টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব ৩

0
294

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৩
লেখা: ShoheL Rana শামী

রাতে খাবার হিসেবে ছিল শুকনো চিঁড়া আর গুড়। দুজনের খাবার নিয়েছিল ওরা। কেবিনের সদস্য হিসেবে রিহান বেড়ে যাওয়ায় তিনজনে ভাগাভাগি করে কোনোমতে ক্ষুধা মেটালো। খেতে খেতে রিহান ভাবছিল, যদি সাথে করে সে কিছু তার যুগের খাবার নিতো, তাহলে খাওয়াতে পারতো ওদের। তখন এরাই হয়তো প্রথম মানুষ হতো, যারা কয়েক যুগ পরের খাবার ১৯৪২ সালে বসে খাচ্ছে! খাবার পর একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো সুফিয়া রিহানের দিকে। পানি পান করে বোতলটা সে ফিরিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে কয়েকটা নাম্বারে ফোন দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। ফোনে নেটওয়ার্কই আসে না।

‘কী যন্ত্র এটা?’ বোতলটা একপাশে রেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সুফিয়া। ‘এমন যন্ত্র তো আগে কখনও দেখিনি।’

জাফর মাস্টারও অবাক হয়ে তাকান ফোনটার দিকে। তিনি রিহানের হাত থেকে ফোনটা চেয়ে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন। তিনিও প্রশ্ন করেন, ‘কী জিনিস এইটা?’

‘আংকেল, এটাকে বলে মোবাইল ফোন। এটা দিয়ে ফোন করা হয়। দূরদূরান্তে ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ করা যায়। গান শোনা যায়। আরও অনেক কিছু করা যায়।’

‘ওহ্!’ বলে ফোনটা ফিরিয়ে দিলেন তিনি রিহানের দিকে। তার আচরণে বোঝা গেল, ফোনটা দেখে যতটা অবাক হয়েছেন, ফোনের কাজ দেখে ততটা অবাক হননি। বিশ্বাসই করেননি হয়তো। হয়তো পাগলের প্রলাপ ভেবেছেন। কিন্তু সুফিয়া বিষয়টা সহজে ছাড়লো না। সে বললো, ‘আপনি বলতে চাইছেন টেলিফোনের মতো এটাও কাজ করে? দেখি, আমাকে আমার বান্ধবী চাম্পার সাথে কথা বলিয়ে দেন তো? পারবেন? পারবেন না। সেই থেকে আপনি উলটাপালটা বকতেই আছেন, বকতেই আছেন।’

‘উলটাপালটা বকছি না। সত্যিই এটা দিয়ে কথা বলা যায়। বলছি না আমি ভবিষ্যত থেকে এসেছি? ভবিষ্যতে এটা দিয়ে কথা বলার জন্য নেটওয়ার্ক আছে, কিন্তু এ সময়ে এটার কোনো নেটওয়ার্ক নেই। আপনাকে কীভাবে যে বুঝায়। আমার ফোনে গান বা মুভি ডাউনলোড করা থাকলে এখনই দেখাতে পারতাম। আফসোস! তাও নেই।’

‘হয়ছে মিস্টার। একটা যন্ত্র দেখাচ্ছেন বলে কি বিশ্বাস করে নেবো আপনার কথা? বুঝছি, আপনি যন্ত্রটা বানাতে গিয়ে একটু বেশি গবেষণা করে ফেলেছেন, তাই মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ সরাসরি বলে ফেললো সুফিয়া কথাটা। মুখে যা আসে তা বলে ফেলা তার স্বভাব, ইতোমধ্যে বুঝে গেছে রিহান। অবশ্য এটা একটা ভালো গুণ। এদের অন্তরে যা, বাইরেও তা। এদের মনে কোনো প্যাঁচ থাকে না। রিহান আর বুঝানোর চেষ্টা করলো না যে, সে ভবিষ্যত থেকে এসেছে।

