গল্প : লারিসা | পর্ব : পনেরো
লারিসা যখন ঘরে গিয়ে ধীরে সুস্থে ড্রিংকসের বোতল, গ্লাস, স্ট্রো, ক্যান্ডেল এসব নিচ্ছিল তখন রোবান এবং তার দল ঘুমন্ত লি রি’র হাত-পা বেঁধে বস্তায় ভরে কাঁধে তুলে নিল। লি রি বস্তার ভেতরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছটফট করছিল৷ ধস্তাধস্তি করেও কাজ হয়নি। চারজন তাগড়া যুবক বস্তাবন্দি লি রি’কে কাঁধে করে রওনা দিলো। ওদের নির্দেশ দিচ্ছিল রোবান।
ড্রিসংকস্ নিয়ে এসে লি রি’কে দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে লারিসা। এদিক ওদিক খুঁজেও যখন লি রি’র কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না তখন লি রি যেখানে শুয়ে ছিল ঠিক সেখানেই একটা মাদুলি খুঁজে পায় লারিসা। অবাক করার মতো বিষয় হলো, বহুদিন আগে একবার যখন লি রি’কে খুঁজতে একদল সাধু এসেছিল তখন একজন সাধুর হাতে ঠিক একইরকম মাদুলি দেখেছিল লারিসা। এতদিন পর এরকম একটি মাদুলি দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নেয় লারিসা। টর্চ দিয়ে বালির ওপর দেখে আর কিছু পাওয়া যায় কি না। তখনই লারিসা বালির উপর অসংখ্য পায়ের ছাপ দেখতে পায়। চ্যাপ্টাকৃতির কাঠের জুতোর ছাপ। যেমন জুতো সে ওই সাধুদের পায়ে দেখেছিল! ছাপ দেখে দেখে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটে লারিসা। ছাপগুলো বালি পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেছে। লারিসার বুঝতে বাকি থাকে না। সে ঠিকই আন্দাজ করে নেয় ওই সাধুরাই লি রি’কে তুলে নিয়ে গেছে। সহসা লারিসার হাত থেকে বোতল, ট্রে, স্ট্রো সবকিছু পড়ে যায়। তারপর ধপাস করে বালির উপর বসে পড়ে সে। চোখদু’টো ঝাপসা হয়ে আসে তার। সে জানে না সাধুদের সাথে লি রি’র কী সম্পর্ক? সাধুরা কেন তাকে তুলে নেবে? আর লি রি কেনই বা ওই সাধুদেরকে এত ভয় পাবে? এসবের কিছুই জানে না সে। কিছুই ভাবতে পারে না। শুধু লি রি’র ভয়ার্ত মুখটা ভেসে উঠে তার চোখে। যেদিন সাধুরা লি রি’কে খুঁজতে এসেছিল, সেদিন তার চোখে প্রচন্ড ভয় দেখেছিল লারিসা। ভয়ে লি রি থরথর করে কাঁপছিল। আতঙ্কে লি রি’র চোখদু’টো ছোটো হয়ে এসেছিল একদম। তবে কি সাধুরা লি রি’কে প্রাণে মেরে ফেলার সম্ভাবনা আছে?
জলে ভেজা চোখদু’টো মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় লারিসা। ঠিক করে, সাধুদের আস্তানায় ছুটে যাবে সে। এবং যেভাবেই হোক, যেকোনো মূল্যে সে লি রি’কে ফিরিয়ে আনবে।
তিনদিন অক্লান্ত খোঁজাখুঁজির পর সাধুদের বসতির সন্ধান পায় লারিসা। একজন বয়স্কা’র কাছে আশ্রয় চায় সে। কারণ সে জানত, সরাসরি লি রি’র কথা জিজ্ঞেস করলে কেউ কিছু বলবে না। আগে ওদের সাথে মিশতে হবে এবং কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মনে মনে খুঁজতে হবে। তা না হলে বিপদ। লারিসারও, লি রি’রও।
কিন্তু আশ্রয় পেতে হলে যে শর্ত পূরণ করার কথা বুড়ি জানালো তা শুনে লারিসার কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেল। বুড়ি বলল, ওদের দলে যোগ দিতে হলে তিনবার আত্মাশুদ্ধি করতে হবে। অর্থাৎ বিয়ে ছাড়াই ওদের নেতার সঙ্গে তিনবার মিলিত হতে হবে!
বুড়ি বলল, “কী? শর্ত পালনে প্রস্তুত?”
