এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ৩১+৩২

0
376

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩১

আরাবের মুখে চার অক্ষরের “ভালোবাসি” শব্দ শুনে নিস্প্রভ হয়ে কিয়ৎক্ষন বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো দোয়া। এটা বাস্তব নাকি ভ্রম তা বুঝতে সময় লেগেছে ওর। কিছুতো আলাদা ছিলো ওই শব্দে। কিছু আলাদা তো ছিলো,এই মানুষটার বলা ওই শব্দে! আশপাশ যেনো থেমে আছে। দুরের ব্যস্ত রাস্তার গাড়ির উচ্চশব্দের হর্ন তো দুর,পাখির কলকাকলির মধুর গুন্জনও কানে পৌছালো না ওর। ভালোবাসি কথাটাই ওর চতুর্পাশ থেকে বেজে চলেছে শুধু। আরাবের মুচকি হাসিটা আরেকটু প্রসারিত হতেই কান গরম হয়ে উঠলো দোয়ার। হৃদপিন্ডটা ধুপধাপ লাফাতে শুরু করে দিয়েছে যেনো। লজ্জায় চোখজোড়া বন্ধ করে মাথা নামিয়ে নিলো ও। আরেকপা এগিয়ে সবে আরাব কিছু বলতে যাবে,পাশে থাকা ছেলেগুলো সুর তুলে “ওওও” শব্দ করে উঠলো। চঞ্চল হরিণীর মতো তৎক্ষনাৎ মাথা তুলে দোয়া একপলক ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। তারপর আবারো আরাবের দিকে তাকালো। সেই মারাত্মক চাওনি! ঠোটে সেই তৃপ্ত হাসি! যা থেকে এতোগুলো দিন লুকিয়ে বেচে এসেছে ও। কিন্তু আজ যে সে ওষ্ঠযুগল ভালোবাসি বলেছে! আজ যে তার সামনে দাড়ানো,আরো শিহরনের! আরো লজ্জার!

চোখ বন্ধ করে এক ভুবনভুলানো লাজুক হাসি দিয়ে দোয়া ছুট লাগালো। আরাব পুরোই বোকাবনে গেছে। দোয়ার লাজুকতামিশ্রিত হাসি ওকে বলে দিয়েছে,দোয়াও ওকে ভালোবাসে। তবে পালালো কেনো? এগোতে গিয়ে হাতের গিটারটার কথা মনে পরলো ওর। সাথে এটাও মনে পরলো,ওর ভালোবাসি বলার পরপরই এই ছেলেগুলো সুর তুলে যে শব্দ তুলেছে,তাতেই আরো লজ্জা পেয়ে গেছে দোয়া। গিটারটা এগিয়ে এক ছেলের হাতে দিয়ে বললো,

-আজ তোমাদের জন্য বাকিটা অপুর্ন রয়ে গেলো!

-আমরা কি করলাম ভাইয়া?

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি আরাব। দৌড়েছে দোয়ার পিছুপিছু। দোয়া ছুটছে। এ গোধুলীতে আরাবের কথায় আকাশছোয়া খুশি যেনো আজ ওকে ছুয়ে দিয়েছে। নাহ্! আজ কোনোমতেই আরাবের সামনে থাকতে পারবে না ও। খোলা চুলগুলো উড়ছে ওর। ঠোট কামড়ে হেসে দৌড়াতে দৌড়াতেই খোপা করলো দু দুবার। থাকেনি। খুলে গেছে আবারো। পেছন থেকে অস্থিরস্বরে আওয়াজ আসছে,

-দোয়া? দাড়াও? আজকে তো তোমার বলার কথা! ওদের মুখে আমি সেলোটেপ মেরে দেবো! একটাবার দাড়াও দোয়া! ওয়েট!

আরাবের পাগলামি কথায় আরো লালাভ হয়ে উঠলো দোয়ার চেহারা। থামেনি ও। বড়রাস্তায় এসে হাপাতে হাপাতে এদিক ওদিক তাকালো বাস,লেগুনার জন্য। সবগুলোতে ভরপুর। এ সময়ে আরো ভীড় বেশি হয় সবখানে। একটা শুকনো ঢোক গিলে পেছন ফিরলো ও। তখনই পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

-তোমার চেহারার লাজুকতা বড় মোহনীয় দোয়া। ও চোখেমুখে ভালোবাসা থেকে পালিয়ে বেরানোর উচ্ছ্বলতাও আকর্ষনীয় লাগে।

দোয়া আরো নুইয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে ঘাড় কিছুটা পাশে ঘুরিয়ে লজ্জানত কন্ঠে বললো,

-আর কিছু?

-প্রেমিকের কাছে তার প্রেয়সীর বর্ননা শুনতে চাও? সৌভাগ্য হবে তোমার সেটুকো সময় পাওয়ার?

দোয়া ওভাবেই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রইলো। আজ চলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আজ পালানোর ইচ্ছে নেই। যা আছে,শুধুই লাজুকতা। শুধুই শিহরন। উত্তর বুঝতে সময় লাগেনি আরাবের। আজ এক অন্য দোয়াকেই আবিষ্কার করেছে ও। আজ সে জীবনযুদ্ধে লড়াকু,কঠোর ব্যক্তিত্বের নয়। সে যে ভালোবাসি শোনার পর আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মতো হৃদস্পন্দনকে অনুভব করছে। নিজেরও,সে প্রেমিকপুরুষেরও। আরাব বলে উঠলো,

-এখানেই বলবো?

