এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ২৯+৩০

0
340

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৯

খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় তাজীনের। চোখ মেলে আগে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো ও। মনে পরলো,এটা এর শশুড়বাড়ি। পাশে তাকিয়ে নিরবকে একেবারে বিছানার কিনারায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখলো। আলাদা কম্বল জরিয়ে মাথা বালিশ ছেড়ে একদমই কিনারায় শুয়ে আছে নিরব। যেনো পুরো বিছানা তাজীনকে ছেড়ে দিচ্ছে। ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে এগোলো তাজীন। আয়নায় তাকাতেই সুমনের চেহারা ভেসে উঠলো ওর সামনে। রাগে চোখেমুখে বারকয়েক পানির ছিটা দিয়ে বেসিন ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো ও। আশ্চর্যজনক ভাবে ওর বন্ধ চোখের সামনে নিরবের অবয়ব দেখতে পেলো যেনো। তৎক্ষনাৎ চোখ মেললো তাজীন। আয়নার নিজের ভেজা মুখশ্রী যেনো বলে উঠলো,একে বলে বিয়ে! এক অনন্য পবিত্র সম্পর্ক!

নিজেকে সামলে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরোতেই চোখ কপালে তাজীনের। কিছুক্ষন আগে বিছানার যে দশা দেখে গেছে,এখন তার উল্টোটাই। পুরো বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে নিরব শুয়ে আছে। কোলবালিশটা অবদি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। যেনো ওই বিছানায় কারো দখলদারিত্ব সহ্য হয় না নিরবের। কোলবালিশেরও না। একটা শুকনো ঢোক গিলে আস্তেধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাসায় মানুষজন বলতে শুধু নিরব আর ওর বাবা। শুনেছে নিরবের মা মারা গেছে ছোটবেলাতেই। বাকি আত্মীয়স্বজন যার যার মতো। গুটিগুটি পায়ে কিচেনের দিকে এগোলো তাজীন। নিরবের বাবা মিস্টার নাফিজ চৌধুরী অমলেট বানাতে বানাতে বললেন,

-উঠে গেছিস মা? কি খাবি বল!

স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো তাজীন। এ মানুষটার দিকে ঠিকমতো তাকায়ও নি ও এখনো অবদি! আর এ কিনা ওকে এতো আদুরে গলায় ডাকছে? তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললো,

-আ্ আপনি এসব কেনো করছেন আঙ্কেল? আমাকে দিন আমি…

-আঙ্কেলকে সহমর্মিতা দেখাতে হবে না!

হঠাৎ করেই‌ পাল্টানো স্বরে কথা শুনে থেমে গেলো তাজীন। নাফিজ চৌধুরী নিজের মতো ব্যস্ত থেকে বললেন,

-নিরবের মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি একাই বিজনেস,বাসা দুটোই সামলেছি। নিরবকে নিয়েই অফিস চালিয়েছি। ওর পড়াশোনা,ওর যত্ম নিয়েছি। তবুও কখনো ওর জন্য কেয়ারটেকার রাখিনি। নিরব বড় হয়ে বায়োমেডিতে জয়েন করার পরও আমি নিজেই রান্নাবান্না করেছি। বাপ ছেলে মিলে একসাথে খেয়েছি। এখনো এসব আমি মজায় মজায়ই করি। ভালোলাগে আমার। সকালে রান্না করে একসাথে বসে খেয়ে দুজনে মিলে অফিস চলে যাই,দুপুরে একসাথে লান্চ বানাই,রাতে কখনো কখনো বাইরে খেতে যাই। নিরবও আমাকে অনেক সময় দেয়। ইনফ্যাক্ট সময় দেবে বলেই বিজনেসে জয়েন না করে বায়োমেডিতে জয়েন করেছে।

তাজীন শুধু তাকিয়ে রইলো। মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-এতো কথা তোমাকে কেনো বলছি তাইতো? আসলে এ বাসায় সবই ছিলো। শুধু একটা মেয়ের অভাব ছিলো আমার বরাবরই। তোমার বাবার কাছ থেকে তাইতো ছেলেবউ চাইনি,মেয়ে চেয়েছিলাম। এখন তুমিও যদি আঙ্কেল বলে ডাকো,আমার মুনাফাটা কোথায় বলোতো?

চোখ ভরে উঠলো তাজীনের। আস্তেধীরে ও এগিয়ে গেলো আরো কিছুটা। কম্পিতকন্ঠে বললো,

-ব্ বাবা!

নাফিজ চৌধুরীর হাত থেমে গেছে। হেসে জরিয়ে ধরলো সে তাজীনকে। একটু থেমে থেকে কেদে দিলো তাজীন। নাফিজ চৌধুরী ওকে সামলে হেসে বললেন,

-এই মেয়ে? কাদছিস কেনো? বাবা ডাকতে কষ্ট হচ্ছে?

