টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব ২

0
396

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০২
লেখা: ShoheL Rana শামী

‘এই আহেন আহেন, এহনি জাহাজ ছাইড়া দিবো। ঢাকার শেষ জাহাজ চইলা যাইবো। তাড়াতাড়ি আইয়া পড়েন।’

একসাথে কয়েকজন হাক ছাড়লো যাত্রীর উদ্দেশ্যে। ঢাকাগামী এটাই শেষ জাহাজ শুনে দ্রুত এগিয়ে গেল রিহান। জাহাজে উঠতে চাইলে একজন তার পথ আটকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘টিকেট নিছেন?’

‘টিকেট? না, নিইনি।’ হতাশার ছাপ ফুটে ওঠলো রিহানের চেহারায়।

‘তাইলে তো জাহাজে উঠবার পারবেন না। আগে টিকেট লন। ঐ যে টিকিট কাউন্টার।’ একদিকে ইশারা করলো লোকটা। রিহান ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। জানে সে, ওখানে গিয়ে ব্যর্থ হবে। ওখানে টিকেটের যে মূল্য চাইবে, তা তার কাছে নেই। রিহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা আবার বললো, ‘কী হইলো সাব? যান, টিকিট লইয়া আহেন। আর না গেলে সরেন। যাত্রী আইতে দ্যান।’

‘ভাই, আমার কাছে তো টিকেটের মূল্য নেই। আমাকে কি কোনোভাবে একটু ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে?’ খুব অসহায় শুনালো রিহানের কণ্ঠ।

‘না ভাই, হেইডা সম্ভব না।’

‘ভাই একটু কষ্ট করে নিয়ে যান না আমাকে? খুব বিপদে পড়েছি।’

লোকটা রিহানের কথা না শোনার ভান করে নিজের মতো করে যাত্রী ডাকতে লাগলো, ‘এই আহেন আহেন, আইজকার শেষ জাহাজ। আহেন আহেন…’

রিহানের পাশে এক মধ্যবয়সী লোক এসে দাঁড়ালেন। রিহান তার দিকে তাকাতেই লোকটা বললো, ‘ঢাকায় যাওয়ার পয়সা নেই? চলুন আমাদের সাথে, আমরা একটা কেবিন নিয়েছি।’

রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা পুনরায় তাগাদা দিলেন, ‘কী হলো, চলুন? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যেতে পারবেন না। ওরা আপনাকে ফ্রিতে নিয়ে যাবে না৷ ব্রিটিশদের জাহাজ। বুঝলেন তো?’

লোকটাকে ভালো এবং ভদ্র মনে হলো রিহানের। হয়তো শিক্ষিতও। লোকটার পিছুপিছু চললো সে। এছাড়া উপায়ও নেই আর। চারপাশটা কোলাহলে ভরে ওঠেছে। কয়েকজন বাদাম বিক্রেতা ওঠেছে জাহাজে। যাত্রীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বাদাম বিক্রি করছে। জাহাজের ডেকে বসে বেশ কয়েকজন খোশগল্প করতে ব্যস্ত। একটা শিশু জাহাজের রেলিং ধরে উঠতে চাইলে এক দম্পতি দৌড়ে যেতে লাগলো শিশুটার দিকে। ওরা পৌঁছার আগেই রিহান শিশুটাকে রেলিং থেকে নামিয়ে তার বাবা-মার হাতে তুলে দিলো। ঐ দম্পতি কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ করলো না। উল্টো এমনভাবে তাকালো যেন মানুষ সদৃশ কোনো চতুষ্পদ জন্তু দেখছে। রিহান নিজের মতো আবারও অনুসরণ করলো মধ্যবয়স্ক ঐ লোকটাকে। কেবিনের সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো সতেরো-আঠারো বছরের এক কিশোরী। ফুলহাতা ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং করে খয়েরি রংয়ের শাড়ি পরে আছে সে। খোপা করা চুলে তার একটা লাল গোলাপ গুঁজানো। মেয়েটা হয়তো বেশ শৌখিন। মধ্যবয়স্ক লোকটার মেয়ে হবে হয়তো সে। বাবার সাথে অপরিচিত কাউকে দেখে মাথায় কাপড় টেনে দিলো।

‘আমার মেয়ে, সুফিয়া।’ পরিচয় করিয়ে দিলেন লোকটা।

‘হাই।’ আলতো করে হাত নাড়লো রিহান। মেয়েটার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মনে হলো নতুন আপদটার কারণে কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু ওর বাবা যথেষ্ট বিনয়ের সাথে রিহানকে কেবিনের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালো। তখন সুফিয়া তার বাবার হাতটা ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা, তুমি কি এই লোকটাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবে? একই কেবিনে?’

‘কী করবো মা? ছেলেটা বিপদগ্রস্ত।’ বাবার সদুত্তর।

‘কিন্তু বাবা, কেবিনে তোমার বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়েও আছে, সেটা কি ভুলে গেছো?

‘না, ভুলিনি। কিন্তু ছেলেটা অসৎ চরিত্রের কেউ মনে হলো না।’

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুফিয়া। তখন ভেতর থেকে রিহান এসে বললো, ‘আপনাদের অসুবিধে হলে থাক… আমি চলে যাই।’

‘থাকুন আপনি, এসেই যখন পড়েছেন। তবে যে বিশ্বাসটা বাবা আপনাকে করেছে, তার মর্যাদা রাখার চেষ্টা করবেন।’

‘অবশ্যই।’ ভরসা দিলো রিহান। তার এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে অন্য কিছু মাথায় আসার প্রশ্নই আসে না। ভদ্র লোকটা যে তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন এটাই বেশ। রিহান নিজের পরিচয় দিলো, ‘আমি রিহান।’ নাম শোনার কোনো আগ্রহই দেখালো না সুফিয়া। জানালার পাশ ঘেঁষে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো নদীর জলের দিকে। তার এমন ব্যবহারের জন্য বাবা দুঃখ প্রকাশ করে বললো, ‘ওর ব্যবহারে কষ্ট পেয়ো না। আসলে মা ছাড়া বড়ো হয়েছে তো। তাই একটু একরোখা।’

‘মা নেই ওর?’

‘না, ওর বয়স যখন তিন বছর, তখন তার মা মারা যায় অসুখে।’

‘ওহ্!’ সমব্যথী দেখালো রিহানকে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে রিহান প্রশ্ন করলো, ‘আংকেল, আপনার নামটা জানতে পারি? ঢাকায় কি কোনো কাজে যাচ্ছেন?’

‘আমার নাম জাফর। এলাকার সবাই জাফর মাস্টার বলেই চেনে। আমার নিজ বাড়ি ঢাকাতেই। চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করতাম। শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে এখন চলে যাচ্ছি। গ্রামে জমি-জমা আছে, ওগুলো দেখাশোনা করবো।’

‘আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’

‘গফরগাঁও থানায়। গফরগাঁও চিনো?’

‘হ্যাঁ চিনি।’

‘তুমি ঢাকার কোথায় থাকো?’

চুপ করে রইলো রিহান। কোনো জবাব দিলো না। কী জবাব দেবে ভেবে পেল না সে। সেও গফরগাঁওয়ের ছেলে। কিন্তু এই সময়টাতে তার পরিচয় দেয়ার মতো কিছুই নেই। আশপাশের অবস্থা দেখে সে ইতোমধ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এখন ১৯৪২ সাল। সে তার সময় থেকে কয়েক যুগ অতীতে চলে এসেছে। এখন সে তার এলাকায় ফিরে গিয়ে হয়তো কিছুই পাবে না। তার আত্মীয়-স্বজন কাউকে না, তার পরিচিত পরিবেশটাও অপরিচিত হয়ে যাবে। রাস্তা-ঘাট, বাড়িঘর সবকিছু তো বদলে যাবে। তবে কীসের আশায় সে ফিরে যাচ্ছে?

‘কী হলো বাবা? তোমার কি যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই?’ জাফর মাস্টার পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন।

‘আংকেল, আসলে কীভাবে যে কথাটা বলি। আপনাকে বললেও হয়তো বিশ্বাস করবেন না। আমি আসলে আপনাদের সময়ের কেউ না।’

‘মানে?’ অবাক হলেন জাফর মাস্টার। সুফিয়াও মুখ ঘুরিয়ে আনলো রিহানের দিকে। মাথার কাপড় কিছুটা নেমে গেছে তার। জানালা দিয়ে ভারি বাতাস ঢুকে তার মাথার চুলগুলো নাড়াচ্ছে। রিহান তার দিকে বোকার মতো একবার চেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো জাফর মাস্টারের দিকে। আমতা আমতা করে বললো, ‘আমি আসলে ভবিষ্যত থেকে এসেছি। আপনার এই সময়ের আরও ৪৮ বছর পর আমার জন্ম হয়েছে।’

এবার ফিক করে হেসে ওঠলো সুফিয়া। হাসিটা তার থামতেই চাইলো না আর। মুখে হাত চেপে ধরে হেসে চললো সে। তারপর রিহানের দিকে ইশারা করে বাবাকে বললো, ‘বাবা ও না-কি ভবিষ্যত থেকে এসেছে। বাবা… হি হি হি… তুমি এই লোকটাকে কোথা থেকে ধরে আনলে?’

বোকার মতো চেয়ে রইলো রিহান বাপ-মেয়ের দিকে। জাফর মাস্টার মেয়েকে কিছুটা ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘সুফিয়া, এটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। ছেলেটা হয়তো মানসিকভাবে একটু অসুস্থ। কারও অসুস্থতা নিয়ে এভাবে হাসতে হয়?’

‘ঠিক আছে বাবা, আর হাসবো না।’ কথাটি বললেও আরও অনেকক্ষণ হেসে চললো সুফিয়া। রিহান কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। এরা ওকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ভেবে নিয়েছে। এজন্যই সে কথাটি বলতে চাইনি প্রথমে।

কেবিনের দরজায় শব্দ হলো। জাফর মাস্টার উঠে দরজা খুলে দিলে এক হকার জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, পত্রিকা লাগবো?’

‘হ্যাঁ, দাও। একটা নবযুগ দাও, আরেকটা বেগম দাও।’

দু পয়সা দিয়ে দুটো পত্রিকা নিয়ে জাফর মাস্টার আবারও কেবিনে এসে বসলেন। তারপর পত্রিকায় মনোযোগ দিলেন। বাবার হাত থেকে নবযুগ পত্রিকাটা নিয়ে শিরোনামগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো সুফিয়া। কী যেন খুঁজছে মনে হলো সে পত্রিকায়। পরে খুঁজে না পেয়ে আশাহত হয়ে রেখে দিলো পত্রিকাটা। রিহান তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘এটা কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকাটা না? শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত করেছেন?’

‘হুমম, অনেকদিন পত্রিকাটা বন্ধ করে রাখছিল। কিছুদিন হলো আবার চালু হয়েছে।’

‘হুমম। ২০০০ টাকা প্রদেয় জামানতের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি এই ব্যাপারে জানি দেখলেন তো?’ কথাটি বলে নিজেকে খুব পারদর্শী মনে হলো রিহানের। মৃদু হাসি ফুটে ওঠলো ঠোঁটের কোণায়। কিন্তু তার কথা শুনে অট্টহাসিতে মেতে ওঠলো সুফিয়া। হাসতে হাসতে সে বললো, ‘এটা তো সবাই জানে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নজরুল সাহেবের লেখাগুলো সবাই পছন্দ করে, তাই জনপ্রিয় একটি পত্রিকা এটি।’

রিহান চুপ হয়ে গেল সুফিয়ার ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেখে। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও বলে উঠলো, কিন্তু দু’বছর পর পত্রিকাটা আর থাকবে না। একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এটা তো কেউ জানে না আমি ছাড়া।

সুফিয়ার হাসিটাও থেমে গেছিল। কিন্তু রিহানের এবারের কথাটা আরও বেশি রসাত্মক মনে হলো তার। পুনরায় হাসতে হাসতে বললো, ‘আপনি কি জ্যোতিষী না-কি? দুবছর পর কী হবে তা আগে থেকেই জানেন? বলুন তো আমার বিয়েটা কবে হবে?’

জাফর মাস্টার এবার পত্রিকা থেকে মুখ তুলে মেয়েকে নরম সুরে ধমক দিলেন, ‘আহ সুফিয়া কী হচ্ছে এসব? কারও সাথে এভাবে ব্যঙ্গ করতে নেই মা।’ তারপর মেয়ের কানে কানে বললেন, ‘ছেলেটার অসুস্থতা নিয়ে মজা করো না।’

মাথা নেড়ে শান্ত হয়ে গেল সুফিয়া। নবযুগ পত্রিকাটা বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বললো, ‘ধরো বাবা, নজরুল সাহেবের লেখা খুঁজছিলাম। কিন্তু আজ উনার কোনো লেখা আসেনি।’

‘আপনি নজরুলের লেখা পছন্দ করেন?’ সুফিয়াকে প্রশ্ন করে রিহান।

‘হ্যাঁ, খুব পছন্দ করি। তাঁর লেখা পড়লে মনে আশা জাগে। স্বপ্ন দেখি একদিন এই দেশ ব্রিটিশমুক্ত হবে।’

‘স্বপ্ন দেখাটা ভালো। আপনার স্বপ্নটা অবশ্যই পূরণ হবে। তবে আরও পাঁচ বছর আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।

‘মি. রিহান, আপনার এবারের কথায় আমি হাসছি না। কারণ, দেশ ব্রিটিশমুক্ত হবে শুনতে ভালো লাগছে। ব্রিটিশরা আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুফিয়া। ‘আহ্, নজরুল সাহেব যদিও আরও বেশি করে লিখতেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে! উনার একটা লেখা বেশি ভালো লেগেছিল, শিরোনাম ছিল এরকম, ”গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ।” যুগযুগ ধরে লিখে যাক উনি এভাবে।’ সুফিয়ার আশাদীপ্ত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠলো। আবার দৃষ্টি ফেললো সে বাইরে। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সুফিয়ার দুচোখে যে আশা দেখেছে রিহান, তা নিভিয়ে দিতে চাইলো না। সুফিয়া যদি জানে নজরুলের লেখার হাত থেমে যাবে একেবারে, আর কয়েকমাস পরই নজরুল বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবে, দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হবে, তাহলে খুব কষ্ট পাবে মেয়েটা। আশা নিয়েই বেঁচে থাকুক সে অন্তত এই কয়মাস…

[[চলবে…]]

(খুব বেশি আশাহত হলাম গল্পটি শুরু করে। আজ যদি বাসর রাতের কাহিনি দিয়ে গল্প শুরু করতাম, হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় করতো আমার গল্পে। সবার মন্তব্য আশা করছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here