দোয়ার পারিপার্শিক মনে পরে গেছে। চোখ মেলে আরাবের দিকে তাকালো ও। আকুতির স্বরে কথাটা বলে হাসিমুখে দাড়িয়ে আরাব। ওকে চোখ‌ মেলতে দেখে আরাব আরেকপা‌ এগিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-তোমার সুপ্ত অভিযোগ,অব্যক্ত আবেগ আর অপ্রকাশিত ইচ্ছেগুলো আপন করার সুযোগ দেবে আমাকে দোয়া? অতি সযত্মে লজ্জারাঙা তোমার এই রক্তিম চেহারার মতো সবটা শুধু নিজের মাঝে শুষে রাখবো। কেউ কিচ্ছুটি জানবে না বিশ্বাস করো! কিচ্ছুটি দেখবে না! আদরে ভরিয়ে দেবো ওই লাজুক চাওনি। ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেবো ওই বেরঙ মনমাঝার। আমি নিচ্ছি সে দায়িত্ব। দেবে না আমাকে? বলো? দেবে না?

আর সহ্য হয়নি দোয়ার। দৌড়ে এবার রিকশাতেই উঠে বসলো ও। ভাড়ার বিষয়টা একবারও মাথায় আসেনি। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাব। দোয়ার প্রস্থান ওকে অবাক করেনি। দোয়ার লজ্জারাঙা মুখটা ওকে থামিয়ে দিয়ে গেছে। ভাষাহীন ভাবে আশেপাশে তাকালো ও। চলমান গাড়ি,লোকজন সব যেনো স্লো মোশনে চলছে। ধুকতে ধুকতে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামলো ও। একটা গাড়ি পার্ক করতে এসে ওর একদম সামনে এসে দাড়ালো। ধ্যান ভাঙলেও হুশে ফেরেনি আরাব। সরে দাড়িয়ে আরেকবার দোয়া যেদিকে গেছে,সেদিকের রিকশার সারিগুলোর দিকে তাকালো ও। ওগুলোর একটা থেকে সাদা রঙের ওড়না উড়ছে। ওটা দোয়ার ওড়না। আরাব যেনো স্পষ্ট দেখতে পারলো,দোয়া রিকশাতে বারবার মুখ ঢেকে নিচ্ছে আর মুচকি হাসছে। মাঝরাস্তায় দুহাত মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো,

-আই লাভ ইউ দোয়া! আই লাভ ইউ!!!

শব্দটা এতোটাই জোরে ছিলো,দোয়ার কান অবদি পৌছেছে তা। খুব একটা দুরেও যাইনি ও। কথাটা শুনে চতুর্থবারের মতো মুখ দুহাতে ঢেকে‌নিলো ও। এই রিকশায় উঠে এটুকো সময়েই তিন তিনবার চেহারা ঢেকেছে হাতে। ওর চেহারা দেখলে যে যে কেউ বুঝে ফেলবে,আজকে কেমন ভয়ংকর অনুভুতির সম্মুখীন হয়েছে ও। রায়নগর পৌছে রিকশাভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে মুখার্জীবাড়ির ভেতর ঢুকলো ও। সিড়ি বেয়ে উঠে দোতালার কেচিগেইটে ব্যাগটা বাধিয়ে সোজা ছাদের দিকে উঠতে লাগলো। চিলেকোঠায় আসার পর এই প্রথমবারের মতো ছাদের দিকে এগিয়েছে ও। দরজা ঠেলে ছাদে উঠে চারপাশ না দেখেই এককোনে হাটু মুড়িয়ে বসে গেলো। আরাবের ভালোবাসি বলার প্রতিটা মুহুর্ত বারবার চোখের সা‌মনে ভেসে উঠছে ওর। ওর বলা প্রতিটা কথা মনে পরে আরো ব্যাকুল হয়ে উঠছে ওর মন। মুখ গুজে নিলো হাটুতে। সুর্যাস্তের পূর্বমুহুর্তের শীতল বাতাস গা ছুইয়ে শীতের জানান দিতে চাইলো। তাতে অনুভবহীন রইলো দোয়া। কিন্তু সে শ্রান্ত হাওয়ায় ভেসে আসা কথাগুলোতে আরেকদফা লজ্জায় পরে গেলো ও। শনশনে বাতাস যেনো ওর কানেকানে বলে গেলো,

-তাকওয়াতুল দোয়ার এতো লাজুকতা? এতো শিহরন? তবে যে তুই প্রেমে পরেছিস দোয়া! প্রেমে পরেছিস! তাহসানুল আরাব নামের প্রেমসমুদ্র যে তোকে অতলে ভাসাতে চলেছে দোয়া! তার ভালোবাসার একেবারে গহীনে ডুবতে চলেছিস তুই! একদম গহীনে!

তাজীন চুপচাপ নিরবের দিকে তাকিয়ে আছে। নিরব একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। শুনশান জায়গাটায় নিরব ওকে টেনে এনেছে অনেকক্ষন হলো। বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তবুও একবর্নও বলেনি নিরব। তাজীনও শুধু ওকে দেখে চলেছে। কিছুই বলেনি। অনেকটা সময় কেটে যায় মৌনতায়। নিরব ওভাবেই মাথা নিচু রেখে বললো,

-এভাবে আর কতোদিন তাজ?

হঠাৎই তাজ সম্বোধন শুনে ভেতরটা ধক করে উঠলো তাজীনের। কেমন কেমন লাগছে ওর। অনুভবটা খুশির নাকি বেশি খুশির,নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। কাপাকাপা কন্ঠে বললো,

-ম্ মানে?

