা যখন হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠে লি রি, “আপনি আমার বউ?”
লারিসা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, “সন্দেহ আছে নাকি?”
লি রি ইতস্তত করে বলে, “বউ, নাম কী তোমার?”
লারিসা খিলখিল করে হেসে বলে, “লারিসা!”
সমাপ্ত
এই গল্পটি দিতে আমি অনেক দেরি করেছি৷ প্রতিটি পর্ব দিতে চার থেকে ছয়দিন সময় নিয়েছি, যা পাঠকদের জন্য খুবই বিরক্তির কারণ ছিল। তবুও যারা যারা শেষ অবধি পড়েছেন তাঁদের ধৈর্য আছে বলতে হয়।
সবার জন্য শুভকামনা।
মো. ইয়াছিন