মাথা তুলে গাল ফুলিয়ে তাকালো তাজীন। নাফিজ চৌধুরী ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

-আমার ছেলে বলে বলছি না। নিরব সত্যিই অনেক ভালো ছেলে। যে ছেলে মা হারা হয়ে বাবার সব দায়িত্বপালনে সক্ষম,সে ছেলে যাকে ভালোবাসবে,তাকেও সবকরমভাবে আগলে রাখতে সক্ষম। ওকে একটু বুঝতে শেখ,দেখবি সবটা ঠিক হয়ে গেছে।

তাজীন মাথা নিচু করে রইলো। নাফিজ চৌধুরী বললেন,

-কি খাবি বললি না!

চুলগুলো খোপা করতে করতে নাফিজ চৌধুরীকে ঠেলে সরিয়ে দিলো তাজীন। বললো,

-বাবা ডেকেছি,তবে ট্রিট করবো ছেলের মতো। আমি খাবার বানাচ্ছি! তুমি এবার যাও পড়তে বসো!

কথাটা বলেই চোখ বন্ধ করে জিভ কামড়ালো তাজীন। নাফিজ চৌধুরীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

-ন্ না মানে…ত্ তুমি গিয়ে রেস্ট নাও বাবা!

হেসে দিলেন নাফিজ চৌধুরী। খানিকটা দুরে বুকে হাত গুজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে সবটাই দেখলো নিরব। বাবার সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর আরো একজন হেল্পিং হ্যান্ড এসে গেছে,তাকে রেস্ট নিতে বলার আরো এক কঠোর শাষক এসে গেছে ভেবে হাসি ফুটলো ওর চেহারাতেও।

মাঝে দু দিন কেটে গেছে। দোয়ার দিনগুলো কেটেছে সেই বাইক এক্সিডেন্টের আগের আর সব সাধারন দিনগুলোর মতোই। ওর জীবনে আরাব আসার আগের দিনগুলোর মতোই। কোনো উত্তেজনা ছিলো না,কোনো শিহরন ছিলো না,কোনো অদ্ভুত অনুভূতি ছিলো না। শুধু ভার্সিটি,চিলেকোঠা,টিউশনি। কয়েকবার মনে হয়েছে,কেউ তো চোখে চোখে রাখছে ওকে। কিন্তু খুজে পাইনি কাউকে। ক্যাম্পাসের এককোনে বসে খোলা বইয়ের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো দোয়া। দুর থেকে ওকে দেখে এগিয়ে আসলো তাজীন। পাশে সে বললো,

-কি পরছিলি?

-হুম? কিছুনা। কখন আসলে?

-সবেই।

দোয়া চুপ করে গেলো আবারো। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে বাদিকের পাতা বাদ রেখে ডানদিকের পাতায় চোখ আটকালো দোয়া। তাজীন বুঝলো,পড়ায় এতোটুকো মনোযোগ নেই ওর। ক্লাসটাইমেও কলম ব্যাগে রেখে উঠে চলে আসতে যাওয়া,বইয়ের একটার পর একটা পৃষ্ঠা ভাজ দেওয়া,ক্লাস থেকে বেরিয়ে একধ্যানে বাইরের কাঠগোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকা,বাইকের শব্দ শুনলেই চোখ বন্ধ করে নেওয়া,বারবার বিনুনির রাবারব্যান্ড খোলা,আবারো বিনুনী করে ব্যান্ড লাগিয়ে নেওয়া,ওড়না মুঠো করে নিয়ে মুঠো খোলা বন্ধ করা,পুরোটা সময়ই ওকে লক্ষ্য করছে তাজীন। মা ভাইয়ের ভরনপোষন নিয়ে দোয়া চিন্তায় থাকে ঠিকই। কিন্তু এতো অগোছালো থাকে না। আজকে ওর এলোমেলো ভাব দেখে মোটেও ভালো লাগছে না তাজীনের। ভার্সিটি থেকে বেরোনোর সময় বলেই উঠলো,

-তোর কি হয়েছে দোয়া?

দোয়া এক অন্য দুনিয়াতেই ছিলো। চমকে উঠে বললো,

-ম্ মানে?

-কিছু তো একটা হয়েছে তোর। এতো এলোমেলো লাগছে কেনো তোকে আজ?

-এলোমেলো লাগছে? তাহলে কি আর হবে? কাউকে নির্ঘাত মিস করছে আপনার বান্ধবী!

নিরবের কথা শুনে সামনে তাকালো দোয়া তাজীন দুজনই। দোয়া তাজীনের দিকে তাকাতেই মাথা নামিয়ে নিলো ও। শান্ত গলায় বললো,

-আপনি এখানে কেনো?

-আসলে বাবা বলছিলো আপনাকে পিক করে নিয়ে যেতে। আপনার নাকি বাসে যাতায়াত করে অভ্যেস নেই।

-আপনার অফিস থেকে এদিক দিয়ে উল্টো হয় না?

-হলেও কি করার? একইবাসায় তো ফিরবো,একইসাথে ফিরি না হয়!

দোয়া মনেমনে খুশি হলো নিরবের স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে। বুঝতে পারলো সম্পর্কে আড়ষ্টতার কারন তাজীনই। তাজীন বললো,

-ও দ্…

-তাকওয়াতুল দোয়া! রায়নগর বাসা! আমি জানি!

নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দোয়া। নিরব আবারো বললো,

-আগেরদিন ভালো করে কথাই হলো না আপনার সাথে। আরাব স্যারের নিজগলায় আপনাকে আমাদের বিবাহকথন শোনানোর ছিলো কি না! যাইহোক! কেমন আছেন?

তাজীনও কিঞ্চিত হা করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এভাবে তো ওর সাথেও কথা বলে না নিরব। আর দোয়ার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেনো কতো জন্ম ধরে দোয়ার পরিচয়পর্ব শুনে এসেছে। দোয়া আমতা আমতা করে বললো,

-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি?

-এইতো,সদ্য বিবাহিত…

তাজীন কপাল কুচকে তাকালো নিরবের দিকে। চোখাচোখি হওয়ায় নিরবের বাকা হাসিটা দেখে তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো ও। বললো,

-আমি চলে যেতে পারবো বাসে।

নিরব দোয়ার দিকে এগিয়ে বললো,

-এবার আপনিই প্লিজ কিছু বলুন! ইনি আমার গাড়িতে না গেলে বাসায় ফিরলে বাবার সবগুলো মার আমার পিঠে তালপরার মতো পরবে।

দোয়া হাসলো মুচকি। তাজীনের কাধে হাত রেখে বললো,

-চলে যাও। তোমাদের ওদিকের ভার্সিটির বাস ছাড়া এখনো অনেক দেরি।

তাজীন আর কথা বাড়ালো না। গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো চুপচাপ। নিরব সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বললো,

-থ্যাংকস্ ম্যাম।

-ম্যাম ডাকছেন কেনো? আমি আপনার বয়সে ছোটই হবো। নাম ধরেই ডাকুন।

-বলছেন?

-হ্যাঁ অবশ্যই।

-না থাক! স্যারকে আজ অবদি ভাইয়া বলে ডাকিনি। ম্যামকে আজই সরাসরি নাম ধরে ডাকা উচিত হবে না। অন্য কোনোদিন। আসছি। ভালো থাকবেন। ম্যাম!

নিরব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তাজীনকে নিয়ে চলে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। নিরবের স্যারের সাথে ম্যামের হিসেবটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো ওর। কিন্তু বাসের হর্ন শুনে সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে বাসে উঠে বসলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রায়নগরের বাসস্টপে নামতেই বাইকের হর্ন কানে আসলো দোয়ার। পুলকিত হয়ে পিছন ফিরলো ও। খুশি নিমিষেই গায়েব ওর। এক ছেলে বাইক নিয়ে দাড়িয়ে। হর্ন শুনে ওর ব্যাকসিটে এক মেয়ে এসে বসলো। চোখ ছলছল করছে,চুলকাচ্ছে দোয়ার। এই বুঝি টুপ করে অশ্রু বেরিয়ে আসে! এই বুঝি ওর কষ্টটা ধরা পরে যায় সবার কাছে। কিন্তু কেনো কষ্ট হচ্ছে ওর? ওর তো কষ্ট হওয়ার কথা না! আরাবের জন্য তো নয়ই! একটা জোরে শ্বাস ফেলে,দাতে দাত চেপে শক্ত হয়ে হাটা লাগালো মুখার্জীবাড়ির উদ্দেশ্যে।

-আরাব কোথায় গেছে মুফতাহির?

তৌফিকার কথা শুনে টাই বাধতে গিয়ে থেমে গেলো মুফতাহির। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ও তৌফিকার দিকে। ছলছল চোখে মুফতাহিরের এলোমেলো টাইটার দিকে তাকিয়ে রইলো তৌফিকা। দোয়ার মেডিকেল টেস্টের বিষয়ে আরাবকে বলা ঘটনায় ওদের দুজনের সম্পর্কে দুরুত্ব এসে গেছে অনেকটাই। এই টাই বাধার কাজেও বাধা পরে ওর। দুদিন হলো ভাইয়ের কোনো খোজ মিলছে না বলে আরো অস্থির হয়ে আছে তৌফিকা। কেদে কেদে চোখের নিচে কালি পরে গেছে ওর। সতেজ চেহারা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। মুফতাহির বললো,

-তোমার ভাই কোথায় যাচ্ছে সেটা কি ওর আমাকে বলে যাওয়ার কথা তৌফিকা?

-গেলে তো তোমাকেই বলে যেতো মুফতাহির!

-এবার বলে যায়নি!

কথা শেষ করে টাই বাধায় মনোযোগ দিলো মুফতাহির। অন্যান্য দিন এই টাই কোনোরকমে প্যাঁচ দিয়ে বাসা ছেড়েছে। কিন্তু আজ তৌফিকা সামনে দাড়িয়েছে। ওকে দেখানো দরকার,ও টাই‌ বাধতে পারে। তৌফিকা সব ভুলে হাত লাগালো মুফতাহিরের টাইয়ে। দু দন্ড স্থির দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। টাই বাধতে বাধতে তৌফিকা বললো,

-দোয়াকে তো দেখলে। তোমার মনে হয়না আমরা ভুল মুফতাহির?

-মানুষের বাইরেরটা দেখে ভেতরেরটা চেনা যায় না তৌফিকা।

তৌফিকা অসহায়ের মতো একটা জোরে শ্বাস ফেললো। মুফতাহিরের বুকে দুহাত রেখে বললো,

-ইদানিং তোমাকে দেখে আমার এই কথাটা কেনো মনে হয় বলতে পারো?

বড়বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো মুফতাহির। তৌফিকা ওর এক গালে হাত রেখে করুনভাবে বললো,

-এতো অচেনা কেনো হয়ে যাচ্ছো মুফতাহির? তুমি তো এমন ছিলে না। তোমার মাঝে এক অন্য মানুষকে কেনো খুজে পাই আমি মুফতাহির? এমন কেনো হচ্ছে?

গাল থেকে তৌফিকার হাত সরিয়ে দিলো মুফতাহির। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

-কারন তুমি তোমার ভাইকে ভালোবেসে অন্ধ হয়ে গেছো। বাস্তবতা চোখে পরছে না তোমার।

-মানে?

-মানে এটাই,তুমি ভুলে যাচ্ছো আরাবের সাথে বিয়ের পর দোয়া রংধনুতে আসবে! ওকে সবাই তৌফিক ওয়াহিদের ছেলেরবউ‌ হিসেবে জানবে! বিয়ের পর যদি কোনোভাবে প্রমান হয়,দোয়া..দোয়া এটাক্টড্,তোমার বাবার মান সম্মানটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাড়াবে সেটা বুঝতে পারছো তুমি? বোঝার চেষ্টা করেছো?

-কিন্তু মুফতাহির,দোয়া এটাক্টড্ না!

-সেটা তুমি মানো,আর কেউ মানবে না!

-আর কারো মানাতে কি যায় আসে?

-আমার যায় আসে! তোমার বাবার যাবে আসবে! এখনো অবদি আমি বাবাকে কিছু বলিনি এটা ভেবে,আরাব নিজের ভুল বুঝতে পারবে। একটা মেডিকেল টেস্ট করানোরই তো ব্যাপার! তারপরই…

তৌফিকা পিছিয়ে গেলো। শক্ত গলায় বললো,

-তুমি যদি এই বিষয় নিয়েই পরে থাকো,আমার আর কিছু বলার নেই। আরাব দোয়াকে ভালোবাসে,দোয়াকেই বিয়ে করবে! আমি ওর বিপরীতে আর কোনো কথাই চাইনা!

-কিন্তু তোমার বাবার দিকটাও ভাবা উচিত!

-কেনো ভাববো? শুধুই সন্দেহের জেরে? আর যদি দোয়া এটাক্টড্ হয়ও,আমি গর্ব করবো আরাবকে নিয়ে!

মুফতাহির রাগে অন্যদিক তাকিয়ে সামলালো নিজেকে। তারপরও চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ওকে ফাইন! থাকো তোমরা দু ভাইবোন নিজেদের চিন্তাভাবনা নিয়ে! আই ডোন্ট থিংক আমি তোমাদের এ বিষয়ে সাপোর্ট করতে পারবো! আর হ্যাঁ,আমি খুব তাড়াতাড়িই দোয়াকে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলবো। আমাদের মাঝে কোনোরকম মিস আন্ডার্স্ট্যান্ডিং চাইনা আমি ওকে নিয়ে! তুমি ভেবে নাও ঠিক কার সঙ্গ দেবে। ভাইয়ের? নাকি রংধনুর বাকি সবার?

টাইটা খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে মুফতাহির বেরিয়ে গেলো। পাথর হয়ে দাড়িয়ে কাদতে লাগলো তৌফিকা। ভাগ্যিস টুইঙ্কেলটা স্কুলে ছিলো। বাবার এই রুপটা একদমই মানতে পারতো না ও। আজ প্রথমবার মুফতাহির এই গলায় কথা বলেছে ওর সাথে। যে মুফতাহির কিনা প্রতিবার মনোমালিন্যের পর নিজে থেকে সরি বলতো,সে আজ এভাবে কথা বলে গেলো ওর সাথে। কাদতে কাদতে একসময় মেঝেতে বসে পরলো তৌফিকা। বলতে লাগলো,

-কোথায় চলে গেলি তুই আরাব? তোর অনুপস্থিতিতে যে সবটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! আমার উপর অভিমান করেছিস বলে নিজেকে কেনো গুটিয়ে নিলি তুই? এই পরিস্থিতিতে তো তোকেই দরকার। বাবা একবার সবটা জানলে যে কোনোদিনও দোয়া রংধনুতে আসতে পারবে না। স্বয়ং মুফতাহির বুঝাবে তাকে। আমার সংসারটা যাই হোক,আমি তোর ভালোবাসায় আচ দেখতে চাইনা আরাব। প্লিজ ফিরে আয় ভাই! প্লিজ ফিরে আয়!!!

#চলবে…

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩০❤

-আজ ভার্সিটির পর তাজীনকে নিয়ে একটু বেরোতে পারবে দোয়া?

ফোনের ওপাশ থেকে আরাবের কন্ঠ শুনে চোখ চকচক করে উঠলো দোয়ার। কপালের ছোটচুলগুলো হাতের উল্টোপিঠে সরিয়ে দিতে গিয়ে থেমে গেলো ওর হাত। ময়দামাখা ডান হাতটার কনুইয়ে ফোন ধরে কাপতে থাকা বা হাত ঠেকিয়ে সামলালো যেনো। ভেতরটা হঠাৎই খুশিতে ভরে উঠেছে ওর। গত চার দিনে আরাবের কোনো খোজ মেলেনি। না সকালগুলোতে কাঠগোলাপের দেখা মিলেছে। অজান্তেই বিষন্নতায় ছেয়ে ছিলো ওর চারপাশ। আজ সকালে রুটি বানাতে গিয়ে হঠাৎই নিচতলা থেকে অরুনাভ মুখার্জী ডাক লাগিয়ে বললো ওকে কেউ ফোনে চাচ্ছে। তাজীন,তৌফিকা বা মাহিমের আম্মু এমনটা আন্দাজ করেই নিচে নেমে ফোন কানে তুলেছিলো ও। কিন্তু না! ওর ধারনা ভুল ছিলো। এটা আরাব! আরাব ফোন করেছে ওকে। ওপাশ থেকে আরাব বললো,

-হ্যালো দোয়া? আছো?

ধ্যান থেকে বেরোলো দোয়া। নিজেকে সামলে বললো,

-জ্ জ্বী বলুন মিস্টার আরাব।

-ভার্সিটির পর বেরোতে পারবে তাজীনকে নিয়ে?

-কেনো বলুনতো?

-আসলে নিরবের সাথে ওর সম্পর্কটা…

দোয়া বুঝলো আরাব ওদের দুজনকে আলাদা একটু সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিতে চায়। এমনটা তো ওউ চেয়েছিলো। খুশিমনে বললো,

-আমি আসবো তাজীনকে নিয়ে।

-ফাইন। কোথায় আসবে টেক্সট করে দিচ্ছি।

-জ্বী।

-এসো তাহলে। রাখছি।

-জ্বী।

কলটা কেটে যায়। দোয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। অরুনাভ মুখার্জীর দিকে এগিয়ে গেলো ও মোবাইলটা ফেরত দেবে বলে। ওকে দেখে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-তোর কপালে ময়দা লেগে আছে দোয়া।

মুচকি হাসি নিয়ে বা হাতে কপাল ছুলো দোয়া। অরুনাভ মুখার্জী আবারো বললেন,

-ব্যস মুছেছে।

মুখের হাসিটা চুপসে গেলো দোয়ার। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-কি হলো? মন খারাপ করে ফেললি কেনো?

-ও্ ও কিছু না কাকাবাবু। আসছি আমি।

দোয়া পা বাড়ালো। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে ডানহাতে চুলে,গলায় ছুইয়ে দিলো নিজের। ইচ্ছা করেই ময়দা লাগিয়ে নিলো গলায় আর চুলে। দোতালায় আসতেই সালমা বেগম বললেন,

-কে ফোন করেছিলো?

-ও্ ওই আসলে…

-আচ্ছা থাক। তুই শেষ রুটিটা বানিয়ে ঘরে আয়। আর বানাতে হবে না। দিয়ান বসে আছে তোর সাথে খাবে বলে। আয়!

সালমা বেগম চলে যাচ্ছিলেন। দোয়া পিছুডাক লাগিয়ে বললো,

-মা?

সালমা বেগম পিছু ফিরে বললেন,

-কি হলো?

-ব্ বলছিলাম যে…

-হ্যাঁ বল?

-ওই ময়দা…

-কি হয়েছে ময়দার?

-ন্ না মানে,আমার চেহারায়…

-কি হয়েছে তোর চেহারায়?

দোয়া এবার ঝটপট বলে ফেললো,

-ও মা? দেখোনা? গলার দিকটা চুলকাচ্ছে কেনো? কি হয়েছে গলায়?

সালমা বেগম এতোক্ষনে খেয়াল করলেন মেয়ের গলায়,চুলে ময়দা লেগে আছে। এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই দোয়া পিছিয়ে গেলো। সালমা বেগম বললেন,

-তোর গলায় আর চুলে ময়দা লেগে আছে দোয়া!

-আমি তাহলে গোসলটা সেরে নেই হ্যাঁ?

দোয়ার কথায় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন সালমা বেগম। শীতের সকালে গোসল কেনো করবে দোয়া? তাছাড়া এখন গোসল করে ভেজা চুল বিনুনী করে গেলে অসুখ করবে ওর। বললেন,

-মুছে ফেললেই হবে। এখন গোসল করলে তোর ভার্সিটি যাওয়ার আগে চুল শুকোবে না।

-চুল ছেড়েই যাবো না হয়!

সালমা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। দোয়া ইতস্তত করতে লাগলো। কেনো যেনো আজ আরাবের সামনে ওর খোলা চুলে যেতে ইচ্ছে করছে। এতো সকালে গোসল করা নিয়ে মায়ের প্রশ্ন ঠেকাবে বলে ইচ্ছে করেই ময়দা গায়ে মাখিয়েছে ও। সালমা বেগম বললেন,

-আচ্ছা তুই গোসল সেরে আয়,এই রুটিটা আমিই বানিয়ে নিচ্ছি।

-না না! আমি বানিয়েই গোসলে যাচ্ছি! তুমি দিয়ানের সাথে বসো গিয়ে।

মাকে ঠেলে ঘরে পাঠিয়ে দিলো দোয়া। রুটি বানিয়ে একসাথে মা ভাইয়ের সাথে খেয়ে নিলো। গোসল সেরে চুল ঠিকঠাকমতো আচড়িয়ে দেয়ালে আটকানো ছোট আয়নাটার সামনে দাড়ালো। কালো টিপটা বড্ড টানছে আজ ওকে। মাথা‌ ঝেড়ে,মুখে হাসি ফুটিয়ে,ব্যাগটা কাধে নিয়ে,ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে পরলো ও।

ক্লাস শেষে আরাবের বলা জায়গাটায় তাজীনকে টানতে টানতে নিয়ে এলো দোয়া। জায়গাটা ভার্সিটির পাশেরই কোলাহলহীন এক রাস্তা। সরু রাস্তার দু পাশে বড় বড় গাছ,বসার সুন্দর সুন্দর জায়গাও আছে। খানিকটা দুরে বিশাল সিড়িবাধানো পুকুরও আছে। ক্যাম্পাসের এ দিকটায় বিকেলে হাটতে আসে অনেকেই। হাটতে হাটতে দোয়া সমানে উকিঝুকি দিচ্ছে এদিক ওদিক ও। তাজীনকে এখনো অবদি কিছু বলেই নি ও। তাজীন কয়েকবার জিজ্ঞাসা করায় বলেছে পরে বলবে। তাই ওউ চুপ হয়ে গেছে। মনটা এখন আর আগের মতো ভালো থাকে না ওর সবসময়। হাটতে হাটতে দোয়া বড় রাস্তা অবদি চলে আসলো। কিন্তু আরাব,নিরব কারোরই দেখা নেই। মনটা খারাপ করে তাজীনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-চলো তোমাকে চটপটি খাওয়াই।

তাজীন মৃদ্যু হেসে আস্তেকরে মাথা উপরনিচ করলো। ওরা এগোবে,তখনই ঠিক সামনের রাস্তাতেই গাড়ি থামালো নিরব। ওকে দেখে খুশি হলো দোয়া। আর বেশ অনেকটাই অবাক হলো তাজীন। নিরব গাড়ি থেকে নেমে সোজা এগোলো ওদের দিকে। একটু আড়ষ্টতার হাসি রেখে বললো,

-আব…আপনারা মানে…

-কেমন আছেন মিস্টার নিরব?

দোয়ার স্বাভাবিক গলা শুনে একটু অবাক হলো নিরব তাজীন দুজনেই। নিরব হাসি টেনে বললো,

-জ্বী ভালো। আপনি?

-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ।

তাজীন নিচদিক তাকিয়ে থেকে বললো,

-আপনি এখানে?

-আসলে আরাব স্যার…

-আসুননা বসে কথা বলি আমরা?

দোয়ার কথা শুনে তাজীন বড়বড় চোখ করে তাকালো ওর দিকে। দোয়া কোনোদিনও এতো আগ্রহ নিয়ে মিশতে চায়নি কারো সাথে। নিরব হাত বাড়িয়ে এগোতে বোঝালো ওদের। দুজনে এগোলো। তিনজনে মিলে বসলো একটা ফাস্টফুডের বাইরের দিকটাতেই। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর নিরব বললো,

-কি খাবেন?

দোয়া তখনও রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। নিরবের কথায় হুশ ফিরতেই বললো,

-আপনারা নিজেদের জন্য অর্ডার করুন। আমি কিছু খাবো না!

-তাহলে বসলি কেনো এখানে?

তাজীনের কথায় মাথা নামিয়ে নিলো দোয়া। সত্যিই আজ ওর কি হয়েছে,ও নিজেও জানে না। কিন্তু যা হচ্ছে,ভালোলাগছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে,এতোগুলো দিন পর আরাবকে দেখতে পারবে ও। তাই চলে যাওয়ারও ইচ্ছে নেই ওর। ধীর গলায় বললো,

-ঠিকাছে,তোমার প্লেট থেকে খেয়ে নেবো।

নিরব নিজে কি খাবে ভেবে নিলো। তারপর মেনুকার্ড তাজীনের দিকে বারিয়ে দিলো। তাজীন বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। একসাথে বসেছে,ওর জন্য অর্ডারটা কি করে দিতে পারতো না নিরব? ও বউ হয় তো ওর? একটা ছোট শ্বাস ফেলে ওর জন্য কি খাবার আনবে তা নিজেই দিলো ও। নিরব দোকানে গিয়ে বলে আসলো। খাবার আসা অবদি নিরব বেশ অনেকগুলো কথাই বলেছে দোয়ার সাথে। দোয়াও জবাব দিয়েছে। আর তাজীন শুধু শুনেছে। একবারের জন্য ওর মনে হলো,এতো কথা নিরব হয়তো ওর সাথেও বলে নি। দোয়া নিরবের সাথে কথা বলার ফাকে ফাকে বারবার রাস্তায় তাকাচ্ছে। তবে কি আরাব আসবে না? ওর প্লান কি শুধু নিরব তাজীনকে দেখা করানোই ছিলো?

আকাশকুসুম ভাবনার মাঝেই খাবারের জন্য ডাক লাগায় দোকানী। এখানকার নিয়ম,নিজের খাবার নিজে গিয়ে টেবিল অবদি এনে খেতে হয়। নিরব ফোন নিয়ে উঠে সরে দাড়িয়েছে সবে। অপেক্ষার সমাপ্তি টানতে চললো দোয়া। খাবারগুলো এনে তাজীন নিরবের সামনে পৌছে দিয়ে এখান থেকে চলে যাবে ও এমনটাই সিদ্ধান্ত নিলো। খোলা চুলগুলো খোপা করবে বলে যেইনা কাধে হাত দিয়েছে,বাইক থামানোর শব্দে থেমে গেলো ওর হাত। সেই‌ চেনা অনুভুতি,সেই চেনা শিহরন। চোখ বন্ধ করে লাজুক হাসিতে হাত নামিয়ে নিলো ও।
বাইক পার্ক করে দুর থেকে খোলা চুলে বসে থাকা দোয়ার লাজুক চেহারাটা সবার আগে দৃষ্টিগোচর হলো আরাবের। শিট! শব্দ করে চোখ বন্ধ করে ডানহাতে বুকের বা পাশ খামচে ধরলো ও। পরেই হাত সরিয়ে গলা ঝেরে নিজেকে সামলে নিলো। শার্টের হাতাটা টান মেরে এগোলো ওদের দিকে। নিরব ততক্ষনে কথা বলা শেষ করে বসেছে। আরাব এগিয়ে গিয়ে বললো,

-হাই নিরব।

-হ্যালো স্যার।

উঠে দাড়িয়ে আরাবকে আলিঙ্গন করলো নিরব। তাজীন দোয়া দুজনেই উঠে দাড়িয়েছে। তবে দোয়া চোখ নামিয়েই রেখেছে। সামনে কালো প্যান্টে ইন করা সাদা শার্ট পরিহিত একেবারে ফর্মাল ড্রেস আপে থাকা মানুষটার চেহারার দিকে তাকাতে আজ বড্ড ইতস্তত লাগছে ওর। কিন্তু কে বলবে,কিছুক্ষন আগে একেই দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে এতোটা ব্যাকুল হয়ে ছিলো? আরাব তাজীনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-হোয়াটস্ আপ তাজীন? কেমন আছো?

-জ্বী ভালো। আপনি?

-বলতে পারো বেস্ট এভার ভালো।

এবার দোয়ার দিকে ফিরলো আরাব। শান্ত গলায় বললো,

-কেমন আছো দোয়া?

চোখ তুলে তাকালো দোয়া। আরাবের চোখে চোখ রেখে বললো,

-ভালো আছি।

পাশে থাকা চেয়ারটা চেপে ধরে মুখের হাসিটা সামাল দিলো আরাব। নিজেকে এলোমেলো লাগছে ওর। চারদিনের অনুপস্থিতি ওকে দুর্বল করে দিয়েছে,নাকি দোয়াকে আরো বেশি শক্ত করে দিয়েছে,বুঝে উঠতে পারছে না ও। তবে যাই হোক,তাতে ওর অবস্থা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। মাত্রাতিরিক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত খুশির প্রভাবে গলা শুকিয়ে আসছে ক্রমশ। এভাবে চলতে থাকলে দোয়ার সামনে থাকা কিভাবে ওর পক্ষে সম্ভব? একটা শুকনো ঢোক গিললো আরাব। ওর অবস্থা দেখে তাজীন বললো,

-এনি প্রবলেম?

আরাব অসহায়ের মতো দোয়ার দিকে তাকিয়ে। প্রবলেম? নাকি প্রবলেমের সল্যুশন? তখনই দোকানী দ্বিতীয়বার ডাক লাগালো খাবার আনার জন্য। নিরব বললো,

-আমি যাচ্ছি।

-আপনি বসুন,আমি যাচ্ছি।

দোয়া হাটা লাগালো। আমিও আসছি বলে দৌড়ে ওর পাশে এসে হাটতে লাগলো আরাব। দোয়া ওর দিকে তাকাতেই নিচু গলায় বললো,

-দে নিড স্পেস।

আর কিছুই বললো না দোয়া। দোকানে এসে সেখান থেকে দুটো প্লেট দু হাতে নিলো ও। আরাব বললো,

-দুটো কেনো?

-আমি আর তাজ একসাথে খাবো। নিজেরটা অর্ডার করে নিন।

-তাহলে আমি আর নিরবও একসাথে খাবো। হি হি!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে আসছিলো দোয়া। হঠাৎই দমকা বাতাসে চুলগুলো সব চোখেমুখে এসে পরলো ওর। দুহাতে প্লেট থাকায় সরাতে না পেরে নড়াচড়া করতে লাগলো ও। আরাব ওর সামনে দাড়িয়ে আস্তেধীরে চুলগুলো কানে গুজে দিলো ওর। বড়বড় চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো দোয়া। আরাব হেসে বললো,

-চুল ছেড়ে এসেছো কেনো আজ?

উত্তর নেই‌ দোয়ার কাছে। তাড়াতাড়ি আরাবকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো‌ ও । পেছন থেকে পকেটে দুহাত গুজে আরামে দাড়িয়ে দোয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো আরাব। হাটার সাথে সাথে দোয়ার ঢেউ খেলানো চুলগুলোর নড়চড়,ঝড় বয়ে‌ যায় ওর মনপ্রান জুড়ে। হাসিটা প্রসারিত করে বললো,

-উত্তরটা তুমি না জানলেও আমি জানি দোয়া। আর সেটা হলো,আমার জন্য! শুধু আমার জন্য!

দু প্লেটে চারজন খাওয়া শেষ করে একসাথে হাটা লাগালো সেই সরু রাস্তাটায়। তাজীন আর নিরব সামনে হাটছে,তার একটু পেছনে দোয়া,আর একেবারে পেছনে ওর চুল দেখতে দেখতে হাটছে আরাব। একবার দোয়ার পাশে হাটতে গিয়েছিলো। দোয়ার চাওনি দেখেই মেকি হেসে পিছিয়ে এসেছে। আর আরাব আগে থেকেই দোয়াকে পছন্দ করে এই কথা তাজীনকে বেশ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলছে নিরব। ওর জানামতে কি কি করেছে,সেগুলোও বলছে। আর তাতে একের পর এক বিস্ময়ের লুক দিচ্ছে তাজীন। দোয়া পেছন থেকে কিছুই শুনছে না,চেষ্টাও করছে না। দে নিড স্পেস! ডানহাতে বাহাতের কনুই ধরে হাটতে হাটতে আরাবের বলা কথাটা মানতে ব্যস্ত ও। রাস্তার পাশে একজায়গায় অনেকগুলো ছেলেমেয়ে গোল হয়ে ঘাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। গিটারে টুংটাং সুর তুলছিলো একজন। ওদের দেখে আরাব পেছন থেকে ডাক লাগিয়ে বললো,

-গাইস? গান শুনবে কেউ?

তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরলো তিনজন। দোয়ার দিকে তাকিয়ে আরাব ‌মুচকি হেসে বললো,

-আমি গাইবো।

নিরব হাত বারিয়ে তাজীনকে এগোতে বললো। ও একপলক দোয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝালো চল বসি। মাথা আস্তেকরে নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো দোয়া। নিরব,তাজীন,দোয়া তিনজন খানিকটা পাশে দাড়ালো। আরাব এগিয়ে ওদের সাথে কিছু কথা বললো। তারপর একজনের থেকে গিটার নিয়ে সুর তুলে দোয়ার দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগলো,

তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার…
তাকে ছোবো ছোবো ভাবছি
আর ছুয়েই পালাচ্ছি
ফের তাকেই‌ ছুতে যাচ্ছি আবার…

অভিমান,পিছু নাও
তাকে‌ পিছু ফেরাও…
তার কানে না যায় পিছুডাক,আমার…
মুখ বুজেই‌ তাকে ডাকছি আবার…
তাকে অল্প কাছে….ছুতে যাচ্ছি আবার

ফাকা বুক,চেনা সুখ,
জানি ঘুম সে ভাঙাবেই(ii)
ভিজে মন বলি শোন,
রাত ভোর জাগতে নেই
মুখ চোরা ডাক তাকে ঘুম পারাক এবার…
তাকে ছুয়ে স্বপ্ন বুনছি,আবার…

তাকে আলতো গায়ে মাখছি
আর আকড়ে মুঠোয় ঢাকছি,
তবু মুঠো আলগা রাখছি আবার…
তাকে ছোবো ছোবো ভাবছি
আর ছুয়েই পালাচ্ছি
ফের তাকেই ছুতে যাচ্ছি আবার…

গাওয়া শেষে চোখ বন্ধ করে গিটারে গানের টিউনটাও শেষ করলো আরাব। বিকেলের ঢলে পরা সুর্যের রশ্মি ঘন গাছগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে পারছে না আর। গাছপালায় ঘেরা জায়গার পুরোটা জুড়ে যেনো স্বস্তি। আচমকাই তাজীনের হাত ধরে হাটা লাগালো নিরব। বিস্ময়ে কিছুই বলে উঠলো না তাজীন। পা বাড়ালো ওর সাথেই। দোয়া শুধু দুজনকে চলে যেতে দেখলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আরাবের দিকে তাকাতেই দেখে ও একদম কাছে চলে এসেছে ওর। একটা শুকনো ঢোক গিললো দোয়া। গানের প্রতিটা লাইন যে ওর জন্যই ছিলো,তা আরাবের চোখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। আরাবের চাওনিতে পরিষ্কার বলা,গানের ওই তাকে সম্বোধন,দোয়ার জন্যই। ব্যাগের ফিতাটা আরো শক্তিতে দুহাতে আকড়ে ধরলো দোয়া। ওর চেহারা দেখে যেনো সাহস বেড়ে গেলো আরাবের। ব্যাগ সর্বশক্তিতে মুঠো করে ধরে রাখা দোয়ার হাতজোড়ার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে উঠলো,

-ভালোবাসি।

#চলবে…

[ অ-ন্নে-এ-এ-এ-ক বড় পর্ব! কেমন ছিলো জানাবেন প্লিজ। বলে রাখি,পর্ব ৩০ এর রিভিউ আর পর্ব ৩১ এর অ্যাটম,পরস্পর সমানুপাতিক হবে! ?
হ্যাপি রিডিং! ♥ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here