জাহাজটা এগিয়ে চলেছে নিজ গতিতে শব্দ করে। রাত আরও বেড়ে চলেছে। যাত্রীদের আওয়াজ থেমে গেছে। ইতোমধ্যে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিরাও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। সময়টা জেগে কাটানোর চেয়ে ঘুমিয়ে কাটানোটা ভালো। রিহান না থাকলে হয়তো জাফর মাস্টারও ঘুমিয়ে পড়তেন। যতই সে ভালো ছেলে মনে করে তাকে কেবিনে নিয়ে আসুক, তবুও মেয়ের সাথে একটা বাইরের ছেলেকে নিয়ে এসে তিনি এভাবে ঘুমোতে পারেন না। ঘন ঘন হাই তুললেও তিনি চোখ বন্ধ করলেন না। মেয়েকে ঘুমাতে বললেন তিনি। সুফিয়া হ্যাঁ/না কিছুই না বলে মাথাটা কাত করলো জানালার সাথে। আনমনে চেয়ে আছে সে জলের দিকে। ভারি বাতাসে তার চুলগুলো উড়তে লাগলো। রিহানের মনে এবার আসল ভীতিটা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। কোথায় যাচ্ছে সে? ওখানে গিয়ে কী হবে? তাদের বাড়িটা কি থাকবে? নিশ্চিয়ই থাকবে না। তবে তাদের ভিটে-মাটিতে অন্য কোনো ঘর থাকতে পারে, বা খালি জমিও পড়ে থাকতে পারে। যদি কোনো ঘর থাকে, কারা থাকবে ওখানে? তার বাবার জন্ম ১৯৬০ সালে। তার দাদা নিশ্চয়ই থাকতে পারে। দাদা হয়তো এখনও বাচ্চা শিশু। কী হবে ঐ বাড়িতে গিয়ে যদি সে বলে, এই বাচ্চা শিশুটা তার দাদা। পাগল ভেবে হয়তো মারধর করবে। এ কোন পরিস্থিতিতে আটকে গেল সে? হঠাৎ মনে হলো, যা ঘটছে সবকিছু যদি মিথ্যে হয়ে যেত? যদি সবকিছু স্বপ্ন হতো। এখনও তার পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না এসব। সুফিয়ার দিকে চোখ যেতেই দেখলো মেয়েটা ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানালায় হেলান দিয়ে। জাফর মাস্টারও ঝিমোচ্ছেন। এই সুযোগে আরেকবার চিমটি কেটে দেখা যাক। এবার জোরে চিমটি কাটলো সে। ‘আহ!’ ব্যথায় ককিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলালো সে। মাথার চুল টানতে লাগলো। গালে চড় মারতে লাগলো, তবুও স্বপ্নটাকে শেষ করতে পারছে না। শেষ হবে কেমনে, যা ঘটছে সবই তো বাস্তব। তবুও মনকে আশ্বস্ত করতে ব্যথা পেলেও চিমটি কেটে চললো সে। সুফিয়ার দিকে আবারও তাকালো। মেয়েটা কাঁপছে। হয়তো শীত করছে তার। এগিয়ে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করতে হাত বাড়ালে হাতটা ধরে ফেলে সুফিয়া।

‘কী মিস্টার, কী অসভ্যতামি করছেন? গায়ে হাত দিতে চাচ্ছেন না-কি?’ মাথা তুলে রাগ ঝাড়লো সুফিয়া। জাফর মাস্টারের ঘুমটাও কেটে গেল। রিহান নরমস্বরে বললো, ‘আমি তো জানালা বন্ধ করতে চাইছিলাম, আপনার শীত লাগছে দেখে।’

‘থাক, আপনার বন্ধ করতে হবে না।’

‘তুই শুধু শুধু ছেলেটাকে এমন করছিস। শুন মা, মানুষ বিপদে পড়লে খারাপ চিন্তা মাথায় আসে না। ছেলেটাও বিপদে পড়েছে।’

‘হয়ছে বাবা, তোমাকে আর লোকটার পক্ষ নিতে হবে না।’ বলে আবারও জানালায় মাথাটা ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সুফিয়া। রিহান মনে মনে ভাবলো, এ কেমন মেয়ে রে বাবা, ভালো করতে গেলেও খারাপ ভাবে। নিজের মতো করে থাকাটাই ভালো। মুখটা কালো করে বসে রইলো সে। কয়েক মুহূর্ত পর চোখদুটো একটু করে খুলে সুফিয়া রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আপনি আসলেই পাগল। যা করছিলেন করুন। চিমটি কাটতে থাকুন নিজেকে।’

রিহান কিছুটা লজ্জা পেল। এই মেয়েটা সব দেখে ফেলেছে। চোখ বন্ধ দেখে সে ভেবেছিল সুফিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। নাহ্, শয়তান আছে কিছুটা। যদি এই পরিস্থিতি থেকে কখনও বের হতে না পারে সে, তবে এদের সাথেই থাকতে হবে তার। আর কোনো উপায় নেই। একই সাথে এই মেয়েটাকে সামলানোর কিছু কৌশল রপ্ত করে নিতে হবে।

শেষ রাতে চোখে ঘুম নেমে এসেছিল রিহানের। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে জানে না। জাফর মাস্টারের ডাকে যখন তার ঘুম ভাঙলো, তখন চারপাশে আলো ফুটে ওঠেছে। নিজেদের ব্যাগ-সামগ্রী গুছিয়ে ওরা নেমে পড়লো জাহাজ থেকে। খানিকদূর হেঁটে ওরা একটা ট্যাক্সি ডাকলো। ওখান থেকে ট্যাক্সিতে করে ওরা রওনা দিলো গফরগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে। রিহান ট্যাক্সি থেকে আশেপাশের পরিবেশে চোখ বুলাতে লাগলো। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দালান সবকিছু বদলে গেছে। তার চেনা পরিবেশের সাথে কিচ্ছু মিল নেই। শহরে এত ফাঁকা জায়গা কখনও তার চোখে পড়েনি। উঁচু উঁচু বিল্ডিংও নেই। তবে রাস্তাটা একই পথেই গেছে। রাস্তার দুপাশে সারি-সারি গাছ। দূরে ধানক্ষেত। খানিক পরপর একেকটা গ্রাম, মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করতে লাগলো রিহান। পুরো রাস্তায় সে কোনো কথা-ই বলেনি। শুধু পরিবেশটা দেখেছে, আর ভেবেছে-কী সুন্দর পরিবেশটা হারিয়ে গেল তার সময়ে এসে।

পরিবেশটাতে একপ্রকার ডুবে গিয়েছিল রিহান। কোন সময় যে ট্যাক্সিটা গফরগাঁওয়ে পৌঁছে গেল বুঝতেই পারেনি সে। এত দূরের পথ মুহূর্তেই যেন শেষ হয়ে গেছে। সুফিয়া না ডাকলে হয়তো ধ্যানটা তার ভাঙতো না।

‘এই যে, কোথায় নামবেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।

‘গফরগাঁও।’

‘এটাই তো গফরগাঁও।’

‘আর একটু সামনে, ঐ যে সামনের এলাকাটায়।’

‘ওখানে কাদের বাড়ির ছেলে তুমি।’ জিজ্ঞেস করলেন জাফর মাস্টার। পুনরায় বললেন, ‘বয়সে ছোটো তুমি, তাই ‘তুমি’ করেই বলছি, কিছু মনে করো না।’

‘না না আংকেল, সমস্যা নেই। তুুমি করেই বলুন আমাকে।’ প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রিহান।

গাড়ি থামলো রিহানের গন্তব্যে এসে। রিহান গাড়ি থেকে নামবে না-কি নামবে না দ্বিধায় পড়ে গেল। সুফিয়া তাগাদা দিলো, ‘কী হলো নামুন, আপনার এলাকা তো এসেই গেল।’

নেমে গেল রিহান ট্যাক্সি থেকে। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলাতে ঝুলাতে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘আংকেল, আপনাদের বাসাটা কোথায়?’

‘কেন? আমাদের বাসা কোথায় জেনে কী করবেন আপনি? মুখের উপর বলে দিলো সুফিয়া। এই মেয়েটা দেখি তাকে একটুও সহ্য করতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা খুব ভালো, আবার মনে হয় এর চেয়ে ত্যাড়া মেয়ে আর নেই। এই দীর্ঘ জার্নিতে রিহান বুঝতে চেয়েছে মেয়েটাকে। কিন্তু বড্ডো রহস্যময়ী মেয়েটা। সুফিয়া ওভাবে কথাটি বললেও তার বাবা নরম স্বরেই ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন, ‘চর আলগীতে গিয়ে জাফর মাস্টারের বাড়ি কোনটা জিজ্ঞেস করলেই লোকে দেখিয়ে দেবে।’

‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ আংকেল।’ ট্যাক্সিটা চলে যাচ্ছিল রিহানকে পাশ কাটিয়ে। ভেতর থেকে সুফিয়ার ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো, ‘তুমি লোকটাকে বাসার ঠিকানা কেন দিলে বাবা?’

আনমনে হেসে ওঠলো রিহান। অল্প সময়েই মেয়েটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। কেমন যেন কঠিন, আবার নরম মেয়েটার মন। ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই হেঁটে চললো সে একটা বাড়ির দিকে। কিন্তু জানে না সে এটাই তার পূর্বপুরুষের বাড়ি কি না। টিনের ছাউনিতে যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটা তার যুগে নেই। এর জায়গায় একটা পাঁচতলা বিল্ডিং হয়েছে। ভিটের চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে দেয়ালও নেই এখানে। উঁচু উঁচু বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। এগুলো কখনও চোখে পড়েনি রিহানের। হয়তো কেটে ফেলা হয়েছে। তারপর ওখানে আরও একটা বিল্ডিং করেছে, যেখানে রিহানের বাবার এক চাচাতো ভাই স্বপরিবারে থাকেন। রিহান চারপাশের পরিবেশটাতে চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগলো, এই নারকেল গাছগুলো একসময় থাকবে না, এখানে বাবার এক চাচাতো ভাই বিল্ডিং তুলবে। ও পাশের খালি জমিটাতে তার এক ফুপু ঘর তুলবে। তার বাবা এখানে থাকবে না। এখানে যে বাড়িটা এখন আছে, ওটাতে পাঁচতলা বিল্ডিং তুলে থাকবে ছোটো চাচা, ছোটো চাচার সাথে দাদিও থাকবে। তার বাবা ঢাকায় জমি কিনে ওখানেই ঘর তুলবে পরে। ঢাকা থেকে রিহান সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসতো, দাদা বাড়িতে। কিন্তু এবারের আগমনটা তার সম্পূর্ণ ভিন্ন। দাদা মারা গেছে বলে দাদাকে কখনও চোখে দেখেনি রিহান। এবার হয়তো দাদাকেও চোখের দেখা হয়ে যাবে তার। পিচ্চি একটা দাদা তার! এমন পরিস্থিতিতেও কথাটি ভেবে হাসলো রিহান। একটা বয়স্ক লোক এসে দাঁড়ালো তার কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনি? কাকে চান?’

‘আপনি কে?’ পালটা প্রশ্ন করলো রিহান।

‘এটা আমারই বাড়ি।’

‘ইউসুফের কী হন আপনি?’

‘ইউসুফ তো আমার পাঁচ বছর বয়সী নাতির নাম। আমি ওর দাদা।’

‘আর ইউসুফ হলো আমার দাদা।’ কথাটি বলতে গিয়েও থেমে গেল রিহান।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here