নিরব পাশ ফিরে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। এবার তাজীনের ভয় হচ্ছে। আবারো বললো,

-ক্ কিছু বলছিলেন আপনি। এভ্…

কথা শেষ করার আগেই আরো খানিকটা এগিয়ে একহাতে ওর কোমড় জরিয়ে ধরে ওকে কাছে টেনে নিলো নিরব। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ তাজীন। নিরব একহাতে ওর গাল স্পর্শ করলো। চোখ বন্ধ করে নিলো তাজীন। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিরব বললো,

-অতীতকে আর কতো মনে রেখে বর্তমানটাকে নষ্ট করবে তাজ? এভাবে চললে কিভাবে ভবিষ্যৎ সাজাবো আমরা?

তাজীনের চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো। ও সত্যিই চায়না সুমনকে মনে রাখতে। সত্যিই চায়না সুমনের মতো ধোকাবাজকে নিয়ে ভাবতে। তবুও বারবার মনে পরে যায়! বারবার ওই ফ্রড লোকটার চেহারা সামনে ভেসে ওঠে ওর। পারেনি নিরবকে ওর প্রাপ্যটা দিতে। পারেনি নিরবকে আপন করতে। ওরই বা কি দোষ? একজনকে নিয়ে আস্তেধীরে চারপাশ সাজাতে শুরু করেছিলো,তার পরিবর্তে হুট করেই অন্যজনকে নিয়ে কিভাবে সবটা সাজাবে ও? নিরব চোখ বন্ধ করেই ছিলো। বলে উঠলো,

-আমাকে একবার সুযোগ দেওয়া‌ যায়না তাজ? ভালোবাসা যায় না আমাকে? খুব ভালোবাসবো তোমাকে বিশ্বাস করো! খুব ভালোবাসবো!

তাজীনের চোখের জল হাতে লাগতেই হুশ ফিরলো নিরবের। চোখ মেলে তাজীনকে কান্নারত দেখে ছিটকে দুরে সরে গেলো ও। মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে দিশেহারার ময়ো করতে লাগলো আচমকাই। রাগ হচ্ছে। ওর নিজের উপর রাগ হচ্ছে! আবেগের বশে এসব বলা একদমই ঠিক হয়নি ওর। তাজীনের সবটা সামলাতে সময় লাগবে। সময় দেওয়া উচিত ওর। তবুও এভাবে কেনো বললো ও? কেনো? অস্থিরভাবে বললো,

-তাজীন…তাজীন প্লিজ কান্না করবেন না! প্লিজ কান্না থামান! দেখুন…দেখুন আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি! আ’ম…আ’ম সরি! আপনি প্লিজ কাদবেন না!

কান্না থেমে গেছে তাজীনের। নিরবের মুখে আবারো আপনি আর তাজীন নাম শুনে ভেতরটা মুচড়ে ধরলো ওর। দম বন্ধ লাগছিলো। আবারো কান্না জুড়ে দিয়ে বললো,

-আপনি…

চোখ বন্ধ করে সরে এসে পাশের গাছটায় কয়েকটা পান্চ মারলো নিরব। তাজীন ছুটে এসে ওর হাত থামিয়ে দিয়ে বললো,

-কি করছেন কি মিস্টার নিরব! এভাবে কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন? কতোখানি…

-আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি তাজীন।

নিরব ঠান্ডা গলায় বললো। একপলক ছলছল চোখে ওর দিকে তাকালো তাজীন। ওকে কাদানোর অনুশোচনা নিরবের চেহারায় স্পষ্ট। ওর নিজের কি হলো,ও নিজেও জানে না। আস্তেধীরে নিরবের ধরে রাখা হাতে নিজেকে মুড়িয়ে নিলো। নিরবের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ওর শার্ট খামচে ধরে বললো,

-আমাকে একটু গুছিয়ে নেবে নিরব? আমি না বড্ড অগোছালো হয়ে আছি। বড্ড এলোমেলো হয়ে আছি।

নিরব আটকে গেছে। তাজীন আরো জোরে মুঠো করে ধরলো ওর শার্ট। একেবারে মিশে যেতে লাগলো নিরবের বুকে। এবার ওকে শক্ত করে জরিয়ে নিরব বলে উঠলো,

-কথা‌ দিচ্ছি তাজ,তোমাকে সাজিয়ে,গুছিয়ে,আগলে রাখার দায়িত্ব আমার।

নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে নিলো তাজীন। ওকে জরিয়ে পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো নিরবও।

আরাবের রংধনুতে পৌছাতে পৌছাতে রাত গরিয়ে এলো। বাইক পার্ক করে গেইটের কাছে কাঠগোলাপ গাছটা দেখে দাড়ালো ও। মাথাটা লাজুক ভঙিমায় চুলকাতে চুলকাতে বিরবিরিয়ে বললো,

-এই মেয়ের আজ রিকশাভাড়া কম পরলো না কেনো? আমার ভালোবাসি বলার সাথেসাথেই দেখছি টাকা বেড়ে গেলো ওর। ইউ আর টু মাচ লাকি মিস্টার তাহসানুল আরাব।

নিজেনিজেই কথাগুলো বলে হেসে ফেললো আরাব। হুইস্টলিং করতে করতে বাসায় ঢুকলো ও। ড্রয়িংরুমে পেপার পড়ছিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। ওকে ঢুকতে দেখে গম্ভীরভাবে বললেন,

-বাসায় ফেরার প্রয়োজনবোধ করলে তবে?

থেমে গেলো আরাব। চোখ বন্ধ করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো একটা। তারপর জোরে শ্বাস ফেলে হাসিমুখে বাবার দিকে এগিয়ে আসলো ও। বললো,

-কেনো? টেনশন করছিলে আমাকে নিয়ে?

-এটা নতুন না যে তুমি বাসায় কিছু না বলে বেরিয়েছো।

-তাই টেনশন করার প্রয়োজনবোধ করোনি তাইতো?

তৌফিক ওয়াহিদ তাকিয়ে রইলেন শুধু ওর দিকে। আরাবের চেহারায় তাচ্ছিল্য স্পষ্ট। বললো,

-মন রাখার জন্য হলেও একবার বলতে পারতে বাবা,চারদিন বাসার বাইরে ছিলে,টেনশন হচ্ছিলো। কেমন আছো?

চোখ সরিয়ে নিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। বললেন,

-তোমার অফিসে রেগুলার হওয়ার কথা ছিলো আরাব!

শব্দ করে হেসে দিলো আরাব। পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-ফার্মাকেমিক্যালস্ ব্রাঞ্চের হিসাবের কিছু গরমিল আর খরচের ডিটেইলস্ দেওয়া আছে। কালেক্ট করাটা আমার কাজ ছিলো,চেইক করে ডিসিশন নেওয়া তোমার কাজ।

আরাব সরে আসলো বাবার সামনে থেকে। এই বিজনেস যে প্রতিনিয়ত ওদের বাবা ছেলের সম্পর্কে দুরুত্ব এটে দিচ্ছে,তার অনুধাবন হলো আবারো ওর। হাত মুঠো করে দাড়িয়ে রইলো। পেনড্রাইভটা নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন তৌফিক ওয়াহিদ। উনি যেতেই মিসেস ওয়াহিদ দৌড়ে নিচে নেমে আসলেন। ছেলেকে জরিয়ে ধরে পাগলের মতো কাদতে কাদতে বললেন,

-এমন কেনো করিস তুই বাবা? কেনো কষ্ট দিস মাকে এভাবে? একটুও দয়া হয়না তোর মায়ের উপর? একটুও কষ্ট হয়না? এতোগুলো দিন কোথায় ছিলি কাউকে কিছু বলে যাসনি। কল রিসিভ করিস নি। আমাদের চিন্তা হয়না বাবা? কেনো এতো পাগলামি করিস তুই?

মাকে চুপচাপ জরিয়ে রাখলো আরাব। মিসেস ওয়াহিদ কাদতে কাদতেই বললেন,

-আমি যা বলেছি,ভুল বলেছি। দোয়াকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুই দোয়াকে রংধনুতে নিয়ে আয়! মুফতাহির আর তোর বাবাকে আমি বুঝাবো! তুই তাও এমন করিস না বাবা! মাকে আর শাস্তি দিস না এভাবে! ক্ষমা করে দে আমাকে? ক্ষমা করে দে?

আরাব মিসেস ওয়াহিদকে টেনে এনে সোফায় বসালো। নিজে মেঝেতর বসে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দুগাল ধরে বললো,

-শান্ত হও মা।

আরো জোরে কেদে দিলেন মিসেস ওয়াহিদ। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো ওর। রিসিভ করে আরাব বললো,

-পৌছেছেন?

….

-ওনাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিন।

ফোন পকেটে পুরে আরাব মাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বললো,

-কেদো না মা। শান্ত হও।

মিসেস ওয়াহিদ কাদছেনই। এরমধ্যেই এক ভদ্রমহিলা ভেতরে ঢুকলেন। আরাব বললো,

-আসুন আন্টি। বসুন।

ভদ্রমহিলা এগিয়ে সোফায় বসে মিসেস ওয়াহিদের দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলেন। আরাব কেয়ারটেকারকে ডেকে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করালো তার জন্য। ততক্ষনে বিসগময়ে কান্না কমে এসেছে মিসেস ওয়াহিদের। খাবার এগিয়ে দিয়ে আরাব বললো,

-নিন আন্টি। প্রথমবার রংধনুতে আসলেন।

মহিলা তখনো কিছু না বুঝে আরাবের দিকে তাকিয়ে। মিসেস ওয়াহিদ বললেন,

-ইনি কে?

একটা ক্ষুৃ্দ্র শ্বাস ফেলে আরাব বললো,

-রনোক যেদিন দোয়াকে কিডন্যাপ করেছিলো,ইনি ওখানেই ছিলেন।

বিস্ফোরিত চোখে দুজনেই আরাবের দিকে তাকালো। মিসেস ওয়াহিদ ফুপিয়ে কেদে দিয়ে বললেন,

-আমি তো নিজের ভুল স্বীকার করছি আরাব! তবুও কেনো শাস্তি দিচ্ছিস আমাকে তুই?

মায়ের কথায় প্রতিক্রিয়া দেখালো না আরাব। নিজে হাতে খাবারের বাটি ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আপনাকে একটা সহজ প্রশ্ন করছি আন্টি। প্লিজ কোনোরকম হেয়ালি করবেন না!

মহিলা একটা শুকনো ঢোক গিললো। বাসা থেকে তাকে একপ্রকার তুলে আনা হয়েছে। ভয় তো রবেই। আরাবের এগিয়ে দেওয়া বাটিটা হাতে নিয়ে বললো,

-ব্ বলো‌ বাবা। বলো কি বলবে?

মিসেস ওয়াহিদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ওনাকে থামিয়ে দিয়ে আরাব একেবারে শান্ত গলায় বললো,

-সেদিন আপনার সামনে থেকে মেয়েটাকে যখন ছেলেগুলো তুলে নিয়ে গেলো,জায়গাটা রায়নগর কৃষ্ণচূড়ার তলা ছিলো না?

-হ্ হ্যাঁ,ও্ ওখানেই! ওখানেই!

-আনুমানিক কয়টা বাজে তখন?

-ওই ঘটনার দু তিনমিনিট পরই মাগরিবের আযান হয়েছিলো।

-তারমানে পাঁচটা পনেরোর দু তিনমিট আগে। পাঁচটা বারো তেরো?

মহিলা মাথা উপরনিচ করলেন। আরাব মায়ের পাশে এসে বসলো এবার। বললো,

-আপুর বাসায় তো গিয়েছিলে। চেনো কৃষ্ণচুড়াতলা। ওখান থেকে তোমরা যে রেস্ট্রুরেন্টে খেতে গিয়েছিলে,গাড়িতে গেলে কতো সময় লাগতে পারে মা?

মিসেস ওয়াহিদ অসহায়ভাবে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর মাথা নেড়ে মানা করলেন এসব কথা আর না বলতে। আরাব কিছুটা শক্তভাবে বললো,

-বলো মা!

চোখ বন্ধ করে মিসেস ওয়াহিদ বললেন,

-মিনিট বিশেক।

মোবাইলে ম্যাপ থেকে দুরুত্ব,সময় আরেকবার দেখে নিলো আরাব। সর্বোচ্চ গতিতে আঠারো মিনিট,জ্যামসহ চব্বিশ মিনিট। মাকে বিষয়টা দেখিয়ে একটা ভিডিও অন করলো ও। ভিডিওটা সেদিনের ওই রেস্ট্রুরেন্টের সিসিক্যাম। মিসেস ওয়াহিদকে একসময় ছুটে যেতে দেখা গেলো কোথাও। আরাব বললো,

-দোয়াকে দেখে দৌড়ে এগিছিলে। তাইনা মা?

মিসেস ওয়াহিদ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালেন। আরাব বললো,

-সময়টা দেখো?

উপরের কোনায় সময় স্পষ্ট,পাঁচটা চুয়াল্লিশ বাজে। মিসেস ওয়াহিদ ছেলের দিকে তাকালেন। আরাব বললো,

-দোয়াকে রনোক পাঁচটা বারো তেরোর দিকে তুলে নিয়ে যায়,গাড়ি থেকে রেস্ট্রুরেন্টের সামনে ফেলে যায় পাঁচটা চুয়াল্লিশে। মাঝখানে সময় ব্যবধান বাইশ মিনিট। যে সময়টা এটুকো আসতে শুধু রাস্তায় কেটেছে। তারমানে যা ঘটার,সেটা দোয়ার সাথে গাড়িতেই ঘটেছিলো মা। রনোক ওকে কোথাও তুলে নিয়ে যায়নি। আটকে রাখেনি।

মিসেস ওয়াহিদ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। আরাব শান্তভাবে বললো,

-এবার তুমিই বলো মা,এটুকো সময়ে গাড়িতে দোয়ার সাথে কি কি ঘটা সম্ভব? কেমন অবস্থায় দেখেছিলে তুমি দোয়াকে? রনোক ভয়ে আমাকে উকি কি ভুল বলেছে? আর দোয়াই বা ঠিক কতোখানি মিথ্যে বলেছে তোমাকে?

#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩২

-রনোক শুধু দোয়াকে ভয় দেখাবে বলে গাড়িতে তুলে নিয়েছিলো। আর অপবাদ দেবে বলে ওর জামার হাতায়…তেমন কিছুই ঘটেনি ওর সাথে মা,যা নিয়ে ওর দিকে আঙুল তুলেছিলে তোমরা। দোয়া…দোয়া তো পবিত্র! ফুলের মতোই পবিত্র! ও রেপড্ না মা! ও রেপড্ না!

দাতে দাত চেপে “রেপড্” শব্দটা আজ উচ্চারনই করে ফেললো আরাব। ওর মায়ের হাত চেপে ধরে ছিলো ও এতোক্ষন। মিসেস ওয়াহিদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে কাদতে লাগলেন আবারো। আরাব বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ায়,একপ্রকার ভয়েই দোয়াকে মানতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন উনি। তাছাড়া এজন্য তৌফিকাও অনেক রাগারাগি করেছিলো। কিন্তু এবার তো সবটা তারই ভুল দাড়ালো। অনুশোচনায় কাদতে কাদতে বললেন,

-আমাকে একবার দোয়ার কাছে নিয়ে যাবি আরাব?

আরাব মাকে কিছু বললো না। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনাকে অসময়ে এভাবে নিয়ে আসার জন্য দুঃখিত।

মহিলার ভয় কাটলেও বিস্ময় কাটেনি। কোথায় তৌফিক ওয়াহিদের ছেলে তাহসানুল আরাব,আর কোথায় ওই সাদামাটা মেয়েটা! ওই মেয়ের জন্য আরাব তাকে জেরা করছে,এটা তার কাছে অবিশ্বাস্যই। তাছাড়া এসব ওখানে উপস্থুত না থেকেও আরাব কিভাবে জানলো সেটাও ভাববার বিষয়। মহিলার চেহারার প্রশ্নের সারি দেখে আরাব বললো,

-সেদিন দোয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর যারা যারা হৈচৈ শুরু করেছিলো,সবাই ওই এলাকারই। তাদের কাছে যতোদুর শুনলাম,ও সময়ে রেগুলার যাতায়াতকারীর মধ্যে আপনিও একজন। মোটামুটি ছয় সাত জনকে ক্রসকোশ্শেন করার পর বুঝতে পারলাম,তারা কেউই ওই সময় ছিলো না। বাকি ছিলেন আপনি। আপনার সেভেন পড়ুয়া মেয়েটির কাছ থেকে জানতে পারি,ডায়াবেটিকসের জন্য প্রতিদিন ওই সময় ওদিকে হাটতে যান আপনি। আর দোয়ার সাথে ঘটনার ঠিক পরদিন থেকেই আপনার হাটার জায়গা বদলেছে। এই ঘটনাকে ইগ্নোর করতে পারিনি। মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম,কিছু তো জানেন আপনি,কিন্তু বলেন নি কাউকে। কিন্তু আমার যে জানার ছিলো! তাই আরেকটু ভয় দেখাতেই এভাবে নিয়ে আসা আপনাকে।

মহিলা চুপ। আরাব আবারো বললো,

-একটা মেয়ের সাথে কেউ জবরদস্তি করছে,সেটা দেখেও আপনি কি করে নান অফ মাই বিজনেস ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন আন্টি?

হীনমন্যতায় মাথা নামিয়ে নিলেন মহিলা। আরাব বললো,

-আজ যদি ওই মেয়েটার জায়গায় আপনার মেয়ে থাকতো,আপনারই মতো কোনো অজ্ঞাত মহিলা ওকে সাহায্যের পরিবর্তে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো,আর তারপর ওই কুৎসিত ছেলেগুলোর হাতে ওর বাজে কিছু হয়ে যেতো,কি করতেন আপনি তখন আন্টি?

-ওভাবে বলো না বাবা!

ব্যস্তভাবে বললেন ভদ্রমহিলা। আরাব বললো,

-পৃথিবীতে মানবসমাজ ব্যতিত অন্য কোনো প্রানীর সংগঠনকে সমাজব্যবস্থা বলা হয় না। কারন তাদের‌ দলগুলোতে উশৃঙ্খল সৃষ্টিকারী এমন কোনো সত্ত্বাই থাকে না,যার বিরুদ্ধে ওদেরকে স্টেপ নিতে হয়। আমরা মানুষেরা সমাজ নামক এই পরিবেশটা কেনো তৈরী করি জানেন? যাতে একদল ব্যক্তিবর্গের একত্রিত অভিমত দিয়ে শিষ্ঠের প্রতিষ্ঠা আর দুষ্টের দমন সম্ভপর করতে পারি। সেখানে আপনার আমার মতো ওই একদল ব্যক্তিবর্গই যদি চুপ থাকে,অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়,তবে তো সমাজের পতন নিশ্চিত! আর তা তো একসময় আমাদেরকেই নিপীড়ন করবে!

মহিলা মাথা নিচু করেই আছেন। আরাব মাকে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। শার্টটা টান মেরে বললো,

-আপনাকে অসম্মান করার উদ্দেশ্য ছিলো না আমার। একজন নির্দোষের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এই ব্যবহার করেছি আপনার সাথে। ক্ষমা করবেন।

মহিলা নিজেও উঠে দাড়ালো এবার। মুগ্ধচোখে আরাবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত বাবা। সত্যিই তো! এভাবেই যদি অন্ধ আর‌ মুক হয়ে থাকি,পরের অপমানের তীরটা যে আমার মেয়ের দিকে ছুড়বে না,তা কে জানে? তোমার ব্যবহারে আমি কিছুই মনে করিনি বাবা। শুধু একটাই দুঃখ,মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়ে ওঠেনি এখনো।

আরাব মুচকি হেসে বললো,

-তার প্রয়োজন হবে না আন্টি। ও তেমন মেয়ে না।

ভদ্রমহিলা মিসেস ওয়াহিদের দিকে তাকালেন। কেদেকেদে চেহারার অবস্থা খারাপ তার। বললেন,

-আপনি সৌভাগ্যবতী। এমন একটা ছেলে পেয়েছেন। এমন একটা বউমা পাবেন। কাদছেন কেনো? আপনার তো উল্লাস করা উচিত!

মিসেস ওয়াহিদ দু আঙুলে দু চোখ চেপে ধরে কাদতে লাগলেন। আরাব মহিলার দিকে তাকিয়ে বুঝালো ও সামলে নেবে। মহিলা হাসিমুখে বললো,

-আমি তবে আসি এখন?

-জ্বী আন্টি। আসুন। যে গাড়িতে এসেছেন,ওটা পৌছে দেবে আপনাকে।

-তোমার আর দোয়ার জন্য শুভকামনা রইলো।

আরাব হেসে থ্যাংকস্ বললো। চলে গেলো ভদ্রমহিলা। আরাব আবারো এসে মায়ের পাশে বসলো। মায়ের হাত মুঠো করে নিয়ে শান্তভাবে বললো,

-একটা মেয়ের কাছে তার সতীত্বর চেয়ে বড় আর কিছুই না মা। পবিত্র হওয়া সত্ত্বেও যদি তার দিকে আঙুল তোলা হতো,তার সতীত্বের প্রমান চেয়ে মেডিকেল টেস্টের কথা বলা হতো,তবে তো তাকে এটাক্ড হওয়ার সমপরিমানই অপমান করা হলো। তাইনা মা?

….

-আর দোয়া যদি এটাক্ড হতোও,তবুও তোমার ছেলেকে নিয়ে তোমার গর্ব করা উচিত ছিলো মা! সমাজের চোখে যে সম্মানহীনা,তাকেই ভালোবেসে,বিয়ে করে,স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে তোমার ছেলে। তুমি তো এক গর্বিত মা!

-দোয়াকে কবে আনছিস রংধনুতে?

আরাব হাসলো। বললো,

-খুব তাড়াতাড়ি।

মিসেস ওয়াহিদ ছেলের গালে হাত রেখে বললেন,

-আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সুদে আসলে আমি মিটিয়ে নেবো আরাব। দোয়া রংধনুতে আমার আরেকটা মেয়ে হয়ে আসবে। ওকে অনেকঅনেক ভালোবাসা দিয়ে আমার সব ভুলত্রুটি পুষিয়ে নেবো দেখিস!

মায়ের হাতের উপর হাত রেখে তৃপ্তিতে হাসলো আরাব। মাকে নিয়ে ঘরে পৌছে দিলো তারপর। ওর বাবা ল্যাপটপে ব্যস্ত। পেনড্রাইভটা যে তার কয়েকদিনের ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার কারন হবে তা বেশ ভালোমতোই জানতো আরাব। মাকে ছেড়ে বললো,

-অনেক রাত হয়েছে বাবা। ঘুমিয়ে পরো। কাল থেকে অফিস যাবো আমি। বাকিসবটা বুঝে নেবো।

বাকিসবটা বুঝে নেবো কথাটা শুনেই আরাবের বাবা মা দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। দম মেরে বসে ওর দিকে তাকিয়ে দুজন। আরাব স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে গিয়ে বাবার সামনে থাকা ফাইলগুলো সহ ল্যাপটপ নিয়ে পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে। ল্যাপটপটা বেডে রেখে ব্যালকনির দিকে এগোলো ও। রেলিং ধরে আগে জোরে শ্বাস ফেললো দুটো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে তৌফিকার নাম্বার ডায়াল করে কানে ধরলো।
ভাইয়ের কল দেখেই তৎক্ষনাৎ উঠে বসে কল রিসিভ করলো তৌফিকা। মুফতাহির আধশোয়া হয়ে বিছানায়া বই পড়ছিলো। একপলক ঘুমন্ত টুইঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে আবারো তৌফিকার দিকে তাকালো ও। তৌফিকা ব্যস্তভাবে বললো,

-কেমন আছিস তুই আরাব? কোথায় তুই? কল কেনো রিসিভ করছিস না কারো? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম,মায়ের কথাটা তো একবার ভাববি? মা…

-টুইঙ্কেল কোথায় আপু?

চারদিন পর এই আপুডাক শুনে নিরবে কেদে দিলো তৌফিকা। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ও। জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে গলা খানিকটা স্বাভাবিক করে বললো,

-সবেই ঘুমিয়েছে।

-এ কয়দিনে তোকে খুব মিস করেছি আপু।

তৌফিকা এবার শব্দ করেই কেদে দিলো। চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাব। বোনের কান্না যে একদমই সহ্য হয়না ওর। বললো,

-আপু প্লিজ কাদিস না। এতো রাতে ড্রাইভ করে রায়নগর গেলে মা রাগারাগি করবে।

তৌফিকা কাদতে কাদতেই বললো,

-আয় না! একটাবার আয় তুই! তোকে পিটিয়ে সোজা করে দেবো! এবার তো টুইঙ্কেলও ক্ষেপে আছে মামার উপর! দুজনে মিলে বালিশপেটা করে তোকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলবো এবার!

-আগে এটা তো ক্লিয়ার কর,মেরে আমাকে সোজা করবি নাকি চ্যাপ্টা?

কান্নার মাঝেও তৌফিকা হেসে দিলো। বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে বললো,

-আমাকে ক্ষমা করে দে আরাব।

-তোর কোনো ভুল ছিলোই না আপু।

-ছিলো আরাব…আমি…

-আজ দোয়াকে প্রোপোজ করেছি। কি কি ঘটলো শুনবি না?

প্রসঙ্গই ভুলে গেলো তৌফিকা। খুশি হয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে ব্যালকনির দিকে এগোলো ও। দুই ভাইবোনের মাঝে বেশ অনেকক্ষনই কথপকথন চললো। কথা শেষে ঘরে ঢুকতেই মুফতাহির বললো,

-আরাব এসেছে?

-হ্যাঁ।

-কোথায় ছিলো ও?

-তোমাকে বলে যায়নি মুফতাহির। আমাকে বলবে বলে তোমার ধারনা?

-আমি আর তুমি কি এক হলাম?

-কেনো না মুফতাহির? একই তো ছিলাম। হঠাৎ করে এর মাঝে প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেনো চলে আসলো বলতে পারো?

মুফতাহির জবাব দিলো না। বইয়ে মনোযোগ দিলো ও। কান্না আটকে জোরে শ্বাস ফেললো তৌফিকা। উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে পরলো ও।
তৌফিকার সাথে কথা বলা শেষে ব্যালকনি থেকে ঘরের ভেতরে চলে আসছিলো আরাব। পেছন ফিরেও থেমে গেলো ও। আবারো আকাশের দিকে তাকালো। শীতের কুয়াশাজরানো নিরব রাতের দৃশ্যপট বরাবরই মায়াবী। কিন্তু আজকের গোল চাঁদ থাকা আকাশটা উজ্জ্বল! উচ্ছ্বল! একেবারেই দোয়ার মতো! কথাটা ভেবে আর ঘরে যাওয়া হলো না ওর। শীতল হাওয়ার মাঝে দাড়িয়ে,তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকেই।

দমকা হাওয়ায় উড়ে উঠলো জানালার পর্দা। চমকে উঠলো দোয়া। দরজা,জানালা সবই‌ লাগানো। তবে পর্দা উড়ে উঠলো কেনো? মা-ভাই দুজনেই ঘুমিয়েছে। পড়া বাদ দিয়ে আজ হাতে সুতোর কাজ নিয়ে বসেছে ও। কি করবে? আজকের ঘটনাগুলো মাথা থেকে সরছেই না ওর। অনেক চেষ্টা করেছে পড়ার। হয়নি। তাই ভাবলো সুতোর কাজে মনোযোগ থাকবে। জানালার পর্দা নড়তে দেখে সুতার টিকিটা হাত থেকে নামিয়ে এগিয়ে গেলো ও‌ জানালার দিকে। পর্দা সরিয়ে দেখলো বড় কাঠের জানালার একপাল্লা লাগায়ই নি ও। নিজের যেকোনো অন্যমনস্কতার জন্য এরআগে রাগ হতো দোয়ার। আজ লজ্জা হচ্ছে। আস্তেকরে জানালাটা লাগিয়ে দিতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ গেলো ওর। চাঁদটা আজ বেশিই বড় বড় লাগছে যেনো। আনমনে বলে উঠলো,

-আজকে আরাব পুর্নিমা?

কথাটা বলেই চোখ বন্ধ করে জিভ কাটলো দোয়া। আবার শব্দটাকে আরাব বানিয়ে দিয়েছে। কান গরম হয়ে উঠলো ওর মুহুর্তেই। জানালা খট শব্দে তৎক্ষনাৎ লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পরলো ও। আজ সর্বকাজের সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে এই নাম! এই নামের মানুষটা!

তাজীন বিছানায় মাথার নিচে হাত দিয়ে খানিকটা উচু হয়ে শুয়ে আছে। নিরব হতভম্বের মতো মেঝেতে পরে। ঠান্ডা মেঝের অনুভুতি যেনো ওর ত্বকে অনুভুত হচ্ছে না। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল একটা কথাই! এটা কি হলো? ঘুমের মাঝে শুধু টের পেলো কেউ একজন ধাক্কা মেরেছে ওকে। বিছানা থেকে একেবারে নিচে পরে গেছে ও সে ধাক্কায়। চোখ মেলে তাজীনকে দেখে একবার ভাবলো হয়তো ঘুমের ঘোরে এমনটা করে ফেলেছে তাজীন। কিন্তু ও যেভাবে শুয়ে আছে,তাতে একদমই মনে হচ্ছে না কোনোরকম ঘুমের ঘোর আছে ওর। নিরবকে হতভম্ব দেখে তাজীন স্বাভাবিক গলায় বললো,

-যেই কালকে একটু জরিয়েটরিয়ে ধরেছি,তুমি মাঝের কোলবালিশটাই তুলে দিলে নিরব?

বড়বড় চোখ করে তাকালো নিরব। এমন কাজ ও কখনোই করেনি। কিন্তু তাজীনের মিথ্যে বলারও কারন চোখে পরছে না ওর। বললো,

-আ্ আমি এটা করিনি!

-তো কি আমি সরিয়েছি কোলবালিশ?

কথাটা বলেই মেঝেতে থাকা কোলবালিশটা দেখালো তাজীন। নিরবের হাত পা ছোড়াছুড়ির অভ্যাস আছে,সেটা নিরব নিজেও‌ জানে। তাই ও যতোদুর সম্ভব কাচুমাচু হয়েই ঘুমায় বিছানাতে। কিন্তু তাজীনের দেখানো প্রমানের বিপরীতে আর কোনো কথা বেরোলো না ওর। মাথা চুলকে বললো,

-আমি কখন করলাম এটা?

তাজীন উঠে বাবু হয়ে বসলো। বললো,

-ইউ লায়ার! বাবাকে ডাকবো?

হচকিয়ে গেলো নিরব। তাজীন এভাবেও কথা বলতে জানে,জানা ছিলো না ওর। তাজীন আবারো বললো,

-ফাইন! তুমি করোনি এটা! এখন এটা বলো,এ কয়দিন দেখলাম বিছানার এককোনে পরে ঘুমাও। যেই কাল একটু ভালোভালো কথা বলেছি,তুমি একেবারে আমার এদিকে এসে শুয়ে পরলে? কাছে আসার ধান্দা রাইট?

-আসতাগফিরুল্লাহ্! আমি এটাও করিনি!

চেচিয়ে বলে উঠে দাড়ালো নিরব। ঠোট টিপে হাসলো তাজীন। উঠে দাড়িয়ে নিরবের দিকে এগোলো ও। নিরবের টি শার্টের বুকের দিকেটায় ময়লা‌ ঝারার মতো করে ঝেরে দিয়ে বললো,

-কেনো করো নি?

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো নিরব। তাজীন ওর টিশার্টের কলারটা ঠিকঠকমতো টেনে দিলো। এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

-আমার ন্যাকামো পছন্দ না। সোজাভাবে বলছি,ঠিকমতো ঘুমাবে বিছানায়। বউ হই তোমার। ওই এককোনে পরে থাকতে দেখেছি তো রেগুলার ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে ফেলে দেবো। বাপের বাড়ি যাওয়ার থ্রেট এখনো দিলাম না। আগে বাচ্চা শশুড় আর শশুড়ের বাচ্চাটাকে ঠিক করে নেই,তারপর ওই থ্রেট দেবো। গুড ডে মিস্টার হাবি।

কথাগুলো বলে নিরবকে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো তাজীন। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো নিরব। হঠাৎই এক বিখ্যাত ডায়লগ মনে পরে গেলো ওর। অস্ফুটস্বরে বললো,

-এটা কি বউ? নাকি সমুদ্রের ঢেউ?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here