লারিসা থতমত খেয়ে যায়। কথা খুঁজে পায় না। কিন্তু লি রি’কে মুক্ত করতে হবে। জীবিত অবস্থায় এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে।
বুড়ি যখন দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে তখন নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা চিন্তা করে বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে যায় লারিসা। অতঃপর তাকে একটি ছোট্ট ঘরে থাকতে দেওয়া হয়। এবং বলা হয়, আজ রাতেই প্রথম আত্মাশুদ্ধি হবে। অর্থাৎ আজ রাতেই…
এইসব চিন্তা করে লারিসার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু লি রি’র কথা ভাবল সে। তার জীবনটা যখন একাকিত্বে ছেয়ে গিয়েছিল তখন ভালোবাসার প্রদীপ হয়ে তার জীবন আলোকিত করতে উপস্থিত হয় লি রি। গত ক’দিনে তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে লি রি। লি রি’কে দেখেই লারিসার বেঁচে থাকার সাধ জেগেছে। লি রি’র জন্যই তার রাত হয়, আবার আঁধার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ে। তারপর আবারো সন্ধ্যা নামে। রাত গভীর হয়ে গেলে বেঘোরে ঘুমন্ত অবস্থায়ও যাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে লারিসা, সেই একমাত্র মানুষটি লি রি৷ তাই তাকে বাঁচাতে সকল দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে রাজি হয়ে যায় সে।
রাতে যখন তার ঘরে রোবান এল, তখনও পালাতে চায়নি লারিসা। রোবান যখন লারিসার পরিধেয় বস্ত্র খুলে নিল, তখনও সে টু শব্দ করেনি। এমনকি তার উদাম বুকের উপর যখন সুতো বেঁধে দিচ্ছিল তখনও সে বাধা দেয়নি৷ চোখ বুঁজে নিজেকে সপে দিয়েছে রোবানের কাছে।
বাইরে হৈ-হুল্লোড় চলছিল। চিৎকার, চেঁচামেচি, গান বাজনা, নৃত্য। শুকনো কাঠ জড়ো করে আলো জ্বালিয়ে আমোদ করছে সবাই। আর আবদ্ধ ঘরে রোবানের অত্যাচার সহ্য করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে লারিসা। রোবান যখন ধাক্কা দিয়ে লারিসাকে বিছানায় ফেলে দেয় তখনও সে নিজেকে সামলে রেখেছিল। কিন্তু যখন তার একদম কাছে এসে রোবান বিশ্রি ভঙ্গিতে মুখ ঘষতে লাগল ঠিক তখন না চাইতেও বিছানার এক কোণে পড়ে থাকা ছোট্ট কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে রোবানের নাক বরাবর আঘাত করে ফেলে লারিসা। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করে। তাই দেখে লারিসা ভয় পেয়ে যায়। উঠে যায়, কোনোমতে নিজের গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। কারণ বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তখন রোবান এসে লারিসার চুল মুঠোয় ভরে নেয়। হেঁচকা টান দিতেই লারিসা দ্বিতীয়বার রোবানকে প্রহার করে। আঘাত পেয়ে পাক খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রোবান। লারিসা তখনও জানে না, তার হাতের ছোট্ট কাঠের আঘাতে বয়স্ক রোবানের মৃত্যু হয়েছে!
সে নিজের প্রাণ বাঁচাতে দরজা ধাক্কাচ্ছিল। কারণ তার ধারণা, রোবানের জ্ঞান ফিরলে সে খুন করার উদ্দেশ্যে হামলা করবে। কিন্তু বাইরে বাজনার আওয়াজ আর সকলের চেঁচামেচিতে দরজা ধাক্কানোর শব্দ কেউ শুনতে পায়নি তবে একজন বয়স্ক লোক সেটা খেয়াল করছিল। সে-ই দরজা খুলে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘামে ভেজা আতঙ্কিত লারিসা বেরিয়ে আসে। লোকজন দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে ভেতরে গিয়ে দেখে রোবান মারা গেছে!
এতদিন পর বসতিতে ফিরে আসতে পারার পেছনে যদি কারোর সাহায্যের হাত থেকে থাকে তবে ওই মানুষটা রোবান। রোবানের প্রতি সবাই কৃতজ্ঞ। সেই মানুষটাকেই মেরে ফেলেছে লারিসা!
ক্ষুব্ধ জনতা লারিসাকে মেরে ফেলতে চায়। তখন বৃদ্ধ লোকটা সবাইকে বাধা দিয়ে বলে, লারিসাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। আপাতত তাকে বন্দি করে রাখা হোক।
তখন রাগান্বিত একজন কোত্থেকে যেন উড়ে এসে লারিসাকে খুব জোরে আঘাত করে। তখন জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় লারিসা।
চলবে
মো. ইয